জ্বলদর্চি

নারীদিবস কি প্রথা পালনেই সীমাবদ্ধ থাকবে?/রোশেনারা খান


নারীদিবস কি  প্রথা পালনেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
রোশেনারা খান


নীলা রায় শহরের একটি নামকরা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। সুন্দরী তো বটেই, সেইসঙ্গে ফিগার সচেতন, রীতিমত শরীর চর্চা করেন। নিজের একটি ক্লাব আছে।  মাঝে মধ্যেই দলবলসহ বেরিয়ে পড়েন। সে একজন মেয়ে বা মা, এরকম কোনও ভাবনা তার মনে কাজ করে না, ইয়ং জেনারেশনের আইডল বলা যায়  তাকে। নিজের ২৫ বছরের ছেলে ও তার বন্ধুদের সঙ্গে অনায়াসে হুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারেন। তার এই নিজের মত জীবনকে উপভোগ করাটা তাঁর মহিলা সহকর্মী থেকে সহ নাগরিক, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার মনে ঈর্ষার উদ্বেগ ঘটাচ্ছে।শুধু  তাই নয়, চরিত্রের প্রতি আঙ্গুল তুলতেও তারা দ্বিধা বোধ করেনা। সবটাই আড়াল থেকে। সামনে একেবারে ভেজা বেড়াল।   

      সালেহা ধনী বাড়ির বউ, ধর্মীয় গোঁড়ামি থাকলেও শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তাই বিয়ের পর সালেহা শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়মিত ক্লাস করে বি এড পাশ করেছে। এখানে  শাশুড়ি মায়ের ভুমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু সালেহার মায়ের পক্ষের আত্মীরা এতে না খুশ। তারা যেমনটা চেয়েছিল, শাশুড়ি বোরখা পরিয়ে রাখবে। যখন তখন বাড়ির বাইরে বের হতে দেবে না। রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত রাখবে। দুঃখের বিষয় তেমনটা ঘটেনি সালেহার জীবনে। এ দুটি উদাহরণ মাত্র।

     এখানে যে বিষয়টা আমাদের ভাবাচ্ছে, তাহল আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সার্থকতা কোথায়? নারীই নারীর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী প্রগতির চাকা কোন পথে এগুচ্ছে? যখন মহিলা সহকর্মী থেকে, নিকট(?)আত্মীয়ারা সমালোচনায়  মুখর। আজকের সময়ে এমনটা হওয়া কি খুবই বাঞ্ছনীয়? কেন বালতিতে রাখা কাঁকড়ার মত যে এগিয়ে যেতে চায়, তার পা ধরে টানাটানি?   

     নারীর এগিয়ে চলার পথ যারা তৈরি করেছিলেন, সেই পথে যারা শিক্ষার  আলো জ্বেলে পরবর্তী প্রজন্মের পথ চলাকে অনায়াস করে গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়  ভাবেননি নারী প্রগতির পথে নারীই অন্তরায় হয়ে উঠবে। তাঁরা চেয়েছিলেন   একদিন এরাও অনেক নারীকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তাদের আলোর নিচে  নিয়ে আসবে। কিন্তু তেমনটা ঘটছে কোথায়? অনেকেই এই ধারণা পোষণ করেন  ওসব কাজ করার জন্য অনেক ক্লাব আছে, এনজিও আছে, সেখানে আমরা চাঁদা দিয়ে থাকি।  তারা করবে।

                  কিন্তু কেন? আপনি বা আমি করব না কেন? আমাদের একজন   সুনাগরিক হিসেবে সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি কোনও দায়বদ্ধতা থাকবে না? সরকারের মধ্যে যখন এতটাই অসচ্ছতা তখন এনজিওগুলো কতটা নির্ভর যোগ্য?  সেটা ও কি ভাব্বার বিষয় নয়? আমরা যদি প্রত্যেকে মানুষকে সচেতন করার কাজটুকু করি, তাহলে কিন্তু সমাজে, পরিবারে পরিবর্তন আসবে। বাড়িতে যে মা  বা বউটি নিজের ঘরে উপোষী স্বামী সন্তানকে রেখে আমাদের বাসি সংসার টাটকা করতে আসে, তার আসতে একটু দেরি হলে চোটপাট করি, মাইনে কাটার ভয় দেখায়, সেই আমাদের মধ্যে ক’জন তার পরিবারের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ রাখি? মানবিক কর্তব্য এবং দায়িত্ব এখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে। এর জন্য সংগঠন গড়ে তোলার (মফস্বল এলাকায় জনসেবার নামে যা ব্যঙ্গের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে) কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে কেন এত অনিহা বুঝি না। যতদিন আমরা পুলিশ প্রশাসনের ঘাড়ে সব দায়  চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাব, ততদিন নারীর মুক্তি, নারীর নিরাপত্তা সম্ভব নয়। বেড়েই চলবে নারীর প্রতি নির্যাতন, শোষণ, পীড়ন।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



       গ্রামে গঞ্জে গৃহস্থের বাড়িতে কান পাতলে  শোনা যাবে ক্ষীণ কাতর আর্তনাদ। সে আর্তনাদ মৃত্যু পথযাত্রী কোনো শাশুড়ি বা মায়ের। যিনি বিনা চিকিৎসায় অনাহারে, অর্ধাহারে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন। কেন এমনটা  হবে? বউমাও তো একদিন শাশুড়ি হবেন! বৃদ্ধা হবেন! শহরাঞ্চলের ছবি আরও করুণ। বৃদ্ধা শাশুড়িকে বাড়িতে তালা বন্ধ করে রেখে শহরের বাইরে বেড়াতে চলে যান। প্রয়োজন মত খাবারও থাকে না। কী অসহায় অবস্থা! এগুলোর সমাধান অনায়াসে করা যায়, যদি আমরা মেকি ভদ্রতার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে প্রতিবেশীর খবর রাখি, তাঁদের পাশে দাঁড়ায়।  

     তা না করে নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়ছি, ছেলেমেয়েদের দাদু ঠাকুমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখে। তাদের স্বার্থপর করে গড়ে তুলে। চারিদিকের এই ধোঁয়াশা  পরিবেশে দম আটকে আসছে, তবু চেতনা হারাবার আগে চেতনা ফিরছে না। এভাবে আমাদের জনবহুল দেশে, যেখানে একটা বড় অংশের মহিলারা নিরক্ষর ও অত্যাচারিত, নিপীড়িত, সেখানে কেউ পাশে নেই। যেটুকু বোধ, মায়ামমতা আছে তা গৃহপালিত পশুর জন্য। যা কিনা স্ট্যাটাস সিম্বল।

     এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব নারীদিবস পালনের সার্থকতা কোথায়? শুধুমাত্র প্রথা পালন করার জন্য? এবিষয়ে  এখনিই না ভাবলে আর কোনদিনই পিছন ফিরে  তাকানোর সুযোগ পাওয়া যাবে না।

                           

Post a Comment

1 Comments