জ্বলদর্চি

‘পথের পাঁচালী’ এবং সত্যজিৎ রায় : একটি আলোচনা/কোয়েলিয়া বিশ্বাস

পথের পাঁচালী’ এবং সত্যজিৎ রায় : একটি আলোচনা

কোয়েলিয়া বিশ্বাস

‘পথের পাঁচালী’ – এই নামটি শুনলেই আপামর বাঙালির চোখে ভেসে ওঠে দুটি পরিচিত মুখ- একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অপরজন সত্যজিৎ রায়। একজন অসাধারণ শব্দ বিন্যাসে মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে তুলেছেন অপূর্ব এক গ্রাম্য কাহিনীচিত্র, আর অপরজন তাকে অপূর্ব সিনেমাটিক মুন্সিয়ানায় নিয়ে গিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। দুজনের কৃতিত্বই এতো বেশি যে ‘পথের পাঁচালী' নামটি শুনলেই আজও মনে পড়ে যায় কিভাবে স্কুলজীবনে পড়াশুনার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে মনের ভিতর খেলা করত অপু আর দুর্গা। কোনো এক নির্জন দুপুরে যখন সবাই দিবানিদ্রায় মগ্ন থাকত, আমার নিজস্ব ‘অপু’ তখন রেলগাড়ি দেখার বাসনায় পুকুর পাড় ছাড়িয়ে, নীলমনি রায়ের ভিটে ছাড়িয়ে, কাশবন ছাড়িয়ে দে দৌড়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী এই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা কমবেশি সবাই খুঁজে পাই আমাদের ফেলে আসা ছোট্টবেলাকে। খুঁজে পাই যান্ত্রিক জীবন-স্তূপে চাপা পড়ে যাওয়া সহজ সরল সেই ছোট্ট ‘আমি’টাকে। আর সত্যজিৎ রায় তাকেই চিরকালীন করে রাখলেন তাঁর সিনেমায়।

  ‘পথের পাঁচালী' বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯২৯ সালে। নিশ্চিন্দিপুর নামক এক স্নিগ্ধ, নির্মল, শান্তিপূর্ণ গ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাস। হরিহর এবং সর্বজয়ার জীবন সংগ্রামের সাথে অপু এবং দুর্গার খুনসুটি, তাদের সরলতা, তাদের গ্রাম্য জীবনচর্যা- সব মিলিয়ে 'পথের পাঁচালী' পাঠকের মনে এক অন্য রূপকথার জন্ম দেয়। সত্যাজিৎ রায় উপন্যাসটিকে সিনেমায় রূপ দেন ১৯৫৫ সালে। বলাবাহুল্য, ভারতীয় চলচিত্রের আন্তর্জাতিকীকরণের পথপরিক্রমা শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই। ক্রমে ‘পথের পাঁচালী' পৌঁছে যায় বিশ্বের দরবারে এবং হয়ে ওঠে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের মাইলস্টোন। সাত্যজিৎ রায়ের অসাধারণ চরিত্রায়ণ, সিনেমাটোগ্রাফি, দৃশ্যায়ন এবং চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার সিনেমাটিকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের শিখরে। তাঁর অসামান্য গল্প বলার ধরন জীবন সম্পর্কে এক চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায় দর্শকের মনে, যা প্রকৃতির মতোই বিশুদ্ধ এবং পবিত্র। সত্যজিৎ রায়ের ছবিটি তৈরি করতে সময় লেগেছিলো তিন বছর। সেই সময় তাঁর অর্থাভাব এতো প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে পরিচালককে তাঁর ব্যক্তিগত পুঁজিও বিক্রি করে দিতে হয়। শেষমেশ সরকারি লোন নিয়ে ১৯৫৫ সালে তিনি ছবিটি সম্পূর্ণ করেন।

  চলচ্চিত্রের খাতিরে পরিচালক কোথাও কোথাও সামান্য সংযোজন বা বিয়োজন ঘটিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা মূল উপন্যাসের নির্যাস বা সাহিত্যরসের ব্যাঘাত ঘটায়নি বিন্দুমাত্রও। বরং সেগুলি দারুণভাবে প্রতীকী হয়ে এক ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেয় দর্শকদের উদ্দেশ্যে। উপন্যাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অসাধারণ গ্রাম্য দৃশ্য এবং গ্রাম্য চরিত্র নির্বাচন প্রমাণ করে পরিচালকের ‘জহুরির চোখ'। বাংলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে অতি সাধারণ এক দরিদ্র্য পরিবারের অপু-দুর্গার কাছে রেলগাড়ী ছিল এক আশ্চার্যের বিষয়বস্তু। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অপু এবং দুর্গার কাশফুলের ভিতর দিয়ে ছুটে যাওয়ার সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য রয়ে যাবে মানুষের মনের মনিকোঠায় অনেক দিন।উপন্যাসটিতে ক্রমে আমরা দেখতে পাই অপু- দুর্গার চড়ুইভাতি, অপুর পাঠশালায় যাওয়া, দুর্গার পূণ্যিপুকুর ব্রত ইত্যাদি, আর এ সবই চিত্রিত করে বিংশ শতাব্দীর বাংলার গ্রাম এবং তার সংস্কৃতিকে। দুই ভাইবোনের ঝড় দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাওয়া, লুকিয়ে আচার চুরি করা, পুতুলের বাক্সে অতি সামান্য জিনিস খুব যত্নে রাখা, দু পয়সার মুড়কি, ওড়কল্মি ফুলের নোলক এই সব কিছু বুঝিয়ে দেয় গ্রামীন সরলতা। এ ছাড়াও আমরা দেখতে পাই হরিহর এবং সর্বজয়ার প্রতিমুহূর্তে সৎ এবং সরল ভাবে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই যেখানে তারা কঠোর পরিশ্রমী অথচ অভিযোগহীন। এ প্রসঙ্গে আরো একটি ব্যাপার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রায় পুরো গল্প জুড়েই আমরা দেখতে পাই অপুর প্রতি সর্বজয়ার বেশি মাত্রায় স্নেহ ও ভালোবাসার প্রকাশ, যা তুলে ধরে পুত্র সন্তানের প্রতি সমসামায়িক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। সত্যজিৎ রায়ও তার চলচিত্রের মাধ্যমে এই বিষয়গুলিকে বিংশ শতাব্দীর বাংলার সামাজিক প্রেক্ষাপটে মানুষের কাছে কমবেশি তুলে ধরতে সফল হয়েছেন।
   ‘পথের পাঁচালী'কে চলচিত্রে রূপ দেওয়ার আগে সিনেমা বলতে বোঝাত সুনির্দিষ্ট প্লট, চরিত্র, ক্লাইম্যাক্স প্রভৃতির মাধ্যমে দর্শকের সামনে একটি আকর্ষণীয় কাহিনী তুলে ধরা। সত্যজিৎ রায়ের হাতে ‘পথের পাঁচালী' বাংলা তথা ভারতের প্রথম ছবি যেখানে গ্রামবাংলার এক দরিদ্র পরিবারের চলমানজীবন কে নিটোল বাঁধনে জীবন্ত রূপ দেওয়া হয়েছে। অপু এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও তাকে ঘিরে গ্রামীণ প্রকৃতি এবং গ্রামীণ জীবনের খুঁটিনাটি যেভাবে চলচিত্রে রূপ পেয়েছে তা এর আগে কখনও হয়নি। সাদামাঠা নিস্তরঙ্গ জীবনও যে চলচিত্রের বিষয় হতে পারে সত্যজিৎ রায়ই সেটা প্রথম বোঝালেন। স্বাভাবিক ভাবেই বিংশ শতাব্দীর দর্শক তাদের ব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনে ‘পথের পাঁচালী'র হাত ধরে এক রোম্যান্টিক জগতের সন্ধান পান, যা আজও বর্তমান।

  ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর খুব শীঘ্রই সিনেমাপ্রেমী মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং ক্রমেই দেশ বিদেশে বিখ্যাত পরিচালকদের কাছে প্রশংসা কুড়িয়ে নেয় । 'পথের পাঁচালী' স্বাধীন ভারতে প্রথম ছবি যা কিনা আন্তর্জাতিক স্তরে সমালোচনার যোগ্যতা লাভ করে। এক বছরের মধ্যে CANNES Film Festival এ এই সিনেমাটি 'Best Human Document' হিসেব ভূষিত হয়। ধীরে ধীরে ঝুলিতে আসতে শুরু করে বিভিন্ন সাম্মানিক পুরস্কার। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য -

  (1) Golden Gate in San Francisco Festival (১৯৫৭)
(২) BAFTA Award (১৯৫৮)
(3) Kinema Junpo Award (১৯৬৭)
(8) Bodil Award (des) )
(৫) Dadasaheb Phalke Award (১৯৮৪)
(৫) Bharat Ratna (১৯৯২)
(৬) Oscar Honorary Award (1992)

   'পথের পাঁচালী'র হাত ধরেই ভারতীয় সিনেমার বিশ্বায়ন ঘটে এবং ভারতকে এনে দেয় একের পর এক আন্তর্জাতিক সম্মান। সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্বজুড়ে সত্যজিৎ রায় তাঁর কাজের মাধ্যমে বহু পরিচালকদের কাছে পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।তবে একটা কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, পরিচালক হিসাবে সত্যজিৎ রায় নিজেকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করলেও সারাজীবন তাঁর পরিচালনার বিষয়বস্তু ছিল একান্ত ভাবে ভারতীয়, আরও নির্দিষ্ট করে বললে একান্ত ভাবে বাঙালি ।ভারতীয়  তথা বাঙালি সংস্কার, রীতিনীতি, জীবনযাপন - এ সবকিছুই ফুটে উঠেছে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। American Film Institute এর একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, “But I wouldn't want to work outside of India, I feel very deeply rooted there. I know my people better than I know Americans or the British. But it's just that I react more immediately to things Indian, I would like to narrow it down even further and say things Bengali..."

  বিশ্বনাগরিক, ভারতীয় বোধ ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ, আদ্যপ্রান্ত বাঙালি এই মহান পরিচালকের সৃষ্টিশীল কাজ বাঙালি তথা ভারতীয় তথা বিশ্ব জনমানসে বেঁচে থাকবে চিরকাল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

Post a Comment

1 Comments