জ্বলদর্চি

ঠাকুরবাড়ির চিত্রকলা--চর্চা/অর্ণব মিত্র

ঠাকুরবাড়ির চিত্রকলা-চর্চা :


অর্ণব মিত্র 


জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫)

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে চিত্রকলার-চর্চা শুরু হয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মাধ্যমে। তিনি ছিলেন পশ্চিমী শিল্পধারার স্বাভাবিকবাদী আঙ্গিকের প্রতিকৃতি শিল্পী।তার জন্ম ১৮৪৯ সালে। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র।তিনি পেন্সিল দিয়ে রেখাচিত্র ও শেডিঙ-এর মাধ্যমে আলোছায়া তৈরি করে দাদা রবীন্দ্রনাথ সহ ঠাকুর পরিবারের আরও কিছু সদস্যের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন।জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ছবিগুলি সবই বাঁ–দিকে ফেরানো প্রোফাইল প্রতিকৃতি। তার কাজে পেন্সিলের রেখার সূক্ষ্মতা পাওয়া যায়।তিনি প্রতিটি মুখের ভাব ও চরিত্রকে সংবেদনশীলতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি তার শেষ জীবন অবধি চিত্রকলার-চর্চা করেছেন। এঁকেছেন নামি-অনামী বহু মানুষের সতেরশো প্রতিকৃতি।তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছেন সব থেকে বেশি।    তার আঁকা ২৫ টি প্রতিকৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে ১৯১৪ সালে লন্ডন থেকে   একটি কোলোটাইপ পদ্ধতিতে মুদ্রিত সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল ।

এছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের বড় দাদা গুনেন্দ্রনা্থের দুই ছেলে গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ও মেয়ে সুনয়নি দেবী ছিলেন চিত্রশিল্পী।শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথও চিত্রকলার চর্চা করেছেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১)
ভারতের চিত্রকলায় আধুনিকতায় আত্মপরিচয় সন্ধানের প্রথম চেষ্টা করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি বিষ্ণু দে তার সমন্ধে লিখেছেন ‘অবনীন্দ্রনাথের সত্তার শিকড় এই বাংলার আদিম গভীরে’।
১৮৯০ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেইসময় ইংরেজ শিল্পশিক্ষক দ্বারা পরিচালিত ‘ক্যলকাটা স্কুল অফ আর্ট’-এ ভর্তি হন। এরপর তিনি ১৮৯২ সালে অলিন্টো গিলারডী-র কাছে ছ- মাস প্যাস্টেল ও জলরঙের প্রকরণ শেখেন ও ১৮৯৩ তে চার্লস পামারের-এর কাছ থেকে স্বাভাবিকবাদী আঙ্গিকে পশ্চিমী ধারার তেল রঙের কাজ ও লাইফ স্টাডিও অনুশীলন করেন। সেই সময় স্বাভাবিকবাদী আঙ্গিকে তার সেরা কাজ হোল ১৮৯১-৯৫ সালের মধ্যে করা প্যাস্টেলে রবীন্দ্রনাথের মুখাবয়ব চিত্র। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যের চিত্রায়ণেও স্বাভাবিকবাদী আঙ্গিকে তার দক্ষতা ও মননের পরিচয় আছে। তিনি একসময় ভারতীয় পৌরাণিক বিষয় নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি আঁকেন ‘রাধাকৃষ্ণ’ চিত্রমালা। 

এরপর তিনি ইংরেজ শিল্পী ও শিল্পশিক্ষক ই, বি, হ্যভেলের সাথে যোগ দেন তার ‘ক্যলকাটা স্কুল অফ আর্ট’-এ উপ–অধ্যক্ষের পদে। যা এখন জাদুঘরের পাশে    ‘সরকারী আর্ট কলেজ’ হিসে্বে পরিচিত। আর্ট স্কুলে হ্যভেলের সংস্পর্শে এসে তিনি মুঘল অনুছিত্রের দিকে আকৃষ্ট হন। এই ভাবে তিনি ১৯০২ সালে আঁকেন ‘সাজাহানের মৃত্যু’ ছবিটি।

১৯০২ সালে জাপানি মনীষী কাকুজো ওকাকুরা কলকাতায় আসেন। ঠাকুরবাড়ির শিল্পী সদস্যদের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। অবনীন্দ্রনাথ চিত্রকলার জাপানি পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তার নিজস্ব দেশীয় প্রকরণ পদ্ধতির সাথে জাপানি ওয়াশ পদ্ধতির সমন্বয় করেন। তার বিখ্যাত ছবি ‘ভারতমাতা’ এই সমন্বয়ের ফসল।ছবিটি তিনি এঁকেছিলেন ১৯০২ সালে।

এরপর তিনি ১৯০৭ সালে দাদা গগনেন্দ্রনাথ-এর সাথে তৈরি করেন ‘ইন্ডিয়ান সোসইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’। সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ মুঘল মিনিয়েচার বা অনুচিত্র ও জাপানি ওয়াশ পদ্ধতিকে মিশিয়ে তার ছবির যে নতুন ধরণ তৈরি করেন তা তখন ‘বেঙ্গল স্কুল’ নামে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছিল। ‘বেঙ্গল স্কুল’এর ধারায় ভারতীয় পৌরাণিক বিষয়ে তিনি বেশ কিছু ছবি আঁকেন। এছাড়া ১৯০৬ থেকে ১৯১১ অবধি তিনি যে কাজগুলি করেন তার মধ্যে ‘ওমর খৈয়াম’ চিত্রাবলী উল্লেখযোগ্য।এরপর তিনি বেশ কিছু নিসর্গদৃশ্য এঁকেছিলেন যার বিষয় ভাবনা এসেছিল মুঘল অনুচিত্র থেকে ।এরপর তিনি ১৯৩০ সালে এঁকেছিলেন ‘আরব্য রজনী’ চিত্রমালা।১৯৩০ সালের পর কয়েক বছরের বিরতির পর তিনি ১৯৩৮-১৯৩৯ সালে আবার বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন।


গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮)

গুনেন্দ্রনা্থের ঠাকুরের বড় ছেলে ও অবনীন্দ্রনাথ-এর দাদা গগনেন্দ্রনাথও ছিলেন মূলত চিত্রশিল্পী। তার জন্ম হয় ১৮৬৭ সালে। ঠিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বেঙ্গল স্কুল’-এর মত করে না হলেও এক নিজস্ব ধারায় ছবি এঁকেছেন তিনি। গগনেন্দ্রনাথ সেভাবে কারু কাছে ছবি আঁকা শেখেননি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দোতলায় দক্ষিণের বারান্দায় ছিল গগনেন্দ্রনাথ ও  অবনীন্দ্রনাথের স্টুডিও। তিনি ছবি এঁকেছেন নানা আঙ্গিকে।এঁকেছেন স্কেচ,কার্টুন,মুসউরি-দার্জিলিং-এর পাহাড়,পুরীর মন্দির ইত্যাদি। তবে তার বিশেষত্ব জলরঙে আঁকা তার কিউবিজম ধারার ছবি। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ বই হয়ে বেরল যখন তাতে ছিল গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি।গগনেন্দ্রনাথের আঁকা শুরু ব্যঙ্গচিত্র দিয়ে।রবীন্দ্রনাথ আরামকেদারায় বসে আকাশে উড়ে যাচ্ছেন।এ ছবিও এঁকেছেন গগন।তিনি প্রতিকৃতি বানিয়েছেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়,মহাত্মা গান্ধী সহ আরও অনেকের।এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর প্রচ্ছদ।     

জলরঙে তিনি বেশ কিছু কাজ করেন। গত শতাব্দীর কুড়ির দশকের প্রথম দিকে গগনেন্দ্রনাথ ‘কেউবিক’ বা পশ্চিমী জ্যামিতিক ধারায় ছবি আঁকা শুরু করেন। সেই সময় তার নিজস্ব জলরঙের মধ্যে পশ্চিমের ‘কিউবিস্ট’ ধারার কাজের প্রভাব এসে পড়ে।ছবিতে নিজস্ব বিষয়ের সাথে ত্রিভুজ,বৃত্ত,অর্ধবৃত্ত ইত্যাদি আকারগুলি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন।আলো –আঁধারি ও রহস্যময় রঙের খেলায় তার ছবি এই ধারার প্রভাবে নতুন ভাবে উপস্থাপিত হল। তার ‘কিউবিস্ট’ ধারার কাজ নিয়ে সেই সময়ের প্রাচ্য শিল্প-বিশারদ স্টেলা ক্রামরিশ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লিখেছিলেন প্রবন্ধ ‘অ্যান ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট’।  


সুনয়নী দেবী(১৮৭৫-১৯৬২) 

চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের বোন সুনয়নী দেবীও ছবি এঁকেছেন। ঠাকুরবাড়ির ভিতর মহলে বোনটি ছিলেন দাদাদের শিল্পচর্চার সাক্ষী।তবে তিনি রং-তুলি হাতে তুলে নিয়েছিলেন অনেক পরে।তিনি দাদা অবনীন্দ্রনাথ-এর ‘বেঙ্গল স্কুল’এর ধারায় পৌরাণিক বিষয়ে ছবি এঁকেছেন ও সাধারণ ঘরোয়া বিষয়েও ছবি এঁকেছেন। লোকশিল্পের সরলতাও নিয়ে এসেছিলেন কাজে। সুনয়নী দেবীর ছবিতে মূলত একাকী মেয়েদের আনাগোনা। তার ছবির চরিত্রদের চোখ-নাক-মুখে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের ধরণ। তার রঙ স্নিগ্ধ। ছবির ভাব শান্ত গোছের। সুনয়নী দেবীর আঁকা মিল্কমেডস, বিরহ, রাধাকৃষ্ণ, টু উইমেন,অর্ধনারীশ্বর-এর মতো ছবিতে দেখা যায় বাংলা ও ভারতের চিরায়ত রুপকল্পের প্রভাব।ছেলেবেলা থেকেই তার পৌরাণিক ছবির প্রতি ভালবাসা ছিল। তার ছবিতে কালীঘাট পটচিত্রের প্রভাব দেখা যায়।  তার ছবির প্রশংসা হয়েছিল ইংলিশম্যান পত্রিকায় এছাড়া তিনি লন্ডনের একটি চিত্র-প্রদর্শনীতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

তারা ধারাবাহিক ভাবে শিল্পচর্চা করেছেন ও সেই সময়কালে সফল শিল্পী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন ।ঠাকুরবাড়ির দক্ষিণের বারান্দা ছিল তাদের শিল্পচর্চার জায়গা।রবীন্দ্রনাথ এই দক্ষিণের বারান্দায় ছবিআকার স্টুডিয়োর নাম দিয়েছিলেন ‘বিচিত্রা’। 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) 

রবীন্দ্রনাথের চর্চার বিষয় সাহিত্য,সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে হলেও তার পরিবারের এই চিত্রকলা-চর্চা নিয়ে তার শুরু থেকেই আগ্রহ ছিল।স্বদেশী আন্দোলনের সময় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৯০৫ সালে গঠিত হয় ‘বঙ্গীয় কলা সংসদ’।এর নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই ।এই সংগঠনের আদর্শ ছিল সেই সময়ে বিছিন্ন ভাবে শিল্প-চর্চাকারী বাঙ্গালি শিল্পীদের একটি ছাদের তলায় একত্রিত করা।  এরপর নতুন ভাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ঠাকুরবাড়িতে ছবি আঁকার যে ধারা তৈরি হচ্ছিল (যা ‘বেঙ্গল স্কুল’ নামে পরিচিত) তাকে বাংলার বিভিন্ন শিল্পীদের মধ্যে প্রসার ঘটানোর জন্য তিনি ঠাকুরবাড়িতেই তৈরি করেছিলেন ‘বিচিত্রা’ স্টুডিও।  

এছাড়া রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে বা কলকাতা থেকে আলাদাভাবে শান্তিনিকেতন-এ ‘কলাভবন’ প্রতিষ্ঠিা করেছিলেন বিভিন্ন ধারায় চিত্রকলার চর্চার জন্য ও ছাত্রছাত্রীদের তা শেখানোর জন্য।

রবীন্দ্রনাথ ‘কলাভবন’ প্রতিষ্ঠিার সাথে সাথে নিজেও চিত্রকলার চর্চা করেছেন। তিনি লেখার সাথে সাথে লেখার খসড়ার মধ্যে কাটাকুটির মাধ্যমে কিছু আকার-আকৃতি আঁকতে শুরু করেন।এ ব্যপারে শান্তিনিকেতন থেকে একটি চিঠিতে তিনি গগনেন্দ্রনাথকে লিখছেন ‘আমার ছবির নেশা আজও কা্টলনা। তোমরা কাছে থাকলে ভরসা পেতুম, কোন রাস্তায় চলেছি সেটা বোঝাপড়া করে নিতে পারতুম’।

অশোক মিত্র তার ‘ভারতীয় চিত্রকলা’ বইতে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালের শেষ দিকে ছবি আঁকা আরম্ভ করেন ও ১৯৪০ সাল অব্ধি আঁকেন। তিনি প্রায় এগার বছর ধরে দু-হাজারের বেশি ছবি আঁকেন।তার কাজের বিষয় হিসেবে দেখা যায় বিভিন্ন প্রাণী, নিসর্গ, নাটকীয় দৃশ্য ও মুখের ছবি।

তিন চিত্রচর্চা কে গভীর ভাবে ও এক সাবলীল প্রকাশ হিসেবে দেখেছিলেন রঙ ও রেখার মধ্যে দিয়ে ।তিনি চিত্রকলায় ‘টেকনিক’ বা পদ্ধতির থেকেও বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ সমন্ধে তিনি বলেন ‘চিত্রকলায় ছবি আঁকার উপকরণ যে বিরাট অংশ গ্রহণ করে বলে আমরা কল্পনা করি, সেটা ঠিক নয়।আমি যা করি তাতে আমি আবদ্ধ নই’। 



তথ্যসূত্র 
কৃত্তিবাস পত্রিকা ‘অবনীন্দ্রনাথ’ সংখ্যা।
আনন্দবাজার পত্রিকা। 
অশোক মিত্র ‘ভারতীয় চিত্রকলা’।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 


Post a Comment

0 Comments