জ্বলদর্চি

শিশু সাহিত্যে নজরুল /প্রসূন কাঞ্জিলাল

শিশু সাহিত্যে নজরুল

প্রসূন কাঞ্জিলাল


শিশুরা ফুলেই মতই সুন্দর, নিষ্পাপ, পবিত্র। যিশু বলেছেন,‘যদি শিশুর মত সরল নিষ্পাপ হওয়া যায়, তা হলেই স্বর্গরাজ্য লাভ করা সম্ভব।’ এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, শিশু ভগবানের কতখানি প্রিয়! শিশু দেবোপম। এজন্য ইংরেজি বা  ইয়ুরোপীয় সাহিত্য শিশুকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। ইংরেজী বা ইয়ুরোপীয় শিশু সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সে তুলনায় বাংলায় শিশু সাহিত্য তেমন সমৃদ্ধ নয়। তবে যারা এগিয়ে এসেছিলেন এবং চমৎকারভাবে সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে শিশুদের মন জয় করেছিলেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সাহিত্যের দু’কূল প্লাবিত করে শিশুদের জন্য লিখেছেন। আমাদের কাছে যা সর্বদাই মূল্যবান। কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত চমৎকারভাবে শিশুদেরকে উপলব্ধি করতেন। খুব সহজে মজা করে তিনি তাদের কাছে নিজের সাহিত্যকে উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি চির শিশু, চির কিশোর’। তাঁর মধ্যে একটা শিশু সুলভ সারল্য ছিল। শুধু তাই নয়, তার মন ছিল শিশুর প্রতি আশ্চর্য সংবেদনশীল। সেজন্য তিনি অতি সহজে শিশুদের সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন এবং শিশুদের মনস্তত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাই শিশুর স্বপ্ন, সাধ, আশা- আকাঙ্ক্ষা কীর্তি-কলাপ, খেলা-ধুলা, ঠাট্টা-তামাশা, অনুকরণ প্রিয়তা, স্কুল জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, মা-বাবার সাথে মান-অভিমান, বুড়ো দাদুকে নিয়ে হাস্যালাপ, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন, কল্পনার রথে চড়ে দুঃসাহসিক অভিযান এসব তিনি নিবিড়ভাবে উপলব্ধি এবং সাহিত্যে সার্থক রূপদান করেছেন। শিশুদের প্রতি তার ভালবাসা ছিল একান্ত নিবিড়, হৃদয়ের গভীরতম ভালবাসা। নজরুল অনুভব করেছেন, শিশুর জগৎ মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তাই শিশুর সকল জিজ্ঞাসা, মান-অভিমান, আদর-আবদার মার কাছেই। আবার মার কাছেও শিশু যেন চির রহস্যময় এবং এই রহস্যের কোন অন্ত নেই। শিশু অবাক বিস্ময়ে মাকে প্রশ্ন করে --- 

'মাগো! আমায় বলতে পারিস
কোথায় ছিলাম আমি
কোন্ না- জানা দেশ থেকে তোর
কোলে এলাম নামি ?'

মাও শিশুকে ভালবেসে উত্তর দেয় ---

'তুই যে আমার, এই ত সেদিন
আমার বুকে ছিলি!'

কাজী নজরুল ইসলাম মা ও সন্তানের যে বিচিত্র, মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক, তা উজ্জ্বল রঙে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাৎসল্য রসের চরম অভিব্যক্তি ফোটাতে পেরেছেন। শিশুকে ঘুম পাড়াবার জন্য যেমন ঘুম পাড়ানী গান লিখেছেন, তেমনি জাগরনী গীতও লিখেছেন :

"ভোর হলো, দোর খেলো খুকুমনি ওঠরে
ঐ ডাকে জুঁই-শাখে 
ফুল-খুকী ছোটরে!
খুকুমনি ওঠরে!"

নজরুল উপলব্ধি করেছেন, শিশু-মন আশ্চর্য কল্পনা প্রবণ। তাই শিশু কল্পনার রথে চড়ে উড়ে যেতে চায় সূয্যিমামার আগে।

"আমি হবো সকাল বেলার পাখী
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি। 

সূয্যি মামা জাগার আগে, 
উঠব আমি জেগে, 
'হয়নি সকাল, ঘুমোও এখন'
মা বলবেন রেগে।"

শিশুমন স্কুলে যেতে চায় না, এর অন্যতম কারণ শিক্ষকদের প্রতি ভীতি; এবং এ বিষয়টিও তিনি চমৎকারভাবে লিখেছেন :

'সেথায় আবার থাকে
এক যে জুজু, গুরুমশাই বলে তাকে
নাকের ডগায় চশমা তাঁহার, মাথার ডগায় টিকি
হাতের ডগায় কঞ্চি বাঁশের, তাই দেখি আর লিখি!'

শিশুর দুরন্তপনার অবস্থাই এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। বস্তুত ‘লিচু চোরের’ মতো অভিনয় উপযোগী কবিতা বাংলা শিশু সাহিত্যে খুবই বিরল। এ কবিতার আবৃত্তি শুনে পাঠক বা দর্শক এক অনাবিল হাস্যরসে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কবিতাটি নাটকীয় গুণে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। নজরুল শিশুদের জন্যে শুধু ছড়া বা নাট্যধর্মী কবিতা রচনা করেন নি, নাটিকাও রচনা করেছেন। - যেমন: পুতুলের বিয়ে। শিশুদের জন্য এ নাটিকাটি খুব উপভোগ্য। বিয়ের সমস্যা শুধু বড়দের নয়, শিশুদেরও। ডালিম কুমারের কাহিনী নিয়ে এ নাটিকাটি রচিত। খুবই চমৎকার এবং হাস্যোদ্দীপক। পুরুত মশাই বিয়ে করাবার জন্য আসতে চায় না। তবু অর্থযোগে আনা হয়। তিনি ডালিম কুমারকে বিয়ের মন্ত্র পাঠ করতে বলেন :

'যদিদং অদয়ং তব
তদিদং হৃদয়ং মম।'

যদি অনুস্বার বিসর্গ সংস্কৃত হয়, তবে মনিই বা বসে থাকবে কেন। সেও চীনে ফুচুংকে বিয়ের মন্ত্র পড়ায় :
 
'ওয়ানং মর্ণং আই সেটঅং এ লেসং ম্যানিং,
ক্লোজ তো মি ফার্মং।'

কাজী নজরুল ইসলাম শিশুকে প্রাণ-মন দিয়ে ভালোবাসেন বলেই শিশুর প্রতি এই মাঙ্গলিক উচ্চারণ করেছেন। শিশুর প্রতি অন্তরের নিখাঁদ দরদ শিশু সাহিত্যকে করে তুলেছে আরও দেশী প্রাণস্পর্শী ও আবেগময়। ‘ঝিঙেফুল’ (১৯২৬), ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘পিলে পটকা’ (১৯৬৪), ‘সঞ্চয়ন’ (১৯৫৫), ‘পুতুলের বিয়ে’(১৯৬৪), ‘চয়নিকা’ ‘ঘুম পাড়ানী গান’(১৯৩৩), ইত্যাদি নাটিকা ও কবিতা। বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্য তার হাতে সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠেছে সার্থক ও অনবদ্য। বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্য খুবই বিরল। তবু এর ভেতর থেকেও যারা সত্যিকার অর্থে হৃদয়ের দরদ দিয়ে শিশুদের প্রতি ভালবাসা জানিয়েছেন তিনি নজরুল, এক চমৎকার শিশু সাহিত্য নির্মাতা, ভবিষ্যৎ এর সঠিক দ্রষ্টা।

বৈচিত্র্যময় এক বিরল প্রতিভার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ছিল তাঁর পদচারণা। বীর রস, করুণ রস, হাস্যরস সবই ছিল তাঁর সৃষ্টির ভান্ডারে। তা ছাড়া 
শিশুসাহিত্য বলতে পাঁচ থেকে এগারো বছরের বালক-বালিকাদের জন্য রচিত যেকোনো সাহিত্য পদবাচ্য রচনাকেই বোঝায়। বয়সের এ মাপকাঠি বালক-বালিকাদের গড়পড়তা মানসিক উৎকর্ষ বিচারের ওপর সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠিত। তবে অনেক ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদের জন্য রচিত রচনাকেও শিশুসাহিত্য বলে থাকেন অনেকে।
উৎকর্ষের বিচারে নজরুলের শিশুসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের এক দুর্লভ সম্পদ। শিশুসাহিত্যের কোনো কোনো জায়গায় তিনি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

‘ঝিঙেফুল’, ‘খুকী ও কাঠবিড়ালী’, ‘মা’, ‘খাঁদু-দাদু’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গল্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘লিচু চোর’, ‘ঠ্যাংফুলী ও পিলে-পটকা’, ‘হোঁদল-কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’, ‘প্রভাতী’ ইত্যাদি ছোটদের জন্য লেখা তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতা। প্রভাতী কবিতায় প্রভাতের বর্ণনা করেছেন অত্যন্ত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকরভাবে, আর উৎসবমুখর ঝর্ণাধারার মতো কবিতাটির গতিও অবারিত।

এই প্রভাতী কবিতাটি ‘ঝিঙেফুল’ কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। ‘ঝিঙেফুল’ কবিতাটিও একটি মিষ্টি কবিতা—

‘ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল
সবুজপাতার দেশে ফিরোজিয়া
ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল!’

‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ কবিতায় খুকুর উক্তির মধ্যে শিশু হৃদয়ের কল্পনাবিলাস ও জীবজন্তুর জীবন সম্পর্কে তার অসীম কৌতূহল ও আত্মীয়তাবোধ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার ভাষা ও ছন্দে শিশুসুলভ চপলতা লক্ষণীয়—

‘কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও?
বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা কুকুর ছানা? তাও?’

ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থে মোট ১৩টি কবিতা রয়েছে, যা পুরোপুরি শিশুদের উপযোগী। নজরুলের আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চয়ন’, যা শিশুসাহিত্যের অনন্য অবদান। এতে আছে ২৬টি কবিতা ও একটি নাটক। তার মধ্যে ‘প্রার্থনা’, ‘মা এসেছে’, ‘জননী জাগো’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, ‘মোরা দুই সহোদর ভাই’, ‘প্রজাপতি’, ‘বগ দেখেছো?’, ‘আগুনের ফুলকি ছোটে’ ও ‘মায়া মুকুর’ উল্লেখযোগ্য।

প্রজাপতি গানটিতে নজরুল শিশুর কাছে প্রজাপতির বিচিত্র সুন্দর রূপ ও তার মুক্ত জীবনের আকর্ষণকে সার্থকভাবে রূপায়িত করেছেন।

‘প্রজাপতি! 
তুমি নিয়ে যাও সাথী করে তোমার সাথে।
 তুমি হাওয়ায় নেচে নেচে যাও,
 আজ তোমার মত মোরে আনন্দ দাও।’

এ ছাড়া বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো 'পুতুলের বিয়ে’, ‘ঘুম জাগানো পাখি’, ‘ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি’ ইত্যাদি এবং কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘শেষ সওগাত’, ‘ঝড়’ ইত্যাদি, যা চিরকাল পাঠকের হৃদয় হরণ করেছে এবং করবে। এ ছাড়া ছড়া, কবিতা-গানে তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান।
 শিশুসাহিত্যে অপরিমিত, তিনি শিশুসাহিত্যে অদ্বিতীয় ও কালজয়ী। তাই চিরকাল শিশুরা ভক্তিভরা নয়নেই তাঁকে স্মরণ করবে ।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments