জ্বলদর্চি

অ্যাপের নাম বাবাজী- ৬/ লেখক বাসুদেব গুপ্ত

অ্যাপের নাম বাবাজী 

 বাসুদেব গুপ্ত

৬ষ্ঠ পর্ব  

বালিশের নীচ থেকে সব শুনতে পায়  শিখা। সে শুনতে চায় না। তবু মনে হয় তার সামনে ম্যাকবেথ বা কোন ট্রাজিক নাটকের প্রথম পর্ব আজ শুরু হতে চলেছে। ডাইনীরা বসে আছে আগুনের সামনে। আকাশ ধোঁয়াটে লাল। সেই লালে মিশে যাচ্ছে আগুনের লাল ধোঁয়া। তাতে ডাইনীরা ছুঁড়ে দিচ্ছে শিশুর কাটা হাত, সাদা পায়রার ছেঁড়া ডানা, বালতি বালতি গর্ভবতীর পেট ছেঁড়া রক্ত।  শিখা আতংকে নীল হয়ে শুনতে থাকে। 
—বলুন প্রসুন কি খবর। 
-হ্যাঁ ভালো আছি। কি করছিলাম। মানে কোমপানীর আর্নিং নিয়েই ভাবছিলাম। 
- না না আমার নিঃশ্বাসের শব্দ, কে  শিখা। হ্যাঁ হ্যাঁ না না কি যা বলেন। সত্যি আমরা আপনার এডভাইস নিয়ে আলোচনা করছিলাম। একদম সত্যি। 
-এডভাইস নয়? ডাইরেকটিভ। হ্যাঁ তা বুঝেছি। কিন্তু এর মধ্যে একটা মরাল আর লিগ্যাল ব্যাপার… 
-লিগ্যাল ইনভেস্টররা দেখবেন? আমার নামা কেস হলে? হবে না? আমাকে দরকার হলে দেশ থেকে বার করে নিয়ে যাবে? হ্যাঁ তা তো দেখেছি অনেক কেস এমন হয়েছে। কিন্ত মরাল ব্যাপারটা?
-মরাল বলে কিছু নেই? আসলে বাঙালী মধ্যবিত্ত তো। পিছুটান তো আছে। না না আমার কেউ কখনও কমিউনিস্ট পার্টি করেন নি। তবু?
-বলছেন আর পেছোন যাবে না। আমার নামে কেস করে দেবে ওরা তহবিল তছরুপের মামলার? এটা কি হলো? 
-কত টাকা? আমার স্যালারি দু কোটি টাকা হয়ে যাবে? এ তো আই আইটির ছেলেদের থেকেও বেশি। কল্পনাও করতে পারি না। আর একটা বি এম ডবলিউ গাড়ী? হ্যাঁ গাড়ী আমি ভালোবাসি।  শিখাও পছন্দ করে ভালো গাড়ী। ঠিক আছে। ভাবি কি করা যায়?
-হ্যাঁ মরাল মানে তেমন কিছু তো না। আমি তো চুরি  করছি না খুন করছি না। ক্লিন বিসনেস। হ্যাঁ জানি বিজনেস মানে একটু খুচখাচ তো থাকবেই। আচ্ছা জানিয়ে দেবেন। আমি রাজি।
দরজাটা হঠাৎ ভীষণ জোরে বন্ধ হবার আওয়াজ হয়। একটা টরণাডো যেন ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দরজা ভেঙে বেরিয়ে গেল।
ফোন রেখে চমকে তাকিয়ে রূপম তাকিয়ে দেখে  শিখা চলে গেছে। এতবড় একটা সন্ধিক্ষণে ও এভাবে চলে গেল? রূপমের আহত লাগে। ঠিক আছে আজকের দিনটা যাক। কাল ডেকে বোঝাতেই হবে। অনেক কনফিডেনশিয়াল ব্যাপার। অনেক আলোচনা করার আছে। 
শিখা ডুব মেরেছে। ফোন ধরছে না। মেসেজ করা হলো অনেক বার। দুটো সাদা টিক হচ্ছে কিন্তু নীল আর হচ্ছে না। রূপম ঠিক করল এনিয়ে  শিখাকে ও চাপাচাপি করবে না। ও কেন কথা বলছে না সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু এরকম একটা ক্রান্তিকারী সময়, এখন ওকে যে কতটা দরকার সে কি ও জানে না? রূপম অসহায় বোধ করে। এই কি ভালোবাসা? প্রেম? অভিমান হয়। তারপর নিজেই বুঝে হাসি পায়, ছেলেমানুষের  মত অভিমান কি তাকে মানায়?  বাবাজী প্রাইভেট লিমিটেডের সি ই ও। এই ঘাটটা পেরোতে পারলে আই পি ও হবে, বাজারে শেয়ার চলবে, কম্পানি লিমিটেড হবে। উঃ ভাবতেই পারে না।  শিখার ওপর ভীষণ রাগ হয় এইভাবে এ সময়ে ছেড়ে যাবার জন্য। ও ফোন করাই বন্ধ করে দেয়। 

কিন্তু  শিখা র ওপর ভরসা করেই তো এতদূর আসা। রূপম তো আঁতারপ্রেনিয়র মাত্র। যোশিজির কাছে হত্যে দিতে হয় অগত্যা। তিনজন ব্যক্তিকে উনি পাঠিয়ে দেন। বড়বাজার থেকে মিঃ চোররিয়া। মাথায় পাকানো পাগড়ী আর গোল সোনার ফ্রেমের চশমার মাঝখানে একটা লাল ধ্যাবড়া টিপ। হাতে একটা ছোট পিকদানী। নিউটাউন থেকে এলেন আগরওয়াল। সুটবুটটাই।  এখনও সাফারি সুট চালিয়ে যাচ্ছেন। আর হাওড়া থেকে এল জিনস টিশার্ট পরা হাতে স্পাইডারম্যানের ট্যাটু করা যুধিষ্ঠির ঠাকুর। একা সবাই প্রসুন জোশীর সংগে বিভিন্ন কাজে যুক্ত। 

অনেকক্ষণ রুদ্ধদ্বারে মিটিং হল। এঁরা বলে দিলেন একদম ফিকর ফ্রি থাকবেন। খালি কি কি বেট পড়েছে সন্ধের মধ্যে আগরওয়ালকে জানিয়ে দিলেই চলবে। তারপর সাত দিনের মধ্যে এরা কিছু একটা ভানুমতির খেল করে দেবেন। না পারলেও ক্ষতি নেই। অনেক বেট ফলস যাবে মানে আগের মতই নরমাল বেট হবে। কিন্তু  নেটওয়ারকে ফেলে দিলে কিছু একটা হবেই। অত সহজে মিস হবার মত কাজ যুধিষ্ঠিরজী করেন না। 

ফুটবল লীগ শুরু হতেই এদিকের খেলা শুরু হয়ে গেল। সিসটেমে হ্যাক করে ঢুকিয়ে দেওয়া হল আজকের বাজী টিম ক তিন গোলে জিতবে। সারা পৃথিবী থেকে বেট পড়ল হারার পক্ষে দশ লাখ। জেতার পক্ষে এক লাখ। খেলায় ক এগিয়ে ছিল দু গোলে হাফ টাইমের মধ্যে। ওদের স্ট্রাইকার নাইজেরিয়ার খেলোয়াড় ওকাবি। দুটো গোল নিজেই করেছে। আর দুটো ক্রস দিয়েছে গোলের মধ্যে অল্পের জন্য গোল হয় নি। হাফটাইমের পরে সেন্টার থেকে পাস পেয়ে হঠাৎ দুর্দান্তে বেগে ওকাবি এগোতে লাগল গোলের দিকে। কেউই তাকে আটকাতে পারছে না। রতু বলল ঠিক জিদানের মত না স্যার। রূপম বারণ করা সত্বেও ওরা আর রূপমদা বলতে পারে না। স্যার বলে। তো ঠিক গোল থেকে কুড়ি গজ আগে হঠাৎ তার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সুরাটের খেলোয়াড় নিশিত প্যাটেল। গোলে মারার আগেই ওকাবি ছিটকে পড়ে গেল আর উঠতে পারল না। স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে চলে গেল। খেলা শেষ হলো ২-০।
নতুন ২৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে রূপম আজ পুরনো গ্যাং অফ ফোরকে ডেকেছিল পার্টিতে। চতুর্থ জন  শিখা। কিন্তু সে সম্প্রতি রিজাইন করেছে। বাকী তিনজন বুদ্ধিমান। কারণ জিজ্ঞেস করে নি। সবাই মিলে খেলা দেখল, কাবাব খেল পিটার ক্যাটের। রূপম খেয়াল করছিল ওরা কেউ কোন সন্দেহ করে কি না। করে নি। প্রথম টেস্ট কেস সফল। ফেক একাউন্ট থেকে সব টাকা যোশির মরিশাসের একাউন্টে চলে যাবার পরে যোশির ফোন এলো,
-কনগ্রাচুলেশানস। বাঙালী ব্যবসা জানে না এই বদনাম তুমি আজ শেষ করে দিয়েছ। ইনভেস্টররা খুব খুশি। 
-তাহলে আমার রেমিউনারাশানটা-
-হবে হবে। দশ মিলিয়ন আর্নিং হলেই হয়ে যাবে
-আমি যে এই ফ্ল্যাটটা ই এম আই দিয়ে কিনলাম। দেখবেন যেন ঝুলে না যাই
-সেটা তোমার হাতে। বাই দি ওয়ে তোমার সেই গারল ফ্রেন্ড নাকি রিজাইন করেছে, কি ব্যাপার
 রূপম খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,
-উই ওয়্যার ইনকমপ্যাটিবল। শি লেফট। 
-আর একজন কাউকে জুটিয়ে নাও। আফটার অল সেক্স ড্রাইভটাকে তো ইগনোর করা ঠিক না।
অনেক রাত অব্দি জেগে রইল রূপম।  শিখা যাবার সময় রুমাল ফেলে গেছে। তাতে পারফিউম ধীরে ধীরে ক্ষীণ। শিখা কি ছিল আমার? সেক্স পার্টনার? তাহলে চলে গেল কেন?
মেথামফেটামিন। ছোট্ট আদরের নাম মেথি। ছোট্ট ছোট্ট নিটোল স্ফটিকের দানা। প্লাস্টিকের থলি খুলে দুটো চোখ অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তাকালে কিছু হয়? নেশা হয়?  শিখার দিকে তাকালে হত। পুরনো বাড়ির ছাদে হেলে পড়া একটা নারকেল গাছ। সারাদিন দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ীটির গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোত। একটু শুনশান হলে বনে বনে জোনাকির বাতি জ্বালানো শেষ করে একটা চাঁদ এসো বসত সেই গাছের কাঁধের ওপর। একসময় সবাইঘু মাতো। পাঁচিলের খাঁজে আশ্রয় নেওয়া ব্যস্ত পায়রা পায়রার বৌ।  শিখাও হেলান দিয়ে একসময় ঘুমে ডুবে গেলে রূপম ওর দিকে শুধু চেয়ে থাকত। কতক্ষণ কতঘন্টা মিনিট? নেশা হতো। সময়ের দড়ির বাঁধন খুলে রূপম ভেসে যেত জ্যোৎস্নায়। 
দুটি আন্গুল এলোমেলো নড়ে চড়ে প্লাস্টিকের পুটুলি খোলে। যুধিষ্ঠির হাতে হাতে দিয়ে গেছে। বলেছে পিয়োর মাল। ধোঁওয়া চাই না। শুঁকলেই হবে। টেবিলে একটা গ্লাসে খানিকটা রাম। একটা ১০০ টাকার নোট। একটা পেপার ওয়েট। তার ভেতরে একটা পরীর মূর্তি। একটা পুরনো ক্রেডিট কার্ড। কার্ডের ওপর সাজানো হয় এক চামচ ক্রিস্টাল। পেপার ওয়েটটা গুঁড়ো করতে থাকে স্ফটিকের দানা। কোনো আক্রোশ নয় ক্ষোভ নয়। শুধু ধীরে ধীরে গঠন থেকে কেওস। স্ফটিক থেকে ধুলো। এনট্রপি বাড়তে থাকা। সারাক্ষণ পরীটার চোখে চোখ। পরীর চোখ মরা মাছের মত স্থির। 

একসময় গুঁড়ো পাউডার সাজিয়ে দেয়া হয় একশো টাকার নোটের ভিতর। ওটাই নাকি দস্তুর। যেন একটা গোপন টানেল। তার ভিতর দিয়ে কেউ আসবে। নোটের একপ্রান্ত ঢুকে যায় নাকে। অক্সিজেন যায় সিওটু আসে। তার মাঝেই রং বদলাতে থাকে রূপমের।  শিখার হাল্কা শরীর সাদা বালিশ চাঁদের আলো। প্রেম নয়। ভালোবাসআ নয়। সেক্স পার্টনার । শূন্যেতা কিয়ে থাকে রূপম। সেখান থেকে যৌনতা নয় শুধু চাঁদের আলো ধীরে ধীরে একটা বিরাট ঢেউ হয়ে যায়। তারওপরে ছোট্ট একটা নৌকায় ভেসে  শিখা কোথায় যা চলে যায়। রূপম হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে শূন্য ঘরে।
ব্যবসা এখন জমে উঠেছে। গাড়ী চলতে শুরু করাটাই কঠিন। চলা শুরু করলে ব্রেক মারা  শক্ত। সেটা রূপ মহাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে। অ্যাপের নাম বাবাজী এখন শুধু খেলার গড়াপেটায় আটকে নেই। কখনও শেয়ার নিয়ে বাজি। টাকার জোরে শেয়ার কিনে নিতে পারে এখন কম্পানী। তারপর বাজির টাকা আর শেয়ার বেচার টাকা দুই দুহাতে। টাকার পাহাড় কেমন করে তৈরী হয় রূপম দেখে। দেখে কেমন করে হাড় জমে জমে তৈরি হয় মারবেল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments