জ্বলদর্চি

আন্তর্জাতিক বাঙালি কবির সংজ্ঞা নিয়ে গর্জে উঠলেন তসলিমা নাসরিন/গৌতম বাড়ই

আন্তর্জাতিক বাঙালি কবির সংজ্ঞা নিয়ে গর্জে উঠলেন তসলিমা নাসরিন

গৌতম বাড়ই


তসলিমা বললেন এবং একদম এক খাঁটি কথা বললেন। তিনি সোজা ব্যাটে খেলেন। আর খেলেন বলেই ছক্কা হাঁকালেও আশপাশে তাকে ক্লীন বোল্ড করবার জন্য কত কাকুতি মিনতি। কারণ ছ্যাঁকা লাগে যে! ভীষণ জ্বলে পুড়ে মরে তারা। এ যে ক্ষুরধার এক শব্দবাণ, একদম অন্তর্ভেদী। তাই তিনি বললেন আর আমরা তাঁর সাহসিকতায় মুগ্ধ হলাম। যে সাহসিকতার জন্য তিনি মূল্য চোকাচ্ছেন বিতাড়িত নাগরিক হয়ে নিজের দেশ ছেড়ে পরদেশে পরভূমে গা- ঢাকা দিয়ে বসবাস করে। তিনি বলবেন, কারণ যে জীবনে কন্ঠ আর লেখনীকে তিনি আপোষ করবেন না বলেই এক সহজাত মানুষ জন্ম পেয়েছেন। তাঁকে সেই নির্ভীক মানুষ বলেই আগে ভাবি, তারপর নারী। 

  কী বললেন তসলিমা নাসরিন?
   কেন গর্জে উঠলেন?

  তিনি সাহিত্যিক, তিনি কবি। তিনি প্রাবন্ধিক, তিনি কলাম লেখক। তিনি কী গর্হিত কাজ করেছেন? জীবনের সরলতায় চরম সত্য, কুটিলতা, নারীদের নিষ্পেষিত একদম অন্দরের জীবন তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছেন বারবার একদম সাদামাটা ভাষায়, না লজ্জা পাননি, মেয়েদেরও তো নিজস্ব বেলা থাকে সেটাই প্রকাশ করে ফেলেছেন। আর তাতে ঘরের চৌহদ্দি থেকে বৃহত্তর অঙ্গনের সেইসব মুখোশগুলো খুলে গলিত দগদগে ঘা নিয়ে হিংস্র মুখগুলো বেরিয়ে পড়েছিল। তিনি এবার বললেন-- 

  "ইউরোপ-আমেরিকার কোনও লেখককে 'আন্তর্জাতিক লেখক' বলা হয় না। তাঁদের বই নানা দেশের ভাষায় অনূদিত হলেও বলা হয় না, তাঁরা নানা দেশের  সাহিত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেও বলা হয় না। উম্বার্তো একো কে ইতালীয় লেখক বলা হয়। গুণ্টার গ্রাসকে জার্মান লেখক বলা হয়। লিও টলস্টয়কে রাশান লেখক বলা হয়। বাঙালি কবি লেখকদের বেলায় আবার অন্যরকম। কলকাতা থেকে ঢাকায় গিয়ে কবিতা পড়ে এলেই 'আন্তর্জাতিক কবি' উপাধিতে ভূষিত হয়, বা কুষ্টিয়া থেকে নদীয়ায় গিয়ে ভাষণ দিয়ে এলেও 'আন্তর্জাতিক লেখক' উপাধিতে ভূষিত হয়। বাঙালিদের মধ্যে আন্তর্জাতিক হওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল"। 

  অন্যায় কিছু বলেছেন কি? না বলেননি, আমার মনে হয় তা একশো শতাংশ সত্যি। এরকম একটা উন্মাদনা প্রবল ভাবে চলছে এবং আগেও চলত। স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের "পথের পাঁচালী" যে ফিল্মটিকে নিয়ে এত আলোচনা, সভা সেমিনার এখনও, ভারতীয় ফিল্মের নতুন যুগের মাইলস্টোন বা কিলোমিটার প্রস্তর ফলক বলা হয়, সে সিনেমাটি কলকাতার সিনেমা হাউসগুলোতে প্রথম সপ্তাহে মাছি মেরেছিল বক্স- অফিসে। যত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে ততই জনপ্রিয় হয়েছে সত্যজিৎ রায় আর তাঁর পরিচালিত "পথের পাঁচালী" আর অন্যান্য ছবিগুলি। বাঙালী আন্তর্জাতিকতার পেছনে ছুটে চলে বরাবর। আর সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। তসলিমা সেই ট্রাডিশনের চাকে ছোট্ট মতন ঢিল ছুঁড়েছেন মাত্র। বাইরের স্বীকৃতি না জুটলে বাঙালী কাউকে সহসা নিজের মতন করে বরণ করে নেয়নি। স্বীকৃতি দেয়নি। আর তার থেকে নবতম এই ট্রেন্ড। কিসের আন্তর্জাতিকতা? আমরা যারা অণুমাত্র সাহিত্যচর্চা করি, আর তা করতে গিয়ে দেখেছি একজন লেখক-'কে তাঁর বিভিন্ন লেখায় মননের দিক থেকেই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে হয়। না হলে লেখার মতন লেখা যাবে না। আর পৃথিবী যতই সুপারসনিক জেট গতিতে চলুক সাহিত্যের কদর আর সৃষ্টি ছিল- আছে-  থাকবে। না হলে ভাবনা যোগাবে কে? এখন আকছার তাই আন্তর্জালের বিপুল বিস্তারে এরকম বেনোজলের ভূরি-ভূরি উদাহরণ দেখি। 

   সাহিত্য চর্চা নিরিবিলির একান্ত সাধনা। তারজন্য কবি সম্মেলনে কবিতা পাঠে নিজের মুখ চিনিয়ে সস্তা বাজিমাত গিমিকে লাভ কী? যে লেখা ভাবাবে, যে লেখা মহৎ কিছু দিয়েছে, তা অবিনশ্বর। লেখকের সস্তার আন্তর্জাতিকতার শিরোপা নয়, লেখাই চিনিয়ে দেবে লেখক-কে। শুধুমাত্র একটি মাত্র বইয়ের (তিতাস একটি নদীর নাম) জন্য আজও মনে রাখি অদ্বৈত মল্লবর্মণ-কে --এক মহান সাহিত্যিক রূপে। কবি জীবনানন্দকে ক'জন চিনত আর জানত তাঁর জীবদ্দশায়? তাই তসলিমা যথার্থ বলেছেন। তিনি এই দুনিয়ার কোনও কৃত্রিমতা, বিশেষ করে একজন সাহিত্যিক বলে সাহিত্য জগতের এই সস্তা অনুর্বর জায়গাগুলিকে কোনও কালে রেয়াত করেননি, তাই তিনি 'তাঁহাদের' কাছে অপ্রিয়, আর আমাদের কাছে ভীষণ প্রিয়। শেষ করব তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেই। না হলে জানবেন না তাঁর সৎ- সাহসের কথা।

   "এই 'আন্তর্জাতিক' হওয়া মানেই  কিন্তু ভালো লেখক হওয়া নয়। সারা জীবন ঘরে বসেও, মহল্লার বাইরে কোথাও না গিয়েও ভালো লেখক বা ভালো কবি  হওয়া যায়। শুধু মস্তিস্ক ধারালো হলেই চলে। কত গোবর যে কতদিকে ছুটছে, কত গোবর যে কত দেশ জয় করে ফেলছে। গোবর যত দূরেই যাক, যত উঁচুতেই উঠক, গোবর গোবরই থেকে যায়।"

  তিনি গর্জে উঠলেন। তিনি কিছু কি ভুল করেছেন? পাঠক মাত্রেই এ লেখা পড়ে জানাবেন।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

3 Comments