জ্বলদর্চি

ভীম ঠাকুর /অমর সাহা



ভীম ঠাকুর
            
অমর সাহা

ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড়, দহিজুড়ি, কাঁটাপাহাড়ি প্রভৃতি জায়গায় আবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিড়াকাটা, নিমতলা, হুমগড়, আমলাশুলি, গোয়ালতোড়, পিংবনি, রামগড়, জলহরি, দক্ষিণশোল, ভাদুতলা, গড়বেতা, চন্দ্রকোণারোড, ডুকি, বিষ্ণুপুর, আঁধার নয়ন, ঘাটাল, কেশপুর প্রভৃতি জায়গায় ভীমপুজো হয় ৷ পুজো হয় সার্বজনীন ৷ পারিবারিক পুজো হয় না ৷ ভীমপুজো উপলক্ষে বিষ্ণুপুর (শালবনি), ভাতমোড় (শালবনি)-এ মেলা বসে ৷ ভীমপুজো ব্রাহ্মণরা করে ৷ যাত্রাবিষ্ণুপুর, ভীমপুরে সাধারণ মানুষ ভীমপুজো করেন ৷ এখানে উপাসক ক্ষেতমজুর, বাগদি, ভূমিহীন মজুর ৷ মেদিনীপুর শহরে পঞ্চুর চকে ভীমপুজোর উপাসকরা সকলেই রিকশাচালক ৷

     মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে ভীমপুজো হয় ৷ এই একাদশী ভীম একাদশী বা ভৈম একাদশী নামে পরিচিত ৷ পুজো রাত্রিবেলা হয় এবং রাত্রিতেই এর নিরঞ্জন হয় ৷ পুজোর দিন ঢেঁকি চালনা বন্ধ থাকে ৷ এইদিন হলকর্ষণ, মুড়িভাজা, কাপড়কাচাও বন্ধ থাকে ৷ ভীম পুজোর উপাচার হিসেবে লাগে সিদ্ধ চাল আর রাঙা আলু ৷ ওইদিন কৃষিজীবী মানুষদের অনেকেই 'ভৈম একাদশী' পালন করে গোটা মুগ ও রাঙা আলু সিদ্ধ খেয়ে থাকে ৷ ভীম ক্ষেত্ররক্ষক দেবতারূপে পরিকল্পিত ৷ মাঘ-ফাল্গুনে চাষের জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন ৷ খনার বচনে আছে 'যদি বর্ষে মাঘের শেষ / ধন্যি রাজা পুণ্যি দেশ ৷' বৃষ্টি হলে অনুর্বর এলাকার মানুষ কৃষিকাজ শুরু করে মাসে ৷ ভীমপুজো সাধারণত মাঘ মাসে হয় কখনও কখনও ফাল্গুন মাসে ৷ ভীম মাঘ মাসেই কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন বলে এখানকার লোকজীবনের ধারণা ৷ ভীমপুজোর সময় বৃষ্টি হলে ফসল ভালো হয় ৷ সেজন্য এলাকাবাসীর লোকেরা ভীমের মূর্তি গড়ে পুজো করে ৷ ভীমের দৈর্ঘ্য ৮, ১০, ১২, ১৫ ফুট পর্যন্ত হয় ৷ যাত্রা বিষ্ণুপুরে ভীমের দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট আকৃতির ৷ এখানে প্রতি বছর ১৫ ফুটের ভীম তৈরি করা হয় ৷ ভীমের দীর্ঘাকৃতির সঙ্গে তার গদাটিও সেইভাবেই তেরি করা হয় ৷ ভীমের গায়ের রঙ লালচে খয়েরি হলুদাভা কালো হয় ৷ মহাভারতে চিহ্নিত ভীমের মতই সুঠাম সবল স্বাস্থ্যবান ভীম নির্মাণ করা হয় ৷ ভীমের দেহাকৃতির সঙ্গে তার মাথাটিও বড় হয় ৷ তার চওড়া কালো গোঁফ, মাথায় বাবরি চুল, পায়ে নাগরা জুতো ৷ কানে বড় বড় দুল, হাতে বালা, কটিদেশে গামছা শক্তপোক্ত করে বাঁধা ৷ ডান হাতে গদা ঘাড়ে নিয়ে বা মাটিতে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ৷
     
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
     মেদিনীপুর জেলার কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য (চক্রবর্তী)-এর 'শিবায়ন' কাব্যে দেখা যায় দারিদ্র থেকে পরিত্রান লাভের আশায় পার্বতীর পরামর্শে শিব ইন্দ্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত কৃষিজমিতে চাষবাসের জন্য রত হন তখন ভীম এ ব্যাপারে প্রধান সাহায্যকারী ৷ মেদিনীপুরের সঙ্গে ভীমের যোগের নানা বিষয় আছে ৷ শালবনি ব্লকে ভীমের নামে গ্রামনামও রয়েছে— ভীমপুর ৷ এই এলাকার ভীম সম্বন্ধীয় কিংবদন্তীও আছে ৷ গড়বেতা-১ নং ব্লকের বগড়ী কৃষ্ণনগরের কাছে একারিয়া গ্রামে পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাস করতেন ৷ এছাড়া একারিয়ার কাছে ভিকনগর গ্রামে পাণ্ডবরা ভিক্ষে করতেন ৷ গড়বেতা স্টেশন সংলগ্ন গনগনির ডাঙ্গাকে ভীম ও বকরাক্ষসের যুদ্ধক্ষেত্র বলা হয় ৷ খড়্গপুরের ইন্দা অঞ্চলে খড়্গেশ্বর মন্দির সংলগ্ন প্রান্তরটি 'হিড়িম্বা ডাঙ্গা' নামে পরিচিত ৷ এখানে ভীমের সঙ্গে হিড়িম্বার প্রথম যুদ্ধ হয়, পরে তার সঙ্গে বিবাহ সম্পন্ন হয় বলে কথিত ৷ মেদিনীপুর শহরেও 'ভীমতলা' নামে একটি জায়গার নামকরণ করা হয়েছে ৷ পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মহাভারতীয় ভীম সম্পর্কিত কাহিনির বিস্তার দেখা যায় ৷ 

     ভীমপুজো সম্পর্কে তুষার চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, "মোটের উপর পূর্বাপর নৃতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞানের আলোয় ভীমপূজার উদ্ভব ও বিকাশের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণে বোঝা যায়, মেদিনীপুর জেলায় ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত ভীমপূজা এক সার্বজনীন লোকায়ত উৎসব ৷ প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তরযুগ পর্যন্ত বিস্তৃত মেদিনীপুরের হারানো অতীতের অন্ধকারে তার আদিম উৎস হয়তো বিস্তৃত ৷ মেদিনীপুর জেলার ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক পটভূমিকায় 'ভীম কাল্টের' সামগ্রিক পর্যালোচনায় বলা যায়, যুগ পরিবেশের প্রভাবে মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডবের বা শিবের উপাখ্যানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেও এবং স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিকায় সম্মিলিত যুবশক্তির পূজা হিসেবে বিবর্তিত হলেও ভীম মূলত আদিম লৌকিক বিশ্বাস অনুষ্ঠানের উৎসে উদ্ভূত ও বিকশিত ৷ অশুভ শক্তি বিতাড়ক, ক্ষেত্র ও গ্রাম রক্ষক এবং উর্বরতাবাদ সংশ্লিষ্ট কৃষি সহায়ক লৌকিক দেবতা ৷" (চট্টোপাধ্যায়, তুষার, 'মেদিনীপুরের ভীমপূজা ও লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা', বিদ্যাসাগর স্মারক গ্রন্থ সম্পাদনা- খান, আজহারউদ্দীন ও চট্টোপাধ্যায়, উৎপল-বিদ্যাসাগর সারস্বত সমাজ, মেদিনীপুর ১৯৭৪, পৃষ্ঠা ৫৬১)      

Post a Comment

0 Comments