পথের ধারে সূর্যমুখীর ক্ষেত
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬৬
বিজন সাহা
বরিসোগ্লেবস্ক
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ আমরা ভোলগাগ্রাদ থেকে চললাম মস্কোর উদ্দেশ্যে। এখানেই শেষ হল আমাদের ভোলগা ভ্রমণ। কারণ এরপর আমরা যে পথে যাব সেটা ভোলগা থেকে অনেক দূরে। মস্কো থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম উত্তর দিকে। ভোলগার শুরু থেকে তভের, ইয়ারোস্লাভল, নিঝনি নভগোরাদ এ সবই ছিল মস্কোর উত্তরে। কাজানে এসে আমরা মস্কোর সাথে একই সমান্তরাল রেখায় পড়ি। এরপর যাত্রা দক্ষিণে। এই যাত্রা পথে বদলিয়েছে প্রকৃতি, বদলিয়েছে সময়। এখন আমাদের ঘরে ফেরার পালা। আগের মত টেনশন নেই, নেই কারো সাথে কথা বলার তাগিদ, নেই বইয়ের জন্য তথ্য জানার তাগিদ। এখন শুধুই নিজেদের কথা বলা, দীর্ঘ ভ্রমণে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করা।
- আচ্ছা বিজন, তুমি তো এ দেশে অনেক দিন। অনেক কিছুই দেখলে। এখন কী এখানে লোকজন আগের চেয়ে বেশি করে ধর্মের দিকে ঝুকেছে?
- যতদূর জানি এ দেশের মোটামুটি ২% মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করে। খুব কম লোকই নিয়মিত গির্জায় যায়। সেদিক থেকে নিয়মিত মসজিদে যাওয়া লোকের সংখ্যা মনে হয় আনুপাতিক ভাবে বেশি।
- এটা কি এদের মানসিকতায় সেরকম কোন পরিবর্তন এনেছে?
- আগে যারা উপাসনালয়ে যেত তাদের দিকে সবাই আড়চোখে তাকাত, এখন সেটা কেউ খেয়ালও করে না। এটা আমি নিজের সোভিয়েত আমলে আর বর্তমানে গির্জায় বেড়াতে যাওয়া থেকেই জানি। তাছাড়া সেটা তুমি সেই সময় আর এই সময়ের বিভিন্ন সাহিত্য পড়েও জানতে পারবে।
- যেমন?
- যেমন, তুমি যদি তলস্তোই বা দস্তইয়েফস্কির লেখা পড় তাহলে সেখানে প্রায়ই গ্রেখ বা পাপ কথাটি পাবে। সে তুলনায় ন্যায় অন্যায়ের উপস্থিতি কম। কিন্তু সোভিয়েত বা আধুনিক লেখায় পাপ পুণ্য এসব শব্দ প্রায় পাবেই না, যদিও ন্যায় অন্যায় – এই দুটো শব্দ প্রায়ই পাবে। এটাই মনে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের লিগেসি, বলতে পার সোভিয়েত মগজ ধোলাইয়ের ফলাফল।
- কিন্তু এখানে পাপ পুণ্য এসব কথা আসছে কেন?
- কারণ এসব শব্দই একটা জাতির মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আভাস দেয়। যেমন ধর আমাদের দেশে সেই ছোটবেলা থেকেই পাপ পুণ্য শব্দ দুটো খুব বেশি ব্যবহার করা হয়। যাই কর, তার ভালো মন্দ বিচার করা হয় পাপ পুণ্য দিয়ে। সেই ছোটবেলা থেকেই এই ধারণা আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আমরা সমাজের চেয়ে অদৃশ্য ঈশ্বরের কাছে বেশি দায়বদ্ধ হই আমাদের কাজের জন্য। ফলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা আমাদের লেগেই আছে। ঈশ্বরের নামে আমরা কাউকে ঘরে ঢুকতে দেই না, কাউকে খুন পর্যন্ত করে ফেলি। এই পাপ পুণ্যের কারণেই কেউ গোমাংস খেলে এক দল যেমন তার উপর চড়াও হয়, কেউ মূর্তি পূজা করলে অন্যদল তার উপর চড়াও হয়। আর পাপ পুণ্য এসবই ধর্মীয় ধারণা। পাপ পুণ্যের অনেক ধারণা বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্ন বলে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা লেগেই আছে। এই শিক্ষা আমাদের সমাজের মনস্তত্ব নির্ধারণ করে।
- আর রাশিয়ায়?
- যতদূর দেখেছি তাতে ন্যায় অন্যায় এখানে সামনে চলে আসে। যদি পাপ পুণ্য নির্ধারিত হয় ধর্ম গ্রন্থে, উপাসনালয়ে, ধর্মযাজকদের কথায়, ন্যায় অন্যায় নির্ধারিত হয় সামাজিক ভাবনায়। সমাজের জন্য যেটা ভালো সেটা ন্যায়, যেটা খারাপ সেটা অন্যায়। সেই বিবেচনায় এটা অনেক বেশি বাস্তববাদী, অনেক বেশি ইহজাগতিক। আর এ কারণেই আমার মনে হয় এটা সোভিয়েত সমাজে সৃষ্টি। ঈশ্বরকে পৃথিবী থেকে বা সমাজ থেকে বিতাড়িত করে এদের পাপ পুণ্যের সমকক্ষ কিছু দেবার প্রয়োজন ছিল মানুষকে। আর সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ সামাজিক সাম্যের কথা বলে। সামাজিক সাম্য কী? সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন, কাউকে না ঠকানো, সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান – এই মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা। তাই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রশ্ন সামনে চলে আসে, অন্তত তাত্ত্বিক ভাবে হলেও। এখন আর সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই কিন্তু সামাজিক ন্যায় বিচারের চাহিদা রয়েই গেছে। তাই দেখবে এ দেশের মানুষ পাপ পুণ্যের কথা না বলে ন্যায় অন্যায়ের কথা বলবে, ন্যায় অন্যায়ের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করবে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ।
- মজার ব্যাপার তো! তাহলে পশ্চিমা বিশ্বে কোন মনস্তত্ত্ব কাজ করে?
- আমি পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না, সেখানে থাকিনি কখনও দীর্ঘ সময়ের জন্য। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকার সাহিত্য পড়ে মনে হয় সেখানে আইন দিয়ে মনস্তত্ত্ব নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ যা তুমি করছ তা প্রচলিত আইন কীভাবে দেখে সেটাই মূল কথা। প্রচিলিত আইন যদি তোমাকে কিছু করার অধিকার দেয় সেটা ঠিক, না দিলে ভুল। দেখনা সেখানে প্রায়ই বাক স্বাধীনতা, অস্ত্র রাখার অধিকার এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এসব দেশে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকারের মতই পবিত্র। এসব অধিকার রাষ্ট্রীয় আইনে দেয়া। আর মজাটা এখানেই। কারণ আইন তৈরি করে মানুষ। সাধারণ মানুষ নয়, সমাজের এলিট শ্রেণী। সেই অর্থে আমাদের দেশে মানুষের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে ধর্ম বা অজ্ঞাত ঈশ্বর, রাশিয়ায় সেটা করে ন্যায় অন্যায়ের সামাজিক ধারণা যেটা জনতার ভেতর থেকে আসে আর পশ্চিমা বিশ্বে সেটা করে শাসক শ্রেণী যারা নিজেদের স্বার্থে দেশের আইন কানুন রচনা করে।
- তোমার কথা কতটা সত্য সেটা জানি না, তবে ভাবনার খোঁড়াক জোগাবে বলেই মনে হয়।
- তুমি এসব নিয়ে ভাবতে থাক। আমি আপাতত রাস্তার সৌন্দর্য উপভোগ করি।
গাড়ি চলছে। রাস্তার দুই ধারে ফসলি জমি। যাত্রার শুরুতে রাস্তার দুই ধারে ছিল বন আর বন, কালেভদ্রে ফসলি জমি। দক্ষিণে প্রায় সর্বত্রই ফসল খামারে উঠে গেছিল। এখানে এখন প্রায় সবই মাঠে। মস্কোর দক্ষিণে কিন্তু ভোলগাগ্রাদের উত্তরে বলে এখানে গরম আসে একটু পরে, তাই ফসল পাকেও পরে। আর একারণেই হয়তো মাঠে ফসল এখনও তোলার যোগ্য হয়নি। হঠাৎ এক জায়গায় দেখলাম বরিসোগ্লেবস্ক লেখা দিক নির্দেশনা। দেমিদকে বললাম সেখানে যাওয়া যায় কিনা। না না, এই জনপদ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। ঐ নামটার মধ্যেই মনে হয় জাদু ছিল। কেন যেন মনে হল উগলিচের কথা। ইতিমধ্যে কয়েক ঘন্টা ড্রাইভ করা হয়েছে। দুপুরে খাওয়া দরকার। তাই দেমিদ গাড়ি ঘুরিয়ে সেদিকে চলল।
তামবভ প্রদেশের এই জনপদ বরিসোগ্লেবস্ক ১৭৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আর ১৭৯৬ সালে তামবভ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯০৩ সালে কাজানস্কি ছেলেদের মনাস্তিরের প্রধান কনস্তান্তিনের উপর তুগোলুকভা ও ইভানভা গ্রামের পাশে কারাচান নদের তীরে স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি মনাস্তির তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। আন্দ্রেই মিখাইলোভিচ নোসভ নামে এক বনিক এর জন্য ভূমি ও অর্থ দান করে উইল করে যান। আর এ কারণেই এটা নোসভস্কি মনাস্তির বলে পরিচিতি পায়। ১৯০৪ সালের ৪ এপ্রিল এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯০৮ সালের আগস্ট মাসে শেষ হয়। মনাস্তিরের প্রথম বিল্ডিং ছিল ব্রাতস্কি বা ভাইদের হোস্টেল। ১৯০৭ সালের ২৬ অক্টোবর এর দোতলায় সেরাফিম সারোভস্কি ও সেরগেই ও গেরমান ভালামস্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের নামে গির্জা পবিত্র করা হয়। ১৯০৮ সালে মনাস্তির তৈরির আবেদন মঞ্জুর করা হয়। এর প্রথম প্রধান বা ইয়েগুমেন হন ইয়েরমোনাখ কনস্তান্তিন। ১৯১৮ সালে বিপ্লবের পরে মনাস্তির বন্ধ করে সেটাকে সংশোধনমূলক প্রতিষ্ঠানের অধীনে দেয়া হয় আর ১৯৫০ সালে সেখানে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ১৯৯০ সাল থেকে সেখানে আবার স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি মনাস্তির কাজ করতে শুরু করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯২০-১৯২১ সালে বরিসোগ্লেবস্কে তামবভের কৃষকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান দেখা দেয়, তবে বলশেভিকরা নির্মম ভাবে সেই বিদ্রোহ দমন করে। ১৯২৮ সালের ২০ জুলাই বরিসোগ্লেবস্ক কাউন্টি বিলোপ করা হয় আর এই এলাকা সেন্ট্রাল ব্ল্যাক ল্যান্ড বা কেন্দ্রীয় কৃষ্ণ জমি প্রদেশের বরিসোগ্লেবস্ক থানার অন্তর্ভুক্ত হয়।
তেকনিকুম বা কারিগরি কলেজ
আমরা যখন বরিসোগ্লেবস্ক এসে পৌঁছই তখন লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। ছোট্ট শহর, লোকজন খুবই কম। আমাদের দেশের বড় গ্রাম বলা চলে। সেখানেই এক স্তালোভায়ায় আমরা দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। হাতে তেমন সময় ছিল না। তাছাড়া দেখার মত খুব বেশি কিছু যে ছিল সেটাও নয়। তারপরেও কিছু পুরানো স্থাপনা দেখে ছবি নিলাম। একটা তেকনিকুম বা কারিগরি কলেজ, একটা পরিত্যাক্ত বিল্ডিং আরও কিছু দালানকোঠা। তবে সেখানকার শান্ত পরিবেশ এখনও বেশ মনে পড়ে। সেখান থেকে আমরা রওনা হলাম তামবভের দিকে।
প্রাচীন শহর বরিসোগ্লেবস্ক
https://www.youtube.com/watch?v=k7FaRSHyRJQ&t=22s
ছবিতে বরিসোগ্লেবস্ক
http://bijansaha.ru/album.php?tag=268
0 Comments