মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৬৭
তমালিকা পণ্ডাশেঠ (কবি, প্রশাসক, সম্পাদক, জননেত্রী, হলদিয়া)
ভাস্করব্রত পতি
'এখনও কি সেই রাস? ঝুলন পূর্ণিমা?
এখনও কি সেই দোল? সেই হোলি খেলা?
এখনও কি চড়কে গাজনে সেই সন্ন্যাসী
জলে ডোবে জলে ভাসে এখনও শামুক খোল।
কল্কে ফুলে দোল খায় ছোট্ট মৌটুসি?
সমস্ত উৎস জুড়ে এখনও তেমনই জলোচ্ছ্বাস?
এখনও কি চাঁদ বুকে নিয়ে রূপো হয়ে গলে যায়
তেমনই তিতাস?
জমেনি কোথাও পলি? জমেনি নুড়ি ও বালি?
ভাঙ্গেনি কোথাও পাড়? উল্টোস্রোতে হয়নি তোলপাড় প্রাচীন নদীর বুক?
আসলে তোমার নদী এখনও তেমনই জেদী ও অহঙ্কারী ভাঙনের ও চোরাস্রোতের দাগ বরাবর
তুলেছে দেওয়াল সারি সারি
তীব্র স্রোত উচ্ছ্বাস ঢেউ গড়ে নেয়
নতুন গভীর চোরা খাঁড়ি
সুদিন দুর্দিন নেই
সমস্ত জীবন জুড়ে
লক্ষ্মণ শেঠ ও তমালিকা শেঠ, ছবি -- কমল বিষয়ী
-- এখনও কি সেই রাস, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠ। কবিতায় যাপন করতেন নিজের মনন এবং চিন্তন। হৃদয়ের শিরা উপশিরায় শুদ্ধ রক্তের সাথে মিশে থাকতো কবিতার অক্ষর। অনুভব করতেন ভালোবাসার বাষ্পচাপ। অনুরণন করতেন প্রেমের আবাহন। অনুধাবন করতেন রাজনীতির গতিশীলতা। আর অনুপ্রাণিত করতেন সকলকে -- স্নেহ, মমত্ববোধ আর আদুরে শাসন দিয়ে। এসব উপাদানই তাঁকে গড়ে তুলেছিল একজন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে। অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে সম্পুর্ন আলাদা। সকলকে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে রাখার ক্যারিশ্মা ছিল তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। তাইতো তিনি লিখতে পেরেছিলেন ---
'হৃদয়ের মধ্যে থেকো আমার হৃদয়ের মধ্যে
প্রকাশহীন গোপন অনুভবে
অদৃশ্য যন্ত্রণা আভরণ আমার
বাতাসে অক্সিজেন দায়ী সবুজ সম্ভার
নিয়ে নিত্য বহমান নদীর দামোদর
যে কোনো মুহূর্তে ভাসাতে পারো এপার ওপার।'
জ্যোতি বসুর সাথে তমালিকা পণ্ডাশেঠ, ছবি -- কমল বিষয়ী
হলদিয়ার দেভোগ গ্রাম। হলদিয়া শিল্পতালুকের প্রাণকেন্দ্র। এখানেই ১৯৫৬ এর ৬ ই আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠ। এরপর গাঁয়ের পরিবেশেই বড় হওয়া কাদাখোঁচা, জলতিতির, দোচুন্টি ফুল আর অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষজনের সঙ্গে সখ্যতার নাগপাশে। শৈশবের দামালপনা আর পারিবারিক বাধ্যবাধকতায় পড়াশোনা -- কোনোটাতেই খামতি ছিল না তাঁর। দেভোগ শ্যামাচরণ মিলন বিদ্যাপীঠ থেকে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে মহিষাদল রাজ কলেজে স্নাতকস্তরে ভর্তি হলেন। বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন 'ফিলজফি'কে। আসলে তিনি দার্শনিক জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন। জীবনের অর্থ অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন। জীবনের গতিপথ ঠাওর করতে চেয়েছিলেন। রক্তমাংসের দেহের সাথে ছায়ার মায়াময় অভিসারী চলন বুঝতে চেয়েছিলেন।
'আমি যত বলি ছায়া তুই যা
ছায়া তবু নড়ে না
যেই শুরু করি চলা
ছায়াও পায়ে পা মেলায়।
এমনি নাছোড় এমনি অভেদ
এমনি অ-শোক না
পা বাড়ালেই পায়ে পায়ে
জড়িয়ে ধরে পা।'
বিজ্ঞানী ড. মনি ভৌমিকের সাথে, ছবি - কমল বিষয়ী
হুগলি ও হলদির সঙ্গমস্থলের বিস্তীর্ণ জনপদ তাঁর জীবনের নানা ওঠাপড়ায় পাশে ছিল। কোকিলের ডাক, বসন্তবৌড়ির চিৎকার কিংবা কচুপাতায় টুপটাপ জলের শব্দ তাঁকে টানতো। শৈশব আর কৈশোরের কাকভেজা উদ্দামতা তাঁকে গড়ে তুলেছিল ভাবুক প্রকৃতির উদারমনা স্নেহশীলা কবি। একদিকে শিক্ষিত পরিবারের একজন সদস্যা, অন্যদিকে জন্মসূত্রে পারিবারিক সাহিত্যচর্চার পরিমণ্ডল পাওয়া। সেইসাথে ছিল মেদিনীপুরের মাটির সোঁদা গন্ধের সাথে আত্মিক যোগাযোগের নির্যাস। এই তিন উপঢৌকনের ত্রহ্যস্পর্শ তাঁকে গড়ে তুলেছিল এক অন্যধারার মানুষ। ফলে হয়ে উঠেছিলেন নির্মল মনের কবি। প্রেমিক কবি। জীবনের গল্পগাথার কবি।
'আমার নিভাঁজ বিছানার দুদিকে
দুটি খাপখোলা তরবারি
আমি যেদিকে পাশ ফিরি
আমাকে ফালা ফালা করে কাটে।'
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সাথে তমালিকা পণ্ডাশেঠ, ছবি -- কমল বিষয়ী
তথাপি নিজের বিবেক বুদ্ধিকে পাথেয় করেই সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগকে দ্বিতীয় স্থানে রেখে প্রথম স্থানে বেছে নিয়েছিলেন 'রাজনীতি'কে। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতি অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে করে তুলেছিল মেদিনীপুরের একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে। রাজনীতির মূল স্রোতে নিজের কর্মজীবনকে সঁপে দিয়েছিলেন আমৃত্যু। আসলে সমাজের খেটে খাওয়া গরিব মেহনতি মানুষের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা মেদিনীপুরের লড়াকু নেত্রী হয়ে বলতে পেরেছিলেন ---
'আশাভঙ্গ স্বপ্নভঙ্গ ভাঙ্গাচোরা মানুষেরা
শেষবার উঠে দাঁড়াতে চাইছেন
বিষাক্ত কন্দ, মূল -- আমের আঁটি --- যবের গুঁড়ো খেয়ে এখনও যারা বেঁচে আছে
তাঁরা হিসেব চাইছে
প্রদীপের তলায় জমাট অন্ধকারের কাছে
স্রোত হারিয়ে যাওয়া নদীর কাছে
রাস্তা ভর্তি খানা খন্দের কাছে
ছায়াহীন রুক্ষ প্রান্তরের কাছে
শস্যহীন মাঠের কাছে
কে কে তাঁদের এই দশা --- এই পরিণতির শিকার করেছে
তাঁদের বুকের লাভা এখনও জমাট পাথর
হঠাৎ কখন লাফিয়ে উঠবে আগুন -- জানা নেই আগুনের কাছে কোনো ছোট বড় নেই।
তৃণ কি মহীরূহ
আগুন কাউকে ক্ষমা করে না
ক্ষমাহীন সেই দিনগুলির জন্য অপেক্ষা করুন মহাশয়গণ শেষ বিচারের সময় আসন্ন।'
কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠের সাথে...
কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশনের স্টেনোগ্রাফারের চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। আরামে আয়েসে কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো অন্য ধাতের ধাতুতে তৈরি। তাই সেই লোভনীয় চাকরি ছেড়ে সিপিআই (এম) দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়েছিলেন। ১৯৮১ এর ২৯ জানুয়ারি জীবনসঙ্গী হলেন মেদিনীপুরের আর এক লড়াকু নেতা লক্ষ্মণ শেঠের। শ্রেণী সংগ্রামের দিশায় পাশে পেলেন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীকে। যিনি ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের আলোকবর্তিকা স্বরূপ। একদিকে সংসার, অন্যদিকে রাজনীতি; একদিকে সংগঠন, অন্যদিকে কবিতাচর্চা! প্রতিদিন পরিশীলিত করতে লাগলেন নিজেকে...
'স্বামী এবং নেতা যুগপৎ এক হলে কীভাবে পরিত্রাণ
হে মার্কস তুমি তা নির্দেশ করোনি
এখন এই যে আকাশের সব বজ্র বিদ্যুৎ
শোবার ঘর বিছানা বালিশে ঝনঝনাৎ
কীভাবে নিঃস্ক্রমণ হে মার্কসীয়গণ
কত জল একাকার কলঘরে
কতক্ষণ স্নান চোখের শাওয়ার খুলে
মুশকিল আসান কীসে
শুধু বিদ্যুতে বৃষ্টিতে
নাকি সঙ্গে আশি কিলোমিটার বেগবান বাতাসে
উড়ে যাবে স্বাতন্ত্র্যবোধ অহং
এবং অংশুমানমুখী
কোনো এক সাধারণ খুকির
স্বাধীন ন্যায় অন্যায় বীক্ষণ
ম্যানিফেস্টোতে তা নির্দেশ করোনি।'
-- হে মার্কস, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে সুদক্ষ প্রশাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ১৯৯৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত সেই পথচলায় তিনি ছিলেন আপোষহীন নেত্রী। একাদিক্রমে টানা চারবার হলদিয়া পৌরসভার পৌরপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন মুন্সিয়ানার সাথে। ২০১৬ এর ২৯ শে মে হঠাৎ এই কর্মতৎপর মানুষটি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার সময়েও ছিলেন হলদিয়া পৌরসভার ১৩ নং ওয়ার্ডের কর্মমুখর কাউন্সিলর তথা পৌরমাতা। ২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ছিলেন হলদিয়া পৌরসভার একজন সজাগ বিরোধী দলনেত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্বশীল ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ছিলেন মহিষাদল বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত বিধায়িকা। স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল এলাকা মহিষাদলের উন্নয়নেও তিনি ছাপ রেখেছিলেন নানাভাবে। তথাপি একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে শুনতে হয়েছে বিরোধী দলের উষ্মা!
'আমি শুধু তোমার জন্য সব হারিয়ে বসে আছি
এখন তুমি বলছ
ভুলে যেতে হবে
ভবিতব্য।'
-- অনু পরমাণু, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
হলদিয়া পৌরসভার পৌরপ্রধান থাকাকালীন হলদিয়ার উন্নয়নে তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন বলা যায়। একাধারে লক্ষ্মণ শেঠ যখন শিল্পবন্দর হলদিয়া নগরীর প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন, তখন তমালিকা পণ্ডাশেঠ হলদিয়াকে গড়ে তুলেছিলেন মোহময়ী। একদিকে যখন নিশ্চিত কর্মসংস্থানের ভিত্তিভূমি হয়ে ওঠে হলদিয়া তখন ভরসার অন্য নাম 'হলদিয়া'কে এক ভিন্নস্বাদের অলঙ্কারে অলঙ্কৃত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন তিনি। গতানুগতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এখানে শিক্ষা স্বাস্থ্য শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির মিলিত প্রতিরূপ তাঁর হাত ধরেই। জনসাধারণের সত্যিকারের পৌরপ্রধানের তকমা জুটেছিল তাঁর।
'কিছুই কি দিইনি তোমায়?
আজ আসন্ন সন্ধ্যায় ছায়ামাখা ধূ ধূ প্রান্তর
পথের দু'দিক থেকে উঠে এসে
প্রশ্নে দীর্ণ করে
দু'হাতে পথ আগলায়।
দিইনি কি কঠিন বাস্তবের
মুখোমুখি হওয়ার সুকঠিন শিক্ষা
দিইনি কি সংযমের পরীক্ষার নামে
ভুরি ভুরি অমল উপেক্ষা।'
-- চৈত্রের চিঠি, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
তিনিই উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করেছেন ভাষা উদ্যানের মধ্যে অমর একুশের শহীদ বেদি। যা কিনা এপার বাংলা ওপার বাংলার মাতৃভাষার আন্দোলনে লড়াকু শহীদদের স্মারক। নিরলস প্রচেষ্টা, উদ্যোগ আর প্রাণান্তকর প্রয়াসের সংমিশ্রণে তিনি গড়ে তুলেছেন পৌরসভার সুরম্য ভাষা উদ্যান, বনফুল গ্রন্থাগার ও প্রেস কর্ণার, আগস্ট আন্দোলনের স্মরণে সুবর্ণজয়ন্তী ভবন, সপ্তপর্ণী ঘাট, উদ্যান, মনীষীদের নামাঙ্কিত পার্ক, সরণি, ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কমিউনিটি হল, প্রকৃতিপ্রেমী ও ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য বালুঘাটায় হলদি তীরে সানসেট ভিউ পয়েন্ট, টাউনশিপের প্রান্তে হলদির তীরে বিদ্যাসাগর পার্ক, রবীন্দ্র নজরুল মঞ্চ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রেখেছিলেন হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। তাঁর কাজের শক্তি ছিল রবিকবির কবিতা --
'যে এসেছিল সে হরণ করেছে চিরনবীন এক প্রাণ
সব হারানোর বেদনারই মানে বাইশে শ্রাবণ।'
-- শ্রাবণ বাইশে, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
হলদিয়া পৌরসভার সামনে ড. বি আর আম্বেদকরের পূর্ণাবয়ব মূর্তি, ভাষা উদ্যানে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মূর্তি, হাতিবেড়িয়াতে বৃটিশ ভারতের তমলুকে প্রথম স্বাধীন সরকারের সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্তের মূর্তি, তমলুকের কাখর্দায় শহীদ মাতঙ্গিনী হাজরার মুর্তি, কলকাতার রানি রাসমণি রোডে কার্জন পার্কে বিদ্যাসাগরের মূর্তি -- তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্থাপিত হয়েছে। যা আজও সমানভাবে উজ্জ্বল।
পরিবেশ বাঁচাতে নানা গঠনমূলক উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। বৃক্ষপ্রেমীদের উৎসাহিত করতে এবং কারখানা সমৃদ্ধ হলদিয়া শহরে সবুজায়নের বার্তা দিতে পৌরসভার পক্ষ থেকে চালু করেন 'বৃক্ষমিত্র' পুরস্কার। এটি সাধারন মানুষের মধ্যে বৃক্ষরোপনের চাহিদা এবং প্রচেষ্টা বাড়িয়ে দিয়েছিল। শহরের শিশু কন্যাদের জন্য বিশেষ প্রকল্প রূপায়ণ, লোকশিল্পী ও মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তমালিকা পণ্ডাশেঠ। পৌরপ্রধান থাকাকালীন ১৯৯৮ এর ৫ ই মে 'হলদিয়া পৌর পাঠভবন' নামাঙ্কিত বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমের উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম আরেকটি গঠনমূলক উদ্যোগের উদাহরণ। আসলে তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষার প্রসারই পারে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে। প্রথাগত শিক্ষার কোনও বিকল্প নেই।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে একসময় তিনি সিপিআই (এম) দলের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অন্যতম সভানেত্রী ছিলেন। বিভিন্ন গণসংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন সবসময়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর নিরলস সংযোগ এবং সাংগঠনিক দক্ষতার সাক্ষ্য সবার চোখ টেনেছিল। রাজ্যস্তরে গনতান্ত্রিক মহিলা সমিতির প্রথম সারির নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন কর্মতৎপরতাকে পাথেয় করে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ও পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন অচিরেই। দায়িত্ববান এবং নিষ্ঠাবান জননেত্রীর পাশাপাশি উদারমনা প্রতিবাদী কবি হিসেবেই মেদিনীপুরের মানুষ তাঁকে চিনেছে।
'পৃথিবী থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার আলোকবর্ষ দূরে মঙ্গলগ্রহের পাশে রক্তিমাভ একটি উপগ্রহে কেন্দ্রীয় অফিস,
সংস্কৃতির নিষ্ঠ ঠিকাদার এই সংস্থাটি চালান
কিছু মার্কসীয় আঁতেল।
ফ্যাশন প্যারেড, বাংলা ব্যান্ড, রবিনা ট্যান্ডনদের বিরুদ্ধে লুকনো রিভলভারের মতো জেহাদি কলম রাখেন বুকপকেটে।
কব্জিতে উল্টো ঘড়ি এঁদের চিনবার
প্রধান কাটমার্ক।
.......
গানে ভাষণে নাটকের শেষে
বিপ্লবের দীর্ঘ জীবন কামনা করার প্রথা আছে।
গণতান্ত্রিক --
কিন্তু কলমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস কম।
পশ্চিমবঙ্গের বেলে ও দোআঁশ মাটিতে
শান্তিতে ডালপালা ছড়িয়েছে
কিন্তু ফলের দেখা নেই.......!'
-- তুলি কলম সংঘ, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
জেলার সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের কাছে নির্ভিক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতায় উৎসাহ দিতে বিশেষ পুরস্কার চালু করেছিলেন। প্রতিবছর ৯ জুন হলদিয়া পৌরসভার জন্মদিন পালনের সময় সেই পুরস্কার তুলে দিয়ে সম্মাননা জানানোর রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল তাঁরই তত্বাবধানে। কবিতা লেখা আর রাজনীতির কচকচানি ছাড়াও দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পাদনা করে গিয়েছেন সাপ্তাহিক পত্রিকা 'আপনজন'। জেলা এবং জেলার বাইরের কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক লেখকদের এক অদৃশ্য ভালোবাসার ডোরে বেঁধে দিয়েছিলেন এই পত্রিকার মাধ্যমে। আজকের কত প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক একসময় এই আপনজন পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমেই নিজের সাংবাদিকতার শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে -- যার কৃতিত্ব তমালিকা পণ্ডাশেঠের। হয়তো অনেকেই সম্পর্ক রেখেছে, কেউবা রাখতে চায়না, আবার কেউবা ভুলে যায়।
'সম্পর্কের দায় এড়াতে কেটে দিই
শিকড় বাকড় ডাল পালা।
উপড়ে ফেলি স্বহস্তে
সম্পর্কের জমিতে প্রোথিত সবুজ চারাগাছ।
স্মৃতির ঝড়ে বাস্তবের গোড়ায় জমে ওঠে
ধুলো বালির আস্তরণ
গেরুয়া রঙ ভাল লাগে এখন।'
-- সম্পর্ক, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠ লিখেছেন ১৬ টি কাব্যগ্রন্থ। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম 'একটি কোরকের মুক্তি' (১৯৯৮)। আর শেষ কাব্যগ্রন্থ ছিল 'এক নৈঃশব্দ্য ভাঙা নারী কথন' (২০১৪)। মাঝের ১৬ বছরে প্রকাশিত হয়েছে নদীর স্বভাব চরিত্র, অন্তরীণ অভিমান, হৃদয়ের মধ্যে থেকো, ভালোবাসার অনু পরমাণু, তৃষ্ণার্ত তটের দেহলী, হঠাৎ এখানে রামধনু, হঠাৎ এখানে রামধনু (২য়), মানুষ বলেই এত পারে, ছেদহীন কথার প্রহার, মনখারাপের জন্মদিন, যুগলবন্দী, কোনো শূন্য শূন্যে থাকে না, ধূলি থেকে তুলে নাও পাপ এবং অনুদিত গ্রন্থ Wisdom of River। কবির প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে 'ঘন ঘোর বর্ষণ পীড়িত প্রকৃতির মতো আচ্ছন্ন সত্তা।' যা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতার লিপিতে লিপিতে --
'শান্তির সন্ধানে চললাম
চললাম নিরাপদ দূরত্বে
যেখানে শুদ্ধতা রক্ষিত হবে
ষোল আনা
কেউ পিছু নেয়নি কেউ ফিরে ডাকেনি
স্বজন আত্মীয় পরিবৃত
কারো জন্য ভাবারও নেই।'
শুধু কবিতা রচনাতে সীমাবদ্ধ ছিলনা কবির কলম। নিপাট ভাষার বুনিয়াদ গঠন যদি তাঁর কবিতার ঘরবাড়ি হয়, তবে কলমের আঁচড় কেটে সাদা কাগজের পৃষ্ঠায় পরিস্ফুটন করা প্রবন্ধ নিবন্ধগুলি ছিল সাহিত্যের নিকোনো উঠোন। সেখানে নিত্যদিন পিদিম জ্বালেন কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠ। মায়াময় আলোকে স্নাত হয় ঘর দুয়ার। আর বর্ণমালার অন্দরে অন্দরে ঘুরে ঘুরে ক্রমশঃ হয়ে উঠেছেন মানবিক কবি। হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক কবি। হয়ে উঠেছেন আকাশ, বাতাস, সোঁদা মাটির কবি।
'প্যাঁচা উড়ে গেল পেয়ারা পাতা ঝরিয়ে
ঘসা কাঁচ রঙা আকাশে
দ্বাদশীর চাঁদ দুলছে
সুন্দরী নারীর চিবুকের ছোট্ট তিলের মতো
ঝকঝকে এক তারা
চোখে চোখ রেখে বলল কবিকে
কবি তুমি কার?
যেখানে আকাশ ছুঁয়েছে নদীর কূল
সেই দিগন্ত প্রসারী বৃক্ষ বলয়ের দিকে তাকিয়ে
কবি বললেন --
আমি কবি ঐ দিগন্তের
আকাশ ও মাটির।'
--- কবি তুমি কার, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
তাঁর লেখা প্রবন্ধ সম্ভার একত্রিত হয়েছে 'আমার শিকড়ে জল দাও'তে। মেদিনীপুরের আরেক বিশিষ্ট কবি শ্যামলকান্তি দাশের সাথে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন 'দুই বাংলার প্রাণের কবিতা'। শিক্ষাবিদ সুদিন চট্টোপাধ্যায় ও ড. আবদুস সাত্তারের সাথে সম্পাদনা করেছেন নানাবিধ প্রবন্ধ সহকারে বিশেষ সংকলন 'কালোয় ঢেকেছে আলো'। সম্পূর্ণ এককভাবে সম্পাদনা করেছেন কবিতাগ্রন্থ 'মানুষ বড়ো কাঁদছে'।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠ ছিলেন মেদিনীপুরের সত্যিকারের মানুষ রতন। কয়েকটা কবিতার বই রচনা করে জাহির করলে বাংলা সাহিত্যের উন্নয়ন হয়না। বিকাশ হয়না। প্রসার হয়না। এই সত্যতা তিনি বুঝেছিলেন। উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি এই হলদিয়ার বুকে সংগঠিত করেছেন বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবের মতো সাহিত্যের বিরাট মহাযজ্ঞ। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সশরীরে উপস্থিত থেকে সাহিত্যচর্চা করাতেই সাহিত্যের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব। এতে ভেদাভেদ দূর হয়, হিংসা দূর হয়, অভিমান দূর হয় আর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জন্মায়।
কবিতাকে আশ্রয় করে তিনি একত্রিত করতে চেয়েছিলেন বাংলা ভাষায় কবিতা চর্চাকারী দেশ বিদেশের কবিদের। আর এজন্যই শুরু করেন এই 'বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসব'। যা তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বাঙালি সাহিত্যিক ও কবিদের মধ্যে। তাঁর আন্তরিক আমন্ত্রণে এবং কবিতার টানে বারবার হলদিয়ার বুকে এসেছেন কবি, সাহিত্যিকরা। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব গুহ, শামসুর রাহমান, শঙ্খ ঘোষ, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ সামসুল হক, তরুণ সান্যাল, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনী বেরাদের পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসবের মাটি। শিল্পশহর কল্লোলিনী হলদিয়ার নদী বিধৌত পলল মাটি।
আসলে তিনি দুই বাংলাকে সাহিত্যের মেলবন্ধনে যুক্ত করেছিলেন। বঙ্গের এবং বহির্বঙ্গের কবিদের সাথে ছিল তাঁর আমৃত্যু সখ্যতা। জেলার কবিদের সঙ্গে ছিল আত্মিক মেলবন্ধন। তমালিকা পণ্ডাশেঠের আবাহনে বাংলা ভাষার কবিরা বারবার একত্রিত হয়েছেন মেদিনীপুরের বুকে। এভাবেই আমৃত্যু তিনি সংস্কৃতি ও সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ করে গেছেন নিজের কর্মগুণে। পরিপুষ্ট করে গিয়েছেন নিজস্ব দক্ষতায়। উদ্বেলিত করে গিয়েছেন কবিতার সুবাসিত গন্ধে।
'তুমি ছিলে দিন ছিল ছায়াময় পথ মসৃণ
তুমিই আমার ভ্যালেন্টাইন ভালবাসার দিন।
বোঝা হয়ে ওঠে
একথা বলেছি তোকে কতবার কতভাবে
সুখ একটা শব্দমাত্র, সুখ বলে কিছু নেই
তবু যে মানুষ কেন ছোটে ঐ নিরাকার শব্দের পেছনেই
মুক্তিও নেই --- কে কাকে মুক্ত করে
নীলমণি লতা জড়িয়ে ওঠে কাঁটা তারে
এইসব কথা তোকে কতটা মুক্ত করল চিঠিতে জানাস আত্মনিপীড়নে যে তুই কী আনন্দ পাস!
ইতি অবিনাশ।'
-- চিঠি দূরের তারাকে, তমালিকা পণ্ডাশেঠ
চিত্রঋণ : কমল বিষয়ী
🍂
6 Comments
অসাধারণ এক কবি--মাটির গন্ধ মাখা
ReplyDeleteধন্যবাদ আপনাকে 🙏💕🙏💕
Deleteঅসাধারণ এক কবি--মাটির গন্ধ মাখা
ReplyDeleteThanks🌹
Deleteতমালিকা পন্ডা শেঠ এর কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য ভাস্করব্রত পতি কে অনেক ধন্যবাদ। রচনার মধ্যে উপস্থাপিত কবিতার অংশগুলি পড়ে বোঝা যায় কী গভীর ভাবে তমালিকা জীবনকে অনুধাবন করেছেন। প্রতি ছত্রে তাঁর জীবনবোধ, মমত্ব, প্রেম, সূক্ষ্ম চেতনা তাঁকে এক বিশেষ আসনে বসিয়েছে। সহজ, সরল ভাষার মধ্য দিয়ে তমালিকা যে সহজেই পাঠকের মন ছুঁতে পেরেছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি কী এখনও কবিতা লেখেন জানার আগ্রহ রইলো।
ReplyDeleteতিনি মারা গিয়েছেন
Delete