দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা
চতুর্থ পর্ব
পি.শাশ্বতী
পুরীর রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিনজনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমে থাকে বলরামের রথ ‘তালধ্বজ’। রথটির চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের রং নীল।
তারপর যাত্রা করে সুভদ্রার রথ। রথের নাম ‘দর্পদলন’। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। এই রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা থাকে, তাই রথটিকে ‘পদ্মধ্বজ’ বলা হয়ে থাকে। এটি লাল রঙের।
সবশেষে থাকে জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম ‘নন্দীঘোষ’। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে, তাই এই রথকে ‘কপিধ্বজ’ বলা হয়। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুট। রথটির রং ‘হলুদ’। তিনটি রথের রং আলাদা হলেও সবক-টির উপরিভাগের রং লাল।
শ্রীক্ষেত্র পুরী হল মর্ত্যের বৈকুণ্ঠ দ্বারকা। এবার পুরীর মন্দিরের কিছু বর্ণনা করা যাক। এই মন্দিরের চারটি দরজা। যেমন, অশ্ব, হস্তী, ব্যাঘ্র এবং সিংহ। অশ্ব অর্থ, হস্তী মোক্ষ, ব্যাঘ্র কাম এবং সিংহ হল ধর্মের প্রতীক। জগন্নাথ সিংহ দরজা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। মহাপ্রভুও এই দরজা দিয়েই প্রবেশ করতেন জগন্নাথ দর্শনে। হস্তী দরজা দিয়ে জগন্নাথ বের হন সমাধিতে যাওয়ার জন্য। এই দরজা বন্ধ থাকে সবসময়। শুধু জগন্নাথদেব সমাধিতে যাওয়ার সময় এই দরজা উন্মুক্ত করা হয়।
এবার আসা যাক জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রার মূল তত্ত্বে। একবার দেবকী এবং বাসুদেবের বাসনা হল তীর্থ স্নান করবেন। বলরাম কৃষ্ণ ও দেবকীকে বললেন, কুরুক্ষেত্রে এক পুণ্য অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণের সময় স্নান করলে মোক্ষ লাভ হয়। কুরুক্ষেত্রে একুশ বার ক্ষত্রিয়দের বিনাশ করা হয়েছিল। তাদের রক্ত থেকেই তৈরি হয়েছিল এই সরোবর। আবার পরশুরাম ওখানে তর্পণও করেন ক্ষত্রিয়দের। ফলে ওই সরোবর পুণ্য তীর্থে পরিণত হয়েছে।
বলরামের কথা শুনে দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণ সবাইকে নিয়ে রওনা হলেন। মা দেবকী, বসুদেব, সুভদ্রা, কৃষ্ণের আট জন মহাপাটরানি। সঙ্গে বলরাম ও তাঁর সঙ্গে বারূণী, রেবতীও যাচ্ছেন। অনেক সৈন্য, অনেক বাদ্যযন্ত্র বাজছে। কুরুক্ষেত্রের সরোবরে এই স্নান হল জগন্নাথের স্নান যাত্রা।
নারদমুনি ভাবলেন, শ্রীকৃষ্ণ আসছেন কুরুক্ষেত্রে এই সংবাদ ব্রজবাসীদের বলতে হবে। নারদমুনি বীণায় কৃষ্ণ নাম করতে করতে এক মাসের বেশি সময় কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে থাকবে এই খবর দিতে চললেন ব্রজে। ব্রজে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলতে শুরু করলো। যোগ ধ্যানে বসে নারদ জানতে পারলেন, বিরহ তাপে অঙ্গ জ্বলছে ব্রজধামের। যমুনা, স্থাবর-জঙ্গম, গোবৎস, গাভী, গোপ-গোপী, মা যশোদা সকলেই কৃষ্ণবিরহে কাঁদছে। নারদমুনি দেখলেন ব্রজে, নন্দালয়ে যশোদা ননী নিয়ে গোপাল গোপাল করে কাঁদছেন। শ্রীদাম পটে আঁকা কৃষ্ণের ছবি দেখে কেঁদে কেঁদে বলছেন, “কানাই দেখ মিষ্টি ফল এনেছি। এঁটো ফল দিইনি রে। এঁটো ফল দিলাম বলে তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি?”
এদিকে রাধা কাঁদে সখীদের গলা ধরে। নারদ বললেন, “তোমাদের নয়নাভিরাম কুরুক্ষেত্রে। চলো তোমরা দর্শন করবে তোমাদের প্রাণগোবিন্দকে।” রাধাকে বললেন, “ললিতা, চল সখী তোকে সাজিয়ে দিই।”
রাধারাণী বললেন, “আমি সেজে বসে আছি। নয়ন সেজেছে শ্যামের রূপ দর্শনে, হাত সেজেছে শ্যামের পদসেবনে, কানের ভূষন আমার শ্যামের নাম শ্রবণ।”
সবাই চলল কুরুক্ষেত্রে। বিরহিনী রাধা ও গোপীরা এক কুঞ্জে শ্যাম আছে শুনে দর্শনে ব্যাকুলতা নিয়ে গেল। দেখল যে বনমালী গোপালকে তারা ভালোবাসত, এ সে কৃষ্ণ নয়। কোথায় বনমালা, কোথায় চূড়া। এ রাজার বেশে কৃষ্ণকে তো তারা ভালোবাসে না! দেখা না করে চললেন রাধা। যোগমায়া দেখলেন রাধারানি কৃষ্ণ দর্শন না করে চলে যাচ্ছেন। কৃষ্ণকে সেকথা বলতে তাঁর মনে বিরহ জেগে উঠলো রাধাবিরহে।
অন্যদিকে যোগমায়া অপূর্ব কুঞ্জ রচনা করলেন রাধা আর প্রিয় সখীদের জন্য। কৃষ্ণ আসবেন রাধার সেই অপূর্ব কুঞ্জে। কিন্তু এর জন্য রুক্মিণী অর্থাৎ লক্ষ্মীকে রাজি করাতে হবে। কিন্তু রুক্মিনী তো রাজি হন না কিছুতেই।
যোগমায়ার এই কুঞ্জ হল গুণ্ডিচা মন্দির। যা যোগমায়া তৈরি করলেন। রথযাত্রার পর যে পনেরো দিন জগন্নাথদেব দর্শনে থাকেন, তখন তাঁর জ্বর হয়। এই জ্বরই হল রাধারবিরহ জ্বর। জগন্নাথ রাধার কুঞ্জ গুণ্ডিচা মন্দিরে যাবে রথে করে। কিন্তু লক্ষ্মী যেতে দেবেন না। বলা হল তাঁর সঙ্গে যাবেন বলরাম ও সুভদ্রা। তবুও রাজি হলেন না লক্ষ্মী। তাই রথে আগে বলরাম, পরে সুভদ্রা তারপর জগন্নাথ। এভাবেই রচিত হল ‘জয় জগন্নাথ, জয় রথযাত্রা’।
(ক্রমশ)
আরও পড়ুন
0 Comments