জ্বলদর্চি

মারণবীজের আজব ধাঁধা পর্ব ১০ /বাসুদেব গুপ্ত



মারণবীজের আজব ধাঁধা পর্ব ১০

বাসুদেব গুপ্ত

ছ’ লেনের বিভাজিত রাজপথ। গাড়ীর পর গাড়ী, ট্রাকের পর ট্রাক। কোথাও গদাইলস্করি চালে ৪০ কিমিতে রাস্তা জুড়ে চলেছে ট্রাকের কনভয়, কোথাও ১২০ কিমিতে রেসিং কারের মত এঁকেবেকে এক একটা অডি টয়োটা বা বিএমডবলিউ হুসহাস করে কাটিয়ে সামনে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দামী গাড়ীর সময়ের দামও যেন বেশি। অর্চির চোখ একটু একটু পরিষ্কার হচ্ছে, ওদের কুশাক এন এইচ ১৯ থেকে বেঁকে গেল এন এইচ ১৮ হয়ে এন এইচ ৪৬। একসময় ছিল এন এইচ ১ আর ২। কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে চলে যেত পাকিস্তানের পেশওয়ার, যার নাম ইতিহাসে সবাই পড়ত। গ্রাণ্ড ট্রাংক রোড। কলকাতা ভারতের রাজধানী হবার অনেক আগে, ইতিহাস হেঁটে গেছে এই পথ দিয়ে, আজও হয়ত কান পাতলে শোনা যাবে ছুটে যাচ্ছে ঘোড়া, মুখে ছুটছে ফেনা, তার পিঠে জরুরী ডাক সম্রাট আকবর পাঠিয়েছেন বাংলার সুবাদারকে। আজ নতুন সরকার এসে রাজপথ নতুন করে ঢেলে সাজাতে ব্যস্ত, পুরনো রাস্তা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, ইতিহাসের টুকরোগুলো এখানে ওখানে অন্য নামে শুয়ে আছে। ইতিহাস নিজেই পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। 

জনবহুল শহরতলী, নদীর ওপর টানা মেঘের মত ব্রিজ সরে যায় এঁকে বেঁকে। ধীরে ধীরে চারপাশে শুরু হয় লাল মাটির টিলা, আমগাছ বটগাছ বদলে গিয়ে হয়ে যায় পলাশ মহুয়া, শাল শিমূল, ধলভূম এগিয়ে আসে রাঢ়ের নম্র মাটিকে তার রুক্ষ লাল শরীরের নীচে ঢেকে ফেলে। বাংলার গ্রামের শ্যামলিমা স্মৃতির মত পড়ে থাকে অনেক পিছনে। 
হঠাৎ জনমানবহীন একটা জায়গায় গাড়ীর চালক বাঁক নেয়। দুরন্ত বাইসনের মত ঢুকে পড়ে একটা একজিট দিয়ে। নিমেষেই ঘন জংগল এসে ঘিরে ধরে ওদের গাড়ী। জোনাকি ঝিঁঝিঁরাও ঢুকতে ভয় পায় এমন জটিল অন্ধকার চারপাশে। একটা ছোট মাটির বাড়ী, ভাঙ্গা টিনের চাল দিয়ে কোনমতে আব্রু রক্ষা করছে। তার সামনে এসে রামালুর গাড়ি হঠাৎ ব্রেক কষে স্টারট বন্ধ কর দেয়। গাড়ীর ভিতর সবাই চুপ। বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। শুধু আকাশে কাস্তের মত চাঁদকে তাড়া করে চলেছে কালপুরুষের ঘোড়া। 
এক মিনিট কোন আওয়াজ নেই। তারপর হঠাৎ ঝপ করে জ্বলে ওঠে নিশার হাতের মোবাইলের আলো। সেই আলোয় দেখা যায় জনা দশেক লোক হাতে তীর ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক জংগলের রাজার সৈন্যদলের মত। একটা কালো পাথরে কোঁদা শরীর এগিয়ে এসে গাড়ীর দরজাটা খোলে, তারপর অর্চি ও নভীনকে দুটো স্ট্রেচারে চাপিয়ে নিয়ে যায় ঘরটির ভিতর। সেখানে লন্ঠনের আলোয় বসে আছেন একজন ডাক্তারবাবু। গলায় স্টেথো, পাশে এমারজেনসী কিট। 
আমরা ঠিক আছি, হাঁটতে পারবো, বলে আপত্তি জানালেও ওদের ধরে শুইয়ে যত্ন করে চেক আপ হয় । তারপর প্যাকড ডিনারে চাপাটি আলুর দম খেয়ে চারজনে গোল চারটে পাথরের পিঁড়িতে হয়ে বসে। দুজনের মনেই কয়েক হাজার প্রশ্ন আর উর্বী আর নিশার কাছে আছে তাদের উত্তর। জবা ফুলের চা এনে দিয়ে গেল একটি সাঁওতাল মেয়ে। সেটা খেয়ে একটু মাথাটা পরিস্কার হল। অবসন্ন শরীরে এল একটু জোর। সিরাজ ওরফে রামালুগাডু ও তীরধনুকধারীদের মধ্যে কি সব আলোচনা ও দেয়া নেয়া হল। তারপর সবাই বোধহয় চলে গেল রাতের খাবার খেতে। ঘরটা ফাঁকা। দূরে একলক্ষ ঝিঁঝির ক্যারর ক্যরর একঘেয়ে শব্দ। 
উর্বী শুরু করল। বলি? নভীন তার কর্তাব্যক্তি কিন্তু তার কর্তৃত্ব এখন বেকায়দা। কিছুই বলতে না পেরে মুখটা করুণ করে মাথা নাড়লো। 
-প্রথম প্রশ্ন নিশা কোথা থেকে এলো। তোমরা খবরে শুনেছ মণিকার বডি জংগলে পাওয়া গিয়েছিল, বুকে গুলি বিদ্ধ হয়ে। এ নিয়ে কিছু ইউটিউব নিউজ চ্যানেলে কিছু গুঞ্জন হয়। কেউ কেউ এনকাউন্টার বলে সন্দেহ করে। কিন্তু গুলি লেগেছে বুকে, আর শুধুশুধু একজন এঙ্করকে মারা হবেই বা কেন তার কোন কারণ পাওয়া যায় নি। টিভির এঙ্কররা সবাই চুপচাপ। কর্তৃপক্ষের কোন রকম প্রতিক্রিয়া নেই। অগত্যা সেটা সবাই চেপে যায়। কিন্তু শুনলে অবাক হবে, সেই শেষ সফরে মণিকার সঙ্গী ছিল নিশা। সেই নিশা কৌশল আমাদের সঙ্গে বসে। সরকারের কাছে এনার কোন খবর নেই। পলাতক বা ফেরার।  নিশা তুমি এবারে বল।
নিশা মন দিয়ে সব শুনছিল। উঠে এসে হ্যান্ডশেক করে। বাঁ হাতে। ডান হাতে একটা বড় ব্যানডেজ। একটা বুলেট হাত ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। নিশা শুরু করে। সে খুব ধীরে ধীরে কথা বলে। আতঙ্ক তার চোখে মুখে, বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠে। 
-সেদিন আমি কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করছিলাম। কি করে ভাইরাসটার সঙ্গে লড়াই করা যায়, তার নানা রকম উপায় নিয়ে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাত দরজার বেল বেজে উঠল। এত রাতে, কে আসবে? প্রায় রাত আড়াইটে। জিজ্ঞেস করলাম “কে? এত রাতে কি ব্যাপার?” “আমি বেরা, দরকারি কথা আছে।“ ডঃ বেরার কন্ঠস্বর। 
“আপনার সঙ্গে এত রাতে আমার কি কথা? কাল অফিসে বলবেন”, ফিসফিস করে বাইরে থেকে ভেসে এল-
-আমরা একটা ব্রেক থ্রু করেছি, ভাইরাসের ফুল জিন ম্যাপিং করে একটা ব্যাপার পাওয়া গেছে। জানোই তো আমাদের ওপর সরকারের কি চাপ। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও, আমরা অপেক্ষা করছি।
শুনে উত্তেজিতে হলাম বইকি। তাড়াতাড়ি পোশাক পরে রেডি হয়ে দরজা খুলতেই, কারা যেন আমার মুখে রুমাল চেপে ধরল। আবছা মনে আছে কয়েকজন কালো কাপড় মুখে দেওয়া মানুষ। বেরাকে দেখেছি বলে মনে নেই। উনি সত্যি ছিলেন না ওর গলার স্বর কেউ নকল করেছিল কিনা জানি না। 
-তার পর? অর্চি প্রশ্ন করে। 
-তারপর যখন জ্ঞান ফিরল দেখি হাতপা বাঁধা একটা ভ্যানের পেছনের সিটে। আর পাশে একই ভাবে পড়ে রয়েছে মণিকা, দি নিউস চ্যানেলের প্রাইম টাইম এংকর। মনে হল বেশ কিছু মার পড়েছে ওর ওপরে, মুখ চোখ ফোলা, একটা হাত কব্জির কাছে বেঁকে গেছে, মনে হয় হাড় ভেঙ্গেছে। আমাকে কিছু মারধোর করে নি। রহস্যটা বুঝতে নিমেষ মাত্র লাগল। নিশ্চয় আমি যে ভাইরাসের ইনফেকশনের যাবতীয় খবর ওকে দিয়েছিলাম, সেটা কেউ ট্রেস করেছে, করে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে জেলে পুরবে বলে। 
-জেলে?
-হ্যাঁ, আর কি ভাববো? সেরকমই ভেবেছিলাম বোকার মত। ওরা যে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মেরে ফেলার জন্য, এতটা খারাপ ওদের আমি কখনো ভাবতে পারিনি। আমাকে মারলে তো রিসার্চের অনেক কিছু হারিয়ে যাবে। তাতে ওদের কি লাভ?
“আমার মনে হয় যারা প্যারানয়েড হয় তারা লাভের থেকে ক্ষতির কথাটাই বেশি ভাবে। একটা ভয় তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তারপর?“ নভীন মন্তব্য করে।
ভাবতে গিয়ে নিশার মুখ চোখ অস্বাভাবিক হয়ে যায়। সেই ভয়ঙ্কর রাতের পুনর্নির্মাণ হতে থাকে ওর সামনে। খানিকক্ষণ বিহ্বল হয়ে বসে থাকে তারপর আবার শুরু করে।
-একটা জঙ্গলের মধ্যে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হল। এক প্রজাপতি গোঁফ অফিসার আমাদের বলে “নেমে যান। এবারে খেলা হোবে। “ কিছুই বুঝতে পারি নি। বোকার মত বললাম “কি খেলা?” লোকটি একটু হাসল। “শিকার শিকার খেলা। ১-২-৩ বলার সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের লাগাতে হবে দৌড়। ১০০ ফুটের হ্যান্ডিক্যাপ। তারপর আমরা ফায়ার করব। আপনারা পালাতে পারলে পালিয়ে যাবেন। নইলে?” 
-“কি সাঙ্ঘাতিক।? “ নভীন বলে। 
-শুনেই আমি ধরে নিয়েছি আমার এই শেষ। দরদর করে ঘামতে শুরু করেছি।
 বলতে বলতেই নিশা সেই স্মৃতিতে বিহ্বল হয়ে সত্যি ঘামতে শুরু করে দেয়। বাকীরা অপেক্ষা করে। 
-আশ্চর্য কথা, মণিকা কিন্তু একটুও ভয় পায়নি। ও খুব রেগে গেল, চীৎকার করে উঠল “ এমনি করে আমাদের কথা বন্ধ করতে পারবেন? ইতিহাসে কেউ পেরেছে? এই শয়তানের কবল থেকে বেরিয়ে আসুন, মানুষ হোন।“ 
-আমাদের কি শেখাবি তুই রেন্ডি, গদ্দার, দেশদ্রোহী বিদেশি চর? আরো জোরে চীৎকার করে ওঠে প্রজাপতি গোঁফ। 
মণিকা মোটেই দমে না গিয়ে বলতে থাকে,
-জানেন এই ম্যাডামের হাতে হয়ত আপনাদের সকলের প্রাণ বাঁচাবার ওষুধের ফর্মুলা? শুনেছেন নতুন ভাইরাসের কথা? যা করোনার থেকে ১০০০ গুণ ভয়ঙ্কর, আর ইনি কাজ করছেন তার ভ্যাক্সিনের জন্য?
-ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না, ওসব ভাইরাস টাস আমরা কিছু জানি না। আমাদের যা অর্ডার আছে তামিল করা আমাদের কাজ। আপনি মানুষ না গাধা না বাঘ, আমাদের কাজ শুট করা, সেটা আমাদের করতে হবে। 
বলতে বলতে, ভীষণ রেগে যায় লোকটি। হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, এক… দুই… তিন… আমি চোখ বন্ধ করে দৌড়তে থাকি। আর মণিকা একটা হিংস্র চিতার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে অফিসারের ওপর। অনেক গুলির শব্দ। আমি সোজা দুটো গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ি। লোকগুলো আমাদের চেজ করে না, এক জায়গা থেকেই গুলি চালাতে থাকে। হঠাত কে যেন আমার হাত ধরে টান দেয়। কানের কাছে একটা আর্তনাদ শুনি, একটা শরীর গড়িয়ে পড়ে মাটিতে, আমিও পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাই। 
শেষ করে নিশা তাকায় সিরাজ তথা রামালুর দিকে। চোখ দিয়ে বয়ে যায় জলের ধারা। সেই জল যাতে আগুন জ্বলতে থাকে গোপনে। 
মারা গিয়েছিল সিরাজ বা রামালুর বোন কৃষ্ণালতা। নিশাকে মুখ বেঁধে এনকাউন্টার করতে নিয়ে যাবার পথে রামালুর বাহিনীর সামনে পড়ে যায় তারা। শুট আউট চলে কিছুক্ষণ। কৃষ্ণা এগিয়ে যায় নিশাকে একটা ঝোপের আড়ালে টেনে আনতে। সেইসময় ওদের একজন হঠাৎ ইনস্যাস থেকে দশ রাউন্ড চালিয়ে দেয়। কৃষ্ণা নিশাকে আড়াল করে বাঁচাতে যায় কিন্তু নিজেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। এনকাউন্টার বাহিনী ওরা দুজনেই মারা গেছে ভেবে ফিরে গিয়ে খবর দেয় কাজ খতম। 
-নিশাকে তাড়াতাড়ি এরা রেসকিউ করে মেডিকাল ইউনিটে পাঠিয়ে এসে দেখে মণিকার বডি উধাও। ওর ফোনটা পড়েছিল সেটা দেখে আইডেন্টিফাই করেছে। ফোনটা পেয়েই তো যত ঝামেলা। কল ট্রেস করে করে তোমাদের স্পট করে। আর তারপরেই তোমাদের ওপর একশান শুরু করে ওরা। 
দুজনে রামালুর দিকে তাকায়। ও নির্বিকার হয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। বোঝা যায় না কি ভাবছে। 
-তারপর ? ঊর্বী এখানে তুমি কি করে এলে? নভীন জিজ্ঞেস করে। এত তথ্য হজম করতে বেশ মুস্কিল হচ্ছে দুজনেরই। 
-ছোট করে বলি। মণিকার নোটবুকটা পড়ে ছিল জংগলের এক কোণে, মণিকা দরকারি খবর ফোনে না, নোটবইতে টুকে রাখত। সেটা কুড়িয়ে পেয়ে ওরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ও পরের ফ্লাইটেই কলকাতায় চলে আসতে বলে। আমাদের মনে হয় ওরা নিশ্চয় তোমাদের ধরার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। তোমরা যে কলকাতায় আছো সেটা আমি বলেছিলাম। তাই চটপট একশান প্ল্যান ঠিক হয়ে যায়। নিশা আর রামালু কলকাতায় একটা ওয়ো বুক করে রেখেছিল। সেখানে আমরা ঠিক করি তোমাদের ট্র্যাক করার এবং যেখানে সম্ভব হবে রেসকিউ করার। 
-আমাদের তো কিচ্ছু জানাও নি?
-জানলে তো সংগে সংগে ওরা আমাদের লোকেশন জেনে যেত। 
-আর সিরাজ বা রামালু? সেটা কি করে হল? 
-তুমি আমাকে টেক্সট করেছিলে তুমি ডঃ দাসের সংগে দেখা করবে। সেটা আমি বাঙ্গালোরে থাকতে পাই। রামালুকে বলতে ও একটু প্রিমিটিভ টেকনিক ব্যবহার করে। আসল সিরাজ কিডন্যাপ হয় পরশু দিন। ওর হাতে লেখা চিঠি নিয়ে রামালু যায় দাসের বাড়ী। তাতে সিরাজ লেখে সে হঠাৎ জ্বরে পড়েছে, দেখে মনে হচ্ছে করোনা। তাই ওর চাচাতো ভাই জব্বর এই চিঠিটা নিয়ে যাচ্ছে। ১৫ দিন কাজ করবে। ও খুব ভাল কাজের ছেলে ইত্যাদি। 
-কিডন্যাপ। সাংঘাতিক। সিরাজ আসলে এখন কোথায়? কোন ক্ষতি করো নি তো? 
-না না। ঐ তো খাবার দিয়ে গেল। ওকে সব বোঝাতে ও আমাদের সংগে কাজ করতে রাজি হয়েছে যতদিন না এই ব্যাপারটার কিছু মীমাংসা হয় । 
বড় করে দুটো নিঃশ্বাস পড়ে দুজনের। তারপর দুজনে একসাথেই বলে ওঠে
-আশ্চর্য। তো নিশা এখন কি করবে? বাড়ী ফিরতে তো পারবে না।
নিশা মৃদু হেসে বলল, 
-হ্যাঁ আমি বাড়ী ফিরতে তো পারব না। কিন্তু আমার রিসার্চ কি হবে? আমাকে মারলে যে বিপর্যয় বন্ধ হবে তা তো নয়। আপাতত আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকবো বলে এরা ঠিক করেছে। যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সব আমার ফোনেই আছে। সেটা আমি চাই বিদেশের কোন বিজ্ঞানীদের হাতে যাক। ভাইরাস তো আর দেশ বেছে আঘাত করে না। কিন্তু তার লজিস্টিক্স বার করতে হবে তোমাদের। কৃষ্ণা সিস্টার আর ফিরে আসবে না। রামালু ভাইএর ক্ষতি অপূরণীয়। খুব কুন্ঠিত লাগছে তাই। আমার প্রাণের থেকে ওঁদের প্রাণের দাম অনেক বেশি। 
কথা শুনে রামালু ঘুরে বসে। আধো বাংলা আধো হিন্দিতে বলে, 
-আপনি কেন মিথ্যে লজ্জা পাচ্ছেন ম্যাডাম। আমরা সবাই একই অন্যায়ের সংগে লড়াই করছি। আর সেই লড়াইএর সংগে এখন যোগ হয়েছে ভাইরাসের সংগে লড়াই। এই লড়াইএর আমরা সবাই এক একজন সেনানী মাত্র। আমার বোনও তাই ছিল। লড়াইতে প্রাণ যখন তখন যেতেই পারে। শহীদ হয়েছে কৃষ্ণা। এটা আমাদের গর্বের। আমরা দুঃখ পাই না। আপনিও একজন সেনার মত কঠিন হোন বহেনজি। আপনার যুদ্ধ এখন সবে শুরু। 
নিশা রামালুর হাতটা চেপে ধরে। ওর ক্ষত বিক্ষত হাতে অনেক দিনের অনেক সংগ্রামের দাগ। 
-নভীন তোমরা কি কি ইনফরমেশন পেলে আর কি ক্লু পেলে বলো শুনি এবার। ব্যাপারটা ইমোশানাল হয়ে যাচ্ছে দেখে উর্বী কথা ঘোরায়। 
নভীন অর্চিকে বলে, 
-তুমিই বলো, মাস মিডিয়া নিয়ে তুমি কাজ কর গুছিয়ে বলতে পারবে।
—বলছি। একটু গুছিয়ে নি মনে মনে। তোমরা শুনে খুশি হবে, আমরা ভাইরাস রহস্যটা প্রায় সমাধান করে ফেলেছি, শুধু শেষ কটা ডট। সেই ডটগুলো যোগ করা বাকী আছে। তাহলেই পুরো সমাধান। ছোট করে বলি। প্রথমত নিশার ভাইরাসের তত্বে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আমার দুর্ভাগ্যময় একসিডেন্ট, উর্বীর প্লেন দুর্ঘটনা, ট্রেন দুর্ঘটনা ও কয়েকদিন আগের ট্রাক দুর্ঘটনা, প্রেসিডেন্টের কনভয় দুর্ঘটনা সবই সেই একই ভাইরাসের কাজ আর আমরাও যে তার বিষদাঁতের রেঞ্জের ভিতরে সেটার প্রমাণ হলো সব আমাদের কিডন্যাপ করা সেই একই ভাইরাসের জন্য আমাদের গাড়ীর একসিডেন্টও হল।
- হুম। ভাইরাস আমাদের একরকম উপকারই করে গেছে। আমাদের আর রেসকিউ করতে কোন একশান করতে হয় নি। নৈলে শুট আউট হতে পারত ও আরও ক্যাজুয়ালটি হবার চান্স ছিলো। 
রামালু বলে, 
-আমাদের পিছনেই চারজন কুইক একশান টিমের লোক ছিল তোমরা তাদের দেখনি। গাড়ীর পিছনে ঘাপটি মেরে ছিল। 
একটু শিউরে ওঠে অর্চি। মৃত্যু যেন পায়ে পায়ে অদৃশ্য বেড়াল হয়ে ঘুরছে। কিন্তু ধীরে ধীরে টেররে ওর অভ্যেস হয়ে আসছে। একটু হেসে আবার শুরু করে। 
-এই ভাইরাসের ইনকিউবেশানের সময় এখনও বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সবকটা কেস দেখে আমরা বুঝেছি মাত্র আধঘণ্টা সময় পাওয়া যায় ভাইরাসের সিমটম দেখা দেবার পর। তার মধ্যে চোখ অসম্ভব ফুলে উঠে, ব্রেনে হেমারেজ শুরু হয়। তারপর চোখটা সম্পূর্ণ বেরিয়ে এসে পেসেন্ট মারা যায়। 
-হ্যাঁ এ গুলো আমরাও জেনেছি। আমাদের পর্যবেক্ষণ আর আপনাদের একই। তারপর? নিশা বলে 
- এবারেই রহস্য। এটা প্রায় ভেদ করেছে নভীন। মন গিয়ে শোন আর কোথাও অসম্ভব বা আজগুবি বললে বলো। প্রথমেই যেটা দেখা যায়, প্রতিটি কেসেই একজন হতভাগ্য ড্রাইভার ইনফেক্টেড হয়। সে গাড়ীর বা ট্রেনের বা প্লেনের পাইলট যে কোন রকম হতে পারে। আর সবকটা কেসেই ডিজেল বা এরো ফুয়েল কেরোসিন ব্যবহার হচ্ছিল। 
-কেরোসিন ডিজেল কেন আর পেট্রোল নয় কেন?
-বলছি। কিন্তু তার জন্য একের পর এক হাইপোথেসিস আমি বলব। দেখা যাক সেগুলো দাঁড়াচ্ছে কিনা। প্রথম অনুমান হচ্ছে এই ভাইরাসটি বিদেশ থেকে এসেছে কিন্তু তার বাসা আমাদের আমদানী করা ক্রুড অয়েলে। আর এই ভাইরাস তেলের মধ্যে বেঁচে থাকে। তেল থেকেই ওরা পুষ্টি আর বাঁচার রসদ দুটোই পায়। ওই পরিমন্ডল ওদের বাঁচবার জন্য প্রয়োজন ঠিক যেমন আমাদের দরকার অক্সিজেন। 

-এবারে পেট্রোল নয় কেন? দ্বিতীয় অনুমান হচ্ছে যখন ক্রুড রিফাইন করা হয় তখন প্রথমেই বাষ্প হয়ে উড়ে যায় পেট্রোল। ভাইরাসের ঘনত্ব তখন এত কম যে বাষ্পীভূত পেট্রোল খুব কম সংখ্যক ভাইরাস বাঁচতে পারে। এরপর তেল অনেক ঘন হয় ও কেরোসিন ও ডিজেল পরপর তৈরী হয়। কেরোসিনে কম ভাইরাস ঢোকে বেশিরভাগ থেকে যায় ডিজেলে। ফলে বেশির ভাগ ডিজেল গাড়ী বা ট্রেনেই আমরা দুর্ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। কেরোসিনে প্লেন ওড়ে। সেরকম একটা প্লেনেই ছিল উর্বী।
শ্রোতাদের চোখ বড় হতে থাকে। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলায় তাদের ডুবিয়ে আবার শুরু করে অর্চি। 
-তৃতীয় অনুমান হলো এই লটটা এসেছে রাশিয়া থেকে। রুশ ইউক্রেন যুদ্ধের সময় প্রচুর তেল সস্তায় আমদানী করা হয়। কোনভাবে সেই তেলেই এই ভাইরাসটা ঢুকে পড়ে। 

-দুটো জিনিষ তা হলে এখনো অজানা থেকে যাচ্ছে। এক এরকম তেল খাওয়া ভাইরাস তৈরী হল কি করে। আর সেটা আমাদের দেশে পৌঁছাল কি করে?
-সে ব্যাপারেও কিছু ক্লু আছে। নভীন ম্যাপটা দাও। একটু ভালো করে মার্ক করার দাও কিছু দাওতো। 
নভীন ডঃ দাসের আঁকা ম্যাপটা বার করে। ব্ল্যাক সিটা কালো করে শেড করে। ডান দিকে একটা বিন্দু, লেখা kavkaz oil terminal টা বড় করে গোল করে মোটা লাইন টেনে দেয় তীরচিহ্ন দিয়ে জহরলাল পোর্ট নভী মুম্বাই পর্যন্ত। তারপর গোল করে মার্ক করে দেয় মারিয়োপল, ওডেসা, খারসন। খারসনের ওপর চৌকশ করে ঘিরে দেয় বায়ো ল্যাব। সবাইকে ম্যাপটা দেখায়। হাতে হাতে ঘুরে আসে। চোখে অবিশ্বাস আর বিস্ময় মিশে সবার মাথা যে ঘুলিয়ে ঘ হচ্ছে সেটা বোঝা যায়। 
-ইউক্রেনের খারসনে একটা বায়ো ল্যাবে ভাইরাস নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা হতো। এর জন্য কিছুটা অর্থব্যয় করত আমেরিকান সরকার কিছুটা ইউক্রেন সরকার । প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটা সেলফ এনিহিলেটিং ভাইরাস তৈরী করা যা নিজেরই অরিজিনাল ভাইরাসকে ধ্বংস করে ফেলবে। 

-সেলফ এনিহিলেটিং মানে? উর্বীর হাঁ আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। নিশা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়। 
-যেমন ধরো কিছু করোনা ভাইরাস নিলাম। তারপর তাতে আমরা জোর করে মিউটেশান করাতে থাকলাম। এমন একটা স্টেজ এলো যখন এই ভাইরাসটা পাল্টাতে পাল্টাতে নিজেরি দুশমন হয়ে গেছে। এখন এই ভাইরাসটাকে সংক্রমিতদের ইনজেকশান দিলে তাদের শরীরের ভাইরাসের সংগে এটা যুদ্ধ করে মেরে ফেলবে। এটা শুধু করোনা নয় যে কোন ভাইরাসের ক্ষেত্রেই চলতে পারে। এ নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে সারা বিশ্বে। 

-এই মিউটেশান করার জন্য হাই এনারজি রেডিয়েশান লাগতো। ইউক্রেন সরকার তাদের যাবতীয় পরমাণু বোমার কারখানা স্বেচ্ছায় বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বশান্তির জন্য। না করলে হয়ত রাশিয়া তাদের আক্রমণ করতে সাহস করত না। সেই পরমাণু শক্তির যা কিছু তারা জানত, সেগুলোকে কাজে লাগিয়েছিল এরকম গবেষণায়। ২৪ ফেব্রুয়ারী এই ল্যাব থেকে একটা ভাইরাসের স্যাম্পল ভর্তি ভেসেল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল খারসন থেকে। তাতে ছিলেন দুই বিজ্ঞানী। ইয়েভশেংকো আর নভোৎস্কায়া। তাঁরা আর একটা ল্যাবে খুব সাবধানে পরীক্ষার জন্য যাচ্ছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশে যেমন আচমকা লকডাউন হয়েছিল তেমনই আচমকাই রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। 
-রাশিয়ান পেট্রোল বোট ওদের চ্যালেঞ্জ করে। কার্গো আছে খুলে দেখাতে বলে। ওরা স্বাভাবিক কারণেই রাজী হন না। ওঁরা বলেন, এই কার্গো দেখানো যাবে না। এগুলো হাই সিকিউরিটি আইটেম। আমার অনুমান, এতে রাশিয়ানরা রেগে যায়, ওদের শুট করে ও বিজ্ঞানীরা মারা যান। জাহাজটি সার্চ করে ভাইরাসের ফাইলগুলো সিজ করে নেয় রাশিয়ানরা। তারা ভেবেছিল এটা কোন নতুন আণবিক অস্ত্রের মডেল। তারপর তারা এই পেলোড নিয়ে রাশিয়ান এলাকায় কাভকাজ বন্দরে নোঙর ফেলে।

-এরপর আর জানা নেই। কাভকাজ বন্দর হচ্ছে রাশিয়ার তেল পাঠাবার টারমিনাল। সেখান থেকে সোজা জাহাজ আসে ভারতে নভী মুম্বাইের জহরলাল নেহেরু পোর্টে। বলা মুষ্কিল, কি ভাবে ঐ ভাইরাস ঢুকল আমাদের দেশে আসা তেলের ট্যাংকার। আমার সন্দেহ ওই শিশিগুলো চুরি হয়, চুরি করে কোন ভাড়াটে চেচেন মার্সিনারি। রাশিয়া নানা রকম স্মাগলার, স্পাই ও নানা রকম দালালে গিজগিজ করে । ওই ফাইলগুলো তারা ভেবেছিল পাকিস্তানের উগ্রপন্থীদের কাজে লাগবে। তারপর কোন খালি ট্যাঙ্কারে ওরা সেগুলো লুকিয়ে রাখে এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে যায়। সব ঘটনাই ঘটে ওই অয়েল টারমিনালে। ট্যাঙ্কারগুলো এর পর ক্রুড অয়েল লোড করে চলে আসে মুম্বাই। সেখান থেকে রিফাইন্ড হয়ে ডিজেল হয়ে আস্তে শুরু করেছে আমাদের পেট্রোল পাম্পে। যেমন যেমন আসছে তেমনই আমরা দেখতে পাচ্ছি তার বীভৎস ক্রিয়াকলাপ।
- আষাঢে গল্প কিন্তু এরকমই কিছু একটা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশের ডিজেল পাম্পে পৌঁছে যায় ডিজেল। যাতে গিজ গিজ করছে ভাইরাস। কালান্তক ভাইরাস। নভীন মন্তব্য করে, অর্চির কথা শেষ হলে
হাততালির আওয়াজে সবাই তাকায়। রামালু হাততালি দিয়ে বলে ওঠে
-আপনারা দারুণ কাজ করেছেন। এ তো পুরো দস্তুর গোয়েন্দা কাহিনীকে হার মানিয়ে দেবার মত। যেটুকু অজানা রহস্য সেটা আজ নয় কাল বেরোবে। কিন্তু এখন আমাদের একশান প্ল্যান কি? কি করে এই ভাইরাসকে আটকানো যায়?
-আমি তা ভেবে পাচ্ছি না। এর কোন ওষুধ বা ট্রিটমেন্ট বার করার আর সময় নেই। একমাত্র উপায় এই ব্র্যান্ডের ডিজেল কেরোসিন এখুনি বন্ধ করে দেওয়া। আর ক্রুড যা আছে নষ্ট করে ফেলা। সেটা তো আমাদের ক্ষমতায় নেই। 
-তা হলে কি আমরা সব ধ্বংস হয়ে যাবো? সরকার কি করছে? নিশা তুমি কতদূর জানো?
-সরকার কি করছে আমরা তো জানি না। আমাদের জানতে দেওয়া হয় না। আমার কাজ ছিল আইসোলেট করা আর সিকুএন্সিং করা। আর তারপর তার প্রতিষেধক টিকা বার করার চেষ্টা করা। 
-দেখি আমার এরিয়া হেডের সংগে কথা বলি। আপনারা ঘুমিয়ে নিন। কোন ভয় নেই। আমাদের লোক সবসময় পাহারায় আছে। গুড নাইট। 
রামালু বেরিয়ে যায়। চারপাশের অন্ধকারে অনিশ্চিতি মিশে ঘন মিশকালো চারদিক। 
পাখা এ সি কিছু নেই। তবু এক শান্ত শীতলতা আস্তে আস্তে এই জংগলের পোড়ো বাড়ীটিতে ঘুম নিয়ে আসে। সব আলো নিভে গেলে তখন শুধু থাকে চাঁদের আলো। সেই আলোয় হিসাবের খাতা লেখা যায় না। শুধু স্বপ্নের রাস্তায় হাঁটা যায়। কারো হাত ধরে। রুচি লুকিয়ে আছে এক ঝাঁক শাল গাছের আড়ালে। 
হঠাৎ স্বপ্ন ভেঙে যায় অর্চির। চোখ যায় বাইরের দিকে। একজন পা টিপে টিপে হেঁটে আসছে ওদের দিকে। দুজন গার্ড তীর ধনুক হাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। 
হঠাৎ ঠা ঠা গুলির শব্দ। পা টিপে টিপে আসা লোকটি চীৎকার করে লুটিয়ে পড়ে। পাহারা দেওয়া দুজন এক লাফ দিয়ে সেদিকে ছোটে। অনেক গুলো গাড়ির শব্দ শোনা যায়। এরা চারজন অন্ধকারে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। 
 -ক্রমশঃ-

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments