জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৩৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩৫

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বাদশ সঙ্ঘগুরু স্বামী ভূতেশানন্দজী পূজ্যপাদ শরৎ মহারাজ বিষয়ে জানাচ্ছেন -- “তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আমি আগেই বলেছি, কখনো বিচার করে দেখিনি। এখনো করি না। ব্যক্তিত্ব বুঝি না, আসতুম যখন দেখতুম -- বেশিরভাগ ঐ ছোট বসবার ঘরটিতে বসে থাকতেন -- দরজার কাছে; আমরা এসে বসতুম -- ছোট তখন। প্রণাম করে বসে আছি, কথা হচ্ছে, সব কথা যে মন দিয়ে শুনছি, বুঝছি তা নয়। কখনো কখনো সেইখানে নিজেদের খেয়ালে চোখ বুজে ধ্যান করতে লেগে গেলুম। আবার তিনি বলতেন -- ‘যা না, ধ্যান করতে হয় তো, ঠাকুরঘরে যা।’ ঠাকুরঘরে ধ্যান করা যেমন, তাঁর ঘরে বসে ধ্যান করার আকর্ষণ যে তার চেয়ে কম জিনিস নয়, সে কথা বলার ধৃষ্টতা হয় নি। সেখানে বসে দেখেছি, কলকাতার নানা লোক আসতেন -- তাঁদের নানা রকমের অশান্তির বোঝা নিয়ে আসতেন এবং সব বোঝা তাঁর পায়ে নিবেদন করতেন। আমরা তখন ছোট -- সংসারের এত দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে কিছুমাত্র পরিচয় নেই। মনে হতো যে, এঁরা কেন সাংসারিক কথা এত করে বলেন, আর মহারাজও নির্বিকার চিত্তে শোনেন। ভাল লাগতো না। কখনো কখনো ভিতরে অভিমান হতো, আমরা কি এসব কথা শোনবার জন্য এসেছি। তিনি যে কেবল দু- চারটি ছেলেকে আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে দেবার জন্য মাত্র বসে নেই, তিনি বসে আছেন যারা তাপিত, যারা এই সংসারে দুঃখকষ্টে নানারকম যন্ত্রণা ভোগ করছে, তাদের সকলের সেই যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য -- এ কথা বোঝার সামর্থ্য ছিল না। তাই ভাল লাগতো না। আমাদের যে ভালো লাগতো না, তা তিনি বুঝতেন না তা নয়, তাই আমাদের জন্য আবার দয়া করে একটু কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বলতেন, ‘এই ডাক্তার এসো না এদিকে।’ ডাক্তার মানে স্বামী পূর্ণানন্দ -- প্রাচীন সাধু, তাঁকে হয়তো আপনারা অনেকেই দেখেননি। তিনি সদর দরজা দিয়ে ঢুকে অপর প্রান্তে যে ছোট্ট ঘরটি পাওয়া যায় -- যেখানে এখন নানা জিনিসের গুদাম মতো, অনেক সময় আমরা যেখানে জুতোটুতো রেখে উপরে যাই -- সেই ঘরটিতে তিনি থাকতেন, বড় একটা ঘরের বাইরে আসতেন না -- জপধ্যান নিয়ে থাকতেন বেশিরভাগ সময়। মহারাজ তাঁকে বলতেন, ‘এসো না এদিকে।’ তিনি বুঝতেন কেন তাঁর ডাক পড়েছে। এসে সৎ প্রসঙ্গ কিছু তুলতেন। তখন অন্তত সেই সময়ের জন্য একটু কথার মোড় ফিরতো। আমরা বুঝতে পারি, সেটা আমাদের জন্য -- আমাদের মতো যারা সংসারে অনভিজ্ঞ এবং তাঁর কাছে এসেছে অন্য জিনিস আকাঙ্ক্ষা করে, তাদের জন্য এইভাবে কথার মোড় ফেরাতেন। কিন্তু এখন অনেক দিন পরে, সংসার সম্বন্ধে সাক্ষাৎ না হলেও পরোক্ষ অভিজ্ঞতা কিছু হওয়াতে, বুঝতে পারছি, কত বড় একটা প্রয়োজন তিনি সকলের মেটাতেন -- ঐভাবে ওখানে স্থির হয়ে বসে থেকে। নিজে কথা যে বেশি বলতেন তা নয়। কিন্তু যাঁরা এসে তাঁর কাছে নিজেদের দুঃখ নিবেদন করতেন, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে দুঃখের বোঝার ভার যে লাঘব হচ্ছে তা বুঝতে পারতেন। ফেরবার সময় -- যে মানুষটি এসেছিলেন, সে মানুষটি আর ফিরতেন না -- ভিতরে শান্তি নিয়ে ফিরে যেতেন।” ( স্বামী সারদানন্দের স্মৃতিকথা, স্বামী চেতনানন্দ সংকলিত, উদ্বোধন কার্যালয় ) একটি অনুপম অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা বলেছেন পূজনীয় ভূতেশানন্দজী। বাগবাজারে মায়ের বাড়িতে সারদানন্দজী সমীপে উপস্থিত হতেন তিনি প্রায়ই। সেইসময়ের কথাই বলেছেন। 


 শ্রীশ্রীমা সারদামণি দেবীর প্রধান সেবকরূপে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে মর্যাদা পেয়ে থাকেন স্বামী সারদানন্দজী। বস্তুতপক্ষে ঠাকুরের আরেক সন্ন্যাসী সন্তান পূজনীয় স্বামী যোগানন্দজী শ্রীশ্রীমার সেবায় ছিলেন পথিকৃৎ। তাঁর দেহ স্বামীজীর পূর্বেই চলে যায়। এরপর সারদানন্দজীই মায়ের সেবার ভার নিজ স্কন্ধে তুলে নেন। এই বিষয়ে স্বামী ঈশানানন্দজী তাঁর ‘মাতৃসান্নিধ্যে’ গ্রন্থে চমৎকার বর্ণনা দিচ্ছেন এইরকম -- “পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাকে দর্শন করিবার কয়েক দিন পূর্বেই তাঁহার প্রধান সেবক পরমপূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজীকে ( শরৎ মহারাজকে ) প্রথম দর্শন করিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল -- কোয়ালপাড়ায় ১৩১৬ সালের ( ১৯০৯ খ্রীঃ ) বৈশাখের এক বৈকালে। তিনি তখন কলকাতায় শ্রীশ্রীমায়ের জন্য একটি নূতন বাড়ি ( উদ্বোধন কার্যালয়, ১২/১৩ গোপালচন্দ্র নিয়োগী লেন, বর্তমানে ১ উদ্বোধন লেন, বাগবাজার ) নির্মাণ করাইয়া শ্রীশ্রীমাকে তথায় লইয়া যাইবার জন্য জয়রামবাটীতে আসিয়াছিলেন এবং শ্রীশ্রীমায়ের বিশেষ ইচ্ছায় তাঁহার ভাইদের বৈষয়িক ব্যাপারে মধ্যস্থ থাকিয়া জয়রামবাটীতে তাঁহাদের সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করিয়া দিতেছিলেন।

 সেই সময় কোয়ালপাড়ায় আমাদের দূরসম্পর্কে আত্মীয় বৈষ্ণবভক্ত ক্ষেত্রনাথবাবু তাঁহার ঠাকুরবাড়িতে মহাসমারোহে নবরাত্রি নামসংকীর্তন করাইলেন। এই উপলক্ষে কোয়ালপাড়া আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা কেদারবাবু ( পরে স্বামী কেশবানন্দ ) ও আমার পিতামহ অন্যান্য কয়েকজন বিশিষ্ট ভক্তের বিশেষ ইচ্ছায় ও পরামর্শে শরৎ মহারাজ নিমন্ত্রিত হইয়া জয়রামবাটী হইতে কোয়ালপাড়ায় আসেন।

 ঐদিন বৈকালে আমার পিতৃদেবের সহিত তিনি আমাদের বাড়ি আসিয়াছিলেন। আমার তখন বয়স ১১ বৎসর হইবে, স্কুলে পড়ি। শরৎ মহারাজকে দেখিলাম একজন স্থূলকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গম্ভীর প্রকৃতির সাধুরূপে। পিতৃদেবের নিকট শুনিলাম তিনি বিলাত ও আমেরিকা গিয়া হিন্দুধর্ম প্রচার করিয়া আসিয়াছেন, বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক এবং শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহধর্মিণী শ্রীশ্রীসারদাদেবীর প্রধান সেবক। আরও শুনিলাম, মাসখানেকের মধ্যেই তিনি শ্রীশ্রীমাকে কলকাতায় লইয়া যাইবেন এবং সেই সময় সুবিধা হইলে পথে কোয়ালপাড়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিবেন।

 আমার মাতা তাঁহাকে একটি রেকাবিতে সামান্য মুড়ি ও ছোলাপাটালি জল খাইতে দিলেন। পূর্বোক্ত নবরাত্রি বাসরে তিন দিন উপস্থিত থাকিয়া স্বামী সারদানন্দজী ধর্মপিপাসু ভক্তদের সহিত ধর্মপ্রসঙ্গ করিয়া জয়রামবাটী ফিরিয়া গেলেন। 

 কোয়ালপাড়ার কয়েকজন ধর্মপ্রাণ যুবক ও বৃদ্ধ ভক্ত সাগ্রহে সেই দিনটির প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। ১৩১৬ সালের ( ১৯০৯ খ্রীঃ ) জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম দিকে একদিন পিতৃদেবের মুখে শুনিলাম, বৈকাল ৪ টা নাগাদ শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী ও স্বামী সারদানন্দ, যোগেন-মা, গোলাপ-মা প্রভৃতিকে সঙ্গে লইয়া কলকাতার পথে কোয়ালপাড়ায় পৌঁছিবেন; আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ দত্ত মহাশয়ের বাড়ির ঠাকুরঘরে শ্রীশ্রীমায়ের এবং বড় রাস্তার পাশে আমাদের স্কুলে আর সকলের বিশ্রামের ব্যবস্থা হইয়াছে। বৈকালে আসিবেন বলিয়া ভক্তেরা তাঁহাদের জন্য সামান্য জলযোগের উপযোগী কিছু মিঠাই ও নারিকেল-সন্দেশের আয়োজন করিয়াছিলেন। কিন্তু ক্রমশ সন্ধ্যা হইয়া আসিল, তথাপি তাঁহারা আসিয়া পৌঁছিলেন না।”
 কেন পৌঁছতে বিলম্ব হচ্ছিল এবং পৌঁছনোর পর কী হয়েছিল সেইসব আকর্ষণীয় প্রসঙ্গ পরবর্তী পর্বে আলোচিত হবে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments