জ্বলদর্চি

হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা - ১০


হারিয়ে যাওয়া ঝিঁঝি পোকা || পর্ব- ১০ 


সু দ র্শ ন  ন ন্দী  

সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা পলায়ন-
ভাবিলাম হায় আর কী কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!

না ফিরে পাওয়া যায় না। ফিরে পাব না কৈশোরে স্কুল থেকে পালিয়ে রূপকথা সিনেমা হলে সিনেমা দেখার রোমাঞ্চের স্বাদ।  স্মৃতিকে সাথে নিয়ে বাঁচার নামই জীবন। সময়ের হাত ধরে প্রকৃতির নিয়মে সব পরিবর্তিত হয়, আমরা আবেগে বলি হারিয়ে গেল। মন মানতে চায়না কি ছিল আর কি হল পরিস্থিতি। আর স্মৃতি সেতো সততই সুন্দর। সুন্দর বলেই হয়তো কষ্টের মোচড়টা একটু বেশি। দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আনচান করে মন। কবিগুরুই সত্য মনে হয়-ভাবিলাম হায় আর কী কোথায় ফিরে পাব সে জীবন ! উত্তর একটিই। না এবং না।

 মাঝে মাঝে গ্রামে যাওয়া আসা থাকলেও একে একে নিভিল দেউটি করে হারিয়ে গেলেন দাদু, ঠাকুমা। ছেলে পরিবার নিয়ে সব আত্মীয়স্বজন ব্যস্ত। তবু নিজের গ্রাম নিজের দেশ নিজের জমি তাই দ্বার অবারিত ছিলই কাকাদের যৌথ পরিবারে। গ্রামের দুই কাকার মধ্যে সেও ভাগ হল একদিন। সুসম্পর্ক রেখেই। আমাদের ভাগ কাকাদের দিয়ে দিলাম। বাবা বলতেন ওদের জমিই ভরসা। ভাগ করব না বলেই তোদের নিয়ে শহরে এসেছি। আমরাও এ নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামাইনি। পড়াশুনায় ব্যস্ত রইলাম আমরাও। তবে নাড়ির টান ছিন্ন হয় নি। শুধু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। সে পরিবর্তন মনে হত গ্রামীণতার অঙ্গচ্ছেদ । গাছ গাছালি কমছে, পুকুর বাঁধের পরিসীমা কমছে, রাস্তা ঘাট তৈরি হচ্ছে লাল মাটির পেট চিরে, আলো আসছে গ্রামে গ্রামে। জোনাকিরা লুকোবার জায়গা পাচ্ছে না। ঝিঁঝি পোকার কণ্ঠস্বর হচ্ছে রুদ্ধ। মাঝে মাঝেই খবর পাই মাঠের আমগাছ গুলো কেটে নেওয়া  হয়েছে। তালগাছ গুলি শেষ। একবার শুনি, আর কেঁপে ওঠে বুক। সে গাছ যে আমার খেলার সাথী ছিল। জীবন থেকে হারিয়ে গেলে সে দুঃখ কম কষ্টের নয়, হলইবা আম কিম্বা তালগাছ। ঘন জঙ্গলের জায়গায় বসছে আকাশমণি গাছ। খালে আর হাঁটুজল পেরিয়ে যেতে হয় না। ব্রিজ হয়েছে।  রাজনৈতিক মনোমালিন্যে ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তবুও   গেলে খালিপায়ে মাটি পায়ে গ্রামে ঢুকতাম। পরিবর্তন লক্ষ্য করতাম, বেদনায় কুঁকড়ে যেতাম।  সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক- সবের পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রাস করছে সে গ্রামকেও। কদিন আগে আবার ঘুরে এলাম গ্রাম থেকে । এবারও সেই ষাট বছর আগের পতঙ্গপুরকে খুঁজে খুঁজে আমি ফিরি। খুঁজে খুঁজে ফিরি আমার শৈশবসাথী সেই আম গাছ, জাম গাছ খেজুর গাছ গুলোকে। খামার আর নেই। হয়েছে পাকা বাড়ি। নেই ঘন জঙ্গল । দশ কিলোমিটার রাস্তাই পিচের পাকা। বেশির ভাগ মাটির দেওয়ালে ইটের গাঁথনি।ঘরের দুয়ার পর্যন্ত ঢালাই রাস্তা। ঘরে ঘরে আলো। অনেক ঘরেই টিভি।  মোবাইলের  টাওয়ার বসেছে রায়ের বাঁধের পাড়ে। ঘন ঘন ছুটছে টোটো, পিচের রাস্তায় চলছে বাস, ঘরে ঘরে  মোটর সাইকেল। দু একটি ঘরে চারচাকাও।পরিবর্তন অনেক হয়েছে গ্রামে । উন্নয়নের হাত ধরেই এই পরিবর্তন। মোরামের সেই নষ্টালজিক ধুলো আর সোঁদা গন্ধ নাকে ঢোকে না, বাঁধটি ছোট হতে হতে পুকুরে পরিণত, গাঁয়ের বধুর অনেকে সিনান সারছে  ঘরের বাথরুমে। বাঁশবনগুলো উধাও রাস্তা করতে গিয়ে, ফিকে হয়েছে জঙ্গল, বাঘ ভালুক নেকড়ে কি একটি শেয়ালও নেই জঙ্গলে। নেই হুক্কা হুয়ার চিল চিৎকার, ভেসে আসে না ঝিঁঝি পোকার পাগল করা আওয়াজ। ঢুকেছে টিভি, স্মার্টফোন, বেরিয়ে গেছে গ্রামীণ নীরবতা।  এক কথায় আজকের সুবিধা- সুযোগ থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তা ঘাট আলো, চিকিৎসা শিক্ষা গ্রামেতে  সবেতেই অত্যাধুনিকতার ছোঁয়া। গ্রাম হয়েছে আধুনিক, আমি আটকে আছি শৈশবে ফেলে আসা আমার গ্রামে। 
কিন্তু শান্তি সুখ কি আগের মতো রয়েছে? জানি না। গ্রামে আমাদের সময় বলত বিশ ঘর তিলি, দশ ঘর গয়লা, পাঁচ ঘর বাগদি থাকে। এখন সেই পরিচিতি পাল্টেছে।  বলা হয়, আগে সব ঘর সিপিএম ছিল, এখন ঘাসফুল। অনেকের হিসাবে দুচারটি ঘরে পদ্মচাষ হচ্ছে ।

তবে শাশ্বত প্রেম রয়েছে। লুকিয়ে লজ্জাভয়ে গোয়ালঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে দেখার রোমাঞ্চ নেই। আছে সাহসী পদক্ষেপ- বেশ করেছি প্রেম করেছি করবই তো ফর্মুলায় । জোনাকিরা হারিয়ে গেলেও, ঝিঁঝির ডাক না থাকলেও এই উত্তরণ, পরিবর্তনও হয় তো কম নয় আজকের সমাজে! আমরা আবেগতাড়িত হই দুর্বল মন নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভুগে। স্মৃতির ভারের এই ব্যামো মহাকাল বরদাস্ত করে না। তার তো দুএকটি ব্যক্তি নিয়ে  আর কাজ নয়, মহাবিশ্বকে শৃঙ্খলায় রাখতে অনেক কসরত করতে হয় তাকে। এই সমাজের আজকের শিশু কিশোররাও হয়তো  আগামী পঞ্চাশ-ষাট বছর পর বলবে কি ছিল আর কি হয়েছে!!(সমাপ্ত) 

 

-----------------------------------------------------------
শুরু হয়েছে সুদর্শন নন্দীর নতুন ধারাবাহিক।
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার     
www.jaladarchi.com  

 


Post a Comment

2 Comments

  1. আমার জীবনের কথা আপনি লিখে মনে করিয়ে দিলেন।এক সাথে পুকুরে চাষ সাঁতার কাটা।আম চুরিকরা আরও কত খেলা। কাকিমা জেঠিমা পিসি মা আর নেই।এখন নিজ সন্তানকে নিয়ে জীবন কাটায়। আমার লেখার অভ্যাস নেই কত কিছুই বদলে গেছে। সেই সব শিক্ষক নেই। শুধুই নেই।আছে জাত পাত আর ও একটি রাজনীতি ।চলে যেতে চাই মা ও বাবার কোলে।

    ReplyDelete