জ্বলদর্চি

শেখর বসু /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল— ৫

শেখর বসু 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা


প্রায় ছ-দশকেরও বেশি সময় ধরে সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন শেখর বসু (জন্ম-১৯৪০)। তাঁর ছোটোবেলায় বাড়িতে সাহিত্যের আবহ ছিল। ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘মডার্ন রিভিউ’ ইত্যাদি পত্রপত্রিকা নিয়মিত বাড়িতে আসত। ছোটোবেলা থেকেই সিরিয়াস পাঠক ছিলেন। হাতের কাছে যে বই পেতেন, তাই পড়ে ফেলতেন। ‘আরব্য রজনী’ তাঁর কিশোর-মনে মস্ত একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করে দিয়েছিল। সেই কল্প-জগতের প্রভাব থেকে গিয়েছে তাঁর সাহিত্য জীবনে।  

স্কুল জীবনে গল্পলেখা শুরু করলেও নিয়মিত সাহিত্যচর্চা শুরু করেন সিটি কলেজে পড়ার সময়ে— ষাটের বছরগুলিতে। সাহিত্যিক রমানাথ রায়ও তখন সিটি কলেজের ছাত্র। ১৯৬৬ সালে রমানাথ রায়, আশিস ঘোষ, কল্যাণ সেন, সুব্রত সেনগুপ্ত এবং শেখর বসু— এই পাঁচজন মিলে ‘এই দশক’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে শুরু করেন শাস্ত্রবিরোধী ছোটোগল্প আন্দোলন। পরে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন গল্পকার বলরাম বসাক, অমল চন্দ এবং সুনীল জানা। বছর দশেক ধরে চলছিল এই আন্দোলন। বাংলা ছোটোগল্পে একটা নতুন ধারা, নতুন হাওয়া এনেছিলেন শেখর বসুরা। 

১৯৬৫ সালে শেখর বসু সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন আনন্দবাজারে। তাঁর প্রথম গল্পের বই ‘দশটি গল্প’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে। ছোটোগল্প তাঁর কাছে ‘বৃহত্তর সত্যের জগৎ’। গল্পের ভিতর দিয়ে জীবনের বৃহত্তর এক সত্যকে ধরতে চান। তাঁর গল্পগুলি শুরু হয় অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাবে। অতি সামান্য কোনও অনুষঙ্গের সূত্রে। কিন্তু গল্পের শেষে এসে আমরা ছুঁতে পারি অসামান্য এক জীবন-সত্যকে।  

আজন্ম কলকাতায় কাটানো শেখরের লেখায় কলকাতা একটা সর্বশক্তিমান চরিত্র হয়ে উঠেছে। তাঁর একটি প্রবন্ধ গ্রন্থের নাম ‘সেদিনের কলকাতা’। পুরনো কলকাতার নিপুণ দৃশ্যকল্প এই গ্রন্থ। আর আজকের কলকাতা নিয়ে কোনও আলোচনা গ্রন্থ নয়, তাকে তুলে ধরেছেন তাঁর গল্পে। যেমন তাঁর ‘কুখ্যাত মানুষের স্মরণসভা’ (‘সানন্দা’, পুষ্পাঞ্জলি, ১৯৯৮)। কলকাতারই গল্প। নাগরিক যাপনের গল্প। 

গল্পের নামকরণ থেকে পরিষ্কার গল্পের বিষয় ; কোন্‌ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিন্যস্ত হয়েছে এই গল্প। গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে একটি স্মরণ সভা। হ্যাঁ, একজন কুখ্যাত মানুষের স্মরণসভা। খারাপ মানুষের স্মরণসভা। একটি কোম্পানির মালিক ছিলেন শান্তিময় ঘোষ। হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন। তাঁর স্মরণসভার ব্যবস্থা করেছেন তাঁর মেয়ে মিস ববিতা ঘোষ (ম্যাডাম), বর্তমান কোম্পানির কর্ণধার। তিনি কোম্পানির নাম্বার টু কিরণ চক্রবর্তী বা কেসি-র উপরে সমস্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। খুব পরিশ্রম করে মুনশিয়ানার সঙ্গে সমস্ত আয়োজন করেছেন কেসি। তিনি সহযোগী হিসেবে নিয়েছেন সুপর্ণকে। সুপর্ণর কাছে নিজের কাজের মুগ্ধ প্রশংসা করে চলেছেন। কীভাবে একটা অস্পষ্ট ছবি থেকে বড়ো আর্টিস্টকে দিয়ে লে-আউট করিয়ে বিরাট আকারে ফটো করেছেন ইত্যাদির নিপুণ বিবরণ। তিনিই আবার সুপর্ণকে বলেন ম্যাডামের বাবার ছবির দিকে একটু তাকিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় “লোকটা এক নম্বরের হারামি।”  

নিমন্ত্রিতদের তালিকায় ম্যাডামের জনা-তিনেক পিতৃবন্ধুকেও রেখেছেন কেসি। তিনজন বুড়োই একই কথা বলেছেন কেসিকে। অনর্গল শান্তিময়ের নিন্দে করেছিলেন। এরকম লোক যত কম জন্মায় ততই পৃথিবীর মঙ্গল। শান্তিময়ের সবরকম দোষই ছিল। লোকটা লম্পট-জুয়াড়ি-মাতাল। নীতির বালাই ছিল না। লোক-ঠকানো, জাল-জোচ্চুরি সব করেছে। কিন্তু তিনজনেই ম্যাডামের ঢালাও প্রশংসা করেছেন। স্মরণ সভায় এসে তিনজনই মৃত শান্তিময়ের সম্পর্কে ভালো কথাই বললেন। কেসি এবার ম্যাডামকে বলতে অনুরোধ করেন। হঠাৎ এরকম আহ্বানে বিব্রত হলেও মাইকের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বাবাকে নিয়ে বলতে শুরু করলেন। 

বাবার স্বভাব চরিত্রে ডিসিপ্লিন ছিল না। কাজকর্ম ভালো ছিল না। বাবার কাণ্ডকারখানা তাঁরও ভালো লাগত না। মায়ের মৃত্যুর পরে প্রতি রাতেই বাড়ি ফিরে শান্তিময় মেয়েকে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ভালো থাকতে বলতেন। “আমার মনে হয়, বাবার বেশ কিছু চাপা দুঃখ ছিল। সেইসব দুঃখের কথা বাবা কখনও আমাকে বলেনি। তবে মনে হত, আমাকে আদর করলে বাবার ওইসব দুঃখ কিছুটা কমত। আবার বাবার আদর খেলে আর ওইসব কথা শুনলে আমার নিজের দুঃখও কমে যেত একদম। শুধু কমাই নয়, মনে তখন খুব জোর পেতাম। মনে হত, রোজ আমার শক্তি একটু-একটু করে বেড়েই চলেছে। মনের জোর ওভাবে না বাড়লে, আজ যেটুকু যা করেছি, তা হয়তো করতে পারতাম না। বাবার কাছে মেয়ের ঋণ স্বীকারের কোনও মানে হয় না। কিন্তু আপনারা কিছু বলতে বললেন তো, তাই—। বলতে গিয়ে হয়তো আমার একেবারেই নিজস্ব কিছু কথা বলে ফেললাম। নমস্কার।”

মিষ্টিমুখ করে একে একে সকলে চলে যান। কেসি সিগারেট ধরান। পাশে সুপর্ণ। হঠাৎ কেমন যেন চমকে ওঠে সুপর্ণ। ফোটোর দিকে তাকিয়ে বলে, “এখন কিন্তু মানুষটাকে আগের মতো খারাপ লাগছে না।” কেসিও বললেন, “আরে! ঠিকই তো। এখন তো লোকটাকে আর বাজে লোক বলে মনে হচ্ছে না। কী করে হল এটা ? মনে হয়, রোদের তেজ বাড়ার ফলে হয়েছে। রোদ বাড়লে অনেক সময় অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি হয় না ? এখন নির্ঘাত ভুল দেখছি আমরা—।” সুপর্ণ এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানায়। কেসিও তর্ক করতে পারেন না। তাঁর মুখ দিয়ে কোনও কথাই বের হয় না। হঠাৎ মনে হল, “ছবির মানুষটি কেমন যেন ক্ষমার চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে আছেন।”    

এখন শুধু সুপর্ণ বা কেসির নয়, পাঠকেরও লোকটাকে ‘হারামি’, ‘কুখ্যাত’ মনে হয় না। আপাত ভাবে বাহ্যিক কাজকর্মের বিচারবিবেচনা করে কোনও মানুষকে চেনা যায় না। তার চরিত্রকে উপলব্ধি করা যায় না। দ্যাখার চোখটাই আসল। ঠিক মতো দেখলে তার অন্য একটা রূপ প্রতিভাত হয়। সেটাই সত্য। বৃহত্তর সত্য। ববিতা ঘোষও মৃত্যুর পরে বাবাকে নতুন করে উপলব্ধি করলেন।                   

শেখর বসু প্রচুর রহস্য গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। একটা রহস্যময়তা তাঁর অধিকাংশ গল্পের মধ্যে রয়েছে। সেই রহস্যময়তাই পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়।     

‘গাছ-মানুষ’ (‘শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকা’, ১৯৮৬) পরিবেশ-চেতনার গল্প। এতদিন নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করেছে মানুষ। বৃক্ষ-নিধন করেছে। মানুষ একবারও ভাবেনি পরিবেশও প্রতিশোধ নিতে পারে। এই গল্প এক বিপরীত প্রতিশোধের গল্প। গল্পের প্রতাপ একজন শৌখিন মৎস-শিকারি। ছুটিরদিনে ছিপ-বঁড়শি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এক অফিস কলিগের কাছ থেকে খবর পেয়ে চলে এসেছে সে কলকাতা থেকে দূরের একটা নির্জন দিঘিতে। তিনটে বাস বদলে আসার পর রিক্সা। তারপরও কিছুটা পায়ে হেঁটে আসতে হয়। এতো ঝঞ্ঝাট করে আসার পরেও জায়গাটা দেখে বড়ো ভালো লেগে যায় তার। দিঘির চারপাশে একই রকমের সবুজ গাছ। সারাদিন ফাতনা লক্ষ্য করে বসে থেকেও মাছ ধরতে পারে না সে। তার মনে হয় মাছ শিকারিকে দেখতে পাচ্ছে জলের ভিতর থেকে। তাই টোপ গিলছে না। 

হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে দ্রুত পোশাক খুলে গাছ থেকে ডালপালা নিয়ে গায়ে দিল। কচি ডাল ভেঙে কোমরের বেল্টে ঘাগরার মতো ঝুলিয়ে নিল। গাছের লতাপাতা ছিঁড়ে প্রতাপ মাথার টুপি আর জামা বানিয়ে নিল। গাছের মধ্যে একটা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সে। আর কী আশ্চর্য, তারপর ঝোড়ো হাওয়া দিতে শুরু করল। গাছগুলোও যেন ফিসফিসিয়ে কিছু বলতে শুরু করল। নড়ে উঠল ফাতনা। একটা কেজি চারেকের রুই মাছ উঠল ছিপে। কিন্তু মাছের চোখে যেন অবাক বিস্ময়।

এই গাছ সেজে মাছ ধরার গল্প সে কাউকে বলে না। নিজেও বিশ্বাস করতে পারে না ঠিক। ঘটনাটিকে কাকতালীয় মনে হয় তার। পরের রবিবার আবারও চলে আসে এখানে। তরুণ রিকশাওয়ালা কথা প্রসঙ্গে জানায় জায়গাটা ভালো নয়। কেউ এই পুকুরে মাছ ধরতে আসে না। প্রতাপ রিকশাওয়ালার কথাকে গুরুত্ব দেয় না। সারাদিন বসে থেকেও মাছ ধরতে পারে না। বিকেল গড়িয়ে যায়। হঠাৎ আগেরদিনের মতো গাছ সেজে ফ্যালে। আর সঙ্গে সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া দিতে শুরু করে। ফাতনাও নড়ে ওঠে। কেজি তিনেক একটা মাছ উঠে আসে ছিপে। সেই মাছেরও উদ্ভুত একটা দৃষ্টি। চোখে যেন সন্দেহের ছায়া। 

তৃতীয় রবিবারও সে মাছ ধরতে আসে। তার মনে হয়েছিল গাছ সাজার জন্য মাছ আসেনি। বিকেলে নির্দিষ্ট সময় মেনে এমনিই ধরা দেয় মাছ। এই ভাবনাটকে সত্যি কিনা বোঝার জন্য সে সকালেই গাছ সেজে ফ্যালে। আর কী আশ্চর্য তখনই ফিসফিসিয়ে গাছেরা কথা বলতে শুরু করে। ছিপে মাছ উঠল। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরে দৌড়ে গিয়ে মাছ তুলল। মাছের চোখে একই রকম বিস্ময় ঘোর। 

এরপর প্রতাপ আর অপেক্ষা করতে পারল না রবিবার পর্যন্ত। ছুটি নিয়েই বুধবার চলে এল দিঘিতে। তারপর থেকে সপ্তাহে অন্তত চারদিন চলে আসে এখানে। এখানকার নির্জন পরিবেশে বড়ো আরাম পায় সে। চোখ বুজে গাছের পাতায় হাত রাখলে শান্তি লাগে তার। এখন মাছ ধরে ঠিকই। কিন্তু সেই মাছ বাড়ি নিয়ে আসে না। ধরার পরেই আবার ছেড়ে দেয় দিঘিতে।  

এর মধ্যে গাছপালার সঙ্গে তার একটা গোপন আত্মীয়তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এতদিন তার চারপাশের গাছপালা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন সব নজরে পড়ছে তার। অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছেদের গায়ে হাত দেয়। বন্ধুরা কেন জানি না এড়িয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার দেখাতে বলছে। আর তার তত মনে পড়ছে দিঘির পাড়ের গাছগুলির কথা। তার মনে হয়— পৃথিবীতে দু-রকমের মানুষ আছে। যারা গাছ ভালোবাসে। আর যারা গাছেদের শত্রু।  

একদিন একটা বড়ো কালো মেঘ এসে ঢেকে ফ্যালে সূর্যকে। ফাতনা নড়ে ওঠার পরেও সে দৌড়ে যেতে পারে না ছিপের কাছে। একচুলও নড়তে পারে না। “পা দুটো যেন মাটির নীচে গেঁথে গেছে। পায়ের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল ও—পা কোথায়, এ তো গাছের গুঁড়ি। আতঙ্কের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেল যখন ও নিজের গায়ের দিকে তাকাল। শরীর, হাত পায়ের কোনও চিহ্ন নেই কোথাও ; তার বদলে শুধুই গাছ, ডালপালাপাতা সমেত আস্ত একটা গাছ। ওর চোখের সামনে মাছের টানে ছিপটা একটু-একটু করে জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল, কিন্তু ও বুঝে গেছে ওর আর কিচ্ছু করার নেই। শুধু আজ বলে নয়, কোনওদিনই নয়। ছিল মানুষ, হয়ে গেছে গাছ। কাণ্ড, গুঁড়ি আর গাঢ় সবুজ পাতাসমেত আসত একটা গাছ। এখন শুধু নিশ্চিন্তে গাছের ধর্ম মেনে একটু-একটু করে ডালপালা ছড়িয়ে আরও অনেকখানি বেড়ে ওঠা। মাথার ওপরে খোলা আকাশ, আশেপাশে অসংখ্য গাছ, সামনে কাঁচের মতো জলের দিঘি। কোনও প্রতিযোগিতা নেই, হতাশা নেই— মনের আনন্দে শুধু গাছ হয়ে থাকা।” 
এরপর গাছের ভাষা জেনে গেল সে। ঠিক পাশের গাছটার কাছ থেকে সে জানতে পারল, দিঘির এই সার বেঁধে দাঁড়ানো গাছগুলো গাছ হয়ে জন্মায়নি। একদা তারা মানুষ ছিল। তাদেরও শখ ছিল মাছ ধরার। তারপর এখানে মাছ ধরতে এসে ধীরে ধীরে গাছ হয়ে গেছে। খবরটা শোনার পরে প্রতাপ অবাক হল না। মনে হল এটাই স্বাভাবিক। সে জানে গাছেরও তো প্রাণ আছে। “ওরা তো রুখে দাঁড়াবেই। এই তো নিয়ম। অত্যাচারিত একদিন ঠিক অত্যাচারির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়। অথচ শহরের নিষ্ঠুর লোকগুলো জানতেও পারছে না সুদূর গ্রামের প্রান্তে গাছেদের বিদ্রোহ কীভাবে দানা বাঁধে উঠছে। ওরা গাছ কাটছে শহরে আর এরা এখানে মানুষকে ধরে ধরে গাছ বানাচ্ছে। প্রকৃতি শূন্যস্থান পূরণ করছে কী অদ্ভুত উপায়ে। মনের খুশিতে নিজের গাছ-শরীরের ডালপালা হাওয়ায় মেলে দিল প্রতাপ।” 

প্রকৃতির উপর অত্যাচার করলে প্রকৃতিও একদিন তার প্রতিশোধ নেবে। ক্ষুদ্ধ হয়ে গিয়েছে প্রকৃতি। প্রকৃতির প্রতিশোধের পালাও শুরু হয়ে গেছে এবার। এভাবেই লেখক আমাদের প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন করেছেন। সাবধান করেছেন।                   

দীর্ঘদিন ধরে লিখতে গিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গল্পের বিষয় এবং আঙ্গিকে বদল এসেছে। কিন্তু তাঁর সাহিত্যের স্বভাবধর্ম বদলায়নি। প্রথমদিকে চরিত্রের নামকরণকে গুরুত্ব দিতেন না। যতি চিহ্নকেও গুরুত্ব দিতেন না। পরে অবশ্য সেখান থেকে সরে এসেছেন। অন্যরকমভাবে লিখতে চেয়েছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর একটা উপন্যাসের নাম ‘অন্যরকম’।  

‘ক্যাকটাস’ (‘লেখা-জোকা’, শারদীয়া ১৪২৮) গল্পে লেখক ক্যাকটাস, গাছের মাধ্যমে মূলত মানব-চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছেন। একজন গাছ-পাগল বিজ্ঞানী আছেন। পাহাড়ি অঞ্চলে থাকেন এই গাছওয়ালা। সেখানেই তাঁর নার্সারি, ল্যাবরেটরি। সারাক্ষণ গাছ নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। বিভিন্ন রকমের গাছ তৈরি করেছেন। পাহাড়ি এলাকার চার ভাগ গাছপালার এক ভাগ তাঁর তৈরি। গাছপালার সঙ্গে বন্ধুর মতো, মায়ের মতো মেশেন।  

তিনি বিশ্বাস করেন প্রকৃতি তথা গাছ অনেকটা মানুষের মতো। অতিথি কথককে তিনি বলছেন— “কিছু গাছ বেশি মাত্রায় লাজুক, অসামাজিক প্রকৃতির ; তাদের মন পেতে গেলে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। কোথাও কোথাও আবার কাঠখড় পুড়িয়েও কাজ হয় না। আমাদের মধ্যে যেমন কিছু-কিছু অসম্ভব গোঁয়ার, ভয়ংকর একবগ্‌গা স্বভাবের লোক থাকে না, প্রকৃতির মধ্যেও আছে। যেমন ধরুন এই ক্যাকটাসটা।” এই বলে পাশের টেবিল থেকে একটা ছোটো টব তুলে লেখককে দ্যাখান গাছওয়ালা। তিনি আরও বলেন— তিন মাস আগেও এর কাঁটা আড়াই ইঞ্চি লম্বা আর মোটা ছিল। এখন কমিয়ে এক ইঞ্চিতে এসেছে। তাঁর বিশ্বাস কাঁটাটা নির্মূল হয়ে যাবে। একেবারে বখে-যাওয়া ছেলেরা যেমন ভালো চিকিৎসক, মনোবিদ এবং অভিভাবকের চেষ্টায় বদলে যায়, সেভাবে। এখানে তিনিই তিনজনের ভূমিকা নিয়েছেন—“ভালোবাসা, গভীর ভালোবাসার অসীম ক্ষমতা। শাসন, শাস্তিতে কিচ্ছু হয় না ; কিন্তু ভালোবাসা বেয়াড়া কারও স্বভাব পালটে দিতে পারে।”

ক্যাকটাসের কাঁটা হয় নিজেকে প্রতিরোধ করার জন্য। ক্যাকটাসের যে প্রজাতিটা নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন “ওই ভ্যারাইটিটা তো রাম-বিচ্ছু। বদ ছেলেদেরও হার মানায়। ওর আড়াই ইঞ্চি কাঁটার মাপ এক ইঞ্চিতে নামাতে আমার প্রায় তিন মাস লেগে গিয়েছে। আসল ব্যাপারটা কী জানেন যতই নিরাপত্তার আশ্বাস দিন না কেন, শান্তির কথা শোনান না কেন কেউ চট করে নিজের অস্ত্র ছাড়তে চায় না। ভালোমানুষদের বোঝানো সহজ, কিন্তু দস্যি-ডানপিটেদের বাগে আনা কঠিন। যেমন এই ক্যাকটাসটা।” প্রয়োজনে এই ক্যাকটাস যেমন কাঁটার মাপ বাড়িয়ে নিতে পারে, তেমনি তার বিষের পরিমাণও।

গাছওয়ালা কথককে বলেছিলেন পরে কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট পাঠাবেন তাঁর জন্য। পাঠিয়েও ছিলেন। তার মধ্যে একটা সম্পূর্ণ কাঁটাহীন ক্যাকটাসও ছিল। গাছওয়ালার ড্রাইভার কলকাতায় লেখকের ফ্ল্যাটে এসেছিল দিতে। কথা প্রসঙ্গে সে বলে গাছওয়ালা মারা গেছেন। তাঁর গ্রিনহাউসের মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওপরের তাকে রাখা ক্যাকটাস পরীক্ষা করার সময় পড়ে যান। হাতে ধরা ক্যাকটাসের কিছু কাঁটা বুকে গেঁথে গিয়েছিল। রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারেন না লেখক। তাঁর মনে হয় “অবাধ্য ক্যাকটাস নির্ঘাত কাঁটার আকার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিষের পরিমাণও বাড়িয়ে ফেলেছিল অনেকখানি। ক্যাকটাসের কাঁটার বিষই গাছওয়ালার মৃত্যুর কারণ, নিছক পড়ে যাওয়ার আঘাত নয়।”

সব ডানপিটে ছেলে ভালোবাসায়ও বশ হয় না। 

লক্ষ করবার মতো এই গল্পের পরিবেশ নির্মাণ। বিশেষ এক ধরনের অন্তর্বাস্তবতার অন্বেষণ করেছেন এখানে। তাঁর অধিকংশ গল্পেই এই অন্বেষণ থাকে। তিনি তাঁর মতো করেই লিখেছেন। নিজেই এক জায়গায় বলেছেন, “আমি আমার মতো হতে চাই।” তাই বাংলা গল্পের ভিড়ে বড়ো সহজে চিনে নেওয়া সম্ভব হয় শেখর বসুর গল্পগুলিকে। 

প্রাত্যহিকতার খুব ছোট ছোট বিষয় থেকে উঠে আসে শেখর বসুর গল্প। যেমন ‘অচল ঘড়ি’ (‘শারদীয়া কৃত্তিবাস মাসিক’ অক্টোবর ২০২০) গল্পটি। গল্পের কেন্দ্রে আছে অচল একটা ঘড়ি। কিন্তু গল্পের একেবারে শেষে এসে অচল ঘড়ির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে পাঠকের। ঘড়িই কাহিনিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। গল্পের প্রধান দুটি চরিত্রকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে। তনিমা আর রূপা দুইজন খুব ভালো বন্ধু। দুজনেই বিখ্যাত পারফর্মার। তনিমা করে শ্রুতি নাটক। রূপা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা। দুজনে দুজনের কাজে মুগ্ধ। একদিন একই মঞ্চে দুজন। মস্ত বড়ো একটা অনুষ্ঠান। মন্ত্রী সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক, প্রযোজক সকলেই উপস্থিত। আয়োজকরা প্রফেসলান। সঞ্চালনায় রূপা। আর তনিমা শ্রুতি নাটকে। দুজনকেই দারুণ লাগছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। তনিমা একাই চারটি বিভিন্ন বয়স ও প্রকৃতির চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করল। প্রেক্ষাগৃহে হাততালির ঝড় বয়ে গেল। এই নাটকের দ্বাদশতম অভিনয় ছিল আজ। নাটক শেষে বন্ধুর পাশে গিয়ে ঝলমলে মুখে রূপা বলল, ‘দারুণ করেছিস।’ কিন্তু তনিমা থমথমে মুখে বেরিয়ে গেল। অনুষ্ঠানের পরে ফোন করলে সে ধরে না। 

পরের দিনও না। কী হয়েছে বুঝতে না-পেরে রূপা বিকেলে গেল তনিমার বাড়ি। বিরক্ত তনিমা জানাল রূপা বারবার তাগাদা দেওয়ার ফলে ভালো স্ক্রিপ্টটা তাড়াহুড়ো করে শেষ করেছে সে। তার মনোসংযোগ নষ্ট হয়েছে। কখন তাগাদা দিয়েছে বুঝতে পারে না রূপা। তনিমা জানায় বারবার সে ঘড়ি দেখেছিল। এটাই তো সঞ্চালকদের তাগাদা দেওয়ার একটা স্টাইল। রূপা হো-হো করে হেসে ওঠে। বলে শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে কাল নীল একটা অচল ঘড়ি পরেছিল সে। শুধু অলংকার সেটা। হাত নাড়লে ঘড়ি থেকে নীল একটা আভা বেরোয়। তনিমার রাগ জল হয়ে যায়। 

পরেরদিন সেই ঘড়িটা বন্ধুকে পাঠিয়ে দেয়। তনিমা নাটকের ত্রয়োদশ শোতে নীল শাড়ির সঙ্গে সেই অচল ঘড়ি পরে। নাটক শেষে ঝোড়ো হাততালি চলেছিল অনেক্ষণ। “অনুষ্ঠানের শেষে বাড়ি ফেরার পথে খাঁজকাটা বড়ো ডায়ালের নীল ঘড়ির দিকে কেমন যেন মায়ার চোখে বারবার তাকাচ্ছিল তনিমা। অচল ঘড়ি থেকে মাঝে মাঝেই মৃদু নীলচে আভা ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে।”     

চমৎকার একটা পরিবেশ রচনা করেছেন এই গল্পে। আর তার মধ্য দিয়ে অচলকে আশ্চর্য দক্ষতায় সচল করে দিয়েছেন। আমাদের যাপনের ফেলে দেওয়া অতি সামান্য কত কিছুই যে মূল্যবান হয়ে ওঠে! মার্কামারা টাইপ চরিত্র তিনি মানতে চান না। একটি প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “চরিত্র সম্পর্কে ট্র্যাজিক, কমিক, টাইপ ইত্যাদি বিশেষণগুলি মানি না। আমি নতুন অর্থে শ্রেণীহীন চরিত্রে বিশ্বাস করি।” চরিত্র নির্মাণের প্রথাগত প্যাটার্নের বাইরে তিনি তাঁর গল্পের চরিত্রগুলিকে রেখেছেন।  

ছোটোগল্পের বয়স তো খুব বেশি নয়। বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে গভীর সংযোগ তাঁর। প্রায় বিশ্ব-ছোটোগল্প মন্থন করে তিনি ছোটোগল্পের ঐতিহ্য, ধারা এবং বাঁক বদলগুলিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন ‘শ্রেষ্ঠ বিদেশী গল্প’ গ্রন্থের মাধ্যমে। বত্রিশ জন লেখককে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। বত্রিশজন বাঙালি লেখককে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছিলেন। বত্রিশ পাতার একটি অসাধারণ ভূমিকাও লিখেছিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি গল্পগুলি বাছাই করেছিলেন। এছাড়াও শেখর বসু সম্পাদনা করেছেন ‘চেখভের হাসির গল্প’, ‘বারোটি কিশোর ক্লাসিক’, ‘আধুনিক রবীন্দ্রনাথের একুশটি ছোটগল্প’ ইত্যাদি গল্প সংকলন। ফলে আধুনিক গল্পের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে প্রথমাবধি সচেতন তিনি। নিত্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিশ্বাসী। সেই বিশ শতকের ষাটের দশক থেকে আজও ছোটোগল্পের নানান দিক নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চলেছেন যে সামান্য কয়েকজন বাঙালি লেখক তাঁদের মধ্যে অতি বিশিষ্ট একটি নাম অবশ্যই শেখর বসু। বাংলা ছোটোগল্প তথা বাংলা সাহিত্যকে তিনি আরও নানাভাবে সমৃদ্ধ করছেন। করবেনও।

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. বড় ভালো লাগল। লেখকের সঙ্গে কোথায় যেন একটা সংযোগ সূত্র পেলাম।

    ReplyDelete
  2. 'ক্যাকটাস' আর 'অচল ঘড়ি' আগে পড়া। এই আলোচনা পড়তে পড়তে ভাবছি, আগে তো এমন করে ভাবিনি। কী দুর্দান্ত আলোচনা।

    ReplyDelete