জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা- ৩২/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩২

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত


স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর দেহত্যাগের পর দ্বিতীয় সঙ্ঘগুরুর পদে আসীন হন স্বামী শিবানন্দজী। সঙ্ঘগুরু হওয়ার পর তিনি শ্রীরামকৃষ্ণময় হয়ে উঠেছিলেন। এই সময় তাঁর মধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ শক্তির বিকাশ হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের কুনুর পাহাড়ে একটি নির্জন বাংলোতে একবার স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য অবস্থান করেন। সেখানে বহু রাজা, রানি, পদস্থ ব্যক্তিগণ, রাজকর্মচারীদের গমনাগমন শুরু হয়, তাঁকে কেন্দ্র করে লক্ষ্য করা যায় বিশেষ উদ্দীপনা। বহু মানুষ আসতেন দীক্ষাপ্রার্থী হয়ে। তিনি কাউকেই বিমুখ করতেন না। ঠাকুরের শক্তি তাঁর ভিতর এমনভাবে কাজ করেছিল যে আগত ব্যক্তিরা দু-একটি কথা বলেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন। মহাপুরুষজীর কথা শুনে এক মুসলমান ডাক্তার সস্ত্রীক এসেছিলেন সন্তানসহ। এই ডাক্তারের স্ত্রী ছিলেন শ্রীকৃষ্ণরূপী ঠাকুরের ভক্ত। ঠাকুরকে দেখতেন গোপালভাবে। মহাপুরুষজী তাঁর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলে ভাবে কাঁদতে থাকেন। অবিরাম কান্নার পর শান্ত হন।

 বেলুড় মঠ মহাপুরুষজীর অতি প্রিয় স্থান ছিল। বেলুড় মঠের মাহাত্ম্য বিষয়ে বলতেন, “বেলুড় মঠ কি কম স্থান গা! স্বয়ং শিবাবতার স্বামীজী এখানে বাস করতেন -- এখানেই তিনি সমাধিযোগে দেহত্যাগ করেন। কিন্তু এখনো তিনি সূক্ষ্মদেহে এ মঠে রয়েছেন। তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। আমি তো তাঁর ঘরের পাশ দিয়ে যেতে কখনো কখনো দেখি তিনি ঘরে রয়েছেন। এ স্থানটি তাঁর খুব প্রিয় ছিল। ঠাকুর বলেছিলেন স্বামীজীকে, ‘তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি আমি সেখানেই (দীর্ঘকাল) থাকব।’ তাই তো স্বামীজী নীলাম্বরবাবুর বাড়ি থেকে আত্মারামের কৌটাটি নিজে কাঁধে করে এনে এ মঠে স্থাপন করেছিলেন। তখন থেকে ঠাকুরকে কেন্দ্র করে এ মঠে কত ধ্যান-জপ, সাধন-ভজন, ত্যাগ-তপস্যা, শাস্ত্রাদি পাঠ-আলোচনা ও ভজন-কীর্তন হয়েছে -- এখনো হচ্ছে। এ বেলুড় মঠ সমগ্র সঙ্ঘের মাথা। এখানে ঠাকুরের সেবাপূজাদি ঠিক ঠিক হলে, বেলুড় মঠটি ভালভাবে চললে -- সমগ্র সঙ্ঘই ঠিক চলবে। তাই তো ঠাকুরের সেবায় এতটুকু ত্রুটি হলেও তোমাদের এত বকি, এত শাসন করি। এ মঠ কি কম স্থান গা! -- এ যুগের মহাতীর্থ।”

 বেলুড় বিষয়ে আরও বলছেন, “শ্রীশ্রীমা-ই তো প্রথম নিজের হাতে ঠাকুরকে পূজা করে এখানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্বামীজী এ মঠের জমি কেনার আগে শ্রীশ্রীমা একবার ঘুসুড়ি থেকে নৌকায় মাঝগঙ্গা দিয়ে দক্ষিণেশ্বর যাবার সময় দেখেন যে, ঠাকুর আদুর গায়ে ঐ জমিতে বেড়াচ্ছেন। তখন ঐ জমির একপাশে কয়েকটি কলাগাছ ছিল। ঠাকুরকে ঐভাবে ওখানে বেড়াতে দেখে মা অবাক হয়ে ভাবছিলেন -- তাই তো ঠাকুর এখানে কেন এলেন! তিনি ও কথা তখন কাউকে বলেননি, পরে স্বামীজী ঐ জমিটি মঠের জন্য কেনার পর মা যোগীন-মা প্রভৃতি স্ত্রীভক্তদের কাছে তাঁর ঐ দর্শনের কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন -- ‘ঠাকুরের ইচ্ছাতেই ঐ জমিটি হলো। তিনিই মঠের জন্য ঐ স্থানটি নির্বাচন করেছিলেন ইত্যাদি’।” 

 মহাপুরুষজীর মধ্যে ছিল অদ্ভুত সরলতা, নিরাভিমান ভাব। এই বিষয়ে স্বামী নিখিলানন্দ উল্লিখিত একটি ঘটনা এইরকম -- “১৯২৬ সালে মঠে প্রথম সন্ন্যাসি-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূজ্যপাদ মহাপুরুষ মহারাজের সভাপতির ভাষণ ইংরেজি ভাষায় লিখবার জন্য আমাকে মঠে আহ্বান করা হয়। আমি তাঁর উপদেশ, নির্দেশ ও আশীর্বাদ নিয়ে ভাষণটি রচনা করে প্রথমে স্বামী সারদানন্দকে পাঠ করে শুনিয়েছিলুম। তিনি সামান্য দু-একটি পরিবর্তনের উল্লেখ করে বলেছিলেন ভাষণটি একটু দীর্ঘ হয়েছে। তবে এ দেশের শ্রোর্তৃবর্গের কাছে অবশ্য চলবে। একবার মহাপুরুষ মহারাজকে শুনিয়ে নিও। মহাপুরুষ মহারাজ ভাষণটি শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন এবং তাঁর অনুমোদনও জানিয়েছিলেন। আমারও মনে হয়েছিল তাঁরই আশীর্বাদে আমি ঐ ভাষণে তাঁর ভাব প্রকাশ করতে পেরেছিলুম।

 স্থির হয়েছিল যে, বোস্টন কেন্দ্রের স্বামী পরমানন্দ ভাষণটি সম্মেলনে পাঠ করবেন। সম্মেলনে মহাপুরুষ মহারাজ এবং স্বামী সারদানন্দ মঞ্চের উপর উপবিষ্ট ছিলেন। অনেক সাধু এবং কলকাতার বহু বিশিষ্ট ভক্ত নাগরিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন।
 স্বামী পরমানন্দ যখন ভাষণটি পাঠ করছিলেন তখন মহাপুরুষ মহারাজ মধ্যে মধ্যে বলছিলেন -- ‘ছোকরা বেশ লিখেছে।’ সম্মেলনের শেষে অনেকে মহাপুরুষ মহারাজকে ভাষণটির অনবদ্যতার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি সহাস্যে বলেছিলেন, ‘ভাষণ লিখেছে দীনেশ, পড়ল বসন্ত। এর মধ্যে আমি এলাম কোথা থেকে হে’?”
 সাধুজীবন বিষয়ে শিবানন্দজী মহামূল্যবান কিছু কথা বলেছিলেন সঙ্ঘের এক সন্ন্যাসী স্বামী দেবানন্দজীকে। দেবানন্দজী স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর দীক্ষিত সন্তান ছিলেন। মহাপুরুষ বলেছিলেন --“...ধ্যানজপ না বাড়িয়ে শুধু কঠোরতা করে শরীরকে কষ্ট দেওয়া আমাদের ঠাকুর পছন্দ করতেন না। ওটা শুধু লোক-দেখানো ধর্মেই দাঁড়িয়ে যায়। অবশ্য যাঁরা যথার্থ ত্যাগী ও আত্মারাম সন্ন্যাসী তাঁদের সম্বন্ধে বলার কিছুই নেই। আর বিশেষত বাঙালি শরীরে এত কঠোরতা সইবে না, কয়দিন পরেই অসুস্থ হয়ে পড়বে, ধ্যানজপ করতেই পারবে না। তাই যার যতটা সয় ততটাই করা উচিত। তবে শুধু শরীর শরীর করাও ভাল নয়। চাই শুধু জ্ঞান ভক্তি বিশ্বাস বিবেক বৈরাগ্য আন্তরিকতা ব্যাকুলতা। ভগবানের উপর অনুরাগ না এলে কিছুই হবে না, জেনো’।” ( শিবানন্দ স্মৃতিসংগ্রহ -- স্বামী অপূর্বানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় )
 বয়সে বড় ও দীর্ঘকাল সন্ন্যাসজীবনে অভ্যস্ত থাকার কারণে শিবানন্দজী গুরুভ্রাতাদের কাছে পৃথক সম্মান ও আদর লাভ করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের মানবলীলা সংবরণের বছরেই ( ১৮৮৬ সাল ) ডিসেম্বর মাসে ঘটে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। গুরুভ্রাতারা প্রায় সকলে একসঙ্গে উপস্থিত হন বাবুরাম মহারাজের পৈতৃক ভিটে ও জন্মস্থান হুগলি জেলার আঁটপুরে। সেখানে বড়দিনের রাতে ধুনি জ্বেলে অগ্নি সাক্ষী রেখে সন্ন্যাসের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন তাঁরা। মধ্যমণি ছিলেন অবশ্যই নরেন্দ্রনাথ। পরবর্তী সময়ে যথাকালে শ্রীশ্রীঠাকুরের পাদুকাসম্মুখে বিরজাহোম অনুষ্ঠানাদি সমাপন করে তারকনাথ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন ও শিবানন্দ নামটি প্রাপ্ত হন। 

শিবানন্দজী দীর্ঘায়ু ছিলেন। আশি বছর বয়স পর্যন্ত ইহজগতে ছিলেন। ১৮৫৪ থেকে ১৯৩৪ সাল -- এই ছিল তাঁর জীবৎকাল। শেষ বারো বছর অর্থাৎ ১৯২২ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সঙ্ঘনায়ক। এই এক যুগ সময় ছিল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ। নিজেকে ঠাকুরের নেহাত এক অযোগ্য যন্ত্র বলে মনে করতেন। ১৯৩৩ সালের ২৫ এপ্রিল দারুণ পক্ষাঘাতে তাঁর বাকশক্তি রুদ্ধ হয় ও শরীরের দক্ষিণ অংশের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে প্রায় এক বছর সময় কাটে। অবশেষে এসে পড়ে শেষের সেইদিন। ১৯৩৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। তার দু'দিন আগে অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি  মহাসমারোহে পালিত হয়েছে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মতিথি। ২০ তারিখ বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তাঁর মুখমণ্ডল অদ্ভুত জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সারা অঙ্গে দেখি দিল পুলক। মস্তক ও অঙ্গের কেশরাশি কদম্বপুষ্পের কেশরসদৃশ দণ্ডায়মান হল। এমন আনন্দপুলকের ভিতরই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, মিলিত হলেন হৃদয়েশ্বর শ্রীরামকৃষ্ণের পাদপদ্মে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments