জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২৪৪/নদীর জলে সোনার গুঁড়োগ্রীস (ইউরোপ)/চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প— ২৪৪
নদীর জলে সোনার গুঁড়ো
গ্রীস (ইউরোপ)
চিন্ময় দাশ

[আমাদের রামায়ণ বা মহাভারত-এর মতো, গ্রীস দেশের মহাকাব্যেও বহু কাহিনী আছে। সেখানে বনজঙ্গলের একজন দেবতার কথা আছে। তাঁর নাম সাইলেনাস। গ্রীক পুরাণ-এ আনন্দ আর নাটক অভিনয়ের দেবতা হলেন ডায়োনিসাস। সাইলেনাস হলেন তাঁর দলের একজন সদস্য। তাঁর শরীরের উপরের অংশ মানবের মতো। আর নীচের অংশ দেখতে ছাগলের মতো।
গ্রীক এবং রোমাণ পুরাণ এবং সাহিত্যে বহু কাহিনী আছে সাইলেনাসকে নিয়ে। এখানে তারই একটি কাহিনী বলব আমরা।
যীশুখৃষ্ট তখনও জন্মাননি। তারও ৭০০ বছরেরও আগে, প্রাচীন আনাতোলিয়া (এশিয়া মাইনর নামেও পরিচিত) এলাকায়, মিডাস নামে একজন রাজা ছিলেন। তিনি ফ্রিজিয়ার রাজ্যের বিপুল শক্তিধর রাজা ছিলেন। দেবতা ডায়োনিসাসের কাছ থেকে একটি বর চেয়ে নিয়েছিলেন মিডাস। সেই বরের গুণে, যে কোনও কিছুতেই হাত ছুঁইয়ে দিতেন তিনি, তাই সোনা হয়ে যেতো!
সেই বর তাঁর জীবনে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল। মিডাস কী করে এমন ভয়াণক বরের হাত থেকে রাহাই পেয়েছিলেন, এবারের গল্পটা তাই নিয়ে।]
 
ডায়োনিসাস ছিলেন নাটকের দেবতা। একবার তাঁর নাটকের দলের লোকজন ভাবল, কোথাও একটু ঘুরে-বেড়িয়ে এলে মন্দ হয় না। একঘেয়েমি কাটে তাতে। 
সেই ভাবনা মতো, বেড়াবার জন্য আনাতোলিয়া এলাকায় এসেছে সবাই মিলে। তাদের মধ্যে সাইলেনাসের নেশা ছিল আঙুরের রস খেয়ে নেওয়ার। সেদিন বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। কখন যে একটা বাগানে বেড়াবার সময় ঘুমিয়ে পড়েছে, নিজেরই খেয়াল নাই  তার।
ঘুরতে ঘুরতে বিকেল নেমে এলো এক সময়। তাই দেখে, দলের বাকি সবাই ফিরে চলে গিয়েছিল, সাইলেনাসকে খুঁজে না পেয়ে। তাই থেকে ঘটনার সূত্রপাত। নতুন নাটকের সূচনা।
এদিকে বিকেল হয়েছে। রাজামশাই মিডাস বাগানে এসেছেন বেড়াতে। হঠাৎ দেখলেন, গোলাপের বাগানে একটা লোক পড়ে আছে। রাজার বাগানে উটকো লোক এল কোথা থেকে? আসেই বা কী করে?  ডাকাডাকি করতে, উঠে বসল ঘুমন্ত মানুষটা।
রাজা তাঁর লোকেদের বললেন—কিছুই বোল না এখানে। তুলে রাজবাড়িতে নিয়ে চলো।
রাজবাড়িতে পৌঁছে, সব কথা খুলে বলল সাইলেনাস। একটা গুণ ছিল সাইলেনাসের। খুব ভালো গল্প বলতে পারত সে। সব শুনে টুনে রাজা বললেন—তূমি চাইলে, আমার কাছে থেকে যেতে পারো। এখনই ফিরে গিয়ে আর কাজ কী? অন্তত কিছু দিন তো থেকে যাও।
সাইলেনাস থেকে গেল মর্তে। রাজা তাকে বিদূষক করে রাজসভায় বসিয়ে রাখলেন। নাটক করা লোক সাইলেনাস। হাসির গল্প বলতে ওস্তাদ। মজার মজার গল্প বলে, সভা জমিয়ে রাখে সে। 
দিন পাঁচেক যাওয়ার পর, সাইলেনাস বলল—এবার আমাকে ফিরতে হবে, রাজা। মনিব নিশ্চয় চিন্তা করছেন। তাছাড়া, নাটকের দলেও নিশ্চয় ঝামেলা হচ্ছে। 
রাজা আপত্তি করলেন না। বললেন—চলো তাহলে। আমি নিজে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। এই সুযোগে দেবতা ডায়োনিসাসকে দেখার সৌভাগ্যও হয়ে যাবে।   
স্বর্গে এসছেন দুজনে। সাইলেনাস ফিরে আসায় ডায়োনিসাস বেশ খুশি হলেন। মিডাসকে বললেন—তুমি বেশ আদর করেই রেখেছিলে আমার লোককে। তার পর নিজেই এসেছ তাকে পৌঁছে দিয়ে যেতে। ভারি খুশি হয়েছি আমি। বলো, কী পুরষ্কার চাও। 
রাজা তো হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন। স্বয়ং বিধাতা পুরুষ পুরষ্কার দেবেন, নিজের মুখে বলেছেন। ভাবলেন, বড় কিছুই চাইতে হবে। বিধাতারও তো মান থাকা চাই। ছোট-মোট কিছু চাওয়া বিবেচনার কাজ হবে না। বললেন—ঠাকুর, দেবেন যদি, একটা বর দিন।
--বলো, কী বর চাই তোমার? 
মিডাসের তো আনন্দ ধরে না। বললেন—নিজের হাতে আমি যা ছুঁয়ে দেব, তাই  যেন সোনা হয়ে যায়।
বিধাতা বললেন—বলো কী হে? সোনা হয়ে যাবে?
--হ্যাঁ, ঠাকুর, সোনা। তাতে ক’দিনের মধ্যে আমি বিশাল ধনী হয়ে যাবো। সারা আনাতোলিয়ার বাইরেও আমার মতো ধনী থাকবে না কেউ।
বিধাতার মুখ জোড়া রহস্যের হাসি। বললেন—ঠিক আছে, দিলাম বর। তাই হবে, নিজের মুখে তুমি যা চাইবে, হাত ছোঁয়ালেই সোনা হয়ে যাবে সব।
আহ্লাদে ডগমগ হয়ে মিডাস ফিরে এলেন স্বর্গ থেকে। প্রাসাদে ঢুকবার আগে, নিজের সেই বাগানে ঢুকে পড়লেন। মন ফুরফুরে। অজস্র গোলাপ ফুটে আছে বাগান জুড়ে। মিষ্টি সুবাদে ম’ম’ করছে চারদিক। ফুলের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন মনের আনন্দে। 
দেবতার দেওয়া বর। সে কি আর বিফলে যায়? হাত ছোঁয়ানো মাত্র সোনা হয়ে গেল ফুল। রাজা তো আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। গোটা বাগান জুড়ে ছুটে বেড়াতে লাগলেন। ছুটছেন, আর হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন ফুলে ফুলে। সারা বাগান সোনার ফুলে ভরে উঠল দেখত না দেখতেই। 
বড় পাথর নুড়ি পাথর নানা আকারের পাথর দিয়ে বাগান সাজানো। পাথরে হাত ছোঁয়াতে লাগলেন। কোথায় পাথর? চোখের পলক না পড়তে, সব সোনা হয়ে যাচ্ছে। তা দেখে, ফূর্তিতে মাটিতে পা পড়ছে না রাজার।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন মিডাস। চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন— কেবল আনাতোলিয়া নয়। সারা দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী হয়ে যাব আমি। বিশাল সেনাবাহিনী গড়ব। সারা দুনিয়া দখল করে নেব দু’দিনের মধ্যে। 
কতক্ষণ ধরে ছোটাছুটি দাপদাপি করছেন। গলা শুকিয়ে আসছে। একটু জল দেওয়া দরকার গলায়। মিষ্টি জলের ঝরণা গড়েছিলেন বাগানে। সেখানে দৌড়ে গেলেন মিডাস। 
ঝরণার জলে হাত ডুবিয়েছেন। এক আঁজলা জল নেবেন। সমস্ত ঝরণাটাই সোণা হয়ে গিয়েছে সাথে সাথে। মুখে তোলা গেল না।
ততক্ষণে রাজার ফিরে আসার খবর জেনে গেছে প্রাসাদ। লোকলস্কর দৌড়ে এসেছে বাগানে। একজন দৌড়ে গিয়ে এক কাপ আঙুরের রস এনে দিয়েছে রাজাকে। 
কাপে হাত লাগামাত্রই সেটা সোনা হয়ে গিয়েছে। কাপ তুলে ঠোঁটে ছুঁইয়েছেন, এবার সোনা হয়ে গিয়েছে আঙুরের রসও। এক ফোঁটাও নামল না গলা দিয়ে। 
নিজের প্রাসাদে ফিরে এলেন মিডাস। খাবার ঘরে ঢুকলেন। বাবুর্চিরা দৌড়ে এসেছে রসুইখানা থেকে। টেবিল সাজিয়ে দিয়েছে রাজার জন্য। উপাদেয় সব খাবার দাবার। মিষ্টি রুটি, নরম মাংস, আঙুর, অলিভ—কত কিছুই। 
কিন্তু মুখে তুলতে পারলেন না কিছুই। যেটাই হাতে তুলে নিচ্ছেন, সেটাই সোনা হয়ে যাচ্ছে। 
একটি মেয়ে ছিল মিডাসের। সন্তান বলতে এই একটি মাত্র মেয়েই। সোনার পুত্তলী। তাঁর নয়নের মনি। সারা দুনিয়ায় মেয়ের চেয়ে আর কিছু প্রিয় ছিল না রাজার।
বাবা ফিরে এসেছেন। খবর জেনে, সে দৌড়ে এসেছে। বাবা—বলে ডাক ছেড়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে এসেছে মেয়েটি। 
🍂
ad

প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলেন রাজা। এতক্ষণে সম্বিত ফিরেছে তাঁর। কী ভুলই না করে এসেছেন, দেবতার কাছে বর চাইতে গিয়ে। এখন নিজের মেয়েকেও হারাতে হবে। তাড়াতাড়ি বাধা দিতে গেলেন। কিন্তু তার আগেই, দু’হাত বাড়িয়ে দৌড়ে এসেছে মেয়েটি। 
ভয়াণক ভয় পেয়ে, রাজা চিৎকার করে বাধা দিতে গেলেন—নাহ-হ-হ-হ।
কিন্তু তার আগেই, মেয়ের বাড়ানো হাতে হাত ছুঁয়ে গিয়েছে বাবার। কোথায় তাঁর প্রিয় কন্যাটি। ঝর্ণার মতো উচ্ছ্বল, ফুটফুটে মেয়েটি উধাও। নিথর একটা সোনার মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে হতভাগ্য বাবা রাজা মিডাসের সামনে। 
হতবাক হয়ে গেলেন মিডাস। কী লোভ, কী নির্বুদ্ধিতা পেয়ে বসেছিল তাঁকে! স্রোতের মত জল গড়িয়ে পড়ছে রাজার দুচোখ বেয়ে। 
প্রাসাদ ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন মিডাস। পেছনে সবাই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু বুঝতে পারছে না, কোথায় যাচ্ছেন তাঁদের রাজা। 
সোজা …র দবারে গিয়ে হাজির হলেন মিডাস। আছাড় খেয়ে পড়লেন দেবতার পায়ে। আবার সেই রহস্যময় হাসি …র মুখে। রাজার মুখ বুক ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে। আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন—দোহাই, ঠাকুর! বাঁচান আমাকে। আপনার বর ফিরিয়ে নিন আপনি। পথের ভিখারি করে দিন। কোনও আপত্তি নাই আমার। শুধু আমার মেয়েটিকে ফিরিয়ে দিন আপনি। সোনা-দানা, ধন-দৌলত কিছুই চাই না আমার। কিচ্ছু না। দয়া করুন আমাকে। 
… বুঝলেন, শিক্ষা হয়েছে মিডাসের। বললেন—ধনদৌলতের কোনও মূল্য নাই জীবনে। মায়া মাত্র। স্নেহ-ভালবাসা, মায়া-মমতা বুকে রেখো। জীবন আনন্দময় হয়ে উঠবে। 
একটু থেমে, আবার বলতে গেলেন—তবে বাপু, …
--কোনও তবে নয়, ঠাকুর! হাত ছুঁইয়ে দিলে সোনা হয়ে উঠবে—এই অভিশপ্ত বর আপনি ফেরত নিয়ে নিন। 
… বললেন—সবই তো বুঝলাম। কিন্তু বাপু, একবার যে বর দিয়েছি, তা তো ফেরত হয় না। তবে, একটা উপায় বলছি। সেটা করো গিয়ে। রেহাই মিলবে এই দুর্ভোগের হাত থেকে।
মিডাস বলল—কী উপায়, ঠাকুর? বলুন আপনি।
দেবতা বললেন-- পাহাড় জঙ্গলে ঢাকা কোনও একটা নদীতে গিয়ে ডুব দিও। সোনার বর ধুয়ে মুছে যাবে তোমার ছোঁয়া থেকে। 
তাই করেছিলেন হতভাগ্য মিডাস। এক পাহাড়ি নদীতে নেমে, অনেক ডুব দিয়েছিলেন। ডুব দিয়ে উঠলেন। কিন্তু মনের ভয় যায় না। যদি কাজ না হয়। আবার ডুব দেন। এইভাবে অনেক বার ডুব দিয়ে পাড়ে উঠলেন। সামনেই একটা ঝোপ। পাতায় হাত বুলিয়ে দেখলেন, পরখ করবার জন্য। কোনও আশ্চর্য হোল না। গাছের পাতা পাতাই আছে। সোনার রঙ ধরেনি তাতে। 
প্রাসাদে ঢুকবার আগে বাগানে গেলেন। সেখানে সমস্ত ফুল সোনার। ছোট-বড় একটাও পাথর নাই। সবই সোনা দিয়ে সাজানো। এবার যেটাতেই হাত ছোঁয়ালেন, সোনার গড়ন উধাও। সবই ফিরে এলো আগের চেহারায়।
দৌড়তে দৌড়তে প্রাসাদে এসে ঢুকলেন রাজা। সামনেই দাঁড়িয়ে রাজকুমারির সোনার মূর্তি। অনেক আকুতি নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। সাথে সাথেই মেয়েটিও  প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল। “বাবা, বাবা” বলে, জড়িয়ে ধরল রাজা মিডাসকে। 
প্রাচীন কালের আনাতোলিয়া এলাকায় আছে সেই নদীটি আজও। যার স্রোতে সোনার কণা ভেসে যায়। সে নদীতেই স্নান করেছিলেন রাজা মিডাস। 
• বেশি দূর গিয়ে কাজ কী? আমাদের বাংলাতেও আছে তেমন এক নদী। সে নদীর স্রোতেও ভেসে যায় সোনার কণা। তাই-ই সে নদীর নাম—সুবর্ণরেখা।

Post a Comment

0 Comments