জ্বলদর্চি

তানসেন--এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/প্রথম পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী               
প্রথম পর্ব        
   
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভীমপলশ্রী

গ্রীষ্মের সূচনাতেই এবার প্রবল দাবদাহের সৃষ্টি হয়েছে আগ্রা নগরীতে। অবশ্য প্রতিবৎসরেই এখানে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড উত্তাপ। তার মধ্যে এই বৎসরের গরম যেন অসহ্য। রোদের তাপে গাছপালা গুলি প্রায় শুকিয়ে গেছে। সকাল ন'টার পরে আরাবল্লী পর্বতের দিক থেকে হলকা হলকা আগুনের মত গরম বাতাস বয়ে আসে। সেই গরম বাতাস বন্ধ হয় সন্ধ্যের পূর্বে। যমুনা নদী এই গরমে সরু একটি সুতোর মতো বয়ে চলেছে। গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন সকলেরই অবস্থা কাহিল। শুখনো গরম বাতাস একটু বেলা বাড়লেই শরীরের চামড়ায় জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। দিল্লির সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর এই গরমে দরবারের কাজ সংক্ষিপ্ত করে দিয়ে সূর্য মধ্যগগনে পরিপূর্ণ তাপ বিকিরণের পূর্বে দরবারের কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন। দরবারীরা যে যারা আবাসে ফিরে যান। কেল্লার ভিতরের রাস্তাগুলিও তাই জনশূন্য হয়ে যায়। নিতান্ত প্রয়োজন না থাকলে কেউ ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে না। শুধু মাঝে মাঝে অসহ্য গরমে হাতিদের বৃংহণ ভেসে আসে। মাঝে মাঝে হাতি ও আরবী ঘোড়াদের গায়ে বান্দারা জল ছিটিয়ে দেয় যাতে অতিরিক্ত গরমে পশুগুলির ভেতরের জীবনীশক্তি কমে না যায়।          

এই সময়েও সুরের জাদুকর মিঞা তানসেনের দৈনন্দিন জীবনের কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ভোরবেলা ঊষালগ্নে তানসেন শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়েন। এই নিয়ম তাঁর শৈশব কাল থেকে যখন বৃন্দাবনে গুরু হরিদাস স্বামীর আশ্রমে থাকতেন তখন থেকেই। সেই সময়ে গুরুর সাথে আকাশে যখন শুকতারা ফুটত তখন যমুনাতে যেয়ে স্নান, আহ্নিক করে যখন আশ্রমে ফিরতেন তখন সবেমাত্র পুবের আকাশে গোলাপি রং লাগতে শুরু করত। পাখির কলকাকলিতে নিধুবন পূর্ণ, বড় বড় গাছের ফাঁক দিয়ে রামধনু রঙের পেখম মেলে ময়ুরেরা  আশ্রম প্রাঙ্গণে খেলা করতো। অবশ্য তখন তিনি মিঞা তানসেন হননি, তখন তিনি রামতনু মিশ্র নামের এক বালক। আজও সে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। 

প্রাতঃকালীন স্নান করে তাঁর সংগীত রেওয়াজের কক্ষে প্রবেশ করে মা সরস্বতীর বিগ্রহকে প্রণাম করে, মনে মনে গুরুদের স্মরণ করে বীণাযন্ত্র নিয়ে বসেন। ধীরে ধীরে তাঁর হাতের আঙুলগুলো বীণার তারের উপরে খেলতে শুরু করে আশাবরী, টোরি বা আহির ভৈরোঁ রাগে নতুন প্রভাতকে স্বাগত জানায়। এর পরে কন্যা সরস্বতীকে সঙ্গীতের তালিম দেন। স্বরস্বতীর সঙ্গীত প্রতিভা দেখে তিনি তাকে নিজেই তালিম দেন যাতে ভবিষ্যতেও সেও পরিপূর্ণভাবে সঙ্গীতশিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। অবশ্য মিঞার অন্য চারটি সন্তানও সংগীতে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। এরা হলেন হামিরসেন, সুরতসেন, তানরস খান ও বিলাস খান। এরপরে প্রাতঃকালীন আহার শেষ করে দেওয়ানীআমে সম্রাটের সভার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাঁর সাথে একজন বীণাবাহক বীণা বহন করে নিয়ে যায়। দ্বিপ্রহরের পূর্বে দরবারী সভা শেষ হলে নিজের কক্ষে ফিরে এসে মধ্যাহ্নভোজ শেষ করে নিঃসঙ্গ দুপুরে নিজের সঙ্গীতকক্ষে কখনো বা বীণাগুলির তন্তু পর্যবেক্ষণ করেন, প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন করেন অথবা গ্রন্থ রচনায় মগ্ন হয়ে যান। সময় পেরিয়ে যায়। এক সময় বিকেল হয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়। দরবারে পুনরায় যাবার প্রয়োজন না হলে বা সম্রাটের কোন নির্দেশ না হলে সন্ধ্যের সময় রাগ পুরিয়া, রাগ ইমন ইত্যাদি সান্ধ্যকালীন রাগে তাঁর কক্ষ ভরে ওঠে। আবার কখনও বা সম্রাটের ইচ্ছায় আগ্রা দুর্গের চবুতরায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত মালকোষ রাগে সম্রাটের দেহমন সিক্ত করে আবেশে ভরিয়ে তুলেন। এইভাবে দিনের পরে রাত্রি, আবার রাত্রির পরে ভোর হয়।                              

এদিনও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। মধ্যাহ্নের আহার সমাপনান্তে নিজের কক্ষে বসে বিভিন্ন রাগ রাগিনী সম্বন্ধীয় গ্রন্থ রচনায় মগ্ন ছিলেন। একটিমাত্র গবাক্ষ দিয়ে আলো ও গরম বাতাস ঘরে ঢুকে যতখানি না আলো আসছে তার থেকে বেশী গরম হাওয়া প্রবেশ করে তানসেনকে ঘর্মাক্ত করে তুললো। তিনি লেখা বন্ধ করে দেখলেন সামনের ছাতিম গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। প্রচণ্ড দাবদাহে আগ্রা দুর্গের সবকিছু যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তানসেন গরমে অতিষ্ঠ হয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে কক্ষের পিছনের দিকে একটি উন্মুক্ত অলিন্দে এসে দাড়ালেন। সূর্যতাপ এখানে এই সময়ে আসে না। যখন সূর্য ওঠে সেই সময়ে এখানে সূর্যালোক প্রবেশ করে, দিনের অবশিষ্ট সময় এই স্থানটি ঠান্ডা থাকে। দূরে যমুনা নদী প্রবাহিত হওয়ার জন্য মাঝে মাঝে ঠান্ডা হাওয়া আসে। উন্মুক্ত অলিন্দের চারদিকে ছোট-বড় কক্ষগুলোর মাঝখানে এই অলিন্দ পথ চারপাশের কক্ষগুলিকে বেষ্টন করে আছে। দুটি কক্ষের মাঝখানে সরু পথ দিয়ে পেছনের দিকে যাওয়া যায়। কক্ষ গুলির পিছনের এই জায়গার মাঝখানে একটি প্রাচীন কূপ আছে যেটি কেবলমাত্র কক্ষগুলির বাসিন্দারাই ব্যবহার করে। অলিন্দ পথ দিয়ে যাবার সময় তানসেন শুনতে পেলেন এক নারী কন্ঠের সুর। স্তব্ধ দুপুরে ভীমপলশ্রী রাগ। এসময় তো এই রাগই গাওয়া হয়। প্রথমে ভাবলেন সরস্বতীর কণ্ঠস্বর, কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলেন সে তো এই মুহূর্তে বেগম মহলে আছে। তাহলে কে এমন নিখুঁত ভীমপলশ্রী রাগ গাইছে? গানের উৎস খুঁজতে খুঁজতে কক্ষগুলির পিছনে ধীর পদক্ষেপে যেয়ে দেখলেন কূপের কাছে এক সুন্দরী যুবতী কন্যা দ্বিপ্রহরের তাপ সহ্য করতে না পেরে স্নানরতা অবস্থায় সুরের জাদু চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কোনদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে জানে এই গরমে কেউ কক্ষ থেকে বের হবে না বা কারো দৃষ্টির সামনে সে পড়বে না, যারফলে সে নিবিষ্ট মনে গাত্র মার্জনা করতে করতে গান গাইছে। সিক্ত অবস্থায় তার শরীরের প্রতিটি খাঁজ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। বুকের উপরে পরনের ঘাগরা বাঁধা আছে। তানসেন ভাবলেন কে এই যুবতী, একে তো কোনদিন হাভেলীর মধ্যে দেখিনি? দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে কোন সুরসুন্দরী নেমে এসে নিবিষ্ট মনে স্নানরতা অবস্থায় সুরের জাদু ছড়িয়ে দিচ্ছে। গাত্র মার্জনা শেষ হতে বালতি নিয়ে কূপ থেকে জল তুলে মাথায় ঢালার সময় নিম্নগামী জলের বেগে তার বুকের উপরে আলতো করে বাঁধা ঘাগরা শরীরের আব্রুকে উন্মুক্ত করে পায়ের কাছে নেমে যেতে তার শরীরের প্রতিটি গিরি উপত্যকা তানসেনের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। যুবতী যারপরনাই লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘাগরা নিচে থেকে তোলার সময় হঠাৎ তার সাথে তানসেনের চোখাচোখি হতে যুবতী লজ্জায় আরক্তিম হয়ে সেই স্থান থেকে ছুটে নিজের কক্ষে যেয়ে অর্গল বন্ধ করে দিল। তানসেন নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত গতিতে সে স্থান ত্যাগ করে তাঁর নিজ কক্ষের দিকে চলে গেলেন। আত্মগ্লানিতে তানসেন ভাবলেন তাঁর সম্বন্ধে যুবতী কি ধারণা পোষণ করল। ভারত বিখ্যাত সংগীত সাধকের এ কি বিকৃত রুচি। কিন্তু তিনি তো কোন অসৎ উদ্দেশ্যে সেখানে যাননি, তিনি কেবলমাত্র সঙ্গীতের উৎস খুঁজতে গিয়েছিলেন। এই প্রাসাদে তাঁর ও সরস্বতীর কন্ঠ ছাড়া কার এমন ঈশ্বর প্রদত্ত কন্ঠ আছে? কার কাছে সে এই শিক্ষা পেয়েছে? যুবতীকে কোথাও দেখেছেন কিনা তাঁর স্মরণে এলো না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যুবতীর পরিচয় জানতে হবে।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর করে শুরু হয়েছে দাদা। 👌🏻অপেক্ষায় রইলাম পরের পর্বের।

    ReplyDelete