জ্বলদর্চি

বিশ সাল বাদ উদার আকাশ : ফারুক আহমেদ/ খাজিম আহমেদ

বিশ সাল বাদ উদার আকাশ :  ফারুক আহমেদ 

খাজিম আহমেদ 


এই শতকের শুরুতেই একজন তরুণ তাড়িত হয়েছিলেন একটি স্বপ্নের দ্বারা। কেউ কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, কেউ গান গাইতে চান গায়ক হওয়ার জন্য। দুনিয়ার তাবৎ তরুণ-তরুণী এই ধরনের হাজারো খোয়াব দেখেন। ২০০২ সালে ফারুক আহমেদ সুরেন্দ্রনাথ দিবা কলেজ-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হিসাবে (একদা ঐতিহ্যবাহী রিপন কলেজ) ভিন্নতর স্বপ্ন দেখেছিলেন। শুধু নিজস্ব আত্মপ্রকাশের জন্য নয়, তিনি বহুজনের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র হিসাবে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ‘পকেট-মানি’ জমিয়ে মায়ের কাছ থেকে পয়সা চেয়ে. দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড় থানার ঘটকপুকুর গ্রাম থেকে আত্মীয়স্বজন কলেজ পড়ুয়া স্নেহভাজনকে টিফিন-এর জন্য যে টাকা দেয়, ঈদ-উল-ফিতর এবং ঈদ-উল-আযহা-র সময় আপনজনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ঈদ-ই’(স্নেহ সহকারে প্রাপ্ত অর্থ); কলেজের দু-একজন বন্ধু-বান্ধবীর টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তা জমিয়ে ‘উদার আকাশ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে ফেলেন। বস্তুত সেদিনই অবিশ্বাস্য একটি ‘প্রোজেক্ট’-এর সম্ভাবনার বীজ বোনা হয়ে যায়। বস্তুত আহমেদ ফারুক ছিলেন একজন যথার্থ– ‘Dreamer’। আমি ‘প্রোজেক্ট’-এর কথা বললাম, সেটি অতিকথন নয়। কেন তার মূল্যায়ন এই সন্দর্ভের মধ্যেই করে দেওয়া হবে।
ঘটকপুকুর উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ঘটকপুকুর নজরুল-সুকান্ত পাঠাগারের গ্রন্থাগারিক রফিকুল ইসলামের সংস্পর্শে আসার সুবাদে ফারুক আহমেদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। পাঠাগারে অবাধ যাওয়া-আসার ছাড়পত্র মেলে রফিকুল ইসলামের কাছে আবৃত্তি আর বক্তৃতা অনুশীলনের জন্য। সেই সুবাদে পাঠ্যবই ব্যতিরেকে বিশ্ব সাহিত্যে চোখ রাখার সৌভাগ্য হয়। রফিকুল ইসলাম, শিক্ষক সেলিম আহমেদ, মুক্তময় মণ্ডল, আবদুর রব খান এবং কবি লালমিয়া মোল্লার সাহচর্য ও সান্নিধ্যে সাহিত্য রচনার হাতেখড়ি হয়।
বস্তুত বিশ সাল ধরে বিরামহীন দ্বিবার্ষিক সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, হাল আমলের রাষ্ট্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর হরেক কিসিমের কারসাজি সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে অর্থাৎ কিনা জীবন-জিন্দেগির প্রতি স্তরকে স্পর্শ করে প্রকাশ করে চলেছেন পৃথুলা আর ‘পারফেক্ট’ আই এস এস এন ২৩২০-৩৪৯৮ নম্বর যুক্ত একটি পিয়ার রিভিউড দ্বিভাষিক রিসার্চ জার্নাল। এটি খুব কম ‘হুজ্জত’ আর ‘তাকত’-এর বিষয় নয়। বস্তুত দু-দশক ধরে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে এই ‘নাছোড়’ তরুণকে। এতদ্বিষয়ের মধ্যে যেটি বিশেষ ‘ডিসগ্রেসফুল’ বিষয় হচ্ছে তাঁর মায়ের সামান্য অলংকার পর্যন্ত ‘গঞ্জ’-এর স্যাকরার কাছে বন্ধক দিতে হয়েছে। মহীয়সী মহিলা ফজিলা বেগম তাঁর সন্তানের জন্য অপত্যস্নেহে যে ‘সেন্টিমেন্ট’-কে বন্ধক দিয়েছিলেন তা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় নয়। বস্তুত বকলমে তিনি তাঁর পুত্রের সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার মারফত বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির উজ্জীবন, কমপোজিট কালচার’বা ‘মিশ্র সংস্কৃতি’ বা ‘যুগ্ম সংস্কৃতি’-র বিকাশে। অপরিচয়ের আড়াল দূর করার প্রয়াসে তা অশেষ সহায়ক হয়ে উঠেছিল, ‘বিশ সাল বাদ’-এখনও তা সমানভাবে ক্রিয়াশীল। সময়ের ফারাক কি নেই। ‘হালত’ কি একই থেকে গেল? পরম আনন্দে ‘রিসফুল’ আমরা বলতে পারি ফারুক আহমেদ ‘গ্রিটস’, ‘গাটস’ এবং ‘গাম্পশান’— ‘উদার আকাশ’ পত্রিকাকে শুধু নয়– ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনকেও একটি মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসাবে উভয় বঙ্গের সাংস্কৃতিক মহলে স্বীকৃত করে তুলেছে। বস্তুত কলকাতাকেন্দ্রিক সম্ভ্রান্ত পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রকাশনার যে সমস্ত বইপত্তরের আলোচনা হয় তা রীতিমতো গাম্ভীর্যপূর্ণ আর মর্যাদাকর বিষয়। দার্শনিক-ভারতবেত্তা আন্তর্জাতিক পরিব্রাজক বিবেকানন্দর অনুভব হল : জনসমাজে সংগতি স্থাপনই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। ফারুক আহমেদ পরিস্থিতির সঙ্গে ‘মেনে-জেনে’ চলতে জানেন। ফলত বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়। তাঁর দু-একজন সাংস্কৃতিক অভিভাবক বহু ক্ষেত্রে তাঁর ভরসার কেন্দ্র হয়ে ওঠেন। বহুদর্শী-ভূয়োদর্শী অভিভাবক পাওয়াও সৌভাগ্যের বিষয়। ফারুক আহমেদ এই সম্পর্কগুলোকে টিকিয়ে রাখতে জানেন। এর ফলেই কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত তাঁর পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকের অভাব নেই। উভয় বঙ্গে এমনকী অসম-ত্রিপুরাতেও ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা আদরনীয় হয়ে উঠেছে।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে বৃহদংশের যে অনীহা আর বীতরাগ তা বাস্তব সত্য। ফারুক আহমেদ পরম আন্তরিকতার সঙ্গে সেই অবাঞ্ছনীয় আর গ্লানির উচ্ছেদে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার জন্য যথার্থ ‘সেক্যুলার’ একটি সাহিত্য-সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে বিশ সাল কাবার করে দিলেন। তাঁর সেই সন্ধান এখনও জারি রয়েছে। বস্তুত রাষ্ট্রীয় পরিচালকবর্গের প্রচ্ছন্ন আবার প্রত্যক্ষ মদতে এই দেশে যেন সাম্প্রদায়িকতাবাদের উদগ্র প্রকাশ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠছে তার প্রতিরোধে যে সমস্ত চিন্তাশীল ভাবুক ব্যক্তিবর্গ উদ্বেগে রয়েছেন তাঁরা ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার মাধ্যমে সুচিন্তিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সন্দর্ভ প্রকাশ করে জনমত গঠনে অশেষ অবদান রাখছেন। রবীন্দ্র-উত্তর বাঙালি সমাজের গর্ব অমর্ত্য সেন, প্রণব মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী পর্যন্ত ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার কল্যাণ কামনা করেছেন। আবদুল আজীজ আল্‌-আমান ‘হরফ প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশ করেছিলেন বেদ, উপনিষদ, গীতা। সংকীর্ণ কোনও চিন্তা, বিভাগ-পরবর্তী পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অগ্রণী পুরুষ আলহাজ্ব আবদুল আজীজ আল-আমান-এর চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেনি। ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন থেকে তরুণ ফারুক আহমেদ প্রকাশ করেছেন, ‘বিবেকানন্দ অ্যান্ড দ্য মেকিং অফ ইন্ডিয়া...’ এবং জগন্নাথকে নিয়ে গবেষণা মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন উদার আকাশ পত্রিকায়। তিনি যথার্থ উদারবাদী বাঙালিয়ানার পরিচয় রেখেছেন। দেশ বিভাগের পর একটি উপেক্ষিত জাতির শিকড় সন্ধানের সওয়ালে প্রকাশ করেছেন। ‘ইসলাম কী বলে’, ‘বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাঃ’ ইত্যাকার গ্রন্থ। ১৯৪৭-উত্তর পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের গ্রহান্তরের জীব হিসাবেই বিবেচনা করছিলেন অনেকে, তাঁদের সম্পর্কে কথা হচ্ছিল, তাঁরা ‘দেশদ্রোহী’ – ‘পাকিস্তানি দালাল’। তাঁদের জীবন-জীবিকা, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে ছিল বিরাট বাধা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একটি লেখায় মন্তব্য করেছিলেন, 'এ দেশে অবাধে মুসলমান তরুণ-তরুণীদের চাকরি হচ্ছে— এ কথা যদি কেউ বলে থাকেন তাহলে আমি বলব, তিনি মিথ্যেবাদী, মিথ্যেবাদী এবং ভীষণ মিথ্যেবাদী।' তিনি এমন মন্তব্যও করেছিলেন যে ভারতের সর্বত্র ‘বিশেষত শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ দ্রুত ছড়াচ্ছে’। ‘প্রেম নেই’-এর লেখক গৌরকিশোর ঘোষ আশ্চর্য ‘ঘরানা বহির্ভূত’ মন্তব্য করেন, ‘... আমাদের অজ্ঞতার দোষে আমরা প্রতিনিয়ত মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিয়ে থাকি, সে সম্পর্কে বিশেষ চেতনা কারো মনে দেখিনে, এটাও তো সত্যি।’ এই অন্তবিহীন সমস্যা সম্পর্কে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ, সময়ের দলিল: প্রকাশ করেন ফারুক আহমেদ তাঁর উদার আকাশ প্রকাশন থেকে খাজিম আহমেদের লেখা  ‘পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা’। পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের ‘আইডেনটিটি’ নির্ধারণের প্রশ্নে সামগ্রিক পাঠক সমাজের সামনে ফারুক আহমেদ পেশ করলেন খাজিম আহমেদের আরও একটি গবেষণা গ্রন্থ ‘বাঙালি মুসলমান : আপন ভুবনের সন্ধানে’। 

ফারুক আহমেদ সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা বিশ সালের মধ্যে হালতক প্রকাশ করেছে ৪২টি সংখ্যা– যাকে বলে ‘At a stretch’ একনাগাড়ে। এর মধ্যে বিশেষ কয়েকটি সংখ্যা যুগ্ম বাঙালি সত্তাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। সেগুলোর উল্লেখ করা যাক। ১. অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ২. আত্মপরিচয়ের অন্বেষণ, ৩. মূল্যবোধের অবক্ষয় ৪. মর্যাদার সন্ধানে. ৫. আত্মবিকাশের দর্পণ, ৬. রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অনগ্রসর ও সংখ্যালঘু, ৭. ভূমিপুত্রদের জাগরণ, ৮. সম্প্রীতির বার্তা। যথার্থ তথ্যের জন্য বলে রাখা কর্তব্য, মোট ১৪টি বিশেষ সংখ্যা এ যাবৎকাল সজ্জন পাঠকের সামনে হাজির করা গেছে।
ফারুক আহমেদের চারটি সম্পাদিত গ্রন্থের আলোচনা বিশেষভাবে করা গেল। গ্রন্থ চারটি– ১. কংগ্রেস ও বাম শাসনে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক, ২. প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন, ৩. পশ্চিমে সূর্যোদয় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উলটপুরাণ এবং সর্বোপরি ৪. বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। 
‘বিশ সাল বাদ’ সালতামামি করতে গিয়ে লক্ষ করা যাচ্ছে অপ্রীতিকর নাজুক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রশ্নে ‘উদার আকাশ’ অনেকখানি অগ্রচারী সৈনিকের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়েছে। কোনও দ্বিধা মনে না রেখে বলছি, প্রগতিশীল, ভাব ও ভাষা সমৃদ্ধ একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠী ‘উদার আকাশ’-এ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
বিশ বছরের সাধনার ভিত্তিতে ‘সোশিও পলিটিকো’ এবং বাঙালির ‘আইডেনটিটি’-র প্রশ্নে যে চারটি গ্রন্থ রয়েছে তার গুরুত্বের বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক। প্রকাশক ফারুক আহমেদ উদার আকাশ থেকে প্রকাশ করেছিলেন তিনটি বই। ১. কংগ্রেস ও বাম শাসনে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক (৭ মার্চ, ২০১১), ২. পশ্চিমে সূর্যোদয় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে উলটপুরাণ (৭ মার্চ, ২০১৪) এবং ৩. প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন (১৫ এপ্রিল, ২০১৫)। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এই তিনটি বই-ই সম্পাদনা করেছিলেন ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ। এই তিনটি গ্রন্থ প্রকাশের পিছনে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। ব্যবসারিকভাবে লাভ বা সাহিত্যচর্চার নেশা থেকে এমন পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলো করা হয়নি।
ভারতের মতো একটি সুবৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণ নির্বাচন প্রায় ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়। রাজনীতি ও সমাজমনস্ক ফারুক আহমেদ কংগ্রেস ও 'বাম শাসনের মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক' প্রকাশ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত ২০১১-র নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ তক বামফ্রন্টের দাম্ভিক আর অহমিকাপূর্ণ শাসনের পরিবর্তন ভীষণভাবে জরুরি হয়ে পড়েছিল। বামফ্রন্টের মতো রেজিমেন্টেড একটি রাজনৈতিক শক্তিকে ধ্বস্ত করে দেওয়া সহজ বিষয় ছিল না। তেমন সময়ে তরুণ ফারুক আহমেদ অসীম সাহসের ওপর ভর করে পরিবর্তনের আওয়াজ তুলেছিলেন। বামফ্রন্টের নেতৃবর্গের ‘তুই কে রে ব্যাটা’-এই মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পাশে পেয়েছিলেন ইতিহাসবিদ সুরজিৎ দাশগুপ্ত (কীভাবে বেঁচে আছে ভারতীয় মুসলমান), বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল (সাচার রিপোর্ট পশ্চিমবঙ্গকে দেখাল অপশাসন সরানো হিন্দু-মুসলমানের যৌথ দায়িত্ব) অভিজ্ঞ সাংবাদিক জয়ন্ত সিংহ (মুসলিমদের কথা দিয়ে কেউ কথা রাখেনি), মীরাতুন নাহার (দেশ বিভাজন, ভোট রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজ), কঙ্কন নন্দী (লঘুগুরু ব্যবধান ঘোচাতে হবে), আবদুর রাউফ (বাঙালি মুসলমানেরা কখনোই কারো ভোটব্যাঙ্ক ছিল না), সাংবাদিক মোশারফ হোসেন (আপন ভাগ্য জয় করার অভিযানে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠী) খাজিম আহমেদ (বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা)কে ২০১১-এর সাধারণ নির্বাচনে জালিম বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ জনমত, পরিবর্তনের পক্ষে উগমনের জন্য পনেরো জন লেখকের বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা প্রকাশের মাধ্যমে ফারুক আহমেদ গণতন্ত্রের পক্ষে একটি সাহসী পদক্ষেপ করেছিলেন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, 'কংগ্রেস ও বাম শাসনে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক' সংকলনটি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। প্রত্যেকটি দৈনিক সংবাদপত্রে এই সংকলনটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এমনকী উত্তর সম্পাদকীয়তে প্রশংসা করা হয়েছিল। শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তনের প্রশ্নে নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা সাড়া জাগিয়েছিল। পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা আজ ঐতিহাসিক সত্য। সাচার কমিশনের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে লিখিত পনেরোটি প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমান নির্বাচকমণ্ডলীকে সিদ্ধান্ত নিতে এই গ্রন্থটি ব্যাখ্যাতীত সাহায্য করেছিল। তথ্যগত দিক থেকে ফারুক আহমেদ ‘কংগ্রেস ও বাম শাসনে মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক’ সম্পাদনা করে সময়ের প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আজকে বাঙালি মুসলমানরা যে তাদের হক আদায়ের জন্য আন্দোলন করছে তার সূত্রপাত হয়েছিল ২০১১-এর ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যমে। সেই পরিবর্তনে আলোচ্যগ্রন্থটি যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল তা সময় প্রমাণ করে দিয়েছে। স্মর্তব্য, এর মধ্যে মাত্র একটি দশক পেরিয়েছে।
আমরা আলোচ্য গ্রন্থে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এইভাবে, ‘আপনি কি হাল ছেড়ে দেবেন?’ ‘আপনি এখন কী করবেন? এতদিন জিহ্বা ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ প্রতিবাদ করেননি। হাত ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ প্রতিরোধ করেননি। জুলুমের বিরুদ্ধে তলোয়ার ব্যবহার করেননি, অর্থাৎ অন্যায়ের প্রখর প্রতিবাদ করেননি। ... ডুমসডে সামনে এসে হাজির। আপনার ব্যালটের তলোয়ারটি ২০১১-তে দিমাগের সঙ্গে ব্যবহার করুন। পরিবর্তনপন্থীরা প্রতিজ্ঞা রক্ষার (Promises to Keep) খাতিরেও আপনার কথা অন্তত এক দশক ভাববে। প্রত্যয় হয় অনেকটাই পথ খুঁজে পাবেন।'
এক দশক আগে আমরা যে মূল্যায়ন করেছিলাম তা যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। এই এক দশকে পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান শ্রেণি জীবন যাপনের সমস্যা মোকাবিলায় অনেকটাই যোগ্য হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই ২০২১-এ সাধারণ নির্বাচনে আপনার মগজাস্ত্র ব্যবহার করুন, যাতে উদগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের রুখে দেওয়া যায়। বাস্তবিক অর্থে অশুভ শক্তিকে অনেকেই বাঙালি রুখে দিয়েছেন বাংলার মানুষের কল্যাণে।
আলোচনাটির শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম বামফ্রন্টের ‘জালিম জামানা’ উচ্ছেদের জন্য জেদি যুবক ফারুক আহমেদ প্রকাশ করেছিলেন আরও দুটি সমাজ-রাজনীতি নির্ভর প্রবন্ধ সংকলন ‘পশ্চিমে সূর্যোদয়...’ এবং ‘প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন’। সেই গ্রন্থদ্বয়ে ছিল বৃহত্তম সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান সমাজ, দলিত অনগ্রসর দুঃখী নিপীড়িত মানুষজনের জীবনের হাজারো ব্যথা বেদনার কথা। আর্থিক বিচারে নিম্নবর্গের, জাতিসত্তার বিচারে নিম্নবর্ণের সাধারণ মানুষ তাঁদের অধিকারের লড়াই কীভাবে লড়বেন এবং অধিকার অর্জন করবেন, সেই বিষয়ে আলোচ্য দুটো গ্রন্থে ৪৬টি নিরীক্ষা-সমীক্ষামূলক প্রবন্ধের মারফত পথ-সন্ধান করা হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে লক্ষ করা গেছিল ২০১৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ব্যাপক চপেটাঘাত খেয়েছিল। বস্তুত ফারুক আহমেদ তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থত্রয়ের মারফত জনমত সৃষ্টিতে সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন, সেটি যথার্থই। প্রশংসার যোগ্য।

'পশ্চিমে সূর্যোদয় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উলটপুরাণ' নামক গ্রন্থে স্বাধীনতা লাভের পরের ছয় দশকের পরিবর্তন সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলা হয়েছিল। এই সময়ে ভারত আর্থিক বিচারে দুটি ভারতে রূপান্তরিত হয়েছিল – ধনী ভারত, দরিদ্র ভারত। ধনী ভারতে রয়েছেন মাত্র ১৫ শতাংশ উচ্চবিত্ত মানুষ যাঁরা ভারতের শোষক ও শাসক।
ভারতের বৃহত্তর সমাজ এই দরিদ্র ভারতের সদস্য যারা নিপীড়িত, শোষিত, নিম্নবর্গের মানুষ, সংখ্যালঘু অনগ্রসর শ্রেণি। এই সমাজ কোনওদিনই নিজের অধিকারটুকু অর্জন করতে পারেনি। কৃষিতে, শিক্ষায়, চাকরিতে গণমাধ্যমে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে, কোনওটিতেই তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকু নিতে পারেননি।
সুবিধাভোগী ১৫ শতাংশ উচ্চবর্গের মানুষ ৮৫ শতাংশ সুবিধাহীনদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। প্রায় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দেশে বৃহৎ মূলধন সম্পন্ন গোষ্ঠীর আধিপত্যবাদকে রাষ্ট্রযন্ত্র পুরো সমর্থন করছে এবং শাসকগোষ্ঠী সেই শ্রেণির স্বার্থেই কাজ করছে।
এই সংকলনটি নিম্নবর্গের সব মানুষকে শ্রেণিবদ্ধ হয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আসবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ন্যায় ও স্বাধীনতা। মূলনিবাসী মানুষের সামাজিক ন্যায়বিচার ও অধিকার অর্জনের প্রসঙ্গ উত্থিত হয়েছে এই সংকলনে। পশ্চিমবাংলার জনমানসে গ্রন্থটির প্রভাব ব্যাপক উপলব্ধি করা গেছিল।
২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছিল ফারুক আহমেদ-এর সম্পাদনায় ‘প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন’। এই সংকলনটিতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল আইনের মারফত সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর সমস্ত মানুষের সমবিকাশে। জনগণকেও তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছিল। প্রশাসন আর সমাজব্যবস্থায় যাতে সমাজবিরোধীরা প্রাধান্য না পায় তার জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন আর প্রতিরোধ গড়ে তোলার মানসিকতার উজ্জীবন আশা করা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই নিজেদের অধিকার অর্জন করতে হবে। শিক্ষার মারফত অর্জিত সচেতনতা দেশ দশের কল্যাণসাধনে মূল ভূমিকা নেবে এমন প্রত্যাশা করা হয়েছিল।
দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে ঐকবদ্ধ হয়ে আমাদের সকলকেই দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। কোনও জাতি যে কোনও ধর্ম বিশ্বাস আর সম্প্রদায়ের হোক না কেন, সকলকে নিয়েই এগোতে হবে। বহুজাতিক দেশে শুধু বিশেষ শ্রেণি স্বার্থ সংরক্ষিত হলে আর যাই হোক, দেশের সংহতি তো গড়ে উঠবেই না বরং বিপন্ন হবে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এই উপমহাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান আর পরিচয়কেই পাল্টে দেয়নি। নানান মতামত আর ধর্মবিশ্বাসী মানুষের মনকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই শতকের শুরুতেই গুজরাটে যে সাম্প্রদায়িক একপেশে গণহত্যা ঘটেছিল তা বিবেকসম্পন্ন মানুষদের কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিকবর্গ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে। বিষয়টি সিভিলিয়ান হর্ষ মান্দার 'Partition of the Heart. Unmaking the Idea of India' নামক গ্রন্থে সেই বীভৎসতার পরিচয় সোজাসুজি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রীয় মদত ছাড়া এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সম্ভব ছিল না। হর্ষ মান্দার-এর ব্যাখ্যা যথার্থ।
২০১৪-র পর থেকে এক উগ্রধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবাদ জাতির একটি বিরাট অংশকে শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ মদতে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এমন অবস্থায় আমরা কি হতাশায় মুহ্যমান হব? অবশ্যই নয়। এমন অবস্থায় আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে ভারতের চিরন্তন বহুত্ববাদের আর বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের আদর্শে। ঠিক যেমন আন্তর্জাতিকতাবাদী বাঙালি অমর্ত্য সেন উচ্চারণ করেছেন তাঁর ‘নিজের কথা পৃথিবীর কথা’ নামক সদ্য প্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থে। আমরা মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখছি।
কহাবত রয়েছে, বিশেষ ধর্মাবলম্বী একটি জাতিসত্তাকে ‘অ্যানিহিলেট’ করার জন্য একদা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে গণহত্যার আয়োজন করেছিলেন সে বাবদে তৎকালীন সিভিলিয়ান হর্ষ মান্দার ইংরেজি ভাষায় একটি লোমহর্ষক ‘কেতাব’ লিখেছিলেন, সেটির নাম 'Partition of the Heart, Unmak- ing the Idea of India'। সেই থেকে হৃদয়কে ভাঙচুর করেই চলেছে।
সাদিয়োঁ কাল থেকে ‘হিন্দুস্তান’-এ বহমান ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য আর ঐক্যবদ্ধকে তছনছ করে ধর্মীয় উন্মাদনার এক লজ্জাজনক অধ্যায় তৈরি হয়। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দেশ এক অদ্ভুত আঁধারের সামনে এসে পড়েছে। ২০২১-এর নির্বাচনে এমনভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে সমাজজীবনে জারিত করেছে যে ঘৃণার এক অদৃষ্টপূর্ব আর ভয়ানক নজির লক্ষযোগ্য হয়ে উঠেছে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দি ভাষাকে কেন্দ্র করে এক জাতি, এক ভাষা আর সনাতন ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িকতাবাদে আচ্ছন্ন ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে উদ্যত। এমন এক ধর্মীয় সমাজ ব্যবস্থা স্থাপনের প্রচেষ্টা করছে, যাতে হিন্দি বলয়ের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়।
বহুতর অঙ্গরাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ উন্নততর শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সেই ‘কৃষ্টি’কে লুপ্ত করতে উদ্যত কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দু-মুসলমান জনগোষ্ঠীকে যুযুধান দু’-পক্ষে রূপান্তরিত করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত।
এই অপপ্রয়াস রুখতে ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনের উদার প্রকাশক দেশ-দশ-সচেতন সম্পাদক ফারুক আহমেদ সম্পাদনা করেছেন, ৭ মার্চ ২০২১ সালে ‘বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম’ নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সংকলন। বিস্ফোরক এই গ্রন্থটিতে পশ্চিমবাংলার সর্বস্তরের বিদ্বজ্জনদের ২৫টি সন্দর্ভ রয়েছে। পাঠক সমৃদ্ধ হবেন।

পশ্চিমবাংলার অখণ্ড হিন্দু-মুসলিম বাঙালি জাতিসত্তার এমন দুর্যোগের দিনে অভিনব চিন্তা-চর্চা সমন্বিত আলোচনাগুলো বাঙালি মননকে অতুল্য এক ঝাঁকুনি দিয়ে যাবে। ইতিহাস বলে, বিজেপি-র মূল চালিকাশক্তি আরএসএস ও তার তৎকালীন দোসর হিন্দু মহাসভা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। বরং ইংরেজদের পক্ষেই ছিল তারা। শুধু তাই নয়, দেশভাগের মূলে প্রকৃতপক্ষে ওই দুই সংগঠনের নেতাদের ভূমিকাই ছিল আসল। অথচ সেই আরএসএস-জাত বিজেপি-র অধুনা নেতারা দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে কী না করছেন! বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ-র শাসনে ভারতের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, তীব্র বেকারত্ব ও ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির জোড়া ধাক্কায় দেশবাসীর নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়েছে। সাধারণ মানুষকে দেওয়া প্রায় কোনও প্রতিশ্রুতিই পালন করতে পারছেন না মোদি ও তাঁর দোসররা।
এই ব্যর্থতা থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে ধর্মকে হাতিয়ার করছেন গেরুয়া নেতারা। ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবাসীকে বিভক্ত করে নিজেদের আসন নির্বিঘ্ন রাখতে মরিয়া তাঁরা। সেই পরিকল্পনার আরও একটি অংশ হল বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেওয়া। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের স্বপ্নে বিভোর তাঁরা। ওই স্বপ্ন সফল করতে এখন হাত বাড়িয়েছেন গোটা দেশের দিকে। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দখল নিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন।
গেরুয়া শিবিরের ওই অন্যায় আগ্রাসনকে রুখে দিতে বাংলার বহু সচেতন ব্যক্তিত্ব জোরদার লড়াই করছেন। লড়ছেন বহু সাধারণ মানুষও। বাংলা ও বাঙালির স্বার্থে তাঁদের এই লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছে ‘উদার আকাশ’। ফারুক আহমেদ সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেন এসব কথা।  রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব ওই অগ্রণীদের একটি অংশের ভাবনার প্রতিফলন সংকলিত হয়েছে ‘বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম’ গ্রন্থে।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাড়ে দশ কোটি বাঙালির অনন্যতা রক্ষায় ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনের এই প্রয়াস অব্যাহত থাকবে, এই অঙ্গীকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সম্পাদক ফারুক আহমেদ। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ভারতের শুভবুদ্ধির মানুষেরা এগিয়ে আসছেন। আমরা কখনওই ভুলে না যাই, মিশ্র সংস্কৃতিই আমাদের অর্জিত বৈভব, তা আমরা রক্ষা করবই।
মানবিক চিন্তাচর্চায় যথার্থ আগ্রহী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মেধাজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সমাজ-রাষ্ট্রচিন্তক, সর্বোপরি আমজনতার সচেতন অংশটি গেরুয়া শাসনের প্রশাসনিক বদমায়েশি সম্পর্কে নিরন্তর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘিষ্ঠ সমাজ থেকে উদ্ভূত প্রতিনিধিস্থানীয় সমাজ-বেত্তা, প্রাবন্ধিকদের ভাবনাচিন্তাকে তুলে ধরা হয়েছে ‘বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম’ গ্রন্থটিতে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের একটি অংশ, যারা আজও উটপাখির মতো মরুবালিতে মুখ গুঁজে উপেক্ষিত অংশের জাগরণকে স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত, তাদের বোধোদয় হবে এমন প্রত্যাশা করা যায়। ভারতের ঐতিহ্যের, পরম্পরার এবং সংহতির ঘোর বিরোধী গেরুয়া শাসনের অবসান ঘটাতে এগিয়ে আসছেন সচেতন দেশবাসী। সীমাহীন রাজকীয় ক্ষমতানির্ভর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘাড়ে-গর্দানে এক হয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের রাজাবাবুরা এতদিন যে সংখ্যালঘিষ্ঠ ও দলিত সম্প্রদায়ের উপস্থিতিকেই স্বীকার করতেন না। আজ তাঁরাই বেমক্কা নির্লজ্জভাবে ছুটে যাচ্ছেন প্রান্তিকের কাছে ভোট ভিক্ষা চাইতে। মূল্যবান এসব কথাই বলিষ্ঠ সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন ফারুক আহমেদ। 
সময়ের দাবি মেনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন উদার আকাশ প্রকাশন ও ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ এমন প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করে।
সুবোধ সরকার, সাহানা নাগ চৌধুরী, বাণী বসু, বারিদবরণ ঘোষ, সফিউন্নিসা, তপোধীর ভট্টাচার্য, খাজিম আহমেদ, অশোক মজুমদার, জয়ন্ত সিংহ, সুমন ভট্টাচার্য, জয়ন্ত ঘোষাল, মোশারফ হোসেন, মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহাম্মদ শামসুল আলম, একরামুল হক শেখ, দীপক দাস, গোলাম রাশিদ, প্রবীর ঘোষ রায়, সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফারুক আহমেদ প্রমুখ এই প্রবন্ধ সংকলনে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জাগিয়ে তুলতে কলম ধরেছেন।

বাঙালি জাতির উত্থানে হুসেন শাহী বংশের অবদান প্রায় তুলনারহিত। বাংলার ইতিহাসে উল্লিখিত জমানার শাসনকাল এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১৯ পর্যন্ত আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বাংলার ‘তখত-তাউসে’ ছিলেন। এর পরেই তাঁর প্রথম পুত্র নুসরত শাহ ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী ধারার সার্থক উত্তরাধিকারী ছিল হুসেন শাহী আমল। এই সময়েই আজকের বাঙালি জাতি একটি নির্দিষ্ট রূপ নেয়।
হুসেন শাহের শাসনকালে এই বঙ্গে অমুসলমানদের জীবন ছিল পুরো নিরাপদ। ধর্ম নিয়ে তাঁদের বিপদে পড়তে হয়নি। হুসেন শাহের উজির, ব্যক্তিগত চিকিৎসক, প্রধান দেহরক্ষী, টাকশালের পরিচালক ছিলেন সকলেই হিন্দুধর্মী। বিশ্বস্ত হিন্দু সেনাপতি তাঁকে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার পরামর্শ দিতেন। রূপ আর সনাতন গোস্বামীর বিষয়টি তো ‘লিজেন্ড’বা কিংবদন্তির পর্যায়ে পড়ে। ড. হবিবুল্লাহ মন্তব্য করেছেন যে, “সেই জমানার এমন উদার ‘অ্যাটিউচাডে’র জন্যই শ্রীচৈতন্যদেবের নেতৃত্বে বাংলায় তৎকালীন নবজাগরণ সম্ভব হয়েছিল।”
বস্তুত, বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতির ইতিহাসে হুসেন শাহীর শাসনকালে বাঙালিয়ানার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছরের সময়কে বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমল বলা হয়। বাংলার এই সুলতানি আমলের প্রধানতম দুটি বৈশিষ্ট্য হল : প্রথমত, বাংলার সীমান্তকে তার প্রাকৃতিক সীমান্তরেখায় স্থাপন করা এবং দ্বিতীয়ত বাংলার নিজস্ব আঞ্চলিক শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ।
ইলিয়াস শাহী আর হুসেন শাহী জমানার শাসকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বাংলা সাহিত্যের বিকাশসহ অন্যবিধ সাংস্কৃতিক উজ্জীবনে হুসেন শাহের অবদান অসামান্য।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের জীবনে গতানুগতিকতা আর সহজ-সরল যাপন নামাহর মধ্যেই কেটেছে। আঠারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে পলাশি যুদ্ধের পর ব্রিটিশ প্রভুদের পদলেহনের মাধ্যমে সুবিধাভোগী বাঙালি জাতির একটি অংশ জাগতিক অর্থে সফল হয়ে ওঠে। উপরন্তু নানা ধন্ধধান্দায় সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান ঘটে। এ বাবদে ঐতিহাসিক বিপন চন্দ্র মন্তব্য করেছেন, ‘‘আধুনিক ভারতে সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থান হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উপজাত ফল।”
নানান ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পেরিয়ে নয়া জাগরণের বহুধা দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও একটি বাঙালি জাতির ধারণা গড়ে উঠেছিল। ১৯০৫-এর সময়কালে তা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেও অনুভূত হয়। শেষমেশ ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় বিভিন্নতার প্রশ্ন তুলে দেশ বিভক্ত হয়ে যায়। ভারত, পাকিস্তান নামে ভৌগোলিক অর্থে তিনটি খণ্ডে ভাগ হয়ে যায়। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই ধর্মীয় ঐক্যের অসারতা প্রমাণ করে ভাষাভিত্তিক জাতিগঠনের সংগ্রাম শেষে, মাত্র ২৫ বছরের মাথায় স্বাধীন গণতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটে। নিখিল বিশ্বে বাঙালি জাতির অবস্থান পশ্চিমবঙ্গ নামক ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য এবং স্বাধীন বাংলাদেশে স্থিত হয়। এই বাঙালি জাতি ‘কমপোজিট কালচার’ নিয়ে পুরো ভূমণ্ডলে ছড়িয়ে রয়েছে।
ভারত পৃথিবীর রাজনৈতিক ‘এরিনা’-য় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ভারতের সংবিধানের মহান রচয়িতাবর্গ সব নাগরিকের সমান মর্যাদার জন্য ব্যাপক সাধনার মধ্যে একটি প্রকোষ্ট জনকল্যাণমূলক কাঠামো তৈরি করেছিলেন, হাল আমলে তা ধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। স্পষ্ট বলা দরকার, গত শতকের আটের দশক থেকে নানান প্রক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা নিজেদের সংঘবদ্ধ করেছে, সংহত করেছে, সংগঠনের মারফত তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আকাশস্পর্শী করে তুলেছে।
এদের স্লোগানটি কী ! “হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান” (হিন্দুস্তাঁ /হিন্দুস্তান নয়)। বহুজাতিক ভারতে তাঁরা এক ভাষা এক ধর্মীয় দেশ প্রতিষ্ঠা করতে চান। উপরন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় আর সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে বীভৎস ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান। প্রতিনিয়ত আমরা তার প্রকাশ লক্ষ করছি হিন্দি ভাষাভাষী এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে। বস্তুত তাঁরা অনার্য দাক্ষিণাত্য এবং পূর্বাঞ্চলের বাঙালিদের মর্যাদাপূর্ণ জাতিসত্তা হিসেবে মান্যতা দূরের কথা, স্বীকারই করেন না। হিন্দু ধর্মাশ্রয়ী নিম্নবর্ণের অন্ত্যজ শ্রেণির মনুষ্য সমাজকে ঘৃণা আর উপেক্ষার চোখেই দেখে থাকে। মুসলমান, খ্রিস্টানরা তো পুরোপুরি ব্রাত্য. একুশ শতকের ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে হালতক ব্রাহ্মণ্যবাদী আর মনুবাদীরা পশ্চিমবাংলাতেও তাদের ‘ডিভাইসিভ’ বা বিভেদমূলক নীতিকে দৃঢ় প্রতিষ্ঠ করতে চায়। এর জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের দরকার। সেই কারণে ভারতের বহুত্ববাদী অর্থাৎ প্লুরালিস্টিক চারিত্র্যকে ধ্বংস করতে চায় এবং পালাবদলের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো অখণ্ড বাঙালি জাতির সামনে উত্থাপন করার অভিপ্রায়েই ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা ও প্রকাশনের সচেতন সম্পাদক ফারুক আহমেদ বর্তমান গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন। প্রত্যয় হয় বাঙালি পাঠক সমাজের কাছে এই প্রয়াস গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে বিপুল সমাদরে। বিভেদকামী শক্তিকে প্রতিহত করে বাঙালি ভারতকে পথ দেখাতে দৃঢ় সংকল্প বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট থেকেছেন।

গ্রামবাংলার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে বিশ সাল ধরে বহু ত্যাগ স্বীকার করে, বহু ঘাম ঝরিয়ে আজ ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা একটি সাহিত্য আন্দোলনের মুখপত্র হয়ে উঠেছে। স্নেহভাজন ফারুক আহমেদের পিতা পত্রিকা প্রকাশের প্রথম দিকে শারীরিক পরিশ্রম করতে কোনও দ্বিধা রাখেননি। নিঃশঙ্ক চিত্তে কলেজ স্ট্রিট থেকে মুদ্রিত কাগজ মাথায় করে নিয়ে শিয়ালদহ বি. আর. সিং হসপিটালের কাছে পৌঁছেছেন এবং ভাঙড়গামী রাজাবাজার থেকে ঘটকপুকুরের বাসে গলদঘর্ম হয়ে বসেছেন। বিষয়টি যেন পিতামাতা-পুত্রের এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। শুধু তাই নয়, সম্পাদক ফারুক আহমেদ-এর পিতা ডাঃ মোঃ আবেদ আলি স্বয়ং ‘অন্য গাঁয়ের আখ্যান’ নামক গল্পগ্রন্থও রচনা করে ফেলেন। উদার আকাশ প্রকাশন থেকেই সৈই গল্পের বই প্রকাশ করেন ফারুক আহমেদ। দৈনিক 'সংবাদ প্রতিদিন' পত্রিকায় নিয়মিত নিবন্ধ লিখেছেন ডাঃ মোঃ আবেদ আলি। ঘটকপুকুর এলাকার মানুষের সেবায় থেকেছেন আজীবন। বিশ সাল বাদ বহু সাফল্য ধরা দিয়েছে। দশ বছরের মাথায় ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন থেকে নানাবিধ গ্রন্থ প্রকাশও হতে থাকে। বস্তুত প্রায় ১২১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থগুলো দেশ দশ, সমাজ-রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রীয় বিচারে অশেষ গুরুত্ববাহী হয়ে উঠেছে।
ফারুক আহমেদ সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার ১৪টি বিশেষ সংখ্যার প্রসঙ্গ আগেই তুলেছি। তাতে স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলার জনগণের জীবন সংগ্রাম-এর বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। অস্তিত্বের সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ সন্ধান করা হয়েছে। বিশেষ জাতিসত্তার আত্মানুসন্ধান বা শিকড় সন্ধান করা হয়েছে। উপেক্ষিত শ্রেণির মর্যাদার সন্ধান আর আত্মবিকাশের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। অনগ্রসর আর ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু নাগরিকবর্গের ক্ষমতায়ন এবং তাতে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকার বিষয়টি অশেষ তাৎপর্যবাহী। সাধারণ মানুষের জাগরণের বিষয়টি বিশেষ সহানুভূতির সঙ্গে বিশ্লেষিত হয়েছে। সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সূত্র সন্ধানে ‘উদার আকাশ’ বিশেষ দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছে। আমরা জানি ‘মিশ্র সংস্কৃতি’ বা ‘যুগ্ম সংস্কৃতি’ আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত এক বৈভব। প্রতিটি সংখ্যা পশ্চিমবাংলার দৈনিক সংবাদপত্র, পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক আলোচিত আর প্রশংসিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোও প্রথা ভেঙে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা ও প্রকাশন সম্পর্কে আলোচনা করেছে। অর্থাৎ কিনা ‘উদার আকাশ’-এর সম্পাদক ফারুক আহমেদ-এর ‘হাই লিঙ্ক’-এর বিষয়টিও লক্ষযোগ্য হয়ে উঠেছে। এহ বাহ্য।
‘উদার আকাশ’ পত্রিকা আর প্রকাশনার বা মোড়ক উন্মোচনের বিষয়টিও চমকপ্রদ। সেই বিষয়টি উল্লেখ করা গেল।
২০১১ সালে পশ্চিমবাংলার বিধানসভা ভোটের অব্যবহিত পূর্বে বিশিষ্ট কবি জয় গোস্বামী ‘কংগ্রেস ও বাম শাসনে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক’ কলকাতার প্রেস ক্লাবে উদ্বোধন করেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী বিশেষ একটি সংখ্যার উদ্বোধন করেছিলেন, ‘নোবেল লরিয়েট’ অমর্ত্য সেন কলকাতার ‘তাজ বেঙ্গল’ হোটেলে ‘প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন। ভিন্ন সময়ে ‘গোর্কি সদন’-এ অমর্ত্য সেন এবং শঙ্খ ঘোষ ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা এবং প্রকাশিত বইপত্তর সাদরে গ্রহণ করেন। বিষয়বস্তু এবং প্রকাশনার মানের প্রশংসা করেন। ২০০৮ সালে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার উৎসব সংখ্যার প্রকাশ করেছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক এবং সাংবাদিক 'City of Joy'-এর নির্মাতা দমিনিক লাপিয়ের। ‘উদার আকাশ’-এর মোড়ক উন্মোচনে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কবীর সুমন, জয় গোস্বামী, ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি,  কল্যাণী কাজী, অমর মিত্র, সবিতেন্দ্রনাথ রায়, আবুল বাশার, সুবোধ সরকার, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মোস্তাক হোসেন, দেবাশিস পাঠক, সুরজিৎ দাশগুপ্ত প্রমুখ। ২০১৫-র ২৬ নভেম্বরে শহিদ মিনারে সংখ্যালঘুদের অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক জনসভায় বক্তা হিসাবে আমন্ত্রিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ সহ আরও অনেকেই। এই ঐতিহাসিক জনসভা মঞ্চে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার ‘উদার ভারত নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ শীর্ষক বিশেষ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 'মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়' গড়ে তুলতে ফারুক আহমেদ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বারংবার বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখার সময়ে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশিষ্ট আধিকারিক ডা. পি. বি. সালিম (আইএএস) ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা প্রকাশে যথেষ্ট উৎসাহিত করেন ফারুক আহমেদকে। ‘নন্দন’-এ উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি-গীতিকার গুলজার ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা হাতে পেয়ে, ভাষার ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও উচ্ছ্বসিত হন। সেদিন ‘নন্দন’-এ সন্দীপ রায় এবং শঙ্খ ঘোষ হাজির ছিলেন। 'উদার আকাশ' প্রকাশনের ‘দ্য সেকুলার ভিশন অফ কাজী নজরুল ইসলাম’ নামক ইংরেজি গ্রন্থটিও গুলজার সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। বিশ সাল বাদ অতীতের দিকে চোখ ফেরালে বোঝা যায়, এগুলোই উজ্জ্বল প্রাপ্তি, বলা যায় ‘টেজার’। সাধারণের এসব নাগালের বাইরে। 

ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে দু-এক কথা বলা যাক। ‘বাংলাদেশ’-এর অভিজাত জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’-র প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’-র কাউন্টারে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা ও প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ পৌঁছনোর পরেই পাঠকদের সংগ্রহের তালিকায় চলে যায়। ‘বিশ সাল’-এর মধ্যে এমন স্বীকৃতি শ্লাঘার বিষয় বই কী! ঢাকার সম্ভ্রান্ত কিতাবখানা বা মহল হচ্ছে ‘বাতিঘর’– সেখানেও ‘উদার আকাশ’ সাদরে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে।
আলোচনা শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল, বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে যে সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল যার প্রভাব ছিল গত শতকের চারের দশকের মধ্যবর্তী কাল পর্যন্ত এবং সেই 'Response to Change'-এর ব্যক্তিবর্গকেও পাঠক সজ্জনের সামনে পেশ করেছে ‘উদার আকাশ’ অনিঃশেষ শ্রদ্ধা আর সম্ভ্রমের সঙ্গে। মর্যাদা আরোপের ক্ষেত্রে যে অবিচার আর আকাল লক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে, তেমনতর সময়ে ফারুক আহমেদ সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’-এর এই সচেতন ভূমিকা প্রশংসার্হ।

‘উদার আকাশ’ (২০০২) এবং ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন (২০০৯) সামাজিক সমস্যা ও সংকট নিরসনের জন্য সর্বদা ক্রিয়াশীল। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সেমিনার এবং প্রেস কনফারেন্সেরও ব্যবস্থা করে। সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং উভয় বঙ্গে সমঝোতা আর সম্প্রীতি বিকাশের জন্য ‘উদার আকাশ’ ‘ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী উৎসব’-এর আয়োজন করে, দুই বাংলায় বিশেষ বার্তা দেয়। পত্রিকা এবং উদার আকাশ প্রকাশনের উদ্যোগে গৌরকিশোর ঘোষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। প্রারম্ভিক বৎসর ২০১৭-তে পুরস্কৃত হন প্রখ্যাত সঙ্গীতকার ও গায়ক কবীর সুমন। নারী জাগরণের অগ্রনায়িকা রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন স্মৃতি পুরস্কার (২০১২) অর্জন করেছিলেন রোকেয়া গবেষক মীরাতুন নাহার। ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা আর ‘উদার আকাশ’ প্রকাশনের এমন পরিশ্রমসাধ্য কাজের জন্য ফারুক আহমেদের সহধর্মিণী শ্রীময়ী মৌসুমী বিশ্বাস সহ-সম্পাদিকা হিসাবে নিরন্তর সহযোগিতা করে চলেছেন। এমন পারিবারিক সমর্থন ফারুক আহমেদের আত্মবিশ্বাসের উপাদান হয়ে উঠেছে। তাঁর একমাত্র কন্যা রাইসা নূর এই আদর্শ দম্পতির প্রেরণার মূল উৎস হিসাবে কাজ করছে হালফিল।
স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবাংলা অনগ্রসর সংখ্যালঘুদের আধুনিক শিক্ষা প্রসারে সমাজ কল্যাণে, স্বাস্থ্য পরিষেবায় অনন্য পথিকৃৎ, শিল্পোদ্যোগী, পতাকা হাউসের কর্ণধার মোস্তাক হোসেনকে ‘উদার আকাশ’ পত্রিকা ও উদার আকাশ প্রকাশনের পক্ষ থেকে ‘দানবীর’ পুরস্কার (১৪২৬) প্রদান করতে পেরে 'উদার আকাশ' পরিবার গর্বানুভব করে। অসহায় মানুষের সেবায় মোস্তাক হোসেন যে অবদান রেখেছেন তা আজ ইতিহাস। ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার ঈদ-শারদ উৎসব সংখ্যা (১৪২৬)-এর মোড়কও উন্মোচন করেছেন তিনি। ফারুক আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিশ্বপ্রেম’ উদ্বোধন করেছিলেন মোস্তাক হোসেন (২০১২)। ‘উদার আকাশ’ পত্রিকার শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে মোস্তাক হোসেনের কথা স্মরণে রাখে ‘উদার আকাশ’।
বস্তুত এশিয়ার অন্যতম বিশিষ্ট দার্শনিক আর পণ্ডিতপ্রবর অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর প্রতিষ্ঠিত অভিজাত ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার ‘লিগেসি’ আবদুর রাউফের ওপর বর্তিত হয়েছিল। জনাব আবদুর রাউফের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার কি যুবা ফারুক আহমেদের কাঁধে, প্রকৃতি ও সময় ন্যস্ত করে দিয়েছে? প্রখ্যাত সাহিত্যিক রশীদ আল-ফারুকি বলেছেন, সাহিত্য রুচি, সংস্কৃতির সঙ্গে প্রগতির সম্পর্ক খুবই গভীর। প্রত্যয় হয়, ‘উদার আকাশ’ অনাগত দু-দশকে প্রগতি নামক সড়কের প্রায় শেষ বিন্দু ছুঁয়ে ফেলবে। ‘উদার আকাশ’ সজ্জন পাঠকবর্গকে কুর্নিশ পেশ করছে। উদার আকাশ প্রকাশন, উদার জীবনের অন্বেষণ। উদার আকাশ কেবল পত্রিকা নয়, আত্মমর্যাদার অভিজ্ঞান। উদার আকাশ কেবল স্লোগান নয়, সুস্থ সমাজ গড়ার অঙ্গীকার। উদার আকাশ দিচ্ছে ডাক, ঘরে ঘরে সাহিত্যের আলো পৌঁছে যাক। বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে বিজয়গাঁথার আর এক নাম উদার আকাশ। ভারতের বিভেদকামী ও অশুভ শক্তির পতন সুনিশ্চিত করতে জেগে থাক উদার আকাশ।


Post a Comment

0 Comments