মারণবীজের আজব ধাঁধা পর্ব ৮
বাসুদেব গুপ্ত
গ্লাস অর্ধেক শেষ হতে হতে এক ঘণ্টা প্রায়। টিভিটা মিউটে চলছে। অনেক লোক প্রচুর তর্ক করে যাচ্ছে। প্রতিদিন ঝগড়া করার বিষয় বার করা শক্ত কাজ। এ জন্যই এংকরদের প্রচুর মাইনে দেওয়া হয়। বেশ একটা ঝিম ধরছিল হঠাৎ সব বন্ধ করে ফ্ল্যাশ আর ব্রেকিং নিউজ বার বার দেখাতে দুজনের চটকা ভেঙে গেল। সোজা হয়ে বসে খবরটা শুনে দেশের সব লোকের মত ওরাও চমকে উঠল।
জরুরী খবর ভেসে ওঠে এলইডি পর্দায়।
রাষ্ট্রপতির গাড়ীতে হঠাৎ দুর্ঘটনা। ড্রাইভার কোন কারণে অসুস্থ ও মৃত। প্রেসিডেন্টের কিছু হয়নি, উনি সম্পূর্ণ সুস্থ, কোন আঘাত নেই।
ক্র্যাশ প্রুফ ১০ কোটির গাড়ীর সমালোচকদের সঠিক জবাব। আবার জানাচ্ছি প্রেসিডন্ট ১০০ শতাংশ নিরাপদ। গাড়ীর কোনই ক্ষতি হয় নি। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ঘোষণা। হোম মিনিস্ট্র্রির প্রবক্তা বিবিসি শীঘ্র তাঁর বক্তব্য রাখবেন।
পুরোটা মন দিয়ে শুনে কি সব ভাবল নভীন। চোখ কুঁচকে হঠাৎ বলে উঠল,
-এই গাড়ীটা পেট্রোল না ডিজেল?
- ডিজেল। এই তো দুমাস আগে ১০ কোটি টাকায় কেনা হল। ড্রাইভারের এন্টিজেন টেস্ট, ব্রিদালাইজার টেস্ট করেই তবে ক্লিয়ারেন্স হয়। এখন ড্রাইভার যদি দুম করে কিছু একটা করে ফেলে। পেট্রল না ডিজেল জেনে কি হবে?
- একটা জিনিষ খেয়াল করে দেখ, যতবার ভাইরাস দেখা গেছে শুধুমাত্র গাড়ীর ড্রাইভারেরই সংক্রমণ হয়েছে। এটা একটু অদ্ভুত না? আর পরের পাজল হলো, সব গাড়ীগুলোই ডিজেল!
অর্চি হাঁ হয়ে যায় এমন অদ্ভুত যোগাযোগের কথা শুনে। নভীনের মাথাটা কি অত্যন্ত চাপে গুলিয়ে যাচ্ছে?
নভীন যেন আশাই করেছিল অর্চির চোখে অবিশ্বাস দেখবে। আস্তে আস্তে বলে,
-আমার মাথা একদম ঠিক আছে। কিন্তু প্রমাণ করব কি করে? আরো কিছু এভিডেন্স চাই। আর ডিজেল জেনেই বা কি লাভ? ডিজেলের সংগে এর সম্পর্ক কোথা থেকে এলো ? একবার রিক্যাপ করা যাক…
-এক। এটা ভাইরাস। এটা নিয়ে সন্দেহ নেই।
দুই। এটা করোনার মত একেবারেই নয়। অন্তত অনেক মিউটেশান হয়েছে।
তিন। এটা ডিজেলের সংগে সম্পর্কিত। হাওয়ায় ওড়ে না। ডিজেলের ধোঁয়ায় ওড়ে।
চার। এর বিস্তার ক্রমশই বাড়ছে।
-আরে তাই তো। অর্চি চীৎকার করে ওঠে। তার মানে গাড়ী স্টার্ট দিলেই ডিজেলের ফিউম তৈরী হয়। আর তার মধ্যে আছে ভাইরাস।
- ডিজেলে ভাইরাস? কোথা থেকে এলো? আর ডিজেলে ভাইরাস বাঁচবে কি করে?
-এটা নিয়ে দেখছি ডঃ তড়িৎ দাসের সংগে কথা বলতে হচ্ছে। খুব পন্ডিত ব্যক্তি। ভাইরোলজি জেনেটিক্স সবেতেই তাঁর শয়ে শয়ে পেপার। কেউ কেউ বলে আমাদের দেশের বায়োলজিক্যাল অস্ত্র তৈরীর একটা পরিকল্পনা ছিল। ওনাকে সেই সেন্টারের হেড করে নিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু উনি প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন যুদ্ধ টুদ্ধ আমার আসে না।
-সরকার চাইলে ঠিক নিয়ে যেত। যাই হোক ওনার কাছে যাবে কি করে?
-তোমরা ব্যবসায়ীদের সম্মানীয় মনে করো না অর্চি। কিন্তু আমাদের অনেক রিসোর্সফুল হতে হয়। ওঁর সংগে আমার এক কনফারেন্সে আলাপ হয়েছিল। এফেক্ট অফ রিনিঊএবল এনারজি অন ইকো সিস্টেম সেমিনার হচ্ছিল। তারপর বছরে একবার করে নমস্কার জানাই। শুনেছি ওনার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। দেখি ফোন করে। ব্যাপারটা বুঝতে হবে।
গাড়ী না নিয়ে ঠিক হলো ইউবার নিয়ে যাবার। গুগল ম্যাপের ওপর নিজেরা ভরসা করতে গিয়ে দুদিন আগেই একটা গাড়ী স্টেশনে রেল লাইনে উঠে গিয়েছিল।
-কলকাতা সিটি এখন তিলোত্তমা না হোক পিটিঊষা বলা যায়। সাঁই সাঁই গাড়ী চলে। শহরটা ফ্লাইওভার দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে। গড় গতি উঠে গেছে ৬ কিমি থেকে ৪০ কিমিতে। অন্ততঃ মেন রোডগুলোতে। সে জায়গায় বাঙ্গালোরের গতি ৪৫ থেকে নেমে হয়েছে ১৮।
অর্চির কথায় নভীন একচোট হেসে বলল,
-যাই বলো কলকাতা অত দৌড়লে ঠিক মানায় না। ভাববারও তো সময় চাই।
এই কথাটাই ডঃ দাস বলছিলেন। ভাববার জন্য সময় চাই। দৌড়ে দৌড়ে ম্যারাথন জেতা যায় কিন্তু পৃথিবীতে হাজার রকম প্রজাতি আর হাজার রকম জীবাণুকে বুঝতে গেলে অসীম ধৈর্য চাই। যা গড়ে উঠেছে কোটি কোটি বছর ধরে তা কি একদিনেই বুঝে ফেলা যায়?
ডঃ দাসের ড্রইংরুম মাঝারি সাইজের, ছিমছাম । অগোছালো বইপত্তর ছড়ানো নেই। সব পরিপাটি। নিজের বড় বড় ছবি কাপ মেডেল সার্টিফিকেট নেই। শুধু একটা দেওয়াল জোড়া ঘড়ির ছবি। অর্চি দেখে চিনতে পারল ডুমসডে ক্লক। আমাদের মধ্য রাত্রির দিকে এগিয়ে যাবার দিনলিপি। ১৭ মিনিট ছিল দু বছর আগে। এখন কমে হয়েছে ১০০ সেকেন্ড। এই মহাজাগতিক ঘড়ির হিসাবে আমরা ধ্বংস হতে বাকী মাত্র দেড় মিনিটের কিছু বেশি।
দূর থেকে নমস্কার ও কুশল বিনিময় করে দুজনে বসতে যাচ্ছে হঠাৎ বেল বাজল। ইউবারের ড্রাইভার।
-আপনার ফোনটা ফেলে গিয়েছিলেন স্যার। এটাই তো?
নভীন তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে দেখে সত্যিই ফোন নেই। এমন ভুল তো ওর হয় না। অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ফোনটা ফেরত দিয়ে জানতে চাইল,
-আপনার নাম?
-নাম জেনে আর কি করবেন স্যার। গাড়িতেই নাম লেখা ছিল দেখেননি যখন ছেড়ে দিন। ফোনটা সামলে রাখবেন। খুব অন্যমনস্ক আপনারা।
বলে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে সে বিদায় নিল। ততক্ষণ ডঃ দাস এসে পড়েছেন। ও নিয়ে আর ভাবা হল না। খচখচ করতে লাগলো এমন ভুল তো হয় না। আর ফোনটা দিয়ে গেল কোন পুরস্কার চাইল না। লোকজন সব বর্তমান সরকারের রাজত্বে সাধু হয়ে যাচ্ছে নাকি?
ডঃ দাস সবটা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর চুপ। একবার উঠে গেলেন। টানা বইএর আলমারী থেকে একটা বই খুঁজে না পেয়ে নভীনকে সাহায্যর জন্য ডাকলেন। বয়সের সংগে শক্তি কমে আসছে।
-একটু দেখুন তো The genetic effects of radiation বইটা পান কিনা।
দুজনে ভাগাভাগি করে দু দিক থেকে খুঁজে অবশেষে টংএর কোণায় বইটির দেখা মিলল। পাশেই জ্বলজ্বল করছে সিদ্ধার্থ মুখার্জির বিখ্যাত বই The Emperor of all maladies। অর্চির বুকটা গর্বে একটু ফুলে গেল বোঝা গেল।
ডঃ দাস চটপট বই থেকে কিছু নোট করলেন একটা প্যাডে। তারপর বসে গেলেন কম্পিউটারে। মনে হল কিছু একটা খুঁজছেন গুগলে। গুগলের কোন দায় নেই দরকারী জিনিষটা তাড়াতাড়ি খুঁজে দেবার। যারা গুগলকে পয়সা দেবে তাদের নামটা আগে দেখানোই এটাই দস্তুর।
দেখতে দেখতে হঠাৎ কিছু একটা পেয়ে চটপট প্যাডে লিখে আবার সোফায় এসে বসলেন। কিছুক্ষণ শান্ত যেন ধ্যানে বসেছেন। অর্চি আর নভীন অবাক শ্রদ্ধায় দেখে যাচ্ছিল, ওনার মুখ চোখ কেমন সার্চলাইটের মত জ্বল জ্বল করছে। জ্ঞানতপস্বী ব্যাপারটা আর চোখে পড়ে না। সব মানুষই কেমন পচাপচা ধান্দাবাজ। এঁকে দেখে কয়েক মিনিটের জন্য মনে হচ্ছিল বিরাট বিজ্ঞানীরা এভাবেই সত্যের খোঁজ করেন।
এখন তাঁকে বেশ তৃপ্ত দেখাচ্ছে। মনে হয় উত্তরটা পেয়ে গেছেন। চুপ করে বসে রইলে দুজন। প্রতীক্ষা। কতক্ষণ উনি কথা বলেন।
এক মিনিট দু মিনিট পাঁচ মিনিট, নিস্তব্ধতা। হঠাৎ মাথাটা গড়িয়ে পড়ে যায়।
স্- ট্রোক। শীগ্গির এম্বুলেনস ডাকো। আমি দেখছি সি পি আর দেওয়া যায় কিনা।
নভীন চিৎকার করে লাফ দিয়ে ওঠে।
ফোন লাগছে না। যতবারই নম্বর ট্যাপ করে একটাই কথা শোনা যায় –“আপনার ফোন এখন নেটওয়ার্ক পরিসেবার বাইরে আছে।“
নভীন ডঃ দাসকে আস্তে করে সোফায় শোয়ায়। নাকে হাত দেয়। প্রাণবায়ু চলাচলের কোন ইঙ্গিত নেই। হাত দুটোকে শক্ত করে জুড়ে হাতের কব্জির দিকটা দিয়ে জোরে চাপ দেয়। মনে পড়ে ছোটবেলায় বয়স্কাউটের শিক্ষা। ওর ফার্স্ট এডের ব্যাজ আছে, কিন্তু সেটা এভাবে লেগে যাবে ভাবতে পারে নি। মিনিটে একশোবার দু ইঞ্চি জোরে চাপ তারপর আলগা।
ফোন আর সিপি আরের চেষ্টা চলতে থাকা কিন্ত কোনটাই খুব সফল হাওয়ার কোন চিহ্ন দেখা যায় না। হতাশ হয়ে ছেড়ে দেবে তখন হঠাৎ-
খুব জোরে বেল বাজে কয়েকবার। বাইরে অনেক গুলো বুটের আওয়াজ। বাড়িতে কেউ ছিল বলে এতক্ষণ বোঝা যায় নি। বেলের আওয়াজ শুনে হঠাৎ কোথা থেকে এক চাকরের আবির্ভাব হয়। সে এসে দরজা খুলতেই প্লেন পোষাকে কয়েকজন গাঁট্টাগোট্টা লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ওপরে। তাদের মধ্যে একজন চেনা। ঊবারের ড্রাইভার। অর্চি আর নভীন দেখে একটা সার্ভিস রিভলবারের ইস্পাতের নল ওদের দিকে তাক করা।
-হাত ওপরে তুলুন। নড়াচড়া বা পালাবার চেষ্টা করবেন না।
আগন্তুকদের চোখ ঘোরে ও অবধারিত পড়ে ডঃ দাসের দিকে। মুখ চাওয়াচাওয়ি হয় তিন জনে। ওদের মধ্যে যে লোকটি হাত তুলতে বলেছিল তার মুখে একটা চকিত আলো খেলে। তার আবার প্রজাপতির মত গোঁফ।
অর্চি কিছুই বুঝতে না পেরে প্রতিবাদ জানাতে গেলে চুপ শালা বলে একজন ওর মুখটা চেপে ধরে মাথায় বাঁটের জোরে একটা ঠোকা দিতে ওর চোখের সামনে ক্ষণিকের জন্য নানা রকম ফুল ফুটে আবার ঝরে যায়। তিনজনে মিলে পুরো ঘরটা সার্চ করতে শুরু করে দেয়। যেমন পুলিশরা করে। যত না খায় তার থেকে বেশি ছিটোয়। পুলিশের কাছে খাওয়ার ব্যাপারে একটু অভিজ্ঞ পরিশীলন আশা করেছিল অর্চি।
নভীন শান্ত হয়ে দাসের মুখটা মুছিয়ে দেয়। হাতের মুঠো শক্ত হতে শুরু করছিল। সেখান থেকে কাগজের টুকরোগুলো চকিতে পকেটে অর্চিকে বলে,
-ডেড। মনে হয় স্ট্রোক। চাকরের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়
-আগে এরকম হয়েছিল?
- হ্যাঁ এইতো আগের সপ্তাহেই তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। বাবু কি-
- নেই। মারা গেছেন।
শুনে ডুকরে কেঁদে উঠে নানারকম আক্ষেপ শুরু হয়। একটা প্রধান আক্ষেপ হলো মাইনে দেবার দিন আজ। এখন মাইনে কে দেবে।
সার্চ থামিয়ে নাটক দেখছিল তিন বহিরাগত। চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসে। এক থাপ্পড়ে ওর কান্না থামিয়ে কলারটা চেপে ধরে প্রজাপতি গোঁফ। নভীনের মনে পড়ে সি আই ডি সিরিয়ালের বিখ্যাত সব চড়ের কথা। -তোর নাম কি? ঠিক বলবি। চালাকি করলে আবার-
-আমি সিরাজ।
-বাবা একেবারে সিরাজউদ্দৌল্লা? তো বাবা নবাব সিরাজ এই লোক দুটি কতক্ষণ এসেছেন এখানে?
-আজ্ঞে আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বলতে পারব নি।
-একসেলেন্ট মাল। চাকরের দারুণ স্পেসিমেন।
-আমরা এসেছিলাম পুরনো বন্ধুর সংগে একটু আলাপ করতে। হঠাৎ উনি ফেন্ট হয়ে যান আমরা সিপিআর দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেও পারিনি।
-এমবুলেন্স ডাকেননি কেন?
-অনেক চেষ্টা করেছি লাইন পাইনি।
-মিথ্যে বলছেন, গর্জে ওঠে প্রজাপতি। আমাদের বোকা পেয়েছেন! আজকের ডিজিটাল ইন্ডিয়ার যুগে ফোন পাওয়া যায় না ওসব ব্লাফ আমাদের দিয়েন না। অধিকারী ওদের গাড়িতে তোল।
তারপর গুঁফো ঘোঁষণা করে,
-ডঃ দাসকে খুনের অভিযোগে অর্চি আর নভীন আপনাদের গ্রেফতার করলাম।
-ক্রমশঃ-
0 Comments