তেত্রিশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সেদিন শরীরটা একটু হলেও ভালো ছিল, আবছা আবছা টের পাচ্ছিলেন উঠোন জুড়ে শোরগোলের কথা…ভাইপোদের অফিসের তাড়া নেই,পুকুরে বুঝি মাছ ধরা হচ্ছে। নতুন বৌমারও যেন খানিক তাড়া ছিল আজ;গল্পে মন ছিল না।জীবনভ’র কখনও কোন অন্যায় কৌতুহল দেখাননি, এবারও তার অন্যথা হয়নি।জানার ইচ্ছে হলেও যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি খেয়ে নতুন বৌমাকে যেতে দিয়েছিলেন… জানলায় এসে পড়া রোদের দিকে তাকিয়েছিলেন আনমনে। হঠাৎ তাঁর দরজায় হৈচৈ …
-’তারামা!ও তারা মা!কেমন আছো গো!’টের পেলেন গায়ে কোমল স্পর্শ, বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুটি নারী অবয়ব…হাতে শাঁখা পলা চুড়ির রিনিঝিনি,পরিনত কন্ঠে কিশোরী বিহ্বলতা…কাছে এসে কিচির মিচির… ‘এমা!কি চেহারা হয়েছে গো তোমার তারামা!চিনতে পারছনি আমাকে!আমি তোমার অঞ্জলী গো!খবর পেয়ে তোমায় দেখতে এসেছি, সঙ্গে শেফালিও!’
কতো কষ্ট করে মানুষ করেছ,বিয়ে দিয়েছ, তুমি ছাড়া…’
চেনা চেনা স্বর যেন চেতনায় ঘা দিল অনেকদিন পরে…
চোখের তারায় তারায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো কবেকার ভুলে যাওয়া সব কথা।
তখন বিরজার সমর্থ বয়স, ঘরভর্তি ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে নিজের খেয়ালে। তাদের দেখভাল এবং ঘরোয়া কাজেকর্মে বিরজারও দিনযাপন চলছিল নিস্তরঙ্গ ছন্দে।
ইতিমধ্যে বড়ো ভাইপোটি পড়া শেষে ওকালতি শুরু করেছে কাছের মেদিনীপুর শহরে, তার জন্য পাত্রী দেখাও শুরু হওয়ার কথা হচ্ছে নিয়মমতো। অন্যদিকে বড়ো দাদাও চাকরি শেষে রিটায়ার্ড করে বাড়ি ফিরে এসেছেন,কলকাতার পাততাড়ি গুটিয়ে। বাড়িতেও কিছু সংস্কার হয়েছিল সেসময় কালের নিয়মে, মাটির দাওয়াগুলি লাল টুকটুকে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হয
পুকুরঘাটে শান সাজানো …বাড়ির সামনে বাহারি ফুলের গাছ লাগানো; সীমানা বরাবর সুপারী-নারকেল, তার পাশে পাশে কামিনী,করবী,রক্ত কাঞ্চন, বোগেনভোলিয়া,কৃষ্ণচূড়া,রাধাচূড়া…একপাশে সরকার থেকে পাওয়া টিউকল…গাঁয়ের মেয়ে-বৌরা সকাল সন্ধ্যায় সেখানে জল ভরতে আসে কলসী কাঁখে। তারপাশেই আনমনে অবহেলায় লকলকিয়ে বাড়তে থাকে একটি শিরীষ। অনেকবারই তুলে দেওয়ার কথা হয়েছে,তবু তোলা হয়নি তাকে;ফুলে পাতায় পল্লবিত হয়ে জেগে থেকে যায় আপন মহিমায়। মাঝেমধ্যে ঐ গাছটির সঙ্গে বিরজা নিজের তুলনা করতেন।কেউ কেউ হয়তো এমন করেই মূল্যহীন হয়েও আপন আনন্দে আপনি বিকশিত হয়ে থাকে কালের নিয়মেই … এদিকে,বাড়ির অন্যরাও যে যার মতো বড়ো বা বুড়ো হতে থাকেন চক্রবর্তী পরিবারের, ভাইঝিগুলিরও বিয়ে হতে থাকে এক এক করে।
🍂
তখনকার দিনে তো সব বাড়িতেই বিবাহ সম্বন্ধ করার সময়ে ঠিকুজি কুষ্টি এসব দেখা হতো,মিলুক না মিলুক মানুষ বিশ্বাসও করতো তা অন্ধভাবে। এই যেমন, জন্মসুত্রে বিরজা মাঙ্গলিক হলেও ছিল নরগণ, কিন্তু বিবাহ সম্বন্ধে তার ছিল রাজযোটক মিল, সে হিসেবে সুখে শান্তিতেই সংসার করার কথা;বিবাহ হয়েও ছিল তেমন বাড়িতেই।অথচ পরিনতি যে সুখের হয়নি,সে ভয় সবসময়েই ছিল মনে। তাই তাঁরই মতো তাদের বড়ো ভাইঝিটিরও কুষ্টিতে যখন মাঙ্গলিক যোগের সঙ্গে কালসর্প যোগের খবর পাওয়া গেল,বাড়ির বড়োরা পড়লেন মহাচিন্তায়। একে তো মেয়ে সন্তান,তায় আবার বামুন বাড়ির কুলীন কন্যা। বিয়ে তো দিতেই হবে, এবং দিতে হবে সঠিক সময়েই। পাড়াগাঁয়ে এসব জানাজানি হলে বিয়ে হওয়ার আশা প্রায় নেইই,এদিকে পিঠোপিঠি বোনেরাও বেড়ে উঠছে দ্রুত,তাদেরও বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সুতরাং পারিবারিক গোপন শলায় ঠিক হলো, কন্যাটি মেজবৌদিদির গর্ভজাত হলেও তাকে কিছুই জানানো হবে না;কারণ সে নেহাতই বোকাসোকা মানুষ,পেটে কথা থাকেনা। এবং বিরজার ওপরেই দায়িত্ব পড়লো মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হবে বড়বৌদিদির বাবার বাড়িতে,সেখানে থাকেন এক পীরবাবা,তাঁর কাছে গিয়ে যদি কিছু নিদান পাওয়া যায়…
নিজে এসব তেমন বিশ্বাস না করলেও পারিবারিক চাপ,স্নেহের দাবী;অগত্যা আবার বড়বৌদিদির বাবার বাড়ি যাত্রা… সেখানে লোকজন কম,কাজের সুবিধে।
মনে আছে,এক শেষ বিকেলের মরা আলোয় পীরের থানে গিয়ে নিদান প্রার্থনার কথা …বুড়ো ফকির বাবা হেসেছিলেন, বিরজার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন,
-’নিয়তি কি খন্ডানো যায় মা!’
-’যা হোক কিছু করুন বাবা।বড়ো আশা করে এসেছি যে…আমাদের বাড়ির বড়ো মেয়ে…’
-’বেশ। আমি যা জানি,তাই করছি। কিন্তু…’
-’তাই করুন।মন জানুক, আমরা চেষ্টা করেছি।তারপরে যা থাকে কপালে’
তারপরে তাঁরই কথায়, গভীর গোপনীয়তার মধ্যেই সেখানকার এক গাছের সঙ্গে অনুঢ়া কন্যাটির বিবাহ দেওয়া হয়,পরের সকালে গাছটি কেটে ফেলা হয় এবং…তার পরবর্তী তিনদিন মেয়েটিকে বৈধব্য পালন করানো হয়… এখনও চোখের সামনে যেন সেসব ঘটনাবলী জলছবির মতো ভাসে।ফিরে এসে লৌকিক বিবাহ দেওয়া হয় পাল্টিঘরে,এবং সুখের কথা,সে এখনও সংসার করছে পাকাচুলে দিব্যি টুকটুকে সিঁদুর লাগিয়ে।
পিসির দুর্ভাগ্য তাকে কেন,তাঁর কোন ভাইঝিকেই ছোঁয়নি, জীবন উপান্তে এসে এই ভরসাটুকুই প্রাপ্তি মানেন যেন…
আধোচেতনে ভেসে ওঠে ছায়া ছায়া অসংখ্য উদ্বিগ্ন মুখ; প্রিয়-অপ্রিয়…এতো মানুষ,এতো মানুষ ভালোবাসে তাঁকে!
বাইরে তখন জষ্টিশেষের নিদাঘতপ্ত দ্বিপ্রহর; নতুন বৌটির নবাগত সন্তানের আগমন কল্যাণে সাধভক্ষনের আয়োজন চলছে, বাড়ি ভর্তি পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের ভীড়। সবাই এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই গল্পে গল্পে উঠে আসছে কর্তামার অসুস্থতার কথা,তাঁর জীবনের একক ব্যতিক্রমী সংগ্রামের কথা…শুনছে এযুগের মেয়ে বৌগুলি।হয়তো শিখে নিচ্ছে জীবন পাঠ,অগ্রজার জীবন থেকে;দূরে জ্বলছে আলো…ঘরে আঁধার,মনোময় মেঘের ধারাপাত…
“একান্তে,গহন নির্জনে, ভালোবাসা কাঁপে আনমনে
এপার ওপার জুড়ে খেয়া, শুধুমাত্র বাওয়া
একা একা বিহঙ্গ ভ্রমণ; শেষে একা ফিরে যাওয়া…”
0 Comments