জ্বলদর্চি

স্বাধীনতা, না স্বেচ্ছাচারিতা? /মিলি ঘোষ

আর কবে ভাবব! 
পর্ব ১ 

স্বাধীনতা, না স্বেচ্ছাচারিতা?
মিলি ঘোষ

 স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা, দু'টো আলাদা শব্দ,  আলাদা বোধ। একটা সূক্ষ্ম সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে এর অনুভূতি। দুটো শব্দই আপেক্ষিক। 

আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। সে'জন্য আমি যা খুশি করার অধিকারী না। আমার রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু যাবার পথে অন্যের বাড়ির জানলার কাচ ভাঙার অধিকার নেই। সেটা করতে যাওয়াই স্বেচ্ছাচারিতা। 

যদিও স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছাচারিতার কোনও সংজ্ঞা হয় না, কিন্তু নির্মাণ একটা থাকেই আর সব কিছুর মতো। আসলে স্বাধীনতা একটা শিক্ষা, যাকে অনুশীলন করতে হয়। যে শিক্ষা গড়ে ওঠে মূলত পরিবার থেকে। 
যে শাসনের মধ্যে শিশুরা বড়ো হতে থাকে, সেই শাসনের মধ্যে সমানভাবে ভালোবাসা থাকাও দরকার। নাহলে, শিশুদের মধ্যে পরাধীনতার বোধ তৈরি হয়। প্রয়োজনে কঠোর হতেই হয়। কিন্তু সন্তানকে মুঠোয় রাখতে গিয়ে অতি শাসনের ফলে নিজের অজান্তেই বাবা, মায়েরা সন্তানের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। আর শিশুরা ভাবে, তারা মা-বাবা'র পরাধীন। 

যদি শাসন আর ভালোবাসা কয়েনের এপিঠ ওপিঠ হয়, তাহলে শিশুর উপলব্ধিও সেই মতোই হবে। বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে তারা বুঝতে শিখবে, যে জায়গা থেকে নিষেধ আসছে, সেই জায়গা থেকে ভালোবাসাও আসছে। ওই একই জায়গায় আব্দারও করা যাচ্ছে। একই মানুষ কখনও কঠোর, কখনও বন্ধু, কখনও খেলার সাথী। কিন্তু ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে তারা যেন স্বেচ্ছাচারী না হয়ে ওঠে, সে খেয়াল বড়োদেরই রাখতে হবে। বাড়িতে শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরি করতে পারলে সন্তানের সেদিকে আকৃষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে। স্বাধীনতা-স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যেকার সূক্ষ্ম ব্যবধান  বাড়ির বড়োদেরই বোঝতে হবে। নাহলে এই ব্যবধান বাড়তে বাড়তে বৃহৎ আকার ধারণ করবে। তখন বুঝিয়েও কাজ হবে না, শাসনেও কাজ হবে না। এর জন্য অভিভাবকদের স্বশিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। মোবাইল ছাড়াও জীবনের স্বাদ যে আরো অনেক কিছুতে নিহিত, তা সর্বাগ্রে তাঁদেরই বোঝা দরকার। নিজেরা যদি সাদা কালোর পার্থক্য না বোঝেন, সন্তানকে কী শেখাবেন! তাঁদের জীবনবোধ, জীবনদর্শনের ওপর নির্ভর করবে সন্তানের বেড়ে ওঠা। 

বারো থেকে বাইশ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। কারণগুলো কী কী : সামনে পরীক্ষা, মা পড়তে বসতে বলেছেন। অথবা দামি মোবাইল, নয়তো বাইক চেয়ে পায়নি। একটা জীবনকে শেষ করার কারণগুলো দেখুন। এ ছাড়া প্রণয় ঘটিত কারণও থাকে। পছন্দের জিনিস চেয়ে না পাওয়া বা পড়তে বসতে বলাই আত্মহত্যার একমাত্র কারণ হয় না। এই বিষয়গুলিকে নিয়ে বাকবিতন্ডা এমন পর্যায় পৌঁছে যায়, যা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা নিতে পারে না। প্রশ্ন সেখানেই, এতদূর গড়াচ্ছে কেন ? আরো আগেই সন্তানকে স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার প্রভেদটা বোঝানো দরকার ছিল না কি ? যা খুশি চাইবার, যা খুশি করবার অধিকার ওদের কে দিয়েছে ? লাগাম বাবা মায়েদের হাতেই ছিল, কিন্তু সময় থাকতে রাশ টানেননি। যার পরিণতি এটাই। একটু বন্ধুর মতো মিশলে ভালোবাসার খবরাখবর ছেলেমেয়েরা মায়ের কাছেই সবার আগে দেয়। জীবন যে কত বড়ো, জীবনের যে আরো কত দিক আছে, এসব না জেনেই  অকালে হারিয়ে যায় প্রাণগুলো। নিজের কষ্টের কথা কারোর সাথে ভাগ করে নিতে না পেরে এক ভয়ঙ্কর মানসিক চাপের মুখোমুখি হয় তারা। মানুষ নিজের বাঁচার জন্য কী না করে, সেই প্রাণকে কত সহজে এরা শেষ করে ফেলতে পারে! বয়ঃসন্ধির সময় ভালো কথাও ওদের খারাপ মনে হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী এবং সন্তানের বয়স অনুযায়ী মা-বাবাকে  অনেক বুঝে চলতে হয়। নাহলেই অভিভাবকরা সন্তানের সাথে তাল দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যান, নয়তো ওরা নিঃস্ব হয় জীবন দিয়ে। যদিও আত্মহত্যার কারণ হিসেবে যা যা বলা হয়, সবটাই অনুমান। আসল কারণ চলে যায়, যে আত্মহত্যা করল তার সাথেই। 

আত্মহত্যা তো শেষ কথা। তা নাহলেও তো অনেক কিছুই ঘটে সংসারে, যা অনভিপ্রেত। যার মূলে থাকে বাবা মায়েদের অনিচ্ছাকৃত বহু ভুল। নিজেদের অজান্তেই স্বাধীনতা দিতে গিয়ে কখন যে তাঁরা ছেলেমেয়েদের স্বেচ্ছাচারী করে ফেলেন, নিজেরাও টের পান না। 

পরিবারের কথা প্রথমেই আসে, কারণ, পরিবারই সমাজ তৈরি করে। কিন্তু আমরা স্বেচ্ছাচারী সর্বত্র। হাসপাতালে আপনজন মারা গেলে দলবল নিয়ে এসে আমরা ডাক্তার পেটাই। আমাদের দাবিটা ঠিক এরকমই, ডাক্তার যখন হয়েছেন, তিনি মানুষকে অমর করবেন। আমি পড়াশুনা করব। বিজ্ঞান জানব, কিন্তু বিজ্ঞান মানবো না। কোন পরিস্থিতিতে কোন রোগ কতটা ভয়াবহ হতে পারে, আমরা জানার চেষ্টাই করব না। কারণ, ডাক্তার আছে। 

নিজের জন অসুস্থ হলে মানুষ ডাক্তারের কাছেই ছোটে। কে না চায় সেই মানুষটা বেঁচে ফিরুক! হাসপাতালে রোগীকে ফেলে রাখা, সময় মতো না দেখা, গরীবের রক্ত শুষে খাওয়া, এসব তো আছেই। কিন্তু ঠিকঠাক চিকিৎসা পেয়েও মানুষ মারমুখী হয়। 
পুরো সিস্টেমটাই 'আমার যেমন ইচ্ছা তেমন করব'-র ওপর দাঁড়িয়ে। যে সময়ে রোগীকে আসতে বলা হয়, তার অন্তত দু'ঘণ্টা পর ডাক্তারবাবু আসবেন ( অবশ্যই সবাই না )। পয়সা খরচ করে নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েও আয়াদের থেকে অবহেলা, খারাপ ব্যবহার সইতে হয়। নার্সদের ব্যবহারও খুব মধুর হয় না। কারণ, পেসেন্ট তখন মুরগি। এছাড়া নার্সিং হোমের চড়া বিলের কথা না বললেও চলে। যে যা করছে, সবটাই তার ইচ্ছায়। আবার সুচিকিৎসা পেয়েও কিছু উগ্র মানুষ ডাক্তার পেটায়। এও তাদের ইচ্ছা। স্ব ইচ্ছায় তারা এই কাজগুলি করছে। তাহলে বলুন, এটা কি স্বাধীনতা,  না স্বেচ্ছাচারিতা ? 

আপনি যত ওপর দিকে তাকাবেন, দেখবেন স্বেচ্ছাচারিতা আরো বেশি। তার ঝুড়ি ঝুড়ি উদাহরণ প্রতিদিন আমরা পেয়ে থাকি, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে। শুধু ওপরের কথা কী বলব, বাড়িতে যে বাসন মাজতে, ঘর মুছতে আসে, সে কখন আসবে, কত টাকা নেবে, কী কী কাজ করবে সবটাই সে ঠিক করবে। মানে, চাকরি নেবার শর্ত। কোনও কোনও পাড়ায় একজন মানুষ গুরুতর অসুস্থ জেনেও বা পরীক্ষার্থী আছে জেনেও পাশের বাড়িতে মাইক লাগিয়ে তিনদিন ধরে কীর্তন হয়। আপনারই কোনও পরিচিত, এমনভাবে বাইক চালিয়ে যাবে, রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটেও ভয়ে আপনি এক পাশে দাঁড়িয়ে যাবেন। রাত দুটোর সময় পর পর তিন চারটে বাইক রীতিমতো আওয়াজ তুলে কোনও বন্ধুর বাড়িতে রাত্রি ব্যাপী ফুর্তির বন্যা বইয়ে দেবে। কী বলবেন আপনি, এসব স্বাধীনতা ? 
১৫ই আগস্টে অনেক আবাসনের ছাদে বা বেসমেন্টে বাজারি হিন্দি গান সহযোগে নৃত্য পরিবেশন করে স্বাধীনতা উৎসব পালন করা হয়। শুরুতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে মূল উৎসবে চলে যায়।  আনন্দ উৎসব করা যেতেই পারে। সে জন্য স্বাধীনতা দিবসকেই বেছে নিতে হবে ? এর কী ব্যাখ্যা দেবেন ? আসলে স্বেচ্ছাচারিতার জন্য কোনও শিক্ষার দরকার হয় না। তাই অশিক্ষিত, মধ্য শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত সব ধরনের মানুষের মধ্যেই এ প্রায় সংক্রামক ব্যাধির আকার ধারণ করেছে। এর প্রভাব এত বেশি, যে সত্যিই আমরা বুঝতে পারি না, কোনটা স্বাধীনতা আর কোনটা স্বেচ্ছাচারিতা।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  2. একদম ঠিক৷ স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা এক নয়৷

    ReplyDelete