জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি কবিতা সিংহ /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি কবিতা সিংহ
নির্মল বর্মন

"ভালোবাসা চাই ভালোবাসা
হাঁকছে পথে ফেরিওয়ালা।
বেরিয়ে দেখি ভুল শুনেছি
বোল হরিবোল বোল হরিবোল"
          (লাল তামাশা --কবিতা সিংহ)

সমাজ সংস্কৃতি বিনোদনের প্রতি কবি এভাবে ভালোবাসা কে ব্যঙ্গ করে সমাজকে কুঠারাঘাত উপহার দিয়েছেন কবি কবিতা সিংহ। কবি ,গল্পকার, উপন্যাসিক ও প্রথিতযশা সাংবাদিক কবিতা সিংহ ১৬ই অক্টোবর ১৯৩১ কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন । পিতা শৈলেন্দ্রনাথ সিংহ ও মাতা অন্নপূর্ণা সিংহ ।মাত্র কুড়ি বছর বয়সে পিতা মাতার অমতে সহপাঠী, গল্পকার ,নাট্যকার ও কবি বিমল রায় চৌধুরীকে বিবাহ  বন্ধনে আবদ্ধ হন। বস্তুতঃ সাংসারিক জীবন যাত্রা শুরু হল জটিল যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে । অমৃতবাজার পত্রিকায় কলমচি  হিসেবে কাজ শুরু করলেন এবং সামান্য কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন ও যথারীতি টিউশনি করতেন। কবি বন্ধুরা কবিকে "ভার্জিনিয়া উলফ " বলে ডাকতেন। কবি কবিতা সিংহ  যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ১৫ই অক্টোবর ১৯৯৮ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবিতা সিংহের ছদ্মনাম সুলতানা চৌধুরী।
 কবি কবিতা সিংহ স্বনামধন্য 'দেশ' পত্রিকা, "প্রসাদ"পত্রিকা, " শতভিষা"  ও "কৃত্তিবাস" পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিলেন ! নারী হয়ে নারীর হৃদয়ের আত্মগ্লানি কে পরিষ্কার করবার জন্য নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃতের মধ্যে অন্যতম হিসাবে পাঠক মহলের সমাদৃত হতেন । কবিতা সিংহ মূলতঃ কৃতি ছাত্রী ও  সু সাহিত্যিক। ফলতঃ  বিশ শতকের পাঁচের দশকের কবিতা আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। প্রাণঞ্জলতার সঙ্গে আকাশবাণীতে কাজ করেছেন।

কবিতা সিংহের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল:-
"সহজ সুন্দরী", "কবিতা পরমেশ্বরী"
"হরিণাবৈরী", "শ্রেষ্ঠ কবিতা",
"সোনারূপার কাঠি", "মোমের তাজমহল" প্রভৃতি। কবি , গল্পকার ও উপন্যাস কবিতা সিংহ সম্পাদনা করেছেন "ইদানিং", "সপ্তদশ অশ্বারোহী" ও "সত্তরের কবিতা সংকলন"। ছদ্মনাম  সুলতানা চৌধুরী নামে কিছু রম্য রচনা  ও গল্প লিখেছিলেন । নারী হয়ে নারীদের জীবনের ব্যথা বেদনা ও অন্যায় শোষণ নিয়ে কবিতা সিংহের মনে অনেক দুঃখ ও যন্ত্রণা ছিল। তাঁর বহু কবিতার মধ্যে তার মনের ঋজু চিন্তা ও প্রতিবাদী মনোভাব কবিতার পাতায় পাতায় সাজানো। কবিতা সিংহ সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি সুমহান অবদানের জন্য "লীলা পুরস্কার", "মতিলাল পুরস্কার" ও "ভূয়ালকা" পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

কবিতা সিংহ গাছকে নিয়ে গাছের মধ্যে 'সত্তা' খুঁজেছেন , তাঁর এমনি একটি কবিতার নাম হল - 'বৃক্ষ'
"বার বার বৃক্ষই  কেবল
বৃক্ষই আমার কাছে ফিরে ফিরে আসে
প্রত্যয়ের মতো
এমন প্রত্যয় আর বৃক্ষশাখা ভিন্ন  কোথা রাখি
বৃক্ষই  আমার সব
আর সাবেকী
-------------------------------------------
---------------------- -------------- ----
বৃক্ষ থেকে শিখে নিই বাহিরে ভিতরে
এইসব মনোময় অঙ্গময় প্রাণময় বাঁচা"

কবি কবিতা সিংহ প্রেম ও প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার করে "ভিলালেন" কবিতায় পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাঠককুল কবিতা পড়ে অভিভূত। জনসংবাদিক হয়ে, একজন নারী হয়ে, কিভাবে নারীর রহস্য উন্মোচন করা যায় তা তিনি এই কবিতায় তুলে ধরেছেন---
"একটি যূথীমালা তোমার এলোচুল
ছড়িয়ে দিতে চায় আমার ভীরুমন
সে সাধ ফুটে আছে ভোরের ঘাসফুলে।
--------- ---+++++ ------------   -------------
সে মালা নিলে তুমি অবাধ চোখ তুলে
মালার তো নয় ও যে , আমার যৌবন
একটি যূথীমালা তোমার এলোচুলে"!


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



বর্তমান সময় ও সমাজে প্রেম , প্রীতি ও ভালোবাসা সামান্য বোঝাপড়া মাত্র। মানুষের মন যে কোনো সময় ভেঙে চৌচির হয়ে যায় কিন্তু হৃদয়ে নাড়া দেয় না , হৃদয়ের মধ্যে কোন অনুতাপ ও অনুশোচনা জাগে না। এভাবেই কবি প্রেম ,প্রকৃতি ও ভালবাসাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ হিসাবে, জনসমক্ষে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন---
"এই যদি তোর মনে ছিল
কেন মাইরি রং দ্যাখালি
বেরিলির ওই বুড়ো বাজারে
ঝুমকো জোড়া হারিয়ে এলি।
পাবই সিওর জেনে গিয়ে
ঝুঁঝকো বেলা রওনা হলি
দূরে হলেই বড় দোকান।
চাঁদনিচকে পথ হারালি"।
কবিতা সিং  উত্থান ও অধঃপতনকে সাবলীল ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‌। জনগণের হৃদয়ের কথা ,মনের কথা আঁতের কথা "ঈশ্বরকে ইভ" কবিতাতে বাস্তব সত্য কে প্রতিফলিত করবার চেষ্টা করেছেন ----
"আমিই প্রথম
জেনেছিলাম
উত্থান যা
তারই ওপিঠ
অধঃপতন‌ ।
আলোও যেমন
কালোও তেমন
তোমার সৃজন
জেনেছিলাম
আমিই প্রথম"
কবি কবিতা সিংহ "পরমেশ্বরীকে" কবিতায় উত্তরাধিকার কীভাবে দিয়ে যাবেন কবি --- তার চালচিত্র নকশীকাঁথার মতো অঙ্কন করেছেন -----
"আমার নিকটে যত চাবি আছে সব ফেলে দেব
এখন তোমার জ্বালা আগুনে হাপরে
লৌহের মাপের গণিতে
চাবি করা, পরখ পরখ  ফের, ফেলে দেওয়া
আবার বানানো!
এভাবেই তোমাকে আমার
সব উত্তরাধিকার দিয়ে যেতে হবে"!
কবি কবিতা সিংহ জীবনের উপান্তে পৌঁছেও অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছিলেন‌। জীবনের পরিণতি নিয়েও কবিতা রচনা করতে ছাড়েননি। এবং তাঁর "শেষপর্বে মাখামাখি হয়" কবিতা সাড়া জাগানো দর্শকের দরবারে উল্লেখিত। পাঠককুল আপ্লুত। কবির কবিতা  যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য---
"এইভাবে এ আঁধার নিয়তি তোমার নারী
চুম্বকের তীব্র টানে ক্রমশ তোমাকে নেয় নিজ ও কেন্দ্রমুখে
কোনো ফুলকি নিমেষ আশার
ভাঙ্গে না আঁধারশায়ী কৃষ্ণ- একাগ্রতা
মৃত্যুটানে বায়ুক্রমে সুস্থির নিষ্কম্প্র হয়ে আসে"!

কবিতা সিংহ পঞ্চাশের দশকের সময় ও সমাজকে পাথেয় করে বিষয়বস্তু পরিবেশনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ে "প্রসাদ" পত্রিকার পাতায় সততার সঙ্গে লিখেছিলেন। বর্তমান সময়ে প্রসাদ পরিবার , প্রসাদের বিস্মৃতপ্রায় কবি সাহিত্যিকদের নামে "প্রসাদ স্মৃতি স্মারক সম্মাননা" চালু করেছেন। সেই কারণে প্রথিতযশা কবি রেবা সরকার মহোদয়ার কবিতা দেশ বিদেশে বহু নামডাক সম্পন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, স্বনামধন্য ধানসিড়ি প্রকাশনী থেকে জনপ্রিয় "স্বভূমে আমি একা ও "পরমান্ন সুখ " কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে,আরো কয়েকটি কাব্য গ্ৰন্থোও প্রকাশিত হয়েছে। সেইজন্য প্রসাদ পত্রিকার পরিবারের পক্ষ থেকে কবি রেবা সরকার কে "কবি কবিতা সিংহ স্মারক সম্মান ২০২২" এ ভূষিত করেছেন। ফলতঃ কবিতা সিংহ বাংলার সারস্বত কাব্যজগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Post a Comment

2 Comments

  1. ধন্যবাদ জানাই।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো।🙏🙏

    ReplyDelete