চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ
কনডোলেন্স
পুলককান্তি কর
সবার দিকে তাকিয়ে একটু অনুমতি নেবার ঢঙেই অতনু বলল, ‘লেট মি সে সামথিং ইন দ্য কনডোলেন্স অফ মাই ফাদার!’ সবাই মৃদু স্বরে সম্মতি দিয়ে বল্লেন, ‘নিশ্চই! তুমি কিছু বল!’
-হোয়াট আই অ্যাম গোয়িং টু টক অ্যাবাউট ইজ মাই আইডিয়া বাট ইট ইজ রিটিন বাই মাই ওয়াইফ পর্ণা, সি ইজ ভেরি সরি ফর হার অ্যাবসেন্স, বাট ইউ নো - সি ইজ ইন দ্য অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ চার্জ অফ ক্যালিফর্ণিয়া ইউনিভার্সিটি, সো সি কুড্ন্ট মেক ইট পসিবল।
পাশের ঘরে কোনও একটা কাজে গেছিলেন অতনুর মা করবী। তিনি বললেন, বাবার বিষয়ে বলবি, তাও দেখে পড়বি নাকি?
অতনু মায়ের কথার কোনও জবাব দিল না। একমনে একটি নাতিদীর্ঘ লেখা পাঠ শেষ করলো। ইংরেজিতেই লেখা। মাঝে মাঝে দু-একটা বাংলা বাক্য স্বগোতক্তির মতো। যেমন বাব খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালো বন্ধু ছিলেন, আমাকে মাঝে মাঝে পড়াতেন - এইসব। তাঁর অভাব যে কোনওদিন পূরন হবার নয়, একথাও বলতে ভুললো না সে।
অতনু তার বছর দশেকের ছেলে নীলোৎপলকে সাথে করে নিয়ে এসেছে এই উপলক্ষ্যে। সে চুপ করে থাকার ছেলে নয়। এদিক ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একফাঁকে জানিয়ে গেল – ‘ডাডা আর.আই.পি, আর.আই.পি।‘ এক বয়ষ্ক ভদ্রমহিলা অতখানি ফর্মালিটির ধার না ধেরে হঠাৎ করে বলে বসলেন ওটা আবার কী? পাশ থেকে কেউ বুঝিয়ে দিল, ওটা হল রেষ্ট ইন পিস। মানে গোদা বাংলায় ‘ভগবান ওনার আত্মার শান্তি করুন। বিলেতে জন্ম তো! বাংলা জানে না!’
সামনের চেয়ারে বসা মীরা নামের এক ভদ্রমহিলা বললেন ‘করবী, তুই কিছু বল!’
-আমি আর কী বলব?
-কিছু বল।
করবী ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। তবুও উঠে বললেন, ‘প্রবীর ঠিক কেমন ছিল আজ পঞ্চান্ন বছরের দাম্পত্যেও আমি ভালো মতো বুঝতে পারিনি। বুঝতে যে খুব চেয়েছি তা নয়। আসলে নিজে একজন নামকরা গায়নোকোলজিষ্ট ছিল - সরকারী ডাক্তার। ট্রান্সফার, চেম্বার নিয়ে ওর দিন কাটতো। ছেলেমেয়ের ষ্কুল টিউশনি নিয়ে কাটতো আমার। ওরা বড় না হওয়া পর্যন্ত আমরা একসাথে কতদিন ছিলাম - তাও হাতে গোনা। প্রবীর যখন রিটায়ার্ড হয়ে ঘরে এলো - তখনই বলতে গেলে আমাদের একছাদের তলায় থাকা।‘
অতনু সামনে থেকে বলে উঠলো – ‘আমাদের এই বাড়ীটা একচুয়ালি বাবারই স্বপ্নের প্রতিফলন। এই বাড়ীর প্রতিটা ইঞ্চিতে বাবার ভাবনা মিশে রয়েছে।‘
অবনী নামের এক ভদ্রলোক বললেন - এটা তোমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে বাড়ী না?
-‘পুরোনো বাড়ী ছিল। বাবা রিটায়ার্ড করার পর ওটা কমপ্লিটলি ডিমোলেশ করে এখনকার শেপ দিয়েছেন।‘ অতনু জবাব দিল।
বক্তব্যের মাঝে ছেদ পড়ায় করবী চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার আবার ফাঁক পেয়ে বলা শুরু করলেন। ‘একছাদের তলায় থাকা মানে ওটা আক্ষরিক অর্থেই, বাস্তবে শুধু খাওয়া দাওয়ার সময় ছাড়া আমাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা প্রায় হতই না। আসলে হয়তো দীর্ঘ দিনের কথা না বলার অভ্যাসই কারণ। প্রবীর গত পনেরো ষোলো বছর খুব শুচিবায়ু হয়ে গেছিল। দিনরাত গা বাঁচিয়ে হাত ধুয়ে দিন কাটাতো। আমি রান্নাবান্না আর গাছপালা নিয়ে দিন কাটাতাম। তবু অদ্ভুৎ একটা ব্যাপার ছিল প্রবীরের। আমাকে কোথাও কখনও একা যেতে দিত না, একটা রাতও ওকে ছেড়ে রাত কাটাতে দিত না।‘
অতনু বলল – ‘কতবার বলেছি ক্যালিফোর্ণিয়ায় আমাদের ফ্ল্যাটে এসে থাকো। ওখানে ল্যাভিশলি বাকী জীবনটা কাটাও। বহুবার বলে বলে নীলের জন্মের পর একবার গিয়ে দুমাস ছিল দুজনে, তারপর আর গেলই না। মা তুমি অনেষ্টলি বলো, ‘হ্যাড ইউ নট এনজয়েড দোজ ডেজ কোয়াইট লাক্সারিয়াসলি উইথ আস?’
করবী নীরবে মাথা নেড়ে পরবর্তী কথায় মনোনিবেশ করলেন। ‘প্রবীর আমাকে বোধ হয় খুব ভালোবাসতো! আমিও হয়তো বাসতাম। আমরা কেউ যদিও সেভাবে পরষ্পরকে বোঝাতে চাইতাম না সব কথা। মোটের উপর মানুষ বোধ হয় ভালোই ছিল।’
কনডোলেন্স মিটিং শেষ হতে মীরা বললেন, ‘করবী, শম্পা আসেনি?’
-সকালে এসেছিল। জামাই এর কী একটা দরকার আছে বলল।
অতনু বলল, ‘সবাই এবার চলুন ছাদে। ওখানে সামান্য একটু লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। দুপুরবেলা কেউ না খেয়ে যাবেন না প্লিজ। বাবা লোকজনকে খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন। কী বলো মা?’
করবী কিছু উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন। বললেন ‘চলুন সবাই উপরে।‘
বেশী জনের আয়োজন ছিল না আজ। মেরেকেটে একশজন। কিছু আত্মীয় স্বজন, কিছু পাড়ার প্রতিবেশী। আগে যেমন শশ্মান বন্ধুদের শ্রাদ্ধের দিনে এবং নিয়মভঙ্গে আসাটা প্রায় অবধারিত ছিল, আজ কাল আর সেসব দিন নেই। অধিকাংশই ফর্মালিটির জন্য আসে। এখনকার সামাজিক পরিমন্ডলে কেউ আর এসব নিয়ে মাথাও ঘামায় না, দোষও দেয় না। বেলা দুটো আড়াইটার মধ্যেই মিটে গেল সব। মীরা বললেন, ‘করবী যা একটু বিশ্রাম কর, সকাল থেকে ধকল তো কম গেল না। আমি দু-চারদিন পরে আসব। তোর ছেলেরা চলে টলে যাক।‘
-তার জন্যে তোকে দু-চারদিন অপেক্ষা করতে হবে না মীরা। আজকেই চলে যেতে চাইছিল রাতে। ফ্লাইটে আজকের রেট খুব বেশী ছিল বলে কালকে কেটেছে।
-কাল কখন যাবে?
-বিকেলেই বেরিয়ে যাবে। আগে দিল্লি যাবে, সেখান থেকে ডাইরেক্ট ফ্লাইট।
-তাও ছোট বাচ্চাটাকে নিয়ে আসার কথা ভেবেছে এটাই অনেক।
করবী বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। আর দাদুভাইটাও যা চঞ্চল হয়েছে! অতনু ছোটবেলায় এত দুষ্টুমি করতো না। একটা স্লেট খড়ি ধরিয়ে দিলে তাতেই নানান আঁকিবুঁকি কাটতো। ওর বায়নাও কম ছিল। বরং শম্পা দুষ্টু ছিল বেশী। লোকে বলে কন্যা সন্তান কম দুরন্ত হয়! তবে শম্পা সে ধারনা ভেঙে দিয়েছে।
-নীল কোন ক্লাসে পড়ে?
-ওদের বিদেশে কীসব স্ট্যান্ডার্ড বুঝি না বাপু। কী একটা বলছিল অতনু। আমি কানে নিইনি।
-বাই দা বাই, অতনু তোকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি?
-ও তো সবসময় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলতো। তবে পার্মানেন্টলি নেওয়ার কথা ভাবার মতো সময় পায়নি নিশ্চই। আর তাছাড়া এটা তো ওর একার সিদ্ধান্ত হবে না। ওর স্ত্রীর পারমিশন চাই।
-তাও! তুই একা থাকবি, মানুষ তো ভদ্রতা করেও বলে।
-তুই কি আমাকে জানিস না মীরা! তুই তো জানিস আমি যে সে বান্দা নই! অতনুও কি আর বোঝে না? সেও বেশ জানে আমাকে বলে লাভ নেই, আমি এখানেই একা একা স্বাধীন ভাবে থাকবো। অকারণে তাই আর বাক্য খরচ করেনি বোধহয়।
-ঠিক আছে করবী, তুই রেষ্ট নে। আমি না হয় কাল সন্ধ্যেবেলা আসবো।
-আচ্ছা।
সন্ধ্যের সময় নাতির জন্য একটু দুধ কর্ণফ্লেক্স আর ছেলের জন্য চা বানিয়ে দরজায় টোকা দিলেন করবী। অতনু একটু পরে দরজা খুললো। দুপুরে ঘুমিয়ে মুখ-চোখ ফুলে আছে। নীল সারা দুপুর দাপাদাপি করে বোধ হয় সবে ঘুমিয়েছে। এই ঘরটায় প্রবীর শুতেন। প্রবীরের ঘর সবসময় টিপটাপ থাকতো। নীল মোটামুটি সব কিছুকেই ওলট-পালট করে দিয়েছে। করবী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে চা খাবি তো?’
-তুমি তো করেই এনেছো দেখছি। আর জিগ্যেস করছ কেন?
-সে তোর ইচ্ছে না হলে নাই খাবি! কফিও খেতে পারিস!
-না মা। চা ই দাও। ও দেশে তো কফিই খাই। চা খুব একটা খাওয়া হয় না।
-তা ঘরে বসেই খাবি? নাকি বারান্দায় চেয়ার পাতা আছে, ওখানে দেব।
-বারান্দাতেই দাও।
এই বারান্দায় শ’খানেক টবে নানান ধরনের গাছ লাগিয়েছেন করবী। নানান ক্যাকটাস, বনসাই, ফুল! সবচেয়ে চোখ টানে হরেক রকমের কাগজফুলের গাছ। অতনু বসে বেশ একটা তৃপ্তির শ্বাস টেনে বলল, ‘অনেক গাছ করেছ তো মা। বলতে বটে, তবে এতটা কল্পনা করতে পারিনি।‘
-বাগানে আরও আছে।
-পুরোনো সেই কাঁঠাল আর বেল গাছটা এখনও আছে মা?
-আছে। দেখে আসতে পারিস!
-চলো!
-ছোটবেলায় তুমি কতবার ভয় দেখাতে ওই বেলগাছটায় নাকি ব্র্রক্ষ্মদত্যি থাকে। আমি আর ছুটকু কত দুপুর যে তোমার চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই গাছতলায় কাটিয়েছি - তার ইয়ত্তা নেই।
করবী কিছু না বলে হাসলেন। অতনু একটু ভাবুক হয়ে বলল, বেশ অন্যরকম দিন ছিল সেসব! বাবা কোনও সপ্তাহে ফিরত, কোনও সপ্তাহে ফিরতো না। পিসি আর জেঠুকে নিয়ে আমরাও ছিলাম একরকম। তবে মা, তুমি বড্ড বেশী শাসন করতে!
করবী মৃদু হাসলেন, উত্তর করলেন না কিছু। অতনু পুনরায় বলল, ‘কিন্তু মা, তুমি যদি এখন ভাবো -এতখানি শাসন করেছিলাম বলেই তুই আজ প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে প্রফেসারি করিস - সেটা কিন্তু ঠিক নয়! বেশী শাসন না করেও কিন্তু বাচ্চা মানুষ করা যায়! ইউ মে এগ্রি উইথ মাই পেরেন্টিং টু নীল। আমি বা পর্ণা একটুও শাসন করি না ওকে। দ্য পেরেন্ট শুড বি ভেরি ভেরি পোলাইট টু দেয়ার চাইল্ড। ইমপেশেন্স ইজ আ পানিশেবল অফেন্স দেয়ার!’
করবী এবারও কিছু বললেন না। অতনু অধৈর্য্য হয়ে বলল,’কী মা, কিছু বলছ না যে?’
-কী বলব? আমাদের বিচার বুদ্ধি মতো যেটা ঠিক মনে হতো, তাই করেছি। আইন মেনে তো কাজ করিনি, হৃদয় থেকে করেছি। আর এটা বোধহয় তোরও মনে হয় নিশ্চই, আমি যাই করে থাকি - তাতে পূর্ণমাত্রায় ভালোবাসা ছিল না - এমনটা নয়। যা করেছি তোদের মঙ্গলের কথা ভেবেই করেছি।
-তাই কী?
-কেন? সন্দেহ হয়?
-না মা, সন্দেহ নয়; তবে একটা অভিমান আছে।
-বলেই ফ্যাল! কবে তোর বাবার মতো আমিও মরে যাবো, আর শোনাই হবে না।
-আচ্ছা মা, তুমি আর বাবা যে দুমাস আমাদের ওখানে কাটিয়েছিলে - কেমন কেটেছিল তোমার?
-ভালো।
-শুধু ভালো? তোমার মনে হয় না - দ্য বেষ্ট অ্যাফোর্ডেবল কমফোর্ট তোমাদের আমরা দিয়েছি?
-তা তো বটেই!
-আমারও সেই একই কথা! বাবা যা রোজগার করতো, আমাদের শিশুবেলায় কি তোমরা আর একটু বেশী কমফোর্ট আমাদের অ্যাফোর্ড করতে দিতে পারতে না?
-বেশী কমফোর্ট বলতে? তুই কি এসি তে থাকা, গাড়ী করে ষ্কুলে যাওয়া - এসব মিন করতে চাইছিস?
-সে সব না হলেও - আমরা দু-ভাইবোন কি একটা সেপারেট ঘর পেতে পারতাম না? সবসময় তোমার সাথে শোওয়া বসা পড়া - একঘরে!
-দ্যাখ অতনু, যে বাড়ীটা ছিল তাতে সাকুল্যে চারখানা ঘর। একটা পৈতৃক ঠাকুর ঘর। একটাতে তোর জেঠু আর একটাতে পিসি থাকতেন। আমি তোদের কোথায় আলাদা ঘর দিতাম? তোদের পড়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। তোদের খাওয়া দাওয়া পোশাক-আষাকে কখনও কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য কি দিয়েছি?
-তুমি ওকে স্বাচ্ছন্দ্য বলো? আই থিঙ্ক ইউ কুড অ্যাফোর্ড বেটার কমফোর্ট ফর আস। আই অলওয়েজ ট্রাই সো দ্যাট নীল ডাজ নট গেট এনি চান্স টু পুট মি বিফোর সাচ অ্যাকুউজিং সিচুয়েশন!
-ভালোই তো বাবা! এর চেয়ে ভালো আর কী আছে! তার মনে তোদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ যাতে না ওঠে সেটাই তো ভালো! ঈশ্বর তোদের এমন দিন দেখতে না দেন – এই কামনা করি।
-তুমি কি রাগ করলে মা?
-রাগের কিছু বিষয় এটা নয় বাবা! বিষয়টা ভাবার। তুই বলে গেলি আমি বরং ভাববো - ভুলটা কোথায় করেছিলাম।
-এটাই তো আক্ষেপের কথা মা! তুমি এখন ভুলটা ধরতে পারলেও রেক্টিফিকেশনটা তো হবে না!
-তাহলে তুইই বা বললি কেন? আর তাছাড়া বিষয়টা রেক্টিফিকেশনের নয়। সেলফ রিয়েলাইজেশনটা তো জরুরী। নইলে সারাজীবন আত্মশ্লাঘা অনুভব করবো যে আমরা ছেলেমেয়েকে সর্বস্ব সঁপে মানুষ করেছি!
-তোমরা পিসি আর জ্যাঠা নিয়ে অকারণ আদিখ্যেতা করতে!
-ওটাই আমাদের সংষ্কার ছিল অতনু! যাইহোক, ছাড় ওসব কথা! রাত্রে কী খাবি? ছবি এসেছে, ওকে সেইমতো বলতে হবে তো!
-ভাতই করো। ফিরে গিয়ে তো সেই রুখা শুখা খাবার!
-কেন? তোরা ওখান থেকে চাল কিনিস তো!
-তা কিনি! তবে পর্ণা আবার ক্যালোরি কনসাস তো!
-ঠিক আছে। দাদুভাই কী খাবে?
-ওর জন্য একটু নুডলস করে দিতে বলো!
-কেন? ও একটু ভাত খাক না!
-নানা রকম নক্সা করবে খেতে। তার চেয়ে এটা সহজে খাবে।
-বাচ্চারা ওরকম একটু করে। তোর মনে নেই - তোদের দুই ভাইবোনকে এটা ওটা গল্প বলে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাত খাইয়ে দিতাম দুইবেলা।
-ওটা আনসায়েন্টিফিক মা! ওতে বাচ্চাদের ওভার ইটিং হয়ে যায়! তাছাড়া অমনোযোগী হয়ে খেলে বাচ্চাদের ডাইজেশন ও ঠিকমতো হয় না!
করবী আর কথা বাড়ালেন না। চায়ের কাপ দুটো নিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘরে দিকে হাঁটা দিলেন। অতনু উঠে গিয়ে একমনে একটা ক্যাকটাসের ফুল দেখতে লাগলো।
অতনুরা খানিকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। করবী বারান্দায় বসে চুপ করে রেকর্ডের গান শুনছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে ওর রেকর্ডপ্লেয়ারটা এখনও টিকে আছে। ঈশ্বর করুন উনি যে ক’বছর বাঁচেন, এটাও যেন ততদিন দেহ না রাখে। তাহলে জীবনের একটা বড় সম্বল হারাবেন তিনি। মীরার আসার কথা, এখনও এল না। হঠাৎ একটা শূন্যতার বোধ মনটাকে ছেয়ে দিল করবীর। প্রবীরের চলে যাওয়ার পর এ ক’দিন লোকজনের আসা-যাওয়া লেগেই ছিল, তারপর অতনু আর দাদুভাই এল। আজ খাঁ খাঁ করে ঘরটা যেন গিলতে আসছে। শম্পা বলছিল অবশ্য ক’টা দিন গিয়ে ওর কাছে কাটাতে। উনি গা করেন নি। ধীরে ধীরে এই নিঃসঙ্গতাকেও তো সয়ে নিতে হবে। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে চমক ভাঙলো তাঁর। ঠিক অনুমানই করেছেন তিনি। মীরা এসেছে।
-কীরে, ওরা কখন গেল?
-এইতো ঘন্টা দেড়েক। ফ্লাইটে উঠে ফোনও করে দিয়েছে।
-তোর কি ওদের জন্য মন খারাপ করছে?
করবী কিছু না বলে হাসলেন। মীরা বললেন, ‘তোর বড় কঠিন হৃদয়।‘
-কঠিন না হলে কি টিকে থাকতে পারতাম এতগুলো বছর?
-তা ঠিক! তবে সন্তানের বিষয়টা তো ঠিক অঙ্ক মেনে হয় না। আবার কতদিনের জন্য চলে গেল!
-অভ্যেস হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো। এখন ওরা বেশীদিন এখানে থাকলেই বরং অস্বস্তি হয়। মনে হয় যেন ঘরে অতিথি এসেছে।
-করবী, এবার শম্পাকে যেন একটু অন্যরকম লাগলো। অতনুকে দেখলাম এড়িয়ে গেল। ব্যাপার কী?
-আমি এসবে মাথা ঘামাই না মীরা! হতে পারে বৈষয়িক ঈর্ষা! বা এমনটাও ভাবতে পারে - সারাজীবন বাবা-মাকে আমি দেখে রাখলাম - আর শ্রাদ্ধ-শান্তির বেলা পুত্রের কর্তব্য বেশী আকাঙ্খিত হয়ে পড়লো?
-তা তুই ইন্টারফেয়ার করলি না কেন? শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ আজকাল অনেক বাড়ীতে তো ভাইবোন মিলেই করে!
-তা হয়তো করে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় ব্যাপারটার মধ্যে লোকদেখানি আছে।
-এটা তোর ঠিক ধারণা নয় করবী। মেয়েরও তো মনে হতে পারে তার বাবার কাজে সে কিছু পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম করে!
-সে মনে হওয়াটা অন্যায় নয় মীরা! আমি সে কথা বলছি না। আমার মনে হয় না ফটোর সামনে জোড়াসনে বসে চালের পিন্ডি গেলানোটাই পারলৌকিক ক্রিয়া। ওটা তো মনে মনে নিবেদনও করা যায়!
-তাহলে তো এইসব অনুষ্ঠানের কোনও মানে থাকে না। লোকচার ভেবে যখন করছিই, তখন মেয়ের অধিকারটাকেই বা স্বীকৃতি দেব না কেন?
-দ্যাখ মীরা তুইও কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার কথাটাই মেনে নিলি। স্বীকৃতি মানে তো লোককে দেখানোই!
-সেভাবে দেখলে হয়তো তাইই। ছেলেকে যদি লোককে দেখাতে হয়, তবে মেয়েকেই বা নয় কেন?
-আমি ওভাবে ভাবিনি মীরা। আর তাছাড়া এসব শ্রাদ্ধ-শান্তি আমি যে বিরাট মানি তাও নয়। একটা কিছু করার বিধান আছে - আমি সেটাই মেনেছি শুধু। প্রবীরের দাদা বা দিদি যখন মারা গেলেন, ওদের কেউ ছিল না বলে অতনুই শ্রাদ্ধ-শান্তির কাজ করেছে। তখন শম্পার কথা কারুরই মনে আসেনি। সেজন্য প্রবীরের বেলাতেও আমার আলাদা করে ওর কথা মনে পড়েনি। আর তাছাড়া প্রবীরও ওর ইচ্ছা কিছু জানিয়ে যায়নি।
-প্রবীরদা উইল টুইল করে যায়নি কিছু?
-করেছে। ওর আলমারীর লকারেই রাখা আছে। আমি দেখিনি যদিও।
-দ্যাখ। এখুনি খুলে দ্যাখ।
-ইচ্ছে করছে না রে মীরা। আবার সেই বিষয় নিয়ে কচকচি। তার থেকে আমি মরে যাবার পর ভাইবোনে আধাআধি করে নিক। কারও কোনও কমবেশীর অভিযোগ থাকবে না। যতটুকু জানি স্পেসিফিক কিছু লেখা না থাকলে ওরা আধাআধি পাবে।
-অভিযোগের কথা উঠছে কেন? কেউ কি জানিয়েছে কিছু?
-সেরকম কিছু না। তবে কাল কথাচ্ছলে ছেলে বলে গেল আমরা ওদের কমফোর্ট আর লাক্সারি তেমনটা দিতে পারিনি - যতটা ওরা পাওয়ার হকদার ছিল।
-তুই কিছু বললি না?
-কী বলব? বেশী বলাটাও একধরনের এক্সিবিশনিজম্।
-তাই বলে কেউ অন্যায় অভিযোগ করবে সেটা মেনে নেওয়াটাও তো ঠিক নয়!
-তা ঠিক! এটা ওর পারস্পেক্টিভ। ও মনে করছে ও ওর ছেলেকে ম্যাক্সিমাম কমফোর্ট প্রোভাইড করছে।
-তাতে ছেলেটির বারোটি বেজে যাচ্ছে না তো! ছেলেবেলায় কৃচ্ছ্রসাধন করাটা ও তো শিক্ষার অঙ্গ!
-নতুন শিক্ষাবিদ ওরা।
-ওরা যে আজ এতটা প্রতিষ্ঠিত, এজন্য কৃতজ্ঞতা বোধ নেই?
-যাচাই করিনি রে!
-তোরা ওদের একটা কমপ্লিট ফ্যামিলি দিয়েছিলি। ওরা কি তাদের সন্তানকে ওটা দিতে পারছে?
-তাদের সেই অভাব বোধটুকু তো তৈরী হয়নি মীরা। হয়তো আমাদেরই শিক্ষা দেওয়ায় কোথাও ত্রুটি ছিল।
-যাইহোক, তুই যা দেখি, প্রবীরদা’র আলমারীটা খুলে দ্যাখ। অতনু ছিল - শম্পাকেও ডেকে নিয়ে উইলটা ডিসক্লোজ করে দিতে পারতিস। এখন কেউ হয়তো ভদ্রতা করে কিছু বলছে না, কিন্তু মনে মনে জল্পনা তো করছেই।
-করলে করুক। ছেলেমেয়ে দুজনেই প্রতিষ্ঠিত। কারোরই টাকার অভাব নেই।
-ঠিক আছে, তুই উইলটা নিয়ে আয়। তোর নিজেরও জানা দরকার - তোর জন্য কী কী আছে?
একটু পরে দুটো খাম নিয়ে হাজির হলেন করবী! একটায় উইল, আরেকটি চিঠি। উইলটায় চমক কিছু নেই। যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি করবী যতদিন বাঁচবেন ততদিন তাঁর। করবীর মৃত্যুর পর পুরোটাই সমান দুভাগে ভাগ হবে।বাড়ীটা যে অধিকার চাইবে - সে তৎকালীন বাজার মূল্য অনুযায়ী বাড়ীটার অর্দ্ধেক দাম অন্যকে দিয়ে দেবে।
মীরা বললেন, এইবার চিঠিটা পড়।
করবী খুলে দেখলেন, তাঁর উদ্দেশ্যেই লেখা। কাব্য, ভনিতা কিছু নেই। শুধু তিন লাইন, পুটু, আমি যদি আগে মারা যাই সেজন্যই এই লেখা। তুমি অতনুকে সব খুলে বলো। ভাবতেই পারো - এই গুরুভার তোমাকে কেন? আসলে তুমি আগে গেলে আমিই বলব। চয়েসটা ঈশ্বরের। প্রবীর।
-কী কথা করবী?
-থাক ওসব!
- তুই জানিস জোর করে বা খুঁচিয়ে কথা শোনা আমার অভ্যাস নয়। তবু আমার মনে হয় - তোর এই কথা আমার সাথে শেয়ার করা দরকার। তোকে আজ অনেকবেশী ক্লিষ্ট লাগছে। প্রবীরদা মারা যাওয়ার পরও তুই এতটা ডিপ্রেসড ছিলিস না। বোধ হয় অতনুর ওইসব অভিযোগ তুই মন থেকে মেনে নিতে পারিস নি। কোথাও কিছু তোকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। তুই বলে ফ্যাল।
-মীরা, তুই তো বহু বছর আমাদের বাড়ী আসিস। তোর কি কখনও মনে হয়েছে আমরা শম্পা আর অতনুর মধ্যে কোনও প্রভেদ করেছি?
-একদমই না। ছেলে-মেয়ে এইরকম জেন্ডার বায়াসনেস তোদের কারোরই ছিল না।
-আমি তোকে একটা এমন একটা কথা বলব, একমাত্র জীবিত মানুষ হিসাবে আমি জানি।
-তোর কথা বুঝতে পেরেছি। তোর গোপনীয়তা বজায় থাকবে।
-অতনু আমাদের সন্তান নয়।
-মানে?
-যা শুনছিস তাই। প্রবীর তখন আসানসোলের ওই দিকটায় পোষ্টিং ছিল, এক স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ের ডেলিভারী করতে গিয়ে মা’টা মারা যায়। সিজারিয়ান কেস ছিল। মেয়েটির বাবা মা এসে প্রবীরের হাতে পায়ে ধরে - বাচ্চাটার একটা ব্যবস্থা করতে। ওরা দিন আনে দিন খায় - এই রকম একটা বাচ্চা কীভাবে সামলাবে? তখন আমাদের বিয়ের বছর তিনেক হয়ে গেছে। প্রবীর সাত পাঁচ না ভেবে - এমন কি আমার অনুমতি না নিয়েই বাচ্চাটিকে নিয়ে বাড়ী আসে। তখন আমিও আসানসোলএ থাকতাম মাঝে মধ্যে। এই বাড়ীতে দাদা আর দিদি থাকতেন। ওঁরা সব শুনে মেনে নেন। আমরা সবাই মিলে ঠিক করি - অতনুকে এইকথা কেউ বলব না।
-শম্পা কবে এল?
-অতনুকে যেদিন প্রবীর বাড়ী নিয়ে এল সেই মাসেই আমার পিরিয়ড মিস গেল।
-পাড়া প্রতিবেশীরা কেউ জানতো না?
-তখন এদিকে লোক বসতি কম ছিল। এদের এই বিরাট চৌহুদ্দি, পাড়ার একদম একদিকে। এখন দেখলে বুঝতে পারবি না।
-তুই চিঠি লিখে বা ফোন করে অতনুকে এই কথা জানিয়ে দে করবী। সেদিন তোকে বড় বড় কথা বলছিল, তার জবাব পেয়ে যাবে।
করবী চুপ করে রইলেন। মীরা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে , কী ভাবছিস? বলবি না?’
-না।
-কেন?
-কী দরকার? ছেলেটাকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একটা শক দেবার?
-কিন্তু এই শিক্ষাটা কি ওর দরকার ছিল না? যে বাবা-মা তার অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের সামনে আলো জ্বালিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে - তাদের দিকে আঙুল তোলার আগে সে এবার দুবার ভাববে।
-সেটা ঠিক কথা মীরা। কিন্তু ধর এই অভিযোগটা যদি শম্পা করতো! এমন তো আকছারই হয় যে পেটের ছেলেমেয়েরা এর থেকেও খারাপ কথা বলে। ওই তো গোধূলির ছেলে কদিন আগে বললো না, ‘তোমরা আমাদের জন্য কী এমন করেছ?’ আজ অতনু ঘটনাচক্রে অন্য রক্তের বলে আমি এই কথা বলে ওকে ওর সঠিক জায়গাটা হয়তো দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু এ আমার গর্ভজ হলে কী বলতাম?
-কিন্তু এটা তো প্রবীরদার ইচ্ছা ছিল। শেষ ইচ্ছাই বলতে পারিস।
-শেষ ইচ্ছা বলেই সম্মান করতে হবে এতটা আমি ওর অনুগত ছিলাম না কোনওদিন।
-কিন্তু প্রবীরদাও নিশ্চই বুঝেছিল অতনুর আত্মম্ভরীতা। তাই বোধ হয় তোকে এরকম লিখে গেছে।
-হবে হয়তো। সবার সিদ্ধান্ত বা বিচার যে একভাবে হবে, তার তো মানে নেই!
-তোর বিচারটা কী শুনি?
-এখনো জানি না রে মীরা। আমি শুধু এটুকু জানি, মা বাবাদের অনেক বেশী ধৈর্য্যশীল, অনেক বেশী উদার হতে হয়। এখনকার মধ্যবয়সী প্রজন্মের বাবা-মা’রা একটা পাশ্চাত্য মোহে আছে। যতদিন সেই মোহ ভেতর থেকে না যাবে, এই অভিযোগ কখনও খন্ডাবে না। আজ অতনু এতকিছু করেও বৃদ্ধ-বয়সে হয়তো ওর ছেলের মুখ থেকে একই কথা শুনবে!
-এসব শুনতে হবে না বলেই বোধহয় বিদেশে অল্প বয়সে ছেলেমেয়েদের সব ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়। অবশ্য প্রবাসী ভারতীয়দের সমস্যা। তারা তো ওদের সব নেবে না। এদেশী সংষ্কারও তো থাকবে কিছু!
-যাই হোক, ওরা সুখে থাকুক এটাই আমার প্রার্থনা। বৃদ্ধ বয়সে অতনুও কষ্ট পেয়ে আমার মতো ভাবুক - ভুলটা কোথায় ছিল - এমন পোয়েটিক জাস্টিস আমি কামনা করি না।
-ওরা যদি কিছুদিনের জন্য তোকে বেড়াতে যেতে বলে, যাবি? এখন তো তোকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই!
-আগে যেতে ইচ্ছে করতো। আজকাল সত্যি আর করে না! আর তাছাড়া কাল আরও একশোটা টব আসছে। নানান ধরনের ফুল অর্ডার করেছি এবার। আমি চলে গেলে ওরা তো সব শুকিয়ে মরে যাবে।
-তোর অবর্তমানে?
-সেটা ওদের ভবিতব্য।
-তুই কি অতনুদের উইলটার কথা জানাবি?
-না।
-তুই কি অন্য আর একটা উইল করে যাবি?
-না। ওদের বাবার উইলটাই থাকবে। আমি মরে গেলে আলমারী খুলে বের করবে। সব তো ওদের বাবারই। আমার আর দেবার কী আছে সংষ্কার ছাড়া? ওটা যখন দিতে পারিনি, তখন আর দেবার গর্ব করব কী করে? ছাড় ওসব। চা করে আনি। তুই আসবি বলে আমারও খাওয়া হয়নি।
করবী দৃঢ় পদক্ষেপে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। মীরা জানেন এই দৃঢ়তাটুকু করবীকেই মানায়!
0 Comments