জ্বলদর্চি

বিদ্বেষে --বিষাদে --রবীন্দ্রনাথ(শেষ পর্ব) স্যার যদুনাথ সরকার ও অন্যান্যরা /তনুশ্রী ভট্টাচার্য

বিদ্বেষে --বিষাদে --রবীন্দ্রনাথ
শেষ পর্ব 
স্যার যদুনাথ সরকার ও অন্যান্যরা

তনুশ্রী ভট্টাচার্য 


আজ বোশোখে তুমুল পুজো 
সেদিন এত ছিল কি ?
রোষ অপবাদ নিন্দা শরে
 বিদ্ধ হতেন কবি।

নিন্দা ও প্রশংসা বিপরীত শব্দ। দুটোই আপেক্ষিক দুটোতেই মানুষ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তবে সেটা আমাদের মত আমজনতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি জীবন সাধক দার্শনিক দীক্ষিত হৃদয়ের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে অনেকটা অন্যরকম। তাঁর জীবনে বিপুল প্রশংসার পাশাপাশি তুমুল অপবাদ নিন্দা রোষ দ্বেষ ও ছিল । কিন্তু দুটো ক্ষেত্রেই তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল তাঁর কাব্য গুনের মতই সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শুধু বাইরেই নয় আমাদের ভাবনার স্তর থেকে যোজন দূরে অবস্থিত  তাঁর সেই নিন্দাকে গ্রহণ করার  ক্ষমতা।

বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেকের  বিরাগভাজন হলেন তিনি। এবং সবগুলোই অহেতুক।যেমন  স্যার যদুনাথ সরকার এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কটা বিশ্বভারতী কে কেন্দ্র করে  নষ্ট হয়ে গেল। অনেক আশা করে ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ কে কবি শান্তিনিকেতনের গভর্নিং বডির সদস্য হতে আহবান করেন।কিন্তু তিনি সে আহ্বান প্রত্যাখান করলেন শুধু তাই নয়‌ একেবারে বিরোধিতা শুরু করলেন। এটা ঠিক সে সময়ে একজন ভাববাদী কবি স্কুল থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়তে চাইছেন ---এটা অনেকেই সহজ মনে মেনে নিতে পারছিলেন না এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও সেটা বিলক্ষণ জানতেন এবং বুঝতেন। তিনি যে একটি অন্যধারার শিক্ষাপদ্ধতি চালু করতে চাইছেন সে ব্যাপারে এমনকি পিয়ারসন বা এ্যান্ড্রুজ সাহেবের ও দ্বিধা ছিল কিন্তু দ্বিধা যখন বিরোধে রূপ নেয় তখন সেটা কবির পক্ষে মর্মপীড়ার কারণ হয়। আর যদুনাথ সরকার সেই মর্মপীড়াটাই দিয়েছিলেন কবিকে। প্রায় ছ বছর গড়িয়ে গেলেও বিশ্বভারতীর প্রতি স্যার যদুনাথের এই বিরূপ মনোভাবের বদল হয় নি।   তিনি এমনকি মাদ্রাজে  রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি বক্তৃতা দেওয়ার কালে  প্রকাশ্যে  বিশ্বভারতীর শিক্ষাব্যবস্থাকে আক্রমণ করেন। শান্তিনিকেতনের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টেলেকচুয়াল ডিসিপ্লিন এবং এক্সাক্ট নলেজ নেই এবং জোড়াতালির শিক্ষা বলে নিন্দা করে তাকে যথার্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দিতে ঘোর আপত্তি করেন । রবীন্দ্রনাথ অনেক চেষ্টা করেও স্যার যদুনাথের এই মনোভাব পরিবর্তন করতে পারেননি । কবির  আক্ষেপ ছিল শ্রীনিকেতনে যে কৃষি বিভাগ শিক্ষা সদনে ছুতোর কামার চামড়া পাকা করার শিক্ষা এগুলি কি বিজ্ঞান শিক্ষা নয়? ভাবের আর বিজ্ঞানের সমন্বয় শিক্ষাই যে তাঁর শান্তিনিকেতনের আদর্শ-- এ ব্যাপারে  কবির প্রতীতী ছিল। সব নিন্দা সহ্য করলেও  "সব হতে আপন" শান্তিনিকেতনের প্রতি এই অবজ্ঞা কবির  মনে যথেষ্ট আঘাত দিয়েছিল।

( আর আজ শান্তিনিকেতন যা হইয়াছেন আমাদের অপরিণামদর্শিতায়----+সে কথা তোলা থাক।)

প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবির  সখ্য ক্রমশ কুহেলিকা প্রহেলিকাময় হয়ে উঠতে লাগলো। প্রবাসী ও বিচিত্রার পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামনে এলো। তবে এ যাত্রায় কবির  কলম ঢাল হয়ে দাঁড়ালো।  শত্রুতা চূড়ান্ত পর্যায়ে  পৌঁছানোর আগেই তার সমাধান সূত্র বেরিয়ে এলো। যখন বিচিত্রা পত্রিকা তিনহাজার টাকায় কবির  উপন্যাস "যোগাযোগ"  কিনে নিয়ে ছাপতে লাগলো।    প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা আর ছাপবেন না  ঘোষণা করলেন।  একটা বৈরীতার পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। তবে রবীন্দ্রনাথ তার খেদ গোপন না করে বরং বিশ্বভারতীর অভাব এই টাকা প্রয়োজন এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্বের ও যে বিনাশ ঘটলো এই কথা জানিয়ে লিখলেন--- "বিশ্বভারতীর দারিদ্র্যে আমি আজ দরিদ্র এবং শিশু কাল থেকেই আমি অত্যন্ত একলা, বস্তুত আজও একলাই আছি"---যে রবীন্দ্রনাথ শত দুখেও একলাই থেকেছেন আজ বিশ্বভারতীর জন্য তিনি এই মর্মবেদনা বন্ধুকে জানাতে বাধ্য হলেন।  তখন শান্তিনিকেতন বড় বালাই। এই কথা রামানন্দ কে নাড়া দিল। তাঁদের মধ্যে একটা ফয়সালা হল। রবীন্দ্রনাথ লিখতে শুরু করলেন "শেষের কবিতা "। দিলেন প্রবাসী পত্রিকায় ।তার সঙ্গে ছিল ভাস্কর দেবীপ্রসাদ চৌধুরী অলংকৃত ছবি। দুটোই সমানতালে বাজারে কাটতে লাগলো বরং "শেষের কবিতা"র টানটা  বেশি হলো। বন্ধুত্বটা অন্তত টিকে গেল ।

🍂

শুধু অগ্রজ বা সমবয়সী নয় পরবর্তী অনুজদের কাছ থেকেও কবিকে কম সমালোচনা শুনতে হয়নি। এবং বেশিরভাগই তা ছিল অকারণ গায়ে পড়া বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা।। বয়সে অনেকটা ছোট হাসির রাজা শিবরাম চক্রবর্তী  একটি  হাস্যকর বিদ্রুপে প্রশ্ন তুললেন--- বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথের একটি অপকর্ম- কি দরকার এই বিশ্বভারতীর? আরো কেউ কেউ বললেন এই অসময়ে কেন বিশ্বভারতী? রবীন্দ্রনাথ বললেন এই দুঃসময়েই সুসময়। মানুষ মানুষের সঙ্গে যে ক্ষেত্রে মিলতে পারে আমি সেই ক্ষেত্রকেই সবচেয়ে বড় বলে মনে করেছি।
"শনিবারের চিঠি"র সজনীকান্ত দাস অহৈতুকী  রবীন্দ্র বিদ্বেষ বিস্তার ঘটাতে লাগলেন। কবির সত্তর  বছর বয়সে  আসতে লাগলো নতুন নতুন আক্রমণ  "শনিবারের চিঠি"র থেকে। কবি রইলেন মৌন। তিনি ভেবেছিলেন সজনীর কথার উত্তর দেওয়া তাঁর নিজের  বিরুদ্ধে যাওয়া। তিনি বিলক্ষণ জানতেন--অহৈতুক অনুরাগের মতোই অহৈতুক বিদ্বেষও আছে ওটা প্রকৃতি সিদ্ধ--- মানতে হবে।    রমাপ্রসাদ চন্দ নামটি রবীন্দ্রবলয়ে  আদৌ পরিচিত নাম নয়। ঘটনাটি এইরকম-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগীশ্বরী অধ্যাপক পদের নিয়োগের প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন এই রমাপ্রসাদ চন্দ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়োগ না করে অন্য আরেকজনকে নিয়োগ করেছিলেন। এই ঘটনায় রমাপ্রসাদ যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে বিদ্বিষ্ট  ভাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানালেন । তাকে সাহায্য করলেন "শনিবারের চিঠি " সাপ্তাহিকের  কর্ণধার সজনীকান্ত দাস।  রবীন্দ্রনাথকে অর্থ লোলুপ সুবিধাবাদী বলতেও তাদের আটকালো না।।

এইসব বিদ্বেষরাগিনীর বিস্তারকালে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ কবিকে আহ্বান জানালেন অক্সফোর্ড বাংলা কাব্য সংকলনের সম্পাদক হতে। কবি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলেন কারণ সেখানে সজনীকান্তকেও আহ্বান করা হয়েছিল। (যদিও শেষ পর্যন্ত সংকলনটি প্রকাশ পায়নি) কবি এভাবেই  কঠিন ভাষা প্রয়োগ  না করেও  অনুচ্চারের মাধ্যমে নিজেকে বিবিক্ত  রাখতে পারতেন। 
এরকম আরো ঘটনা ছড়িয়ে আছে কিন্তু রবিরশ্মির ছটায় সেগুলো ম্লান হয়ে গেছে। তবে যে ক্ষরণ হয়েছিল,  যে বেদন তিনি পেয়েছিলেন  তার চিহ্ন  ছড়িয়ে আছে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আর সেই সৃষ্টিসুধায় সেই বিদ্বেষ বিষাদকেও তিনি অমর করে গেছেন। 
বাস্তব সেটাই।
বাস্তবে কি? রবীন্দ্রনাথ একজন মানুষ ।দেবগুন সম্পন্ন  একজন মানুষ। মানুষের ধর্মের পূজারী একজন মানুষ। তাঁকেও দুঃখ লাগে। তিনিও শত্রুতায় বিচলিত হন । কিন্তু তাঁর দিক থেকে কেউ আঘাত পেয়েছে জানলে তিনি ক্ষমা পর্যন্ত চেয়ে আসতে পারেন। যেমনটি তিনি চেয়েছিলেন নোবেল পাওয়ার পর একটি সংবর্ধনা সভায় তাঁর কিছু বাক্য প্রয়োগে কেউ মানসিক আঘাত পেয়েছে এটা মনে করে পরের দিনে উপস্থিত প্রত্যেক ব্যক্তির বাড়ি গিয়ে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছিলেন। বিদ্বেষরাগিনীর আলাপ বিস্তারে তাঁর সায় ছিল না। তিনি যে কড়ি ও কোমলের কবি।
 এই রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আজকের এই উগ্র কথাবার্তা উদ্ধত শব্দ ব্যবহারের বিপন্ন সময়টায় 
এই রবীন্দ্রনাথ কেই যেন আমরা মনে রাখি।।।

Post a Comment

0 Comments