বিপ্লবী বসন্তকুমার সরকারের কথা
ম ঙ্গ ল প্র সা দ মা ই তি
দেশের তরুণ ও যুব-সম্প্রদায়কে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে বর্ধমান রাজকলেজের এক জনসভায় ভাষণ দিয়ে চলেছেন বিপ্লবী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল। তাঁর সুললিত কন্ঠস্বর এবং অগ্নিস্রাবী বক্তৃতায় বারেবারে শিউরে উঠছেন ওই কলেজেরই একজন তরুণ ছাত্র। বক্তৃতা যত শুনছেন ততই তাঁর মনটা ইংরেজদের প্রতি ঘৃণায় ভরে উঠছে। তার কিছুদিন পর কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে সেই ছাত্রটিকে দেখা গেল। সেখানেই আরো কিছু তরুণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্ ঘটল। তারপর হিন্দু হস্টেলের মাঠে সেই তরুণদের সঙ্গে তিনিও নিয়মিত লাঠিখেলা, বক্সিং ও কুস্তি শিখতে লাগলেন। অন্তরের মধ্যে ধীরে ধীরে জ্বলে উঠল দেশপ্রেমের জ্বলন্ত আগুন। একে একে পরিচয় হ’ল অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, পুলিনবিহারী প্রমুখ বিপ্লবী নেতার সাথে। অরবিন্দ ঘোষের ‘ভবানীমন্দির’ পত্রিকার একজন দারুন ভক্ত হয়ে উঠলেন। অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করে গোপনে বোমা তৈরির কাজেও লেগে গেলেন, পরিগণিত হলেন একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরুপে। হ্যাঁ,-ইনিই হলেন বিপ্লবী বসন্তকুমার সরকার। স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের একজন নেপথ্য সৈনিক।
বিপ্লবী বসন্তকুমার সরকার ১৮৮৬ সালের ১৮ মে মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানার অন্তর্গত কাতরাবালি নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্রীপতি চরণ সরকার। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় ৭৫/১,সিমলা স্ট্রিটে দেবেন্দ্র মল্লিকের বাসায় থাকাকালীন ঠনঠনিয়া কালীমন্দিরে আশু দাশ, কালী ব্যানার্জী প্রমুখ বিপ্লবী তরুণের সঙ্গে তিনিও শপথ নেন- “যতদিন পর্যন্ত দেশোদ্ধার না হয় ততদিন বিলাতী দ্রব্য ছোঁব না”। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় বসন্তকুমার সরকারের সশস্ত্র বৈপ্লবিক জীবন।
১৯০৭ সালে ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এলেনকে স্টিমারে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হ’ন।
১৯১৪ সালে বালেশ্বরের চাঁদবালীতে অস্ত্রশস্ত্র রাখার ভার পড়ে বসন্তকুমার সরকারের উপর।
এদিকে গোপন অনুশীলন সমিতিগুলোতে অর্থাভাবের জন্য কাজ করা যাচ্ছে না। তাই সন্ত্রাসবাদী অন্যান্য বিপ্লবীদের সাথে তিনিও রাজনৈতিক ডাকাতি শুরু করেন। ১৯০৮ সালে ঢাকা ‘বারহা’ বাজার লুঠ করেন। অস্ত্র অপহরণের ব্যপারে ‘রডা’ কোম্পানির বন্দুক চুরির যে প্রসিদ্ধ ঘটনা ঘটে তাতেও তিনি যোগদান করেন। তারপর অন্যান্য বিপ্লবীদের মতো তিনিও ইংরেজ সরকারের নজরে পড়েন এবং জেলে যান। মেদিনীপুর, যশোহর ও প্রেসিডেন্সি জেলে বেশ কয়েক বছর কারাবরণ করার পর মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন নি। ১৯২৯ সালে লাহোরে যে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসে তারজন্য তিনি গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যাওয়ার ভার নেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই ১৯১৯ সালের জালিয়ানওয়ালাবাগের হিংসাত্মক হত্যাকান্ড আর দ্বিতীয়বার ভারতের বুকে ঘটতে না দেওয়া।
তারপর ১৯৩০ সালে বাড়িতে বোমা তৈরির অপরাধেও আবার জেলে যান। জেল থেকে ফিরে আসার পর তিনি গান্ধীজীর মতাদর্শে দীক্ষিত হ’ন। এরপর তাঁর জীবনের মধ্যে ঘটে গেছে আরও কত বিচিত্র ঘটনা। কখনো বিনপুরের কুইকাকো স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাজ করেন, কখনো মেদিনীপুরে লাইব্রেরী খুলেন। কিন্তু ইংরেজদের জন্য কোন কাজই সুষ্ঠুভাবে করতে পারেন নি। তাঁর বৈপ্লবিক জীবনের পথে নানা সময়ে যে সকল বিপ্লবীর সাথে পরিচয় হয় তাঁরা হলেন
হেমন্ত বসু, অমর বসু, মনীন্দ্র সিংহ, গোবিন্দ সিংহ, রামেশ্বর নাথ, নকুলেশ্বর ভট্টাচার্য, শৈলেন চক্রবর্তী, প্রভাকর চৌধুরী এবং চণ্ডী পাল। এই চণ্ডী পাল পড়ে সন্ন্যাসী হয়ে ধান্যছড়া নিগমানন্দ সারস্বত আশ্রমের মহারাজ হ’ন।
বিপ্লবী বসন্তকুমার সরকার শেষ জীবনে স্ব-গ্রাম কাতরাবালিতে ফিরে আসেন। দেশের তরুণদের মধ্যে দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য তাঁর ভাই রাঘব সরকার প্রতিষ্ঠিত নেতাজীনগর শ্রীপতি শিক্ষাসদন বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬৫ সালের ৫ এপ্রিল অগিযুগের এই বিপ্লবী লোকান্তরিত হ’ন। মুক্তিযুদ্ধের এই নেপথ্য সৈনিককে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
0 Comments