জ্বলদর্চি

রমাপদ চৌধুরী-র ‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাস ও খড়গপুর শহর /অর্ণব মিত্র

রমাপদ চৌধুরী-র ‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাস ও খড়গপুর শহর

অর্ণব মিত্র
 

 সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী জন্মেছিলেন খড়গপুরে। তার কিশোর বয়স অবধি ছেলেবেলা কেটেছিল এই রেলশহরে।তারপর তিনি স্নাতকোত্তর পর্বের পড়াশুনার জন্য কোলকাতা গেছিলেন । লেখক হিসেবে তার প্রথম উপন্যাস হল ‘প্রথম প্রহর’। ১৯৫৪ সালে 'প্রথম প্রহর' উপন্যাস প্রকশিত হয়। ‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাসের ‘তিমুদা’ নামের চরিত্রটি হলেন আসলে তিনি নিজেই।উপন্যাস জুড়ে খড়গপুরের বিভিন্ন যায়গার বর্ণনা দেখা যায়।চাঁদমারির মাঠ, ইন্দা, সাহেবপাড়া বা বোগদার দিকের ইংরেজদের বাংলো এলাকা,ও উত্তরে দুর্গামন্দির ইত্যাদি জায়গা গুলির বর্ণনা পাওয়া যায় ঘটনা অনুসারে। এর মধ্যে মন্দির, ইংরেজদের তৈরি গির্জা ও বিভিন্ন স্থানের কথা এসেছে বেশ কয়েকবার। 


১ 
উপন্যাসেটি কাহিনির সুত্রপাত বা ভূমিকা ও শেষকথা বাদ দিয়ে বাইশটি পরিচ্ছেদে পরিবেশিত হয়েছে।

উপন্যাসের শুরুতেই ভূমিকা-পর্বে দেখা যায় ট্রেনের কামরায় একজন বিবাহিত মহিলার সাথে লেখকের দেখা হয়। সেই মহিলা লেখককে খড়গপুর শহরে লেখকের কাটানো ছেলেবেলার কথা মনেকরান।একে একে সেইসব মানুষদের কথা বলেন যাদের লেখকও চিনতেন।সেই মহিলা বলেন ‘সদাশিব জ্যাঠা সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেছেন শুনেছ!’। লেখক সেই কথা শুনে উপন্যাসে লেখেন মহিলার সদাশিব জ্যাঠার কথা বলাতে ‘ভোরবেলায় তার তুলসীদাস আবৃত্তি যেন কানের কাছে ভেসে এলো’।এই সদাশিব জ্যাঠার ভোরবেলায় আবৃত্তি আসলে গোলবাজারের দুর্গামন্দির থেকে ভেসে আসত।কারণ লেখকের বাবা  রেলের চাকরিসুত্রে যে বাংলোটি পেয়েছিলেন সেটি গোলবাজারের দুর্গামন্দিরের উল্টোদিকে অবস্থি্ত।তাই ভোরবেলায় সদাশিব জ্যাঠার তুলসীদাস আবৃত্তি লেখক ছোটবেলায় শুনতেন তাদের দোতলা রেলের বাংলো থেকে। 

এ ব্যাপারে তিনি আর এক জায়গায় উপন্যাসের সাত নম্বর পরিচ্ছেদে লিখছেন-‘ভোরবেলায় ঘুম ভাঙ্গলেই সদাশিব জ্যাঠার মন্ত্রপাঠ শুনতে পেতাম।আমাদের কোয়ার্টারের একপাশে ছিল হিন্দুস্থানীদের রামমন্দির,আর আরেকদিকে বাঙ্গালীদের দুর্গামন্দির।সংস্কৃত মন্ত্রের উচ্চারণে সমস্ত পাড়াটা যেন ভোর বেলাতেই জমজম করে উঠত।বেরিয়ে এসে দেখতাম খড়ম পায়ে সদাশিব জ্যাঠা চলেছেন দুর্গামন্দিরের দিকে। তারপর লিখছেন ভোরবেলায় মন্ত্র পড়তে পড়তে খালি গায়ে খড়মপায়ে হেঁটে যেতেন দুর্গামন্দির পর্যন্ত।দুর্গামন্দিরের নাটমণ্ডপের একপাশে ছিল একটা বাধানো কুয়ো।কুয়োর জলে স্নান সেরে আবার মন্ত্রপাঠ করতে করতে ফিরতেন তিনি।এখানে গল্পে গোলবাজারের কাছে হিন্দুস্থানীদের রামমন্দির ও বাঙ্গালীদের দুর্গামন্দির –দুটি মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

এছাড়া গোলবাজারের দুর্গামন্দিরের কথা উপন্যাসের আরও কয়েক জায়গায় এসেছে।

তিনি গোলবাজার দুর্গামন্দির সমন্ধে উপন্যাসের তিন নম্বর পরিচ্ছেদে লিখছেন-‘ আমাদের ঐ রেল কলোনিটায় তখন যে ক-জন বাঙ্গালী ছিল তাদের সংখ্যা আঙ্গুলে গোনা যেত।তাদেরই চেষ্টায় একটা দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।মন্দিরটা ছোট ছিলনা।অগুন্তি সিঁড়ির ধাপ,যেমন উঁচু তেমনি দীর্ঘে আর প্রস্তে, রাজবাড়ি বলে ভুল করবার মতো।এক সারি মোটা মোটা থাম,মোজায়েক করা লম্বা বারান্দা।মন্দিরের পশ্চিমে ছিল একটা অর্ধসমাপ্ত নাটমণ্ডপ।মন্দিরের একপাসে ছিল একটুকরো ফুলের বাগান,আরেক পাশে একটা কুয়ো।

এরপর চার নম্বর পরিচ্ছেদে লিখেছেন দক্ষিণের এক মহান্ত ‘কাশী যাবার পথে দু-দিনের জন্য বিশ্রাম নিয়েছিলেন দুর্গামন্দির চত্বরে।সেই সময় খুব ভিড় হয়েছিল দুর্গামন্দিরের সামনে।এছাড়া ভী,ভী,গিরি-যিনি একসময় স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন,যখন খড়গপুরে এসেছিলেন তখনও দুর্গামন্দিরের প্রসঙ্গ এসেছে।রমাপদ চৌধুরী লিখছেন ‘আর বম্বে থেকে যিনি আসতেন তার নাম ছিল গিরিসাহেব।একদিন বেশ জোর মিটিং বসেছিল মনেআছে। দুর্গামন্দিরের চত্বরে অনেকে জোড়ো হয়েছিলো।গিরিসাহেবও এসেছিলেন’।


উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদে দেখা যায় লেখকের ছোটবেলার প্রতিবেশী বাড়ির মেয়ে নিরুর দাদু গল্প করতে করতে ইন্দার খড়গেশ্বর মন্দির সমন্ধে বলছেন। নিরুর দাদু বলছেন ‘তখন ঐ জায়গাটা ছিল একেবারে জঙ্গল। আর বনের মাঝখানে, ঐ যেখানটার নাম ইদা,ঐখানে ছিল একটা মন্দির। খড়গেশ্বর মন্দির ছিল ওখানে,একজন কাপালিক একটা মড়ার উপর বসে তন্ত্র সাধনা করতো আর মড়ার খুলিতে করে কারণ পান করতো ।তিনি লেখেন ‘দাদু গল্প বলে যেতেন আর আমরা যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম সে সব ছবি’। তারপর কয়েকপাতা পরে লিখছেন ‘দেখেছিলামও একদিন।আমি আর ওয়াটসন সাহেব, দু-জনে বন্দুক হাতে নিয়ে বেরিয়েছিলাম সন্ধ্যের দিকে।দূর থেকে মন্দিরের ভাঙ্গা চূড়াটা দেখা যেতো,তাই ইচ্ছা হতো ভেতরে কি আছে দেখবার।ইন্দা পর্যন্ত যেতে যেতে বেশ রাত হয়ে গেল সেদিন।তবে বন্দুক হাতে নিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা দেখতে হবে মন্দিরটা কিসের।জঙ্গলের মধ্যে যেখানে মানুষের চিহ্ন নেই কোথাও,সেখানে মন্দির এলো কোত্থেকে’।

এরপর তের নম্বর পরিচ্ছেদে কিশোর তিমু তার সমবয়সী কিশোরী বন্ধু পরীর সাথে এক রাতে রামাই পণ্ডিতের খোঁজে  খড়গেশ্বর মন্দির যায়।লেখক বলেন ‘খড়গেশ্বর মন্দিরটা যত কাছে আসে ততোই ভয় বাড়তে শুরু করে।ইদার মাঠ পার হয়ে কাশ ঝোপের ভিতর দিয়ে মেঠো রাস্তাটা মিলিয়ে গেছে গাছগাছালির অন্ধকারে।তারপর লিখছেন ‘ভাঙ্গা মন্দিরটার সামনে স্তূপীকৃত হয়ে পড়ে ছিল একরাশ ইট তার ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে কয়েকটা চারাগাছ।সেই ইটের স্তূপ পার হয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো পরী’।

এরপর খড়গেশ্বর মন্দিরের কথা এসেছে উনিশ নম্বর পরিচ্ছেদে। তিমু বলে ‘একাই খড়গেশ্বর মন্দিরে চলে গিয়েছিলাম একদিন।খড়গেশ্বরের পুজো দেওয়ার জন্য। মাঠের পর মাঠ পার হয়ে।ভাঙ্গা পুরনো মন্দিরটায় যেতে গা ছমছম করে উঠেছিল। কাঠবেড়ালির শব্দে চমকে উঠেছিলাম প্রথমটা।তবু ভয় পেয়ে ফিরে আসিনি।গিয়ে দেখলাম কেউ কোথাও নেই।


উপন্যাসে আবিদ হোসেন বা ফুলজান বিবি-র মতো মুসলিম চরিত্র এসেছে।কিন্তু ইন্দার কাছে পী্রবাবা মসজিদ,পুরাতন বাজার মসজিদ বা অন্য মসজিদের বর্ণনা লেখক অবশ্য করেননি।

তবে লেখক মালঞ্চ রেলগেটের দিকে পুলিশথানার কাছে ‘তিনপটিয়া’ গির্জার কথা উপন্যাসে বেশ কএক জায়গায় লিখেছেন যেখানে শহরের তামিলরা প্রার্থনার জন্য আসতেন। তিনি লিখেছেন তাদের বাংলোর সামনে দিয়ে তামিল খ্রিস্টানরা ‘তিনপটিয়া’ গির্জায় যেত।
তিন নম্বর পরিচ্ছেদে আছে ‘শহরের পশ্চিম প্রান্তে রেলের কারখানা ভোঁ বাজিয়ে ছুটি হতেই প্রতিদিনের মত হাজার হাজার সাইকেলের ভিড় দেখা দিলো।থানার সামনে দিয়ে,ডাকঘরের পাশ দিয়ে, তিনপটিয়া ক্রিশ্চানদের গির্জা পার হয়ে তিন নম্বর কোয়াটারের লাইন ধরে’।


৪ 
খড়গপুরকে বলা হয় মিনি ইন্ডিয়া। বিভিন্ন ধর্মের ও বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের সহাবস্থান এই রেলশহরে দেখা যায়। রমাপদ চৌধুরীর ‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাসে সেই সময়ের ইতিহাসের সাথে সাথে খড়গপুর শহরে আলাদা আলাদা ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের একটি ছবিও ফুটে ওঠে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments