জ্বলদর্চি

ধান /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩৩
ধান

ভাস্করব্রত পতি

'মোর ধানক্ষেত, এইখানে এসে দাঁড়ালে উচচ শিরে,
মাথা যেন মোর ছুঁইবারে পারে সুদূর আকাশটিরে!
এইখানে এসে বুক ফুলাইয়া জোরে ডাক দিতে পারি,
হেথা আমি করি যা খুশী তাহাই, কারো নাহি ধার ধারি।
হেথায় নাহিক সমাজ-শাসন, নাহি প্রজা আর সাজা,
মোর ক্ষেত ভরি ফসলেরা নাচে, আমি তাহাদের রাজা।
এইখানে এসে দুঃখের কথা কহি তাহাদের সনে,
চৈত্র দিনের ভীষণ খরায় আষাঢ়ের বরিষণে।'
      -- ধান ক্ষেত, জসীমউদ্দীন

কত ছড়া এই ধানকে ঘিরে। কত প্রবাদ এই ধানকে ঘিরে। কত ইতিহাস এই ধানকে ঘিরে। আমরা যাঁরা এ রাজ্যের বাসিন্দা তাঁরা জানি ধান নিয়ে এখানে কি উন্মাদনা। লোকসংস্কৃতির চক্রব্যূহে ধান একটা আলাদা সমীহ আদায় করে থাকেই। তা সে পৌষ পার্বনই হোক বা নল সংক্রান্তি! 
 ধান কেন্দ্রিক লৌকিক উৎসব

বাঙালীর মাঙ্গলিক পূজার্চনায় ধান কিংবা ধানের শিষ অতি প্রয়োজনীয়। এই ধানই তো আমাদের পেটের জঠরানল নিবৃত্তি করে। ধান হল লক্ষ্মী। তেমনি দুর্গাপূজায় ‘নবপত্রিকা'তে যে নয়টি গাছের আনয়ন করা হয় তার মধ্যে ধান একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। “আমার বাড়ি যেও কুটুম বসতে দেব পিঁড়ে / জলপান করতে দেব শালিধানের চিঁড়ে / শালিধানের চিঁড়ে নয়রে বিন্নি ধানের খই / মোটা মোটা সবরী কলা কাকমারা দই'। এ ছড়া আমাদের পরিচিত। শালিধানের নামও আমাদের জানা। বাংলা প্রবাদে পাই 'যে দেয় ভাত শালা পানি শালি, যম তারে পাড়ে গালি।' এখানে 'শালি' অর্থে শালিধান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শালিধানের উল্লেখ করেছেন এইভাবে -- 'বাঁদরওয়ালা বাঁদরটাকে খাওয়ায় শালিধান্য'। 
ধানের দেবী লক্ষ্মীর সাধভক্ষন

ধানের বিজ্ঞানসম্মত নাম Oryza sativa Linn.। এটি Gramineae পরিবারের অন্তর্গত। প্রাচীন সংহিতায় ৫ রকম ধানের উল্লেখ পাই। যেমন শালি ধান্য, ব্রীহি ধান্য, শুক ধান্য, শিম্বী ধান্য ও ক্ষুদ্র ধান্য। তাদের মধ্যে হেমন্তকালের পাকা ধানকে বলে শালি ধান্য। এটিই অপভ্রংশতায় 'শাল' হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু শালিধানের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন — কফিশাল, জঁটাশাল, রঘুশাল, চাঁপাশাল, কবিরাজশাল, রক্তশাল, লাটাশাল, ভুতুশাল, সীতাশাল, ঝিঙ্গাশাল, চাঁপাশাল, গঙ্গাশাল, অগ্নিশাল, ভীমশাল, মেঘনাদশাল, লেবুশাল, শ্রাবণশাল ইত্যাদি। প্রাচীন পুঁথি থেকে আরও কিছু ধানের নাম উল্লেখ করা যেতেই পারে। সেগুলি হল- খেজুর ছড়ি, ক্ষীরকলস, গন্ধতুলসী, অপরাজিতা, কাজলঘন্টা, রূপনারায়ণ, লোহাগড়া, লীলাবতী, সোনাখড়কি, সূর্যমণি, হাতিপাঁজর, মরিচদান, হরিশঙ্কর, মন্দিরকলা, আলাচিতি, দাদুসাই, গুয়াথুপি, গুড় জোয়ানী, আশ্বিন গুটিকা, কার্তিকগোনা, গন্ধকেতকী, চাঁপাসোনা, চড়ুইনখ, জটামাধব, বাঁকচুর, পর্বত গুটিকা, বকুলমালা, বাঁশগজাল, মাধবলতা, মৌকলস, বীরকুল, তাম্রচুর, নন্দলাল, কপিলারস, জলামুখি, পাণ্ডবমুড়ি, ফেঁপরি, মেঘডুম্বুর, মহিষনাদ, মাধবলতা, দলকলকি, রোয়া, মৌবাস, উত্তরকুলি, দুগ্ধরাজ, মহিষনাদ ইত্যাদি। বেশ কিছু ভোগ ধানের নামও পাওয়া যায় এখানে। যেমন বিষ্ণুভোগ, দুর্গাভোগ, গোপালভোগ, রাজভোগ, ভোগজিরা, বাদশাভোগ ইত্যাদি। এই সব ধান বেশ সুগন্ধীও হয়। আগেই বেশ কিছু শালিধানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই পুঁথিতেও মেলে অনেক শালিধানের নাম। যেমন - পিঁপড়েশালি, রঘুশালি, মাধবশালি, তুলাশালি, উত্তমশালি, গৌতমশালি, চিত্রাশালি, পাটশালি, হীরাশালি, গুড়শালি, কপূরশালি, ঝিঙ্গাশালি, পরমান্নশালি, রঘুশালি, ধুতরাশালি, বৃন্দেশশালি, কুসুমশালি, রায়শালি, চন্দনশালি, লাউশালি, সীতাশালি ইত্যাদি।
ধান জমিতে ধানচাষী

প্রজাতিগুলি অবশ্য গ্রামগঞ্জ থেকে প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছে। শালিধান বৈদিক যুগের পরবর্তী সময়কালের ধান। প্রথমদিকে বৈদিক যুগের চাষীরা যে ধানের চাষ করত তা হল 'ব্রীহি'। এই ধান বুনে চাষ করা হত কেবল। বর্ষাকালে চাষ হত। কিন্তু শালিধানের চাষ হত শীতকালে, রোপন পদ্ধতিতে চাষ হত শালিধান। আসামে অসমীয়া ভাষায় রোপন পদ্ধতিতে চাষের জন্য চারা তৈরির উপযুক্ত বীজ ধান ভেজানোকে বলা হয়ে থাকে ‘জালি। যার উৎপত্তি 'শালি' থেকে। এই রোপন পদ্ধতিতে শালিধানের চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়। ফলে আসামে একটি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের নাম হয় ‘শালি’। বীজ ধান থেকে চারা তৈরি করে রোপন পদ্ধতিতে ধান চাষের বিবরণ মেলে প্রাচীন পালি সাহিত্যে। আর ৬০ - ৭০ দিনে যেসব ধান পাকে, সেগুলো ষষ্টিক ধান্য বা ষেটে ধান বলে। যা সংস্কৃতে ব্রীহি ধান্য নামে পরিচিত। যব জাতীয়কে শুক ধান্য বলে। মুগ, কলাই প্রভৃতিকে শিম্বী ধান্য এবং কঙ্গ, শ্যামা, কোদো এইসবকে ক্ষুদ্র ধান্য হিসেবে পরিগণিত। 

এছাড়াও ভুতুধান, কলামোচা, কুমোর কানাই, আগিরমান, মাসুরি, দুধের সর, রত্না, জয়া, পঙ্কজ, বাঁশকাঁটা, পাটনাই, হাতিপাঁজর, কবিতা, সবিতা, বাঁশমোতি, গন্ধমালতি, দেরাদুন, বাদশা ভোগ, পাঁকোই ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। উচ্চফলনশীল তথা হাই ইয়েলডিং চাষ হিসাবে ধানের যে সব প্রজাতির প্রচলন এখন দেখা যায় সেগুলি হল - নেটিভ ওয়ান, তাইনান থ্রি, আই টি, ললাট, আই আর ছত্রিশ, হাজার দশ, চোদ্দশ চুয়াল্লিশ, শঙ্কর, মিনিকিট, জয়া, পদ্মা, ব্লুবেলি, শ্যামাশ্রী, জয়ার ক্রশ, আই আর চৌশট্টি, ক্ষীতিশ, ২২৫৪, শতাব্দী ঝাউ নম্বর ওয়ান, রত্না ইত্যাদি। আমন ধানের প্রজাতি হিসেবে শঙ্করশাল, জামাইনাড়ু, চাঁপাশাল, জংলিজটা, বুড়াকাখর, রঞ্জিত, লক্ষ্মীকাজল, মোতী, আই টি ৫৬, গীতাঞ্জলি, হীরা, ধনরাজ, পঙ্কজ, স্বর্ণ পঙ্কজ, পাঁকোই, মুগাই ইত্যাদি প্রজাতির ধানের প্রচলন আছে। সমস্ত শঙ্কর প্রজাতির ধানই কম সময়ে ফলন দেয়।

খৃষ্টীয় প্রথম শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত অর্থাৎ চরক সংহিতার কাল থেকে ভাবপ্রকাশের কাল পর্যন্ত মোট ১৮ প্রকার দেখা যায়। এগুলি এক গুণসম্পন্ন নয়, দোষ বা ক্ষতিকর হিসেবেও সব যে এক তাও নয়। শিবকালী ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন, "(১) শরৎ বা গ্রীষ্ম কালের ধানের বিশিষ্ট ধর্ম হচ্ছে, তার তন্ডুলের অন্ন পরিপাকের সঙ্গে সঙ্গে পিত্তকর হয়। (২) প্রতিটি ঋতুর সন্ধিক্ষণে যে ধান পাকে, সেটা পিত্তকর যেমন হয় না, তেমনি শ্লেষ্মার প্রাধান্যও নিয়ে আসে না। এগুলো কিন্তু বোনা ধান, এগুলোর চারা ফেলে পুনরায় রোপণ করতে হয় না। (৩) আর এক রকমের ধান, যেগুলো প্রথমে চারা তৈরী ক'রে নিয়ে পরে রোপণ করা হয়, সে ধানের চালের গুণ হচ্ছে, পিত্ত ও কফনাশক। তবে সামান্য বায়ু বাড়ে। (৪) যে ধানের শুঁয়ো বড় এবং লাল রঙের, এগুলোও চারা তৈরির পরে রোপণ করা হয়। আর সাধারণতঃ ৯০ দিনের আগে পাকে না। তেমন নিম্নভূমিতে (জলাসন্ন জমিতে) এ ধান পাকতে আরও দেরী হয়। সেইগুলিই আয়ুর্বেদ মতে হৈমন্তিক ধান্য অর্থাৎ হেমন্ত ঋতুতে পাকে"।

আমন ধানের চাষের ক্ষেত্রে ১ বিঘা বা ৫২ ডেসিম্যাল জমিতে প্রয়োজন হয় ১০-১২ কেজি বীজধান। জৈষ্ঠ্যের ১৫ থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত বীজতলা ফেলানোর কাজ চলে। বীজ রোপন শুরু হয় আষাঢ়ের ১৫ থেকে শ্রাবণের শেষ পর্যন্ত। আষাঢ়ের শুরু থেকে লাঙল দেওয়া হয়। ধানা কাটা শুরু হয়ে যায় অঘ্রাণের ৮-১০ তারিখে। আর তা চলে পৌষের ১৫ তারিখ পর্যন্ত। আবার বোরা ধানের চাষের ক্ষেত্রে এক বিঘা জমিতে প্রয়োজন পড়ে ২০-২৫ কেজি বীজধান। এক্ষেত্রে বীজতলা জমিতে ফেলা হয় অঘ্রাণের ১০ তারিখ থেকে মাসের শেষ পর্যন্ত। পৌষের ২০-২২ তারিখ থেকে মাঘের ১৫ তারিখ পর্যন্ত বীজতলা তুলে জমিতে রোপনের কাজ চলে। আর ধান কাটা শুরু হয় চৈত্র মাসের ২২ তারিখ নাগাদ। বৈশাখের ১৫ তারিখ পর্যন্ত তা দীর্ঘায়িত হয়। এ সময় কাল বৈশাখীর প্রকোপ থাকে। তাই চাষীরা যত দ্রুত সম্ভব মাঠের ধান ঘরে তোলার চেষ্টা করে। সব শেষে বলি, আউস ধানের কথা। আউস ধান চাষের ক্ষেত্রে এক বিঘা জমিতে প্রয়োজন ১৫-২০ কেজি বীজধান। বৈশাখের ২২ তারিখ থেকে বীজ ধানের তলা ফেলা হয়। বীজতলা রোপনের কাজ শুরু হয় জৈষ্ঠ্যের ১৫ তারিখে। মাসের শেষ পর্যন্ত তা জারি থাকে। আউস ধান কাটা হয় শ্রাবণের ১৫ তারিখ থেকে শ্রাবণের শেষ পর্যন্ত। সমস্ত শঙ্কর প্রজাতির ধান তথা উচ্চ ফলনশীল ধানই আউস ধান হিসেবে চাষ হয়।

'ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন— খেতে মাঠে প’ড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম— সাপের খোলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ— কেমন নিবিড়।
ওইখানে একজন শুয়ে আছে— দিনরাত দেখা হ’তো কতো কতো দিন,
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।'
   -- ধান কাটা হয়ে গেছে, জীবনানন্দ দাশ

প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ 'শূন্যপুরাণ' এ বহু ধানের নাম পাওয়া যায়। এই নামগুলি অবশ্য বৌদ্ধযুগের। শূন্যপুরাণে উদ্ধৃত ধানের নাম হল আজান, আমপারণ, আলাচিত, আন্ধারকুলি, আমসলো, আসতির, আসঅঙ্গ, উড়াশালী, ককটি, কনকচুর, কাঁঙদ, কামদ, কালাকার্তিক, কালাযুগর, কুষুমমালী, কোটা, খরিকম্বা, খেজুরছড়ি, খেমরাজ, গআবলী, গন্ধতুলসী, গন্ধমালতী, গুজুরা, গোতমপলাল, গোপালভোগ, চন্দনসাল, ছিছরা, জলারাঙ্গি, জেধ, জোলি, ঝিঙাশাল, তসরা, টাঙ্গন, তিলসাগরি, তুলানধান, তুলাশাসি, তোজনা, দলাগুড়ি, দাড়, দুধরাজ, নাগরজুগান, পালাল, পর্বতজিরা, পাঙ্গুসিয়া পাতল, পাখর, ভেফেরি, বককড়ি, বন্ধি, বানি, বুখি, বুড়ামাত্তা, বিদ্ধসালী, ভজনা, ভাদোলী, ভাদ্দমুখী, মইপাল (মহীপাল) মাধবলতা, মুক্তাহার, মৌকলস, মূলামুক্তাহার, রক্তসাল, রাসগড়, রাজদল, লতামৌ, লাউসলী, লালকাজিনী, বাঁকই, বাঁকচুর, বাঁকসাল, বাগনবিচি, বাঁসকটা, বাঁজগটা, বাঁসমতী, বোআলি, সনাথড়কি, সালছাটী, সীতাসালী, সোলপনা, হুকুলি, হরিকালি, হরি, হাতিপাঞ্জোর ইত্যাদি।
সদ্য রোপিত বিস্তীর্ন ধানের জমি

আবার রামেশ্বর ভট্টাচার্যের 'শিবায়ন' কাব্যেও 'শিবের চাষরঙ্গ' পালায় বহু ধানের নাম খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলি হল কপোতকণ্ঠিকা, হাতিপাদ, রাঙ্গামেট্যা, শঙ্করজটা, শঙ্করশালি, সীতাশালি, হরকুলি, ভবানীভোগ, ভোজনা, রান্দী, হরিশঙ্কর, হাতিপঞ্জর, হুড়া, হিঞ্চি, হলুদগুড়ো, কেলেকানু, গৌরিকাজল, লক্ষ্মীকাজল, কেলেজিরা, কানিয়া, কার্তিক, কয়াকচ্চা, কাশীফুল, কালিন্দী, কনকচুর, কুষুমশালী, দুধরাজ, দুর্গাভোগ, জগন্নাথভোগ, কোঙরভোগ, পর্দেশী, ধুস্তর, কৃষ্ণশালী, কোঙরপূর্ণিমা, কল্মিলতা, কনকলতা, কামোদ, খেজুরথুপী, খয়েরশালী, ক্ষেম, গঙ্গাজল, গয়াবলি, গোপালভোগ, গন্ধমালতী, গুয়াথুপী, গুণাকর, চামরতালি, জলারাঙ্গী, ঝিঙ্গাশালী, বলাহিভোগ, ধুল্যা, নিমুই, নন্দনশালী, রূপানারায়ণ, বাঁকশালী, রঙ্গয়করি, নহীপ্রিয়, পূণ্যবতী, রামশালী, বুড়ামাত্রা, বাকচুর, দাড়বন্দী, বুয়ানি, বাকোই এবং রামগড়। রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’- এ শিবের ধানচাষ সম্পর্কে অনেক কথা লেখা আছে। গ্রামের মহিলারা পড়তেন 'লক্ষ্মীচরিত্র' থেকে ‘বিনন্দ রাখালের পালা'। সেই পুঁথিতেও রয়েছে হরেক ধানের নাম। এই 'বিনন্দ রাখালের পালা'তে বিনন্দ রাখাল গোশুড়ার বিলে গিয়ে ভূবনমোহন ধান চাষ করে লক্ষ্মীর বারে। এখানেই লেখা আছে— "বিনন্দ রাখাল বলে শুন ওগো মাতা। / অসাধ্য চাষের কৰ্ম্ম অসম্ভব কথা। / কথা শুনি মাতা কার্তিকের গুরুবারে। / আড়াই পোয়া ধান্য বেয়ান দিল বুনিবারে / নদী খাল মড়াচির লাখরাজ জমি। / লক্ষ্মী বলে বরপুত্র বুনে এস তুমি। / আড়াই পোয়া ধান্য হবে তিন লক্ষ আড়া। / বিশেষ কবির তোরে ইন্দ্র হৈতে বাড়া"। 

মোঘল আমলে আকবরের সময়কালে ভারতে সবদিক থেকেই উন্নতি দেখা গিয়েছিল। কৃষিকাজেও পিছিয়ে ছিলনা তখন। সে সময় যে সব ধানচাষ হত তার নজির আছে 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থতেও। সেখানে মেলে যে সব ধান বা চালের নাম সেগুলি হল দেওয়ান প্রসাদ চাউল, ষাঠী চাউল, সংজেরা চাউল, সুখদোষ চাউল, দেকের চাউল, খঞ্জন চাউল, দাসজেরা চাউল, মিছরি চাউল ইত্যাদি।

ধান অতি মাঙ্গলিক উদ্ভিদ। পূর্ব মেদিনীপুরের কয়েকটি ব্লক এলাকায় ধানেশ্বরী দেবীর পূজার্চনায় প্রয়োজন পড়ে ধানের গুচ্ছের। ড. বঙ্কিম মাইতি লিখেছেন —'খেজুরি নন্দীগ্রামে আছেন ধানের দেবী ধানেশ্বরী। হেলে কৈবর্ত ও মাহিষ্যদের মধ্যে তার পুজো প্রচলিত। অগ্রহায়ন পৌষে মাঠের ধান উঠলে গ্রামের ভেতর তেমাথাতে মূর্তি গড়ে পূজা হয়। পূজা করেন সাধারণত চক্রবর্তী পদবীর ব্যাসত্ত ব্রাহ্মণ। মূর্তি দুর্গার মত গৌরী, দ্বিভূজা। পাশে একগাছি পাকাধান। দুর্গামন্ত্রেই তাঁর পুজো হয়। লক্ষ্মীর মত তাঁর কক্ষে কুম্ভ বা শতদল আসীনা নন। এই দেবীকে বলা হয় ধান্যশ্রী গৌরী। যা ধানেশ্বরীর সংস্কৃত রূপ। ইনিই গ্রামের রক্ষাকর্তা বা ক্ষেত্ৰপালিকা। এই ধান্যশ্রী গৌরী সারা বছর ধরে মৃত্তিকামূর্তি গড়ে খড়ের চালাঘরে পূজিতা হয়। ব্রাহ্মণরা পুজো করেন। দেবীর সামনে সরায় ধান থাকে। যা অনেকটা অন্যান্য হিন্দু পরিবার লক্ষ্মীপূজায় করে থাকেন। পৌষ সংক্রান্তির পর পোড়ামাটির লক্ষ্মী প্রতিমাকে সারা বছর এভাবেই পূজা করা হয়।

'বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি — ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্নে ভরে;
সোনালি রোদের রঙ দেখিয়াছি — দেহের প্রথম কোন প্রেমের মতন
রূপ তার — এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছ ঢেকে গূঢ় রূপ — আনারস বন।'
    -- জীবনানন্দ দাশ

ধান এমনই এক উদ্ভিদ যা সর্ব প্রাণীর প্রয়োজন কোনও না কোনও ভাবে। যজুর্বেদে (বাজসনেয়ি সংহিতা) পাই — 'ধান্যমসি ধিনুহি দেবান্। প্রাণায় ত্বা। উদানায় ত্বা। ব্যানায় ত্বা। দীর্ঘামন প্রসিতি মায়ুষে, ধাং দেবো বঃ সবিতা। চক্ষুয়ে ত্বা। মহীনাং পয়োসি'। এটির অনুবাদে আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য লিখেছেন— 'তুমি ধান্য। প্রাণকে ধারণ করাও তাই ধান্য। দেবতাদের এবং প্রাণীদের অগ্নিকে প্রীত কর এবং দীর্ঘ প্রাণের স্থিতিকারক শ্বাসকে রক্ষা কর, তাই আয়ুও তুমি। আবার উর্ধ্ব চেষ্টা এনে উদানরূপেও অবস্থান কর। উৎক্রান্তির সময়ও তোমার বলাধান থাকে। সমগ্র দেহে বোপে থাক— তাই তোমারই নাম ব্যান। ব্যানই বল। দেবতাদের তুমি সজীব রাখ। দীর্ঘকাল অবিচ্ছিন্ন আয়ুকে তুমিই রক্ষা কর। তোমাকে ভক্ষণ করে গবাদি ক্ষীর দান করে, তাই তুমিই ক্ষীর।'
বাংলা প্রবাদে আছে --
'গোয়ালে দুধাল গাই 
গোলায় যার ধান।
পুকুরেতে মাছ ভরা 
টাকায় নেই টান। 
পুত যার লেখে পড়ে 
খায় দুধভাত। 
কলিকালে মানুষ নয় 
সেই জগন্নাথ।'

🍂

Post a Comment

0 Comments