জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প (গ্রীস) এক ময়ূরের একশ' চোখ /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প -- গ্রীস 
চিন্ময় দাশ 

এক ময়ূরের একশ' চোখ 

হাজার হাজার বছর আগের কথা। আর, কথাটা এক পাহারাদারকে নিয়ে। 
পাহারাদার মানুষটার চেহারা এমন কিছু আহামরি ছিল, তা কিন্তু নয়। আর পাঁচজন মানুষের যেমন চেহারা হয়, তেমনই। গায়ে-গতরেও যে খুব তাগড়াই, তাও ন। তবুও তাকে পাহারার কাজেই লাগানো হয়েছিল।
  এই যখন মানুষটার হাল, তাহলে কেন লাগানো হয়েছিল এমন কাজে? আসলে লাগানো হয়েছিল তার চোখ দুটোর জন্য। পায়ের আঙ্গুলে লেগে থাকা ধুলোর কণাটিও সে দেখতে পায়। আবার, অনেক দূরের মাঠে কোন একটা ঘাসফড়িং লাফিয়ে ওঠে যদি, সেটিও তার চোখ এড়ায় না। লোকটাকে লড়াই-টড়াই করার জন্য তো আর রাখা হয়নি। রাখা হয়েছে একজন কয়েদিকে নজরে রাখবার জন্য। ভারি দক্ষতার সাথেই নিজের কাজটি করে যায় সে।
  ব্যাপারটা হল, কয়েদিটাকে গরাদে আটকে রাখা চলবে না-- এমনই ফরমান ছিল। ফাঁকা জায়গাতেই রাখতে হবে তাকে। সেজন্যই সবসময়ের একজন পাহারাদার দরকার ছিল। এদিকে পাহারাদার মানুষটার যে কেবল খর দৃষ্টিই ছিল, এমনটা নয়। সে নাকি ঘুমাতো না কোনদিন। কয়েদির উপর চোখ সেঁটে রেখে, সারা দিন-রাত চুপচাপ বসে থাকত।
  এমনটা আবার হয় না কি? কতদিন না ঘুমিয়ে থাকতে পারে কেউ? আসলে পাহারাদার কিন্তু ঘুমাতো। তবে কেউ কোনদিন টের পেত না সেটা। আসল রহস্য ছিল লোকটার চোখ দুটোতে। বড় বড় দুটো চোখ। আর, কী গভীর নীল রঙ সে চোখের মণি দুটোতে। লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত তার চোখের দিকে।
  খবরটা কেউ জানত না। তার এক একটা মণির ভিতর ছিল পঞ্চাশটা করে ছোট ছোট চোখ। তার মানে, গুণে গুণে একশ'খানা চোখ ছিল সেই লোকের। তবে ঘুমোবার সময় দুটো তারার দুটো চোখই কেবল ঘুমাত। বাকিগুলো জেগেই থাকত সবসময়।
তাতে ঝামেলা হয়েছে কয়েদিটার। এমন চোখকে ফাঁকি দিয়ে সটকে পড়বে, তার উপায়টি নাই। কী করা যায়, কী করা যায়? অনেক দিন বাদে, কয়েদিরা মিলে একটা উপায় বের করল।
  পাহারাদার মানুষটা ছিল গান-পাগল। সুর কানে গিয়েছে কি, একেবারে মজে যাবে মানুষটা। এই খবরটা কয়েদিরা জেনে ফেলল। তাতেই একটা ফন্দি এসে গেল তাদের মাথায়। বীণা বাজিয়ে দারুণ গান গাইতে পারত এক কয়েদি। তাকেই কাজে লাগানো হল।  
  একদিন কয়েদিরা কাজ করছে মাঠে। দূরে বসে পাহারা দিচ্ছে পাহারাদার। এমন সময় একপাল ভেড়া নিয়ে হাজির হল একটা লোক। পাশের জমিতে ভেড়াগুলো ছেড়ে দিয়ে, আলের উপর বসে পড়ল লোকটা। পাহারাদারও দেখল তাকে। 
খানিক বাদে ভারি মিষ্টি সুরে বীণা বাজিয়ে গান ধরল লোকটা। সে গান শুনে, পাহারাদারের মন আনচান। হাঁক দিয়ে বলল-- ভেড়াগুলো নিয়ে আমার এই জমিতে চলে এসো না !
লোকটা তো এই ডাকেরই অপেক্ষায় ছিল। পাহারাদাররের সামনে এসে হাজির হল। গায়ের কোট, বা পায়ের জুতো-- সবই ভেড়ার চামড়ার। নেহাতই সাধারণ চেহারার একটা লোক। একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে বসল দুজনে।
  শুরু হল দুজনের আলাপ পরিচয়, গল্পগাছা। কখন বেলা গড়াল, সূর্য ঢলে পড়ল-- খেয়াল নাই দুজনের। যখন খেয়াল হল, পাহারাদার বলল-- কথা অনেক হল। এবার গান ধরো তুমি।
বীণা তুলে গান ধরল লোকটা। গান শুনছে, কিন্তু নিজের কাজের কথা ভোলেনি পাহারাদার। তার চোখ দূরের কয়েদিটির দিকে। এদিকে, মেষপালক গান ধরেছে বটে, স্থির তাকিয়ে আছে পাহারাদারের চোখ দুটোর দিকে। পলক পড়ছে না তার।
  সূর্য ডুবতে দেরি নাই। সুরের যাদুতে ডুবে আছে চার পাশ। হয়েছে কী, সুরের আবেশে এক লহমার জন্য পাহারাদারের একশখানা নীল চোখ একসঙ্গে বুজে গেল। ঝিমুনি লেগে একবারের জন্য সামনে ঢুলে পড়ল পাহারাদার। এজন্যই ওৎ পেতে অপেক্ষা করছিল লোকটা। এক কোপে পাহারাদারের  মাথাটা আলগা করে দিল ধড় থেকে। 
কাজ শেষ। যে যার জায়গায় চলে গেল ভালো মানুষের মত। অভাগা পাহারাদারের দেহটা পড়ে রইল  গাছের তলায়। 
  তারপর? তারপর সকাল হল। আলো ফুটল বনে-পাহাড়ে, মাঠে-ঘটে। এক শিকারী চলেছে তীর-ধনুক নিয়ে। তার চোখে পড়ে গেল পাহারাদারের শরীরটা। চোখ দুটো দেখে চমকে গেল সে। এমন চোখও হয় না কি কারও ! 
  লোভ সামলানো দায়। তীরের ফলা দিয়ে চোখ দুটো তুলে নিয়ে, ফিরতি পথ ধরল লোকটা। ঘরে ফিরে বউকে বলল-- দ্যাখো, কী জিনিষ এনেছি।
দেখে, বউ তো ডগমগ। যেন আর চোখ সরাতে পারছে না। আলো জ্বলছে মণি দুটোতে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে, মণির ভিতর অজস্র বিন্দু দেখতে পেল বউটা।
তখন তাকে আর পায় কে? আহ্লাদে আটখানা যেন। হয়েছে কী, একটা পোষা ময়ূর ছিল বউটির। ভারী আদরের পাখি। কী তার চেহারা। কী গায়ের রঙ! আর, লেজখানা কত বড়। এতবড় লেজ আছে না কি কোনও পাখির?
  তবে সত্যি বলতে কী, লেজের কথা এলে, মন একটু খুঁতখুঁত করে তার। ময়ূরের লেজখানা বড় বটে, কোন বাহার নাই লেজটার। একগোছা লম্বা লম্বা পালক শুধু।
  এতদিনে লেজখানা সাজিয়ে নেবার সুযোগ এসেছে। মণি দুটো থেকে একটা একটা করে নীল চোখগুলো তুলে, নিজের ময়ূরের এক-একটা পালকের মাথায় বসিয়ে দিল সুন্দর করে। ময়ূরের লেজের যত বাহার, সবই সেদিন থেকেই। 
  লেজের এক একটা পালকে একটা করে ডাগর চোখ বসানো। যেন হাতে তুলি নিয়ে, যত্ন করে এঁকে দিয়েছে কেউ। যখন মেঘ ডাকে আকাশে, আনন্দে পেখম মেলে দেয় ময়ূর। গুটিয়ে রাখা লেজের একশ'খানা চোখ ফুটে ওঠে একসাথে। ঠিক যেন পুব আকাশের গায়ে আঁকা ঝলমলে রামধনুটি।
  তা দেখে আনন্দে বুক ভরে যায় সকলের। বেচারা পাহারাদারের কথা তখন কিন্তু কারও মনে পড়ে না।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. বাঃ। খুব মজার তো?
    ময়ূরের পেখমে চোখের মতো আঁকিবুকি .. তার ও এমন সুন্দর রুপকথার. .. ..
    ভালো লাগলো।।
    ভালো থাকবেন চিন্ময় দা !
    . জ্বলদর্চি কে অনেক অনেক শুভেচ্ছা

    ReplyDelete