জ্বলদর্চি

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

কবি সুকান্ত যার কলম কাঁদত শোষিতদের জন্য

সু দ র্শ ন  ন ন্দী


একুশ বছরের জীবন। যে বয়সে অন্য কবিরা হয়তো লেখালিখিও শুরু করেননি অথচ সেই বয়সে সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে মাত্র  ছয় সাত বছর লেখালিখি করে বাংলা সাহিত্যের আসনটি শুধু পাকা করেন নি, বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষগুলির হৃদয়েও চিতিয়ে আসন পেতেছেন যা বেশ ব্যতিক্রম। কবি নজরুলকে আমরা বিদ্রোহী কবি বলি। সেই বিদ্রোহ যেমন অন্যায়,শোষণ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তেমনি সুকান্তকে আমরা বলি প্রতিবাদী কবি ।

কিসের প্রতিবাদ? ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রতিবাদ? না।  এই প্রতিবাদ নিজের জন্য নয়, নিরন্নের জন্য, নিঃস্বের জন্য। এই প্রতিবাদ সেই প্রতীকী মোরগের জন্য, যে খাবারের জন্য অট্টালিকার ভেতর রাশি রাশি খাবার থেকে উদরপুরণের প্রত্যাশা করে আর বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়  খেতে নয়, খাবার হিসেবে। এই ভাবনা সেই হতভাগ্য রানারের জন্য যে উদয়াস্ত কঠোর পরিশ্রম করে এবং টাকার বোঝা নিয়ে গেলেও সেই অর্থ তার ছোঁয়া চলে না। এই প্রতিবাদী কবি লিখেছেন তাঁদের যন্ত্রনার কথা যারা এদেশে জন্মে পদাঘাত শুধু পেল। লিখেছেন উলঙ্গ শিশুটির কথা।

ছয় সাত বছরে যথাসম্ভব নিংড়ে দিয়ে গেছেন তিনি মানব মুক্তির জন্য, পরাধীনতার শেকল ভাঙ্গার জন্য, শোষণের বিরুদ্ধে, শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য।

জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট তার মাতামহের বাড়িতে কালীঘাট, কলকাতায়। বাবার প্রকাশনী ব্যবসা। সারস্বত লাইব্রেরীর স্বত্বাধিকারী, যেটি ছিল একাধারে বইয়ের প্রকাশনা ও বিক্রয় কেন্দ্র। স্বল্প জীবনে মৃত্যুশোক তাঁকে গ্রাস করেছিল। অতি প্রিয় ও আদরের জেঠতুতো বোন রাণীদি এবং মা মারা গেলেন। সেই থেকে নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন, কবিতাই হয়ে উঠল সঙ্গী। মর্নিং সোস দ্য ডে, সকাল দেখে বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। তেমনি শৈশবেই সুকান্তের সাহিত্যানুরাগ স্পষ্ট হতে থাকে। তার প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয় বিদ্যালয়েরই একটি পত্রিকা-‘সঞ্চয়’ এ।  শিখা পত্রিকায় সেসময় প্রায়ই সুকান্তের লেখা ছাপা হতো। এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তার ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়।  

বাগবাজারের কমলা বিদ্যামন্দিরে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা।  বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। ১৯৪৪ সাল থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন ভারতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের মাধ্যমে। ১৯৪৪ সালেই ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এর প্রকাশনায় তিনি ‘আকাল’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করেন। তাঁর মতাদর্শের ভিত্তিতেই অর্থাৎ সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় স্ফুরিত হয় তাঁর অক্ষর-জীবন। সেই অক্ষর জীবনের মুল লক্ষ্যই লক্ষ লক্ষ  ক্ষুধার্তের মুখে রুটি তুলে দিতে। নিরন্নের এই ক্ষুধার্তবোধ সুকান্তের হৃদয়ে এতো তীব্র হয়েছিল যে পূর্ণিমার চাঁদও হয়ে যায় বিবর্ণ। ক্ষুধার্তের চোখে সেই গোলাকার চাঁদ ঝলসানো রুটি হয়েই আটকে থাকে।

সুকান্ত দুঃখী-দরিদ্র সাধারণ মানুষকে নিয়ে লিখেছেন অধিকাংশ কবিতা। এছাড়া লিখেছেন রূপকধর্মী কবিতাও। বলেছেন বেদনার কথা বস্তুর রূপক-প্রতীকে। এসব কবিতার মধ্যে একটি মোরগের কাহিনী, কলম, সিগারেট, দেশলাই কাঠি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব কবিতার রূপকের আড়ালে প্রবল ভাবে লক্ষ করি কবির প্রতিবাদী চেতনা ।

সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করেছেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। শোষণ, অন্যায়, বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ পাঠকদের উদ্বুদ্ধ করে তোলে।   তার রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি।

  স্বল্পায়ু জীবন ছিল তাঁর।  ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে  মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র ২১ বছর। শেষ হয়ে গেল এক প্রতিবাদী কলম যে কলমে সুকান্তই বলতে পারেন এ বিশ্বকে নবজাতকের বাসযোগ্য করে যাবেন তিনি, সূর্যকে বলতে পারেন, হে সূর্য তুমি ত জানো আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!, সিগারেটের প্রতীকে হুঁশিয়ারি দিতে পারেন-হঠাৎ জ্বলে উঠে বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে মারতে, যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল।   



Post a Comment

3 Comments