জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -১৩৪

জ্বলদর্চি ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা-১৩৪
সম্পাদকীয়,
আগে বিকেলবেলা আমরা পাড়ার লাইবেরীতে যেতাম বই পালটে নতুন বই নিতাম। এখন পাড়ার লাইব্রেরীগুলো প্রায় উঠে গেছে। সদস্য কমে গেছে কিনা। লাইব্রেরী মানেই তো আর শুধু একটা ঘর ভর্তি বই নয়। সেই বই পড়ার বন্ধু থাকতে হবে তো!  হ্যাঁ, বইবন্ধু। আমরা সকলেই এখন ফোনবন্ধু। তাই অনেক স্কুল গ্রীষ্মের ছুটিতে লাইব্রেরী নিয়ে প্রোজেক্ট করতে দিচ্ছে। প্রোজেক্ট মানে কিন্তু নেট দেখে টুকে দেওয়া নয়। প্রোজেক্ট মানে হাতে কলমে কাজ। এই নিয়ে একটা গল্প লিখে পাঠিয়েছে সব্যসাচী আঙ্কেল। স্কুলে স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হয়ে এল। কিন্তু গ্রীষ্মের দাবদাহ এখনো কাটেনি। মাঝে মাঝেই কালবৈশাখী হচ্ছে। তারই মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় নজরুল জয়ন্তী পালন হচ্ছে। এবারের সংখ্যায় তা নিয়ে লিখেছে দোলনচাঁপা আন্টি আর  কাজী নজরুলকে এঁকে পাঠিয়েছে অভিজিৎ ও জয়দীপ। তোমাদের বন্ধু রেনেসাঁ একটা ছোট্টি ছড়া লিখে পাঠিয়েছে। এবারের সংখ্যায় ছড়া লিখেছেন প্রতাপ আঙ্কেল। শ্রীকান্ত আঙ্কেলের উপন্যাসে গ্যাটসো, রামসি, সাঙ্গদের সঙ্গে তোমাদের আলাপ জমে গেছে তা আমি জানি। বাসবদত্তা আন্টি মহাবালেশ্বর বেড়াতে নিয়ে গিয়ে পশ্চিমঘাটের ইতিহাসের গল্প মনে করিয়ে দিয়েছে। মজার কথা লাইব্রেরী যাও কিংবা বেড়াতে, তা ক্ষণিকের অবসর। বাকি সময় আমাদের সকলকে নিজেদের কাজ করতে হবেই। নাহলে খাব কী? এই যেমন চাষীরা চাষ করে তবেই না আমরা ঘরে ঘরে ভাত রেঁধে খাই। এবারের  সংখ্যায় তেমন চাষীবন্ধুদের ছবি তুলে পাঠিয়েছে অপু দাদা। এই ছবি দেখে মনে হচ্ছে বর্ষা আর এলো বলে সেই আনন্দে নাচের ছবি উশিকার পেনে। এসো চাষ করি আনন্দে। - মৌসুমী ঘোষ।

ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
শ্রীকান্ত অধিকারী 
পর্ব ১৩

গ্যাটসোর কথা যে এমন হুবুহু মিলে যাবে এটা কেউই ভাবতে পারে নি। কারও মন ভালো নেই। বিশেষ করে বড়ো মামি আর ছোট দুটো ছেলে মেয়ের। বড়ো মামি তো বলেই দিল,-কী কুক্ষণেই যে এই নেপালিটাকে নিয়ে এলে, আর গাড়ি পেলে না? সবেতেই বিড়ালের মত আগে আগে কাটে। কত কষ্ট করে কোমরের যন্ত্রণাকে ঘরে রেখে দিয়ে নদী নালা পেরিয়ে এই পাহাড়ে এলাম, আর এখন দেখো ঘরে বসে বসে ঠাণ্ডাতে কাঁপো। 
রামসির মা অবশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়,-বৌদি, ও নেপালি নয় লেপচা। সিকিমের আদি বাসিন্দা। 
সেই ভোর থেকে রামসি আর শিঙি মুখ ছোট করে বসে আছে। সারাক্ষণ মাথায় হনু টুপি আর হাতে পায়ে মোজা পরে অদূরে টানা বৃষ্টির ঝাপসা-পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে কার ভাল্লাগে। শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টি। অঝোরে বৃষ্টি। পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে হর হর করে বন্যার মত জল ছুটে নীচে নামছে। তার বিকট হুঙ্কারে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। 
 হাড়কাঁপা ঠান্ডায় ওরা সকালের সব কাজ সেরে ব্রেকফাস্টের জন্য তৈরি,এবার বেরিয়ে পড়বে ইয়ুম্থাঙের উদ্দেশে।ওরা প্রায় রেডি। তখনই সাঙ্গ লেপচা চায়ের সঙ্গে সেই মারাত্মক খবরটা দিয়ে যায়। প্রায় এক কিলোমিটার আগে যেখানে মিলিটারি ক্যাম্প রয়েছে ঠিক তারপরেই পাথুরে রাস্তায় ধ্বস নেমেছে।
এইটুকু খবরেই বিষাদের ঘনঘটা গোটা পরিবারে নেমে আসতে দেরি করে না। এই 
খবরের সত্যাসত্য নিয়ে রামসির বাবা, বড়ো মামা এবং ছোট মামা যখন ব্যস্ত তখন গ্যাটসো ওদের শেষ আশায় জল ঢেলে দেয়,-রাস্তা বনধ। গাড়ি একদম নেহি চল রাহা হ্যায়। চলাচল আজকে ভি হোংগে ইয়া নেহি হোংগে আভি কাহা নেহি যা সকতা, লেকিন ফৌজিলোগ কাম পে লাগে হুয়ে হ্যায়। জলদি হি কুছ হোগা। 
-জলদিহি মতলব? রামসির বাবা বলে। 
-লগভগ এক দিন লাগ যায়েগা। তব তক– 
-তব তক? 
-ইধার উধার সাইট সিন কর সকতে হৈ। 
আর কোনো কথা নেই। সব শেষ! টানা বৃষ্টি হলেও গাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলে চিন্তা থাকে না। 
কিন্তু ধ্বস মানে তো সারা দিন ঘর বন্দি হয়ে থাকা। 
 পাহাড়ি রাস্তায় ধ্বস নামা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ভাগ্য ভালো যে রাস্তায় যেতে যেতে হয় নি। নইলে গোটা দিনটাই মাটি হয়ে যেত। 
 হোমের বৃদ্ধা মালকিন দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। তাদেরও যেন ব্যাপারটা ভালো লাগে না। তারাও চায় ‘কুছ দিনের মেহমান’রা খুশিতে থাক। তবে না আবার কেউ না কেউ ওদের সুইট হোমে স্টে করবে। বিষণ্ণ মনে বলে,-এক কাম কিজিয়ে, মনাস্ট্রি দেখ সকতে হৈ। সাথ মে আপেল বাগান। আভি কুছ আপেল সাপেল পের মে হোগা। যাইয়ে। বলার সময় বৃদ্ধা মহিলার কোঁচকানো চামড়ার মাঝে চোখগুলো চক চক করে উঠছিল। যেন সে বোঝাতে পেরেছে, না না তোমাদের সময় নষ্ট হবে না। 
  দেখা গেল এই পরামর্শ রামসিদের প্রত্যেকের ভালো লেগেছে।অন্তত এই অপশনটা নেওয়া যেতেই পারে। এই সুযোগে গ্যাটসো বোঝাতে শুরু করে ফাকা রোডের বাইপাশ দিয়ে গেলে ঝামেলা কম।আর মাঝে মাঝে সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে পা রেখে আশপাশের অপূর্ব সিনারি প্রত্যেক ট্যুরিস্টদের মন কেড়ে নেয়। ওদেরও মন খারাপ করবে না। সেপ্টেম্বর অক্টোবরেও আপেল থাকে। গাছ থেকে আপেল পেরে খাওয়ার মজায় আলাদা। সে ব্যবস্থা গ্যাটসো করে দেবে।কথা শেষ করেই বড়ো মামির দিকে তাকায়। হয়তো বুঝে গেছে এই সব পরিকল্পনার পারমিশন দেওয়ার মালিক একমাত্র ওই বয়স্ক মহিলা। 
ইতোমধ্যে  শিঙি পাশের রুম থেকে ঘুরে এসে জানায় বিটলেদের ঘরে তালা দেওয়া। কাল থেকে বেচারি মেয়েটা জুলজুল করে তাকিয়েই ছিল, কোনো কথা হয় নি। শিঙি ভেবেছিল আজ না হয় গাড়িতে এসে ক্লান্ত হয়ে গেছে, কাল ঠিক ওর সঙ্গে খেলবে।কিন্তু আজ এখনও পাত্তা নেই। 
ছোট মামা রামসির দিকে তাকায়।রামসির মুখটা তখন দেখার মত।ভয়ে চুপসে। গতকালের সাপের ভয়টা সে ভুলেই গেছিল।কিন্তু আজ শিঙির কথাতে সেই ভয়টা আবার জমিয়ে  আসে।কাল আর ওই সাপের ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথা হয় নি।শুধু ছোট মামা বলেছিল,ডাংগুলি খেলেছিস কখনো? গুলিটাকে তুলে ডাঙের বাড়ি মারতে হয় গায়ের জোরে। তবেই বহুদূরে পাঠাতে পারবি। কনফিডেন্স দরকার বুঝলি। ওই ছোট ছোট ভয় বিপদগুলো হল গুলি। আর তোর হাতে সব সময় আছে ডাঙ।মানে কনফিডেন্স। ব্যস! মার বাড়ি। গাঁয়ের সেই হ্যাফপ্যান্ট পরা ছেলেগুলো দেখিস নি। কেমন কনফিডেন্সের সঙ্গে ডাঙের বাড়ি মারে।  
-কিন্তু ছোটমামা, বড়ো মামা বা বাবা কেউ জানল না। 
ছোট মামা হাসে। বলে,-নাই বা জানল। কী দরকার সব কিছু বলার। কিন্তু কিছুতেই সেই লোকটার মুখ যেন চোখের সামনে থেকে সরাতে পারে না রামসি। সঙ্গে সেই অস্ত্র! 
ছোট মামা অস্ত্রটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতেই গ্যাটসো চিৎকার করে ওঠে,-সাব! 
বেশ আশ্চর্য হয়ে ছোটমামা বলে, কী এটা? 
গ্যাটসো বলে,-বানপোক। 
ছোটমামাকেও দেখা গেল না গতকালের ঘটনার সেই বাংলাদেশি লোকটার প্রসঙ্গ তুলে কিছু বলতে। উলটে বেশ অবাকই লাগল গ্যাটসোর সঙ্গে ছোটমামার হৃদ্যতার বহর দেখে। গ্যাটসোর কাঁধে হাত রেখে এবং পিঠ চাপড়ে বলে, চলো গ্যাটসো এবার বেরিয়ে যাই। দেখে আসি ভগবান তথাগতের মনাস্ট্রি। 
--বৃষ্টি তাঁরই সৃষ্টি, 
গ্যাটসো-রামসি সঙ্গে আছে 
করবে আমার কি! 
বলেই দু’হাত তুলে প্রাণভরে বলে,-জয় জয় শাক্যমুনি, জয় জয় মহাশ্রমণ, জয় জয় অর্কূচ! ‘আমি অর্হত্ত্ব চাই না,নির্বাণ চাই না,-একবার তোমার স্বরূপ আমাকে দেখাও। যে দেহে তুমি এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে সেই দেব-দেহ আমাকে দেখাও!’ 
ঝমঝমে বৃষ্টি এখন ধরে এসেছে। বাইরের রাস্তা ঘাট ঘর বাড়ি গাছ পাথর এখন ধোয়া, ঝকঝকে। শুধু সুর্যের কিরণ স্পর্শের অপেক্ষা। 
ওরা বাইরে পা দিয়েছে। দেখে সামনের জমিতে দাঁড়িয়ে সাঙ্গ। হাসি মুখে বলে, হাম ভি যায়েঙ্গে। 
(ক্রমশ)

অভিজিৎ ভঞ্জ
শ্রেনী:- নবম। জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর‌।

রাত পাহারা 
রেনেসাঁ গঙ্গোপাধ্যায় 
নবম শ্রেণি, সেক্রেড হার্ট স্কুল,আদ্রা, পুরুলিয়া


বাঁশবনে আজ চাঁদ ওঠেনি
জোনাক জ্বলা আলো 
এর ভেতরে গা ছমছম, 
বিদ্যুৎ চমাকালো। 

দূরে ওটা কে  দাঁড়িয়ে? 
যায় না তো মুখ দেখা 
কেউ কোথা নেই রাত পাহারায়
কাকতাড়ুয়া একা।
জয়দীপ সাহা
সপ্তম শ্রেণি, সোদপুর হাই স্কুল, উত্তর ২৪ পরগণা

ইচ্ছেধারা
সব্যসাচী ধর

তথাগতস্যার ক্লাসে এসে  সব ছেলেমেয়েদের মুখগুলো এবং  জানলার ওপাশের গাছগুলোকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। স্কুলের চারপাশে এখনো অনেক পুরনো গাছ আছে এই গ্রামীন স্কুলে।গুমোট আবহাওয়ায় গাছগুলো যেন স্থির  হয়ে  দাঁড়িয়ে আছে, একটি পাতাও নড়ছে না। ক্লাসের ভিতরেও সবাই যেন  কেমন থম মেরে বসে আছে। তবে জহুরীর চোখে বুঝতে পারলেন সবরকমের মণিমানিক্যই  বর্তমান,  ঝিকমিক করে ওঠাটা শুধুমাত্র  সময়ের অপেক্ষা ! তথাগতস্যার  কিছুক্ষণ চুপ করে বসে পরিবেশটাকে বুঝে নিতে চাইলেন। 
             হেডস্যার জপনারায়নবাবু গতকালই  প্রেয়ারলাইনে বলে দিয়েছিলেন --"নতুন একজন স্যার আসছেন আমাদের স্কুলে। শুনেছি খুব পণ্ডিত মানুষ, লেখালেখিও  করেন নানা পত্রিকায়। তোমরা
এমন কোনো আচরণ করবে না, যাতে নতুন স্যারের খারাপ লাগে এবং আমাদের স্কুলের সম্মান নষ্ট হয়।"
        সেই নতুন স্যার তথাগত আচার্য স্কুলে জয়েন করেই প্রথম ক্লাস নিতে এসেছেন ক্লাস  ফাইভে। হেডস্যার বলেছিলেন --"এই তো এলেন তথাগতবাবু, আপনার তো রুটিনও করা হয়নি। ওটা করতে দু একদিন সময় লাগবে। তার মাঝে আপনি ইলেভেন টুয়েল্ভের দু একটা প্রভিশনাল ক্লাস নেবেন কেমন?" 
       বয়স্ক প্রধানশিক্ষক জপনারায়নবাবুকে মধ্য তিরিশের তথাগত বলেছিলেন-- "আমাকে আবার 'আপনি' সম্বোধন কেন স্যার --' তুমি' বলবেন । আর ফাইনাল রুটিনে আমাকে উঁচু ক্লাসে তো রাখবেনই, তবে কয়েকটা ফাইভ সিক্সের  ক্লাস দিলে বেশ ভালো হয়। একটু দেখবেন। আর আজকে যদি সেরকম হয় তো  ভালোই হয়। "
  তথাগত স্যারের কথা শুনে হেডস্যার খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন-- "বেশ তাই হবে ভাই। আজ তো সুবিনয় স্যার আসেননি। ওর বাড়িতে হঠাৎ একটা সমস্যা হয়েছে। তুমি তাহলে আজকে ওর ক্লাসগুলোই করে নাও।" 
  সেইমতো  সুবিনয়বাবুর ফাইভের ক্লাসে তথাগত স্যারের আসা। আজও অবশ্য হেডস্যার প্রেয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে  সকলের উদ্দেশ্যে নতুন স্যারের দিকে তাকিয়ে বলেছেন-- "গতকাল তোমাদেরকে  বলেছিলাম, আমাদের স্কুলে একজন শিক্ষক মহাশয় যোগদান করবেন -- ইনিই সেই নতুন শিক্ষক তথাগত আচার্য। আমাদের ইংরেজির শিক্ষিকা মন্দিরাদির জায়গায় এই স্যার এলেন। তোমাদের নিজ নিজ ক্লাসে এই স্যার যখন যাবেন উনাকে প্রণাম করবে। স্যারের কথা শুনবে, ভালো করে পড়াশুনা করবে। আর একটা কথা বলি, উনি কিন্তু একজন সাহিত্যিকও --  বহু পত্র-পত্রিকায়  লেখেন। তথাগতবাবুর  লেখা কয়েকটি বই আমি পড়েছি। ফলে সাহিত্যের বেশ কিছু জিনিস তোমরা এই স্যারের কাছে থেকে সরাসরি জানতে পারবে।"

    হেডস্যারের কথামতো  ক্লাস ফাইভে প্রবেশ করা মাত্রই হুড়োহুড়ি করে সবাই নতুন স্যারকে প্রণাম করেছে। --- " আরে থাক থাক, সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসো"--বললেও কেউ প্রণাম না করে নিজের জায়গায় ফেরেনি। কিন্তু ক্লাসে 'স্পিকটি নট' অবস্থা। সব ছেলেমেয়েরা কেমন যেন ঘাবড়ে আছে। আসলে স্যার যে একজন লেখক এবং উনার লেখা অনেক বই আছে -- এটাই বোধহয়  কেমন যেন আড়ষ্টতার সৃষ্টি করেছে এই  ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে। 
  থমকে যাওয়া পরিবেশকে লঘু করতে চেয়ে স্যার বললেন-- "একদিক থেকে পরপর নিজের নাম, 
আর কোথায় বাড়ি বলো। তোমাদের নাম গুলো আগে জানি, তবেই না!"
   নাম পর্বে একটা সুবিধা হলো--নাম বলার সঙ্গে
সঙ্গে সবার ভিতরে জমে থাকা নীরবতার কপাটটা খুলে গেল। 
     অনন্ত তো জিজ্ঞাসা করেই ফেলে-- "স্যার আপনার বাড়ি কোথায়?" জয়ন্তী বলে --"স্যার আপনি আমাদের বাংলা পড়াবেন?" বসুধা অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে -  "স্যার আপনি গল্প লেখেন? গল্প কী করে লিখতে হয় স্যার? "
     তথাগত স্যার এবার এক এক করে বলেন-- "আমার বাড়ি শান্তিপুর। তোমাদের আজকে পড়াবো না। আজকে শুধু কথা বলি তোমাদের সঙ্গে।"  তারপর বসুধার দিকে তাকিয়ে বললেন--
" গল্প লিখি তো। গল্প লেখা? সে বড় সহজ কাজ। শুধু কাগজ কলম নিয়ে শুরু করলেই হলো। দেখবে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে কী জানো? গাছ লাগাতে গেলে যেমন মাটি তৈরি করতে হয়, বীজ বা চারা রোপণ করতে হয়  তেমনি লিখতে গেলেও একটু প্রস্তুতির দরকার পড়ে । চোখ কান মন-- তিনটেই খোলা রেখে লেখার জমি তৈরি করতে হয়।  আর এর জন্য বই পড়তে হবে জানো তো। নানা রকম বই, পত্র পত্রিকা, যা পাবে পড়বে। আর চারপাশকে কত কী ঘটছে সেগুলোও ভালো করে
দেখতে হবে।"
                             -----------

   -- " একটা লাইব্রেরী আছে জানেন। আছে বলাটা ঠিক হবে না, ছিল একসময়। লাইব্রেরীয়ান দিবাকর সরকার রিটায়ার্ড করেছেন তা প্রায় আট বছর হলো। তারপর তো রিক্রুটমেন্ট হয়নি ।  সেই যে বন্ধ হলো ঘরটা আর খোলা হয়নি। মাঝে দু একজন স্যারকে বলেছিলাম একটু যদি দায়িত্ব নিয়ে কাজটা চালিয়ে দেন,  সপ্তাহে একদিনও যদি খোলেন, তাহলে বইগুলোতে একটু হাওয়া বাতাস লাগে।
 কিন্তু মুশকিল কী জানেন,  সবার হাতেই এখন একটা করে বড়  মোবাইল ফোন । ওতেই খবরের কাগজ, ওতেই বইপত্তর, ওতেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড!" -- হেডস্যার  এতক্ষণ কথাগুলো বলছিলেন  কারন তথাগত টিফিন পিরিয়ডে হেডস্যারের কাছে এসে
কিছু কাগজপত্তরে সই করতে করতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন--"এই স্কুলে লাইব্রেরী নেই স্যার? "
    হেডস্যারের কথায়  লাইব্রেরীর সব ব্যপারটা 
পরিস্কার হয়ে গেছিল তথাগতর। 
 --"স্যার, আমাকে চাবিটা দেওয়া যাবে?"
--"দেওয়া যাবেনা কেন ভাই ? এ তো বড় ভালো প্রস্তাব। কিন্তু সে ঘরের যা অবস্থা।"... 
 তারপর দুটো বড় বড় চাবি তথাগতর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। 
   পরেরদিন উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছেলেমেয়েকে
নিয়ে তথাগতস্যার যখন লাইব্রেরীতে ঢুকলেন তখন সত্যিই সেটা ধূলামন্দিরে পর্যবসিত হয়েছে। কোথায় যে কী আছে বোঝা যায় না। মাকড়সার জাল, আরশোলা টিকিটিকি লাফ দিয়ে এসে গায়ে পড়ে। তবে দিনকয়েকের পরিশ্রমে পাগলাদাশু ,মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ডেভিড কপারফিল্ড, আঙ্কেল টমস্ কেবিন সকলে যেন স্নান সেরে ঝকঝক করে উঠলো। 
  এখন লাইব্রেরী খোলে নিয়মিত। তথাগত স্যার লাইব্রেরীতে  উপস্থিত ছেলেমেয়েদেরকে বললেন --"এবার ওদের মুক্তি দিতে হবে।"
-- "বইয়ের মুক্তি ? সেটা কি করে স্যার? মুক্তি মানে তো উড়তে দেওয়া,স্বাধীনতা! বইগুলো তা কি পারবে?"--ক্লাস ইলেভেনের ঈশানী জিজ্ঞাসা করে। 
  একটু চুপ করে থেকে স্যার বললেন ,--"কথাটা একটু কঠিন তোমাদের জন্য, তবুও বলি। ধরো, একটা ভাবনা এলো  আমাদের মাথায়। চট করে সেটা লিখে ফেললাম  খাতাতে । তারপর ধরো ছাপার কালিতে বইয়ে স্থান করে নিলো লেখাটা। আপেক্ষিক ভাবে সেটা মাথা থেকে মুক্ত হলো। কিন্তু আবার বদ্ধ হয়ে গেলো গ্রন্থের মধ্যে। ভাবনাটা জাস্ট মাথা থেকে বের হয়ে বইয়ে ঢুকে গেলো। কিন্তু লেখকের চিরন্তন মুক্তি ঘটলো না। আসলে কী জানো? লেখকের নিজস্ব  মুক্তি হলেও চিরন্তন মুক্তি  নেই । কালিতে অক্ষরে তিনি বদ্ধ হয়ে থাকেন গ্রন্থের ভিতরে নানাভাবে বিন্যস্ত হয়ে ।"  
    লাইব্রেরীতে স্যারের পাশে থাকা ওরা সকলে হাঁ করে কথাগুলো শুনছিল-- টুয়েল্ভের তড়িৎ  জিজ্ঞাসা করে,-- "তাহলে মুক্তি কোথায় স্যার? কোনভাবেই কি মুক্তি নেই? 
  -- "অবশ্যই আছে। অবশ্যই আছে। গানের স্বরলিপি যখন খাতা থেকে বাদ্যযন্ত্রে প্রয়োগ করা হয়  তখন তাতে যেমন সুর এসে যায় আর স্বরের সংযোগে গান হয়ে ওঠে তেমনি লেখকের মুক্তি আছে শুধুমাত্র একটা জায়গাতেই । সেই মুক্তির জায়গা হলো একমাত্র পাঠক। পাঠকের আনন্দে লেখকের মুক্তি।"
সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন-- যা কিছু আনন্দ আছে দৃশ্য গন্ধ গানে / আমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।"
 -- "তাহলে স্যার আমরা কী করবো? " --ক্লাস টেনের
আশরফী জিজ্ঞাসা করে।
  --"বই পড়বে। ক্লাসের নির্দিষ্ট বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেখানে যতটা পারা যায় অন্য বই পড়বে। তাহলেই লেখক মুক্তি পাবেন। লেখকের জ্ঞান তোমাদের মধ্যে দিয়েই প্রসারিত হয়ে যাবে, বিস্ফারিত হয়ে উঠবে।"
 
   দিনকয়েক পরেই টিফিনের সময়  সহকর্মীদের সঙ্গে বসে  গল্প করতে করতে তথাগতস্যার  একটা ভালো প্রস্তাব দেন সবার দিকে তাকিয়ে । সকলেরই মনে হয় প্রস্তাবটা খারাপ নয় তো ! হেডস্যার জপনারায়নবাবুকে ডেকে এনে শোনানো হয় নতুন
প্রস্তাবের কথা । বৈঠক করে সে প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। প্রস্তাবটি হলো -- সারাবছরে নানান প্রজেক্ট দেওয়া হয় এখন স্কুলে। এবার তার সঙ্গে যোগ হবে সব ক্লাসের স্টুডেন্টদের  লাইব্রেরীর বই পড়া ও  বইটি সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করা। শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রতিটি ক্লাসের সেরা তিনটি প্রজেক্টের জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে ছাত্রছাত্রীদের। অন্য কিছু নয়, পুরস্কার দেওয়া হবে নতুন বই ।লাইব্রেরীর বই দেওয়া নেওয়ার কাজটি তথাগত স্যার নিজেই করবেন।  

    আশ্চর্যজনকভাবে স্কুল লাইব্রেরীর ধূলিধূসরিত কক্ষটি কিছুদিনের মধ্যেই ঝকঝক করতে থাকে। 
এক এক করে মাষ্টারমশায়রাও সেখানে এসে বসেন। 
অবসর পেলেই মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকার
যে কালচার তৈরি হয়েছিল তা কিছুটা কমে আসে
বিদ্যালয়ের অফিস ঘরে। 
      বিরূপাক্ষ স্যার একদিন তথাগতকে বলেন,-- "কতদিন হলো স্কুল ম্যাগাজিন বের হয় না। আমাদের একটা ম্যাগাজিন ছিল জানো তথাগত।  নাম ছিল  'ইচ্ছেধারা'। আবার ওটা চালু করা যায় না? 
   দিনকয়েক পরেই  কাজ শুরু হয়ে যায় ম্যাগাজিনের। কত লেখা জমা পড়তে থাকে। সবই যে ভালো লেখা তা নয়। যেগুলো খুব কাঁচা তথাগত স্যার ভুল ধরিয়ে দিয়ে আবার লিখতে বলেন। 
      প্রায় দশটা মাস কেটে গেছে। বর্ষার বৃষ্টিধারায় নতুন ঘাস গজিয়ে সবুজ হয়ে উঠেছে স্কুল কম্পাউন্ডের বিশাল মাঠ। শাল শিমুল কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো নতুন পাতাতে ভরে উঠেছে। স্কুলের  বাঁধানো স্টেজের সামনে ত্রিপল টাঙিয়ে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে সেই সবুজ কম্পাউন্ডেই । মাইকে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত। এবারে একটু বড় আয়োজন করেছেন হেডস্যার। হলঘরেই প্রতিবার শিক্ষক দিবসের  অনুষ্ঠান হয় । অনেকদিন পর এবারে এই দিনেই প্রকাশ পাবে স্কুলের ম্যাগাজিন 'ইচ্ছেধারা'। 
সেরা লাইব্রেরী প্রজেক্টের জন্য পুরস্কার পাবে সব ক্লাসের তিনজন করে ছাত্রছাত্রী। 

   সুন্দর একটা অনুষ্ঠান হয়। একেবারেশেষের দিকে তথাগতস্যার কিছু কথা বলার জন্য মাইকের সামনে আসেন। সকলকে নমস্কার জানিয়ে বলেন--" আমার ব্যাপারটা একমাত্র হেডস্যারকে জানিয়েছিলাম, এজন্যই বোধহয় উনি এত আয়োজন করেছেন। এতবড় মণ্ডপ, মাইক, বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ। 
 বলতে খারাপ লাগছে তবু বলতেই হবে। আমি চলে যাচ্ছি এখান থেকে। একটা কলেজে চাকরি পেয়ে গেছি আমি। এখান থেকে মুক্ত হয়ে গেলাম।"
    সকলে অবাক হয়ে ওঠে। কান্নার রোল ওঠে সমবেত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে।   হঠাৎ ক্লাস টুয়েল্ভের তড়িৎ উঠে দাঁড়িয়ে তথাগত স্যারকে জিজ্ঞাসা করে -- "আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন স্যার? স্যার মুক্তি সম্বন্ধে একদিন কি সুন্দর বলেছিলেন! মুক্তি কাকে বলে?
   তথাগতবাবু বলেন -- "এই যে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে তোমরা চলে যাবে স্কুল ছেড়ে। ওতে কী আমাদের কষ্ট হয় না? তোমাদের ওই চলে যাওয়া কি মুক্তি? 
 আসলে কি জানো? আমাদের জীবন মানেই এগিয়ে যাওয়া। আমরা সবাই শুধু এগিয়ে যাচ্ছি প্রতি পলে পলে। আমি অপেক্ষা করবো তো তোমাদের জন্য। তোমরা এবার পাশ করে কলেজে যাবে তো। ওখানে 
আবার দেখা হবে তোমাদের মতো প্রবহমান 
মুক্তমনাদের জন্য। আচ্ছা ভাবো তো সেই কবে ভগবান তথাগত একদিন সব ছেড়ে চলে গেলেন না? তারপর চৈতন্যদেব? স্বামী বিবেকানন্দ? এগুলো কিন্তু  চলে যাওয়া নয়। বৃহত্তর মুক্তি। শিক্ষার মুক্তি। 
     অনুষ্ঠান শেষ হয়। সকলে  নির্বাক হয়ে গেছে । হাতে হাতে নতুন 'ইচ্ছেধারা'। তার ভিতরের পাতায় কারো কারো চোখ কান মন ছাপার কালিতে স্থায়ী হয়ে বসে আছে। সামনের পাতায় সুন্দর প্রচ্ছদে ইচ্ছেধারার নীচে সবুজ কালিতে লেখা -- সম্পাদক-- তথাগত আচার্য।

ধারাবাহিক ভ্রমণ
মহাবালেশ্বরের পথে
বাসবদত্তা কদম

(চতুর্থ পর্ব) এলিফ্যান্ট পয়েন্ট কে প্রাণভরে দেখে, ছবি তুলে হাঁটা লাগালাম ড্রাইভার দাদার সঙ্গে। সে’ই আমাদের গাইড এবং চালক। এখান থেকে দশমিনিট হাঁটলেই কেট পয়েন্ট। এখান থেকে দেখা যায় কৃষ্ণা নদীকে। পাহাড়ের বুকের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে কৃষ্ণা নদী। ওপর থেকে দেখা যায় নদীর একটি বাঁধ আর নদী। এখানকার দৃশ্যও খুব সুন্দর।   
সেই প্রাচীন কাল থেকে, হয়ত বা কয়েক লক্ষ বছর ধরে, হয়ত বা তারও বেশি দিন ধরে এমন অপূর্ব সাজে সেজে পশ্চিমঘাটের সহায়দ্রি রেঞ্জ দাঁড়িয়ে আছে।
অজস্র বার তার মালিকানা বদল হয়েছে। কখনো রাজা যাদবেরা। কখনো বিজাপুরের আদিলসাহি সুলসানত। কখনো মারাঠা রাজ শিবাজি। কখনো ব্রিটিশ। কালের নিয়মে শাসক পালটায়, এক্ষেত্রেও পালটেছে বার বার কিন্তু সব শাসকই বার বার এইসব পাহাড়ের রূপে মুগ্ধ হয়েছেন।
ব্রিটিশ আমলে এ পাহাড় ছিল বম্বে প্রেসিডেন্সির সব বড় কত্তাদের গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল।  ঠিক যেমন আমাদের বাংলার বেলায় দার্জ্জিলিং ছিল একসময়।
দেখার জায়গাগুলোর নামও সব কিরকম সাহেব। সাহেব। সেই যে তারা গরমকালে বম্বে ছেড়ে মহাবালেশ্বরে এসে থাকতেন; নামগুলোও হয়েছে সব তাদেরই পছন্দমতো।
এলফিনস্টোন ছিলেন বম্বের তখনকার গভর্নর। তাই তাঁর নামে মহাবালেশ্বরের পাহাড়ের নাম আবার বম্বে শহরের স্টেশনের নাম। এসব নাম দেখে বোঝাই যায় এগুলো শাসককে খুশি করার চেষ্টায় দেওয়া হয়েছে। আর নাম একবার মানুষের মুখে বসে গেলে তাকে পালটানো খুব কঠিন। তাই বোধহয় নামগুলো স্বাধীনতার এত বছর পরেও একই রয়ে গেছে।
এরপর গেলাম কৃষ্ণাবাই মন্দিরে। এই মন্দিরটি মহাবালেশ্বরের সব থেকে প্রাচীন মন্দির। কালো পাথরের তৈরি। মন্দিরের একটি কুন্ডে অতি ধীর ধারায় জল এসে পড়ছে পাহাড়ের কোন গভীর থেকে। মনে করা হয় এই কুন্ডটির থেকেই কৃষ্ণা নদীর উৎপত্তি। মন্দিরের মধ্যে শিব এবং দেবী কৃষ্ণার মূর্তি রয়েছে। এই মন্দিরটি একটি হেরিটেজ সাইট। স্থানীয় লোকেদের কথা অনুযায়ী মন্দিরটি পান্ডবদের আমলে তৈরি। সে কথার সত্যতা জানা নেই তবে মন্দিরটি খুব প্রাচীন তা বোঝা যায়। এই মন্দিরের খুব কাছেই গোকর্ণ মন্দির। এটিও অত্যন্ত প্রাচীন শিবের মন্দির।
মহাবালেশ্বর, চিত্রগ্রাহক - বাসবদত্তা

এরকমই ঘুরতে ঘুরতে ড্রাইভার দাদা দেখালেন বম্বের কিছু বিখ্যাত মানুষদের বাড়ি। বম্বে শহরের কোলাহলের বাইরে পাহাড়ে নির্জনতায় ঘেরা সে সব বাড়িঘর।  
ঘুরে দেখতে দেখতে খিদে তো পায়। এত ঘুরেও খিদে পাবেনা তা কি হয়? আর ঘুরতে গেলে বেশি খিদে পায় এ তো সবাই জানে। ড্রাইভার দাদাকে বলা হলো একখানা ব্রেক দিন আমাদের। পেটে কিছু পড়ুক। আবার চললো গাড়ি। বেশ খানিক গিয়ে এক জায়গায় ঘ্যাঁচ করে থামলো। 
কথা ভদ্রলোক বড়ই কম বলেন। হাতের ইশারায় দেখালেন রেস্টুরেন্ট আর সঙ্গে স্ট্রবেরি ফার্ম। বললেন এখানে স্যান্ডুইচ আর স্ট্রবেরি শেক খুব ভালো।
-মন চা, চা করছে আর খাবো শেক! 
আহা! আহা! স্যান্ডুইচ খানার কি অপূর্ব সোয়াদ! চোখ বুঁজেই বললাম শেকটাও বলেই দাও।
আওয়াজ এলো, -চা বলতে বললে যে?
-পয়ে...। মুখে স্যান্ডুইচ তো; আমি কি করব? অমন আওয়াজই বের হলো।
এলো শেক। কেমন খেলাম? বলবো না। সব কি বলে দিলে চলে? 
এরপর সেই রেস্তোঁরার স্ট্রবেরির বাগানে নিয়ে গেলে তারা। 
লাইন দিয়ে গাছ আর স্ট্রবেরি ঝুলছে। কেউ টুকটুকে লাল। কেউ সবুজ। কেউ বা আধা সবুজ, আধা হাল্কা লাল। দেখেই মনে হচ্ছে পেড়ে নি। কিন্তু না। যাবে না পাড়া। নিষেধ আছে। দেখ। ফটো তোলো যত ইচ্ছে কিন্তু ছুঁতে পারবে না। কোনো মানে হয়!
( ক্রমশ)

ঝামেলায় যেও না
প্রতাপ সিংহ  কলকাতা 

তুমি বাপু ঝামেলাতে যেও না 
রাস্তায় মারধর খেও না।
দিনকাল একদম ভালো নয়,
মনের শান্তি হবে নয়ছয়। 
অনর্থ বেধে যাবে লহমায়, 
তখন তোমার প্রাণ যায়-যায়।
অশ্রাব্য গালাগাল, কিল-চড়,
পড়বে সমানে ঘুষি, থাপ্পড় 
অনুরোধ, অনুনয়, নিষ্ফল, 
সরবে না গুন্ডার দলবল। 
পাবে না এখন তুমি রক্ষে
ভুলে যাও সম্প্রীতি সখ্যে।
ওরা তো ভদ্রবেশী জানোয়ার, 
গাড়িবাড়ি ভেঙে করে ছারখার। 
তাই বলি ঝামেলায় যেও না 
অকারণ মারধর খেও না।
স্মরণীয় দিবস
নজরুল জন্মজয়ন্তী (২৪ শে মে)
কলমে দোলনচাঁপা তেওয়ারী

সাম্য, বিদ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল আজকের দিন অর্থাৎ ২৪ শে মে জন্মগ্রহণ করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর  আবির্ভাব একেবারে উল্কার মত। বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাবের মুহূর্তেই যেন সমস্ত আকাশকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সংগীত বিশেষজ্ঞদের মতে রবীন্দ্র পরবর্তী নজরুলের গান অনেকটাই ভিন্ন ধরনের, অধিকাংশ গানই রাগ-প্রধান।বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সংগীত কার ছিলেন তিনি। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে, তাঁর সৃষ্টির প্রাচুর্য দেখলে অবাক হতে হয়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করলেও তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তিনি অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ- ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান হওয়ায়, শৈশবে তিনি ইসলামীয় শিক্ষায় দীক্ষিত হলেও বড় হয়েছিলেন এক ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তাঁর মধ্যে বিকশিত হয়েছিল এক প্রতিবাদী সত্তা।
১৯২২ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাজদ্রোহীতার কারণে কারাবন্দি করেন। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের এক বিদ্রোহী সন্তান বলেই পরিচিত ছিলেন।
যে নজরুল সুগঠিত দেহ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও প্রাণ খোলা হাসির জন্য বিখ্যাত ছিলেন সেই তিনি ১৯৪২সালে এক গুরুতর স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হয়ে সব ধরনের সক্রিয়তা থেকে দূরে সরে গেলেন। এক দীর্ঘ সময়ের জন্য তিনি সাহিত্য থেকে দূরেই থেকে গেলেন আমৃত্যু।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেখানকার সরকার কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে কলকাতা থেকে ঢাকাতে স্থানান্তর করেন এবং ১৯৭৬ সালে তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আজ একবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মননে কাজী নজরুল ইসলামের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর কবিতা ও গানের জনপ্রিয়তা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে চিরদিনই থাকবে। তাঁর মানবিকতা সত্তা, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ভাবনা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধতা, নারী-পুরুষের সমতার বন্দনা আবার প্রেমে রোমান্টিক প্রেমিক সত্তা নজরুল ছাড়া আর কার মধ্যে থাকতে পারে।
আজ থেকে একশ বছর পরেও যেখানে যেখানে বাঙালি থাকবে সেখানে সেখানে কাজী কবির আদর্শ প্রতিফলিত হবে।
উশিকা দাস
পঞ্চম শ্রেণী, বাণী মন্দির গার্লস হাই স্কুল, হুগলি
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ১৩৩ তম ছোটোবেলা সংখ্যাটি পড়ে মলয় সরকার যা লিখলেন)

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৩৩, পত্রিকাটার নামকরণের মধ্যে, ‘বিশেষ’ শব্দটা আছে। কাজেই এর বিশেষত্ব নিশ্চয়ই কিছু আছে।দেখা যাক-

প্রথমেই মন ভাল করে দেয় ঋপণ আর্যের ছবি।আগেই বলেছি, উনি পত্রিকাটির মূল সুরটা ধরে নিয়েছেন। এখানে দু একটি কথা বলতেই হয়। নারায়ণ দেবনাথ যেমন শুকতারার মূল সুরটি ধরেছিলেন, ফলে শুকতারা আর হাঁদাভোঁদা একাত্ম হয়ে গিয়েছিল, এবং তার ফলে আমৃত্যু উনি পত্রিকাটির সাথে জড়িয়েছিলেন, ঋপণও তেমনি, শিশু মনের সঠিক সুরটি ধরেছেন বলেই আমার বিশ্বাস। ছবিটিতে দুটি শিশু, যাদের চোখে মুখে যেমন সারল্য, মনেও তার প্রতিচ্ছবি। ফলে দেখতে পাই একটি পেপসি নিয়ে দুজনে ভাগ করে খাচ্ছে। তাও একই সঙ্গে। আজকাল, সকলের মধ্যে, যে কোন জিনিস একা ভোগ করার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, এটি তার বিপরীত কথা বলে বৈকি।আমাদের ছোটবেলায় সব ভাই বোন, এমন কি বন্ধুদের সঙ্গেও যে কোন জিনিস ভাগ করে খাবার শিক্ষাই আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখি, সদ্য জ্ঞান হওয়া শিশুও একা এবং নিজে যে কোন জিনিস খাবার বা ভোগ করার এক সর্বনাশা আত্মসর্বস্ব স্বার্থপর মনোভাবের শিকার। যার ফলে প্রতিটি শিশু বা বড়রাও আত্মসর্বস্ব ধারণার বশবর্তী এবং ফলে বন্ধুহীনতা এবং তার পরিণতিতে নানা মানসিক অসুখের শিকার।যা বৃহত্তর ক্ষেত্রে এক সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ হিসাবে পণ্ডিতেরা ব্যাখ্যা করছেন।
 এই শিশু দুটি, বোঝাই যায় খুব উচ্চবিত্ত ঘরের নয়, কিন্তু মানসিকতায় অনেক উচ্চতর স্থানে থাকার শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। এটি বর্তমান যুগের শিশুদের শিক্ষণীয় বৈকি। এখন অনেক মা বাবা পর্যন্ত সন্তানদের শিক্ষা দেন, আমি নিজে দেখেছি, কাউকে ভাগ না দিয়ে খেতে, কাউকে বই পত্র না দিতে, বা পড়াশোনার ব্যাপারে বন্ধুদের সাহায্য না করতে। ছবিটি তার প্রতিবাদ বলে ধরে নিতেই পারি।
এর পর আসি সপ্তম শ্রেণীর শৌর্যর লেখায়। লেখাটি, যে কোন বড়দের লেখার সাথে পাল্লা দিতে পারে বলে মনে হয়।খুব সুন্দরভাবে এক একটি কবিতার নাম ব্যবহার করে কবিতাটি সুন্দর ছন্দে লিখেছে।
সঙ্গীতা রাণার আঁকা রবীন্দ্রনাথ দেখে তো ধন্দে পড়ে যেতে হয়, এটি সত্যিই আঁকা ছবি না তোলা ফোটোগ্রাফ।  ভীষণ ভীষণ সুন্দর হয়েছে পাকা হাতের এই ছবিটি।
শ্রীপর্ণা ঘোষের কথা তো নতুন করে বলার নেই। সাহিত্যিক মা বাবার কাছে তার শিক্ষার ভিত পাকা। তাই দেখতে পাই তার কল্পনার ঘোড়া ছুটে বেড়ায় অনেক উচ্চমার্গে।কল্পনায় এমন একটি স্কুল ও তার কার্যক্রমের ব্যাপারগুলো ও এত সুন্দর বর্ণনা করেছে, যা অতুলনীয়। শুধু তাই নয়, গল্পের শেষ লাইনটিও দিয়ছে একেবারে বড় লেখকদের মতই, ‘ধরনী আর মা কে একাকার হতে দেখেছিলাম’। শুধু একটাই কথা
‘ধরণী’ বানান–

ভানুপ্রিয়া মাহাত কবিতাটি ভালই লিখেছে, তবে মনে হল, ও যেমন অনেক ভাল লেখে, তার থেকে  এবার একটু কমজোরী।ও একটু বড় হয়েছে (দশম শ্রেণীতে পড়ছে) বলেই বললাম। তবে নিশ্চয়ই আগামী দিনে আরও ভাল লেখা পাব ওর কাছে, এ বিশ্বাস রাখি।
সমাদৃতা পাঠভবনের ও স্নেহা তার স্কুলের  রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের ভাল বর্ণনা দিয়েছে।
প্রবাহনীল তো পাকা কবি। বেশ সুন্দর লিখেছে। এরা ভবিষ্যতের বড় কবি হোক, এটাই প্রার্থনা।
শ্রীকান্ত অধিকারীর রহস্য ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে মনে হচ্ছে। এগোচ্ছে ভালই।
বাসবদত্তা কদম, যেখানেই বেড়াতে যান, বর্ণনায় সমস্ত দৃশ্যকে হুবহু তুলে ধরেন খুব সুন্দর। মনে হয় সেখানে না গিয়েই দেখা হয়ে যায়।
দোলনচাঁপা তেওয়ারী বরাবরের মতই, প্রতিটি দিনকে স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁর লেখার মাধ্যমে। ফলে কচি কাঁচা পাঠকদের কাছে দিনগুলোর পরিচিতি সম্যকভাবে হয় আর আমরা যারা বুড়ো হয়েছি, তাদেরও নতুন করে মনে পড়ে যায় দিনগুলোর কথা।
আর অলঙ্করণে যারা হাত লাগিয়েছে, সেই ছোটরা,অবন্তিকা,অনুশ্রুতি, রুদ্রাংশ, জয়দীপ ইত্যাদিরা তো নিতান্তই অপরিহার্য পত্রিকাকে সুন্দর করে তুলতে।
সব মিলিয়ে সম্পূর্ণ রাবীন্দ্রিক একটি পত্রিকা সংখ্যা হিসাবে সত্যই এটি 'বিশেষ' সুন্দর সংখ্যা।
আর, এবার তো বলতেই হয়, পত্রিকার চলার মূল সুতো যাঁর হাতে, তাঁর কথা।
আসলে নতুন করে কিছু বলার নেই। পাকা মাঝি যেমন নদীর বুকে তরতর করে নৌকো বেয়ে যায় পাকা অভিজ্ঞ হাতের গুণে, মৌসুমীও তেমনি এতদিন ধরে, সুন্দর একটা পত্রিকাকে শিশুদের উপযুক্ত করে চালিয়ে নিয়ে চলেছে।
আমরা যারা পত্রিকা পড়ি, তারা হয়ত ভাবি না, একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা, চালানো কত কঠিন, সব মান বজায় রেখে; কিন্তু এরকমই একটা কঠিন কাজ ও করে চলেছে নিঃশব্দে। এর জন্য ওর নিশ্চয়ই অভিনন্দন প্রাপ্য হয়। প্রার্থনা করি অনেক দূরের পথ পাড়ি দিক জ্বলদর্চি ছোটোবেলা।

Post a Comment

0 Comments