ইস্কুল ফিস্কুল
পর্ব-১১
সৌমেন রায়
চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি
পা পিছলে আলুর দম (১)
এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির এখন নাম হয়েছে কো কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি। কারণ এগুলো শিক্ষারই অঙ্গ। বিবিধ এক্টিভিটি বিবিধ গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়। সবাই লেখাপড়ায় ভালো হয় না। কেউ হাতের কাজ ভালো করে। কেউ খেলাধুলায় ভালো, কেউ ভালো আবৃত্তি করে, আবার কেউ বা গুছিয়ে বক্তব্য রাখতে পারে। প্রত্যেকের সুপ্ত গুন গুলির বিকাশ করা স্কুলের অন্যতম কাজ। নাটক কৈশোরের অমিত শক্তিকে সঠিক পথে চালাতে সাহায্য করে, ভ্রমণ দিগন্ত বিস্তৃত করে অনন্তের আস্বাদ দেয়। এই সব কো - কারিকুল্যার অ্যাক্টিভিটি গুলি কিশোর বয়সীদের প্রাক্ষোভিক বিকাশে( Emotional Development) সহায়তা করে। কিশোর বয়সে এমনিতেই নিজের মধ্যে ঝড় চলে। নিজেকে প্রকাশ করার প্রবল আকাঙ্খা হয়। এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপ তাদের সে সুযোগ করে দেয়। তাই এইগুলি স্কুলে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রিক বিকাশের জন্য। বর্তমানে এসবের কিন্তু অভাব নেই স্কুলে। একঘেয়ে পড়াশোনা থেকে ছাত্রছাত্রীরা এখন মুক্ত। কিন্তু কথা হচ্ছে কত্তা লাভের গুড় পিঁপড়ে খাচ্ছে না তো ? আগে গুড়ের হিসাব করা যাক তারপর পিঁপড়ের হিসাব হবে। গুড়ের সঙ্গে কিছু গাদও থাকবে। মানে সার্বিকভাবে স্কুলে সারা বছর কি কি হয় দেখা যাক।
জানুয়ারি ২ তারিখ হয় বুক ডে। ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ হয় সেদিন। তবে সেই সময় ছাত্র-ছাত্রীরা নিউটনের প্রথম সূত্র অনুযায়ী স্থিতি জাড্য আক্রান্ত থাকে। তাই এই সময় তাদের স্কুল আসতে মন চায় না। বই দেওয়া চলে ফেব্রুয়ারি গড়িয়ে মার্চের প্রথম দিক পর্যন্ত। ব্যতিক্রমী দু একজন প্রকৃতি পাঠ (বাঁশবন, আমবনে অনর্থক ঘোরা ) ও শরীর চর্চা (মোবাইল গেম) নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে তারা ফার্স্ট ইউনিটের ঠিক আগে আগে বই সংগ্রহ করে। বছরখানেক হল নির্দেশ এসেছে দু তারিখ থেকে পুরো সপ্তাহ পালিত হবে স্টুডেন্ট উইক হিসাবে। নাচ, গান, সেলিব্রেটি মিট, কুইজ, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ সহ যাবতীয় শিক্ষনীয় বিষয় আছে সাজেশন লিস্টে। এমনকি ফুড ফেস্টিভেল পর্যন্ত আছে । যেহেতু ফুড ফেস্টিভেলটি নতুন তাই বেশ সাড়া ফেলেছে। আর যা আলোড়ন ফেলে তাকে কি সপ্তাহে আটকে রাখা যায়! বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা ঘটা করে করছেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে দিচ্ছেন। সেখানে আবার নাইস, কনগ্রাচুলেশন, এইসব কমেন্টের বন্যা। তাই দেখে করতে মন চাচ্ছে খগেন, নগেন সবার। আপনি হয়ত ভাবছেন খাবার ও রান্না জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দুটি বিষয়ে প্রাথমিক পাঠ স্টুডেন্ট পেয়ে যাচ্ছে স্কুলে। খাদ্য সম্পর্কে, কি খাব কি খাব না, ফুড ভ্যালু এইসব নিয়ে একটা জ্ঞান গড়ে উঠছে। তাহলে আপনি বিলকুল বেকুব। খাদ্য তালিকায় হিট ফুচকা, আলু কাবলি, চাওমিন, মোমো ইত্যাদি ইত্যাদি।
জানুয়ারির মাঝামাঝি আসে মকর পরব । গ্রামে এটা বড়ো পরব। তাই ঐ সময় গ্রামাঞ্চলে ছেলে মেয়েরা স্কুল কম আসে। তারপর ২৩ ও ২৬ শে জানুয়ারি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা , তার আগে তার প্রস্তুতি। এইসময় এদিক ওদিক হয় স্পোর্টস। আনন্দে মেতে ওঠে সব ছাত্র-ছাত্রী। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্কুলের মাঠ। শ্রেণীকক্ষে ম্লান মুখ গুলি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কোন কোন স্কুলে শিক্ষামূলক ট্যুর হয় এই সময়, আবার কোন কোন স্কুলে অন্য সময় ।ট্যুর কিন্তু দিনে আবদ্ধ থাকে না, থাকা উচিতও নয়। যেমন পড়া বইয়ের পাতায় বেঁধে রাখা যায়না সেরকম ট্যুরকেও ট্যুরের দিন বেঁধে রাখা উচিত নয়। সেই কারণে সেটা আগে পিছে বেশ কিছুদিন চলতে থাকে। অনেকদিন আগে আমার স্কুল জীবনের এক বায়োলজি শিক্ষক টুয়েলভ এর ক্লাসটা শুরু করতেন ‘ তোমাদের এবার যে এক্সকারসন টা হবে ‘ এই বলে। তারপরে ক্লাসটা কি হতো সেটা আপনারা অনুমান করে নেন। এরই মাঝে কোন স্থানে পড়ে সরস্বতী পূজা। বাঙালি নবীনদের ভ্যালেন্টাইনস ডে। ইদানিং স্কুলের সরস্বতী পুজোতে মাতামাতি একটু কম হচ্ছিল। স্টুডেন্টরা সব টিউশনের পুজো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল । স্কুলে যেহেতু একটা শাসনের বন্ধন থাকে তাই যথেষ্ট এন্টারটেইনমেন্ট এর সমস্যা হয়। সেই কারণে স্কুলের শিক্ষকরা ভেবেচিন্তে হাতে কার্ড বানানো, আলপনা দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন রকম করে আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ফলে কোনো কোনো স্কুলে তা আবার চেগে উঠেছে। কোথাও কোথাও ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে( 28 th) পালিত হয় বিজ্ঞান দিবস। তার একটা প্রস্তুতি আছে। ছোটখাট এক্সজিবিশন করা আছে। এইসব করতে করতে চলে আসে মাধ্যমিক বা এইচ এস সেন্টার। সেন্টারে হয় না এমন ‘ভাগ্যহীন ‘ স্কুল কমই আছে। আবার কম সংখ্যক ‘ভাগ্যবান ‘ আছে যাদের দুটো সেন্টার হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক। এ সময় গোটা স্কুল বন্ধ থাকে দশ থেকে পনের দিন। এরপর খানিক পড়া হওয়ার কথা কিন্তু ওই যে এত সব অনুষ্ঠানের ঘোর কাটতে একটু সময় লেগে যায়। দু চার দিন পড়াশোনার পর হোলি। গান্ধীজীর বুনিয়াদি শিক্ষার অনুসরণে কেউ কেউ আবার হোলিতে রং বানানো শেখান ছেলেদের। হোলির পর ইউনিট টেস্ট। ইউনিট টেস্টের আগে পিছে অনুপস্থিতি। প্রথম ইউনিটের সিলেবাস কিন্তু শেষ হয়ে যায়। কারণ পড়ে তো শিক্ষক।
তারপর চৈত্র সংক্রান্তি। এটিও গ্রামাঞ্চলের বড় উৎসব। তাই উপস্থিতি কম থাকে। মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছাত্র ছাত্রীরা ঈদ এর আগে পরে কম আসে। ঈদ বিভিন্ন বছর বিভিন্ন সময় পড়ে। সেইসব মিটে খানিক পড়াশোনার প্রস্তুতি শুরু করতে করতে গরমের ছুটি। বেশ কয়েক বছর রবীন্দ্রনাথের বাজার মন্দা । ছুটির চোটে জন্মদিনটা পালন করা হয়ে উঠে না। তারপর আছে অপরিকল্পিত ভাবে পরিকল্পিত গরমের ছুটি। মানে এক্সট্রা গরমের ছুটি। গরমের দেশে লিস্টে দশ দিন ছুটি রাখা হয় এক্সট্রা দেওয়া হবে বলেই। সকাল স্কুল প্রায় উঠে গেছে। ছাত্রছাত্রীদের টিউশনের অসুবিধা। মাস্টারমশাই দের যাতায়াতের অসুবিধে। ছুটি বেশ একটা চমৎকার সমাধান। বিকল্প ভাবার কষ্ট অনেক! সেই ছুটি উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গে একই সময়। হয়তো দক্ষিণবঙ্গে যখন গরম উত্তরবঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে। তা হোক এক রাজ্য এক নিয়ম। আগে ছুটি ব্যাপারটা স্কুলের হাতে ছিল( মোট ছুটি নির্দিষ্ট ছিল,স্কুল গুলি নিজেরা ডিস্ট্রিবিউশন করত)। এখন অনেকটাই সরকারি নিয়ন্ত্রণে । আগে ফ্যান বিহীন ক্লাসরুমে ক্লাস হতো। এখন ক্লাসরুমে ফ্যান আছে। তখন কি গরম পড়ত না? এসব প্যানপ্যানানি গেয়ে লাভ নেই। সময় পাল্টেছে।
আরো আছে নির্বাচন। প্রতি পাঁচ বছরে তিনটি নির্বাচন হয় নির্বাচনের সময় শিক্ষকদের ট্রেনিং হয়, ডিউটি যেতে হয় । কিন্তু সে বেশি দিনের নয়। সমস্যাটা হয় অন্যত্র। সোনার বাংলায় নির্বাচনে রক্তপাত সবচেয়ে বেশি। তাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক, এমনকি জম্মু কাশ্মীরের থেকেও বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী এখানে মোতায়েন থাকে। তাদের থাকার ব্যবস্থা হয় স্কুল গুলিতে। সেই সমস্ত ‘সৌভাগ্যবান’ স্কুলগুলি আরো বেশি দিন ছুটি থাকে।
গরমের ছুটি খোলার পর পড়াশোনার সুযোগ কিঞ্চিত বেশি। কিঞ্চিত কিছু পরিমাপ নয়। আপনি যেমন খুশি ভাবুন। তবে বেশি ভাববেন না। কারণ এখানেও আছে। পুজোর ছুটির আগে সাড়ে তিন মাসে আছে স্বাধীনতা দিবস, শিক্ষক দিবস, গান্ধী জয়ন্তী । যদিও গান্ধী জয়ন্তীতে পশ্চিমবঙ্গে তেমন কিছু হয় না। আমরা বাঙালিরা বড় যুদ্ধ তেমন করিনি । কিন্তু যুদ্ধ ব্যাপারটা বেশ ভালোবাসি। অহিংসা ব্যাপারটা কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে ! সেই কারণে বোধহয় গান্ধী বঙ্গে খুব একটা জনপ্রিয় নন। আছে রাখি উৎসব। কোন কোন স্কুলে রাখি বানানোর প্রতিযোগিতা হয়। এই সময়ই পালিত হয় অরণ্য সপ্তাহ। গাছ তুলে দেওয়া হয় ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে। ফটাফট ছবি পোস্ট হয় সোশ্যাল মিডিয়াতে। গাছের অবস্থা কি হবে কেউ জানে না। কিন্তু ছবি অবিনশ্বর। আপনার সবুজায়ন প্রচেষ্টার সাক্ষ্য হয়ে থেকে যাবে অনন্তকাল। এই সময় নির্মল বিদ্যালয় সপ্তাহ পালিত হয়। রোজ প্রার্থনার সময় পরিচ্ছন্নতার গান গাওয়া হয়, হাত ধোয়া শেখানো হয়, বিদ্যালয় পরিষ্কার করা হয়, স্থানীয় এলাকায় পরিচ্ছন্নতার পাঠ দেওয়া হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের হাজার ব্যস্ততা।এই সময়কালের মধ্যেই হয় শ্রেণি ভিত্তিক ফুটবল লিগ। সাত থেকে দশদিন ব্যাপী টিফিনের পর থেকে খেলা চলে । লীগ চলাকালীন স্টুডেন্টরা বিশেষ করে ছেলেরা খুব চঞ্চল থাকে। ক্লাসে মনোযোগ না থাকলেও বোঝা যায় তারা বেশ একটা আনন্দে আছে। এই সময় অনেক স্কুল বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ সভা করে। এই সময় না হলে বছরের কোন না কোন সময় হয়। নাচ, গান, আবৃত্তি তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, ডিবেট, কুইজ এবং তার প্রস্তুতি নিয়ে সপ্তাহখানেক বেশ হৈ হৈ কান্ড। এই সুযোগে কিছু নতুন প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যায়। বিদ্যালয়ের সভাগৃহ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বিবিধ সৌদামিনীর ঝলকে। বিদ্যালয়ের আপাত মলিন সভাকক্ষগুলি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন পর কোনও শ্রান্ত অবকাশে সভাকক্ষের স্বেদ সিক্ত শরীরের স্মৃতি হয়ত মনে শান্তির প্রলেপ দেয়। অনেক স্কুল প্রতিবছর না হলেও মাঝে মধ্যে নাটকের আয়োজনে করে থাকে ছুটির আগে আগে।
এই সময় আবার ব্লক ও জেলাস্থরের ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান সংস্থা গুলির নিদ্রা ভঙ্গ হয়। এরা সব বিবিধ অনুষ্ঠানের ডাক পাঠায়। যেমন বিজ্ঞান মডেল প্রদর্শন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়ার ট্রায়াল, মক পার্লামেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবেরও প্রস্তুতি লাগে। এগুলিতে পুরো স্কুলের ছাত্রছাত্রী অবশ্য লাগেনা। আর প্রতি বছর সবগুলি হয়না।
( পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায়)
1 Comments
আর একটি প্রতিভা প্রকাশের ক্ষেত্র বাদ পড়ে গেছে স্যার, স্টুডেন্ট দের ।সেটি হলো যেয়ে বসন্ত উৎসব। এটি ও যেহেতু একটি উৎসব,তাই স্বাভাবিকভাবেই এটিরও প্রস্তুতি ইত্যাদি ইত্যাদি আছে ।
ReplyDelete