জ্বলদর্চি

ইউরোপ (ইউক্রেন) -র লোকগল্প (চড়ুই পাখির দোলনা)/ চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প-- ইউরোপ (ইউক্রেন)
চিন্ময় দাশ

চড়ুই পাখির দোলনা 

ছােট্ট একটুখানি বাসা চড়ুইপাখির। কোনরকমে পা-মাথা গুঁজে থাকতে হয়। তাতে ভারি মন ভার হয়ে থাকে পাখিটার। মাঝেমাঝে এক-আধটু দোল খেতে না পারলে, ভালাে লাগে না কি? 
তার বাসার সামনেই, নীচে একটা ঝােপ। ঝুপড়ি গাছটাকে গিয়ে চড়ুই বলল-- ঝােপদাদা, তােমার ডালে ছােট্ট চড়ুই ভাইকে একটু দোল খেতে দেবে ?
-- আচ্ছা আপদ তাে সক্কাল বেলা! ঝােপ রেগে গিয়ে বলল- আমার আর কাজ নাই নাকি ? যা, ভাগ এখান থেকে। 
একথা শুনে, যেমন কষ্ট হােল, তেমনি রাগও হােল চড়ুইয়ের। সে গিয়ে হাজির হােল এক ছাগলের কাছে। বলল-- ঝােপটার ভারি দেমাক। ছােট্ট চড়ুইকে একটু দোল খেতে দেয়নি তার ডালে। ঝােপটাকে খেয়ে ফেলবে চলাে তাে তুমি।

   ছাগল মাথা নেড়ে বলল- খেয়েদেয়ে কাজ নাই আমার। পারবাে না, ভাগ। 
চড়ুই এবার হাজির হােল নেকড়ের বাসায়। তাকে বল--- ঝােপ আমাকে তার ডালে দোল খেতে দেয়নি। ছাগলকে বললাম, সে ঝােপ খেলাে না। তুমি ছাগলটাকে খাবে চলাে। 
নেকড়ে লেজের এক ঝাপটা মেরে বলল-- কেন, আমি কি শিকার করে খেতে পারি না? তাের কথায় যেতে হবে আমাকে ? পারবাে না, যা।
সামনে একটা গ্রাম দেখতে পেয়ে, চড়ুই গিয়ে মােড়লকে ধরে পড়ল-- ঝােপটার ভারি দেমাক। ছােট্ট চড়ুইকে একটু দোল খেতে দিল না তার ডালে। ঝােপটা খেতে বললাম ছাগলকে। সে রাজি নয়। নেকড়েকে বললাম, সে ছাগলকে খাবে না। তুমি নেকড়েটাকে মারবে চলাে।

   মােড়ল একবার চেয়ে দেখল পুঁচকে পাখিটাকে। মাথা নেড়ে বলল-- আমি বাপু এসব ঝামেলার মধ্যে যাবাে না।

   সােজা তাতারদের পাড়ায় এসে হাজির হাল চড়ুই। চড়ুই ভালােই জানে, তাতার জাতির (তুর্কিস্থান আর ইউক্রেনে বাস করে এই উপজাতি লােকেরা) লােকগুলাে যেমন বলবান, তেমনি সাহসী। মােড়লকে শিক্ষা দিতে হলে তাদেরকেই দরকার। এক তাতারকে ডেকে বলল-- ঝােপটার ভারি দেমাক। ছােট্ট চড়ুইকে একটু দোল খেতে দিল না তার ডালে। ছাগল ঝােপটাকে খেল না। নেকড়ে ছাগলকে খেল না। মােড়ল নেকড়েকে মারবে না। তুমি মােড়লকে মারবে, চলাে। 
তাতার বললাে-- না বাপু, সেটি হবে না। তােমার কথায় আমি খামােকা মানুষ মারতে যাব কেন?
এবার মাথায় রাগ চড়ে গেল চড়ুইয়ের। সােজা আগুনের কাছে গিয়ে বলল-- তাতারদের পাড়া জ্বালিয়ে দেবে, চলাে। তাতার মােড়লকে মারবে না। মােড়ল নেকড়ে মারবে না। নেকড়ে ছাগল মারবে না। ছাগল ঝোপ খাবে না।

   তাকে থামিয়ে দিয়ে, আগুন বলল-- তা, ঝােপের দোষটা কী ?

   চড়ুই বলল-- একটা ছােট্ট চড়ুইকে তার ডালে একটু দোল খেতে দেবে না ঝুপড়ি গাছটা। এটা কেমন কথা? 
-- সে যাই হােক। আমি তাতারদের পাড়া জ্বালাতে রাজি নই। চড়ুইকে বিদায় করে দিল আগুন।

   চড়ুই নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির হােল। বলল-- আগুন তাতারদের ঘর জ্বলাবে না। তাতার মােড়লকে মারবে না। মােড়ল নেকড়ে মারবে না। নেকড়ে ছাগল মারবে না। ছাগল ঝােপ খাবে না। ঝােপ তার ডালে একটু দোল খেতে দেবে না চড়ুইকে। আগুনকে নিভিয়ে দেবে চলাে তুমি। বড্ড দেমাক আগুনের।

   নদী পাত্তাই দিল না চড়ুইকে। বলল-- যত্তো সব ঝামেলা। তুমি যাও এখান থেকে।

   চড়ুই এবার গিয়ে ধরল একটা ষাঁড়কে। বলল-- ঝােপ তার ডালে একটু দোল খেতে দেবে না ছােট্ট চড়ুইকে। ছাগল ঝােপকে খাবে না। নেকড়ে ছাগলকে খাবে না। মােড়ল নেকড়ে শিকার করবেনা। তাতার মােড়লকে মারবে না। আগুন তাতারদের পাড়া জ্বালাবে না। জল আগুন নেভাবে না। তুমি চলাে তাে, নদীর জল খেয়ে শুষে ফেলবে।

   -- আমি জলের সাথে বিবাদ কররে যাব কেন ? প্রতিদিন জল দেয় সে আমাকে। বলে, হেলতে দুলতে চলে গেল নাদুস-নুদুস চেহারার ষাঁড়বাবাজী।

   যাঁড়কে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। পিঠে ডাণ্ডা পড়লেই ঠাণ্ডা হবে বাছাধন। গজগজ করতে করতে একটা লাঠির গুদামে গিয়ে হাজির হােল পাখিটা। মালিককে বলল-- একটা লাঠি পাঠাও তাে। কষে কয়েক ঘা লাগাতে হবে যাঁড়কে।
লোকটা অবাক হয়ে বলল-- কেন, কেন?
চড়ুই তখন সব বলে গেল গলগল করে।

   সব ঘটনা শুনে, মালিক বলল-- লাঠি আমি দেব না। ভালোয় ভালোয় সরে পড়াে এখান থেকে। 
রেগেমেগে চড়ুই এসে হাজির হােল উইপােকাদের বাসায়। একজন রানি থাকে পােকাগুলাের। চড়ুই রানিকে বলল তার হয়রাণির কথা। শেষে বলল-- তােমার বাহিনী পাঠাও। তারা গিয়ে লাঠির গুদামটা খেয়ে সাবাড় করে ফেলুক।

   রানি ঠোঁট উলটে বলল-- দূর দূর, ঐ শুকনাে জিনিষ কামড়াতে কে যাবে। কাউকে পাঠাবনা আমি।

   এর দোরে, তার দোরে ঘুরে ঘুরে, মাথা গরম হয়ে গেছে পাখিটার। সে মরিয়া হয়ে এক মােরগের কাছে গিয়ে হাজির হােল। বলল-- এই মিষ্টি ছােট্ট পাখিটাকে একটি বার দোল খেতে দিল না ঝুপড়ি গাছটা। ছাগলকে বললাম, ঝােপ খেতে। সে খেল না। নেকড়ে ছাগল শিকার করল না। মােড়ল নেকড়ে শিকার করল না। তাতার মােড়লকে মারলনা। তাতারদের পাড়া জ্বালিয়ে দিল না আগুন। জল আগুন নেভাল না। ষাঁড় জল শুষে খেলাে না। লাঠির মালিক রাজি হােল না যাঁড়টাকে সপাং সপাং কয়েক ঘা বসিয়ে দিতে। উইপােকাগুলাে গিয়ে কুরে কুরে খেয়ে ফেললে, লাঠিগুলাের দফারফা হয়ে যেত। তা, উইপােকাদের রানির কী দেমাক! সে শুকনাে জিনিষ খেতে পাঠাবেনা তার পােকাদের। একটুখানি দোল খাবো। তাই নিয়ে সকাল থেকে কত হয়রাণি বলাে তাে আমার।
   মােরগ বলল-- সবই বুঝলাম। তা, আমি কী করব? কোলে বসিয়ে দোল খাওয়াব তােমাকে। 
চড়ুই বলল- আরে দূর। তাই বলছি নাকি তােমাকে? আমি এসেছি তােমাকে ভােজের নেমন্তন্ন করতে। চলাে।

   -- ভােজ? কোথায়? কীসের ভােজ? মােরগের যেন আর তর সয় না। 
   এতক্ষণে হাসি ফুটল চড়ুইয়ের মুখে। একটা কিছু করা যাবে এবার। ছােট বলে, সেই সকাল থেকে কেউ তার কথায় কান দেয়নি। এবার দেখাচ্ছি মজা।

   চড়ুই মােরগকে বলল-- উইদের বাসাটায় হাজার হাজার পােকা। নিজের চোখে দেখে এলাম এইমাত্র। আহা, কী নধর টুসটুসে চেহারা সব। মহাভােজ হয়ে যাবে তােমার। চলাে।

   মােরগ তাে এক পায়ে খাড়া। এমন সুযােগ ছাড়া যায়? তার বউ হাজির হয়ে বলল-- দাঁড়াও একটু, ছানাপােনাগুলােকে ডাকি। সবাই মিলে যাব। কতদিন এমন মহাভোজ হয়নি।

   দেখতে দেখতে পাড়ার সব মােরগ-মুরগি, তাদের ছানাপােনা সবাই জড়াে হােল সেখানে। কোঁকর-কোঁ, কিচকিচ শব্দে গােটা পাড়া সরগরম। পথ-ঘাট কাঁপিয়ে শােভাযাত্রা চলল ভােজের বাড়িতে।

   মােরগদের আসার খবর পেয়েই, পড়ি-কি-মরি করে উইপােকার বাহিনী ছুটল লাঠির গুদাম সাবাড় করতে। পােকার সারি দেখে, মালিক তটস্থ। তাড়াতাড়ি লাঠি পাঠিয়ে দিল যাঁড় পেটাতে। লাঠি আসতে দেখে, যাঁড় চোঁ-চোঁ দৌড় লাগাল নদীর জল শুষে নিতে। অমনি আগুন নেভাবে বলে, নদীর জল বইতে লাগল দু'কূল ছাপিয়ে। তা দেখে, আগুন ছুটল তাতারদের পাড়ার দিকে। তাতার লােকটা দৌড়ল মােড়লের বাড়ির দিকে। অমনি তীর ধনুক বাগিয়ে মােড়ল ছুটল নেকড়ের খোঁজে। মোড়লকে আসতে দেখে, নেকড়ে দৌড় লাগাল ছাগল খাবে বলে। উরিব্বাস, নেকড়ে বলে কথা! প্রাণ বাঁচাতে ছাগল ছুট লাগাল ঝােপের দিকে।

   ভারি একটা হট্টগােল শুরু হয়ে গিয়েছে। সব তালগােল পাকিয়ে যাওয়ার জোগাড়। চড়ুইর মনে সে কী আনন্দ। চেষ্টা করলে, ছােট্ট একটা জীবও কেমন জব্দ করে দিতে পারে সব বড়দের-- দেখুক সবাই।

   চড়ুই এক এক করে সকলের মাথার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে চলছিল। ছাগল যখন ঝুপড়ি গাছটার কাছে এল, চড়ুইও তখন ঠিক মাথার উপরে। ঝােপ ছাগলকে আর তার পিছনের পুরো সারিটাও দেখতে পেয়েছে।  চড়ুইকে দেখতে পেয়েছে। সে তাড়াতাড়ি কাঁচুমাচু মুখে চড়ুইকে বলল-- একটু দোল খাবে তাে, বাছা। তা খাও না। অত ঝামেলা পাকাবার কী দরকার? রাজ্যে যে যেখানে ছিল, সবাইকে এনে ফেলেছ।

   আহা, কী আনন্দ, কী আনন্দ! ঝুপড়ি গাছটার কথার মুখের মত জবাব দেওয়া যেত। তা করল না চড়ুই। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে কী লাভ? 
কিছুই বলল না, কিছুই করল না চড়ুই। শুধু ডানা গুটিয়ে টুক করে নেমে পড়ল একটা সরু ডালে। দোল খেতে লাগল মনের আনন্দে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments