জ্বলদর্চি

শান্তিপদ নন্দ ( শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক, এগরা )ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১

শান্তিপদ নন্দ (শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক, এগরা)

ভাস্করব্রত পতি


সেটা ১৫০০ থেকে ১৬০০ সালের মাঝামাঝি কোনও একটা সময়। পুরীর বৈরামপুর পরগণার স্বর্গোদ্বার এলাকা থেকে ওড়িশার রাজা মুকুন্দদেব হরিচন্দনের দেওয়া কুড়ি বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি ও পারিবারিক বিগ্রহ জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা সহ তৎকালীন ওড়িশার রাজস্ব বিভাগ টানিয়া দণ্ডপাটের অধীন দাতুনীয়াচোর বিশির 'দণ্ডবনিয়া' গ্রামে ভাগ্যের সন্ধানে এসে বসতি স্থাপন করেন ওড়িশার 'নন্দ' পরিবার। সেসময় চলছিল ব্যাপক খরা। ভাগ্যের পরিবর্তনে আসা এহেন ব্রাহ্মণ পরিবারের এক সুযোগ্য সাহিত্যরসিক গবেষক হলেন শান্তিপদ নন্দ।

দুই মেদিনীপুরে এই মুহূর্তে যে কয়জন বর্ষীয়ান মানুষ আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি চর্চায় ব‍্যাপৃত, শান্তিপদ বাবু তাঁদের মধ্যে অন্যতম। উৎকল সংস্কৃতির সাথে পারিবারিক ভাবেই পরিচিত। ওড়িয়া বাংলা মিশ্র আদব কায়দা, লোকাচার তিনি পেয়েছেন ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই। তাই তাঁর রচনায় ফুটে বেরোয় এতঞ্চলের লুক্কায়িত ইতিহাস, সংস্কৃতি আর সাহিত্যের নানা অবয়ব। তাঁর রচনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে বঙ্গ-উৎকল সংস্কৃতির অজস্র প্রতিচ্ছবি। একটা মিশ্র সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে শান্তিপদবাবু জীবনের ব্রত হিসেবেই নিয়েছেন।

১৯৪০-এ জন্ম মোহনপুরের দাঁতুনিয়া গ্রামে। এখন থাকেন এগরা শহরে। এক প্রাচীন সংস্কৃতিমনস্ক ব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষ প্রিয়নাথ ও হেমন্তকুমারীর একমাত্র পুত্র তিনি। রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সারস্বততীর্থ বিশ্বভারতী থেকে ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শিক্ষালাভ করেন। টানা ৩৪ বছর বড়মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হয়ে শান্তিপদবাবু তাঁর ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার দরুণ ২০০৬ সালে লণ্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন।

তাঁর কথায়, আমাদের জানতে হবে আমার বসবাসের পার্শ্ববর্তী এলাকার বিবরণ। নিজের এলাকাকে জানার ইচ্ছা থাকলে অন্য এলাকার প্রতিও সমীহ ভাব জন্মায়। যে মোহনপুর এলাকায় তাঁর বেড়ে ওঠা, সেই মোহনপুরকে নিয়ে তিনি লিখেছেন আস্ত একটা বই 'মোহনপুর ইতিকথা'। এখানকার জনজীবন, সম্প্রদায়, লোক উৎসব, লোকশিল্প, লোক সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তিনি দিয়েছেন অসংখ্য অজানা তথ্যের সম্ভার। মোহনপুরের মতো প্রত্যন্ত জনপদকে অন্যদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তো তিনিই। ১৯৭৪ সালে বি এড পড়ার সময় বিষ্ণুপদ পাণ্ডার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। গবেষণামূলক কাজের ধারার সাথে তখন থেকেই পরিচয় হয়ে যায়। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় পেয়েছিলেন অনেক মনিমুক্তোর সংস্পর্ষ। অন্নদাশঙ্কর রায়, হেমলতা ঠাকুর, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ দে, সৈয়দ মুজতবা আলী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র সেন, সুধীর কর, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, শিশিরকুমার ঘোষ প্রমুখদের কাছে থেকে শিখেছিলেন অনেক কিছুই।

এখনও নিয়মিত প্রকাশ করেন 'এষণা' নামে একটি গবেষণাধর্মী পত্রিকা। স্থানীয় অঞ্চলের সাহিত্য, সংস্কৃতি তুলে ধরতে তিনি ১৯৮০ সাল থেকে হাতিয়ার করেছেন এই 'এষণা'কে। ইতিমধ্যে লিখে ফেলেছেন আরও বেশ কিছু গবেষণাধর্মী বই। চরৈবেতি, সাহিত্য সংস্কৃতির নানা দিগন্ত, সংস্কৃতির অঙ্গণে, মেদিনীপুরের ইতিহাসের উপাদান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (সম্পাদিত), অবসন্ন চেতনার গোধূলি বেলায় ইত্যাদি বইগুলির দরুণ আজ শান্তিপদ নন্দকে জেলা তথা রাজ্যের সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ কুর্ণিশ করে। বর্তমানে শান্তিপদবাবু "Temple architecture of Egra Ramnager Mohanpur and Dantan In The Twentieth Century of Bengal" বিষয়ক একটি প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন। এটির কাজ প্রায় শেষের পথে। মূলতঃ ওড়িশার লাগোয়া থানাগুলি নিয়ে কাজ। এই বয়সেও অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই দুরূহ কাজটি সমানে চালিয়ে যাচ্ছেন।

তাঁর যাবতীয় কাজের প্রেরণা ছিল প্রয়াত স্ত্রী বনজ্যোৎস্নাদেবী। এখনও তাই বারংবার তাঁর অভাববোধ কুরে কুরে খায়। কিন্তু, 'কাজের মানুষ' শান্তিপদ নন্দ দু'দণ্ড শান্তি খুঁজে পান লেখায় বুঁদ থেকে। তাঁর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো তাঁর মতো উন্মুখ নয়। তাই সখেদে তিনি বলেন, আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাটি শুকিয়ে যাচ্ছে। তবে আমি মনে প্রাণে বিশ্বাসী আমাদের পারিবারিক ইতিহাসের বহু কাহিনী অনুসন্ধিৎসু উত্তর পুরুষেরা নিশ্চয়ই শুনতে পাবে।

তিনি শুনতে পেয়েছেন সেই অমোঘ 'পরিবর্তন'-এর স্বর। কিভাবে মানুষ ক্রমশঃ বিমুখ হয়ে পড়ছে নিজের সংস্কৃতি, ইতিহাস থেকে। কিন্তু সেই কষ্ট বুকে চেপে আজও তাই কলম ছাড়েননি। মেদিনীপুরকে ভালোবাসেন। মেদিনীপুরের মাটিকে ভালোবাসেন, মানুষকে ভালোবাসেন। তাই এই উর্বর এলাকার কোনায় কোনায় ঘুরে ঘুরে খুঁজে পেতে তুলে আনেন হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির টুকরো। মেদিনীপুরের লুকিয়ে থাকা রতন খুঁজতে খুঁজতে হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'।

নিজের স্মৃতি রোমন্থন করেছেন 'অবসন্ন চেতনার গোধূলি বেলায়'তে। কিভাবে একটা বংশ থেকে একটা মানুষের উৎপত্তি হল তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ। লিখেছেন অজস্র প্রবন্ধ। কখনও ইটপাথর মন্দিরের টেরাকোটা, কখনও পাঁচরোলের মন্দিরের কারুকার্য! পুঙ্খানুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল তাঁর লেখা অজস্র প্রবন্ধ। ৮৩ বছর বয়সেও তিনি ভেঙে পড়েননা। এগরা শহরের বুকে 'প্ৰিয়ভিলা'তে বসে সাহিত্যজগতের এই অতি প্রিয় মানুষটি একাকী নিরালায় নিঃসঙ্গে নিভৃতে করে চলেছেন ইতিহাস খননের কাজ। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্মানকে পরোয়া করেননা তিনি। মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সম্মানই তাঁর কাছে মহার্ঘ্য।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments