জ্বলদর্চি

অমর সাহার 'কঙ্কাল' কাব্যের পাঠ প্রতিক্রিয়া স্বপন কুমার দে

 অমর সাহার 'কঙ্কাল' কাব্যের পাঠ প্রতিক্রিয়া

স্বপন কুমার দে

বিশ্ব বিখ্যাত মনীষীর সেই বহু শ্রুত আপ্ত বাক্যটি মনে রেখেও বলা যায়, নামে অনেক কিছুই এসে যায়, যদি সেই নামটি কোনও সাহিত্য বা শিল্পবস্তুর হয়। তাই আলোচনার শুরুতেই 'কঙ্কাল' শব্দের ব্যঞ্জনা কাব্যদেহ নির্মাণের প্রধান শর্ত বলে আমার মনে হয়েছে। বিগত এবং বর্তমান কমবেশি তিরিশ বছরের সময়কালীন মানব প্রবৃত্তির যে অনাবৃত নগ্নতা কবিমনকে আচ্ছন্ন করেছে সে সবই এ কাব্যের বিষয় নির্মাণের উপকরণ।

কবি অমর সাহার 'কঙ্কাল' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি আমাকে অনেকক্ষণ যাবৎ ভাবিয়েছে। অনেক সময়ই  গ্রন্থনাম অনেক কিছুই বলে দেয় বা বলা ভালো পাঠকের সামনে ভাবনার জগৎ খুলে দেয়। মনোবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব কথা জানা না থাকলেও আমাদের মত সাধারণ পাঠকের মনে কঙ্কাল সম্পর্কে একটা ভীতি বা গা শিউরে ওঠার অনুভূতি জাগে। এই কাব্যে সেই শিউরে ওঠার বাস্তব দিকগুলি চিহ্নিত। সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সমাজ বৈকল্যের রূপটিও সমানভাবে দর্শনীয়। বর্তমান সমাজ যেন মাংস-চর্বি-রক্ত-চর্মহীন এক কঙ্কাল। ভালোবাসার স্পর্শ নেই, সহানুভূতি-বিবেক-মনুষ্যত্ব যেন দূর গ্রহের বিরল গুণাবলি। জিঘাংসা, রিরংসা, লালসাভরা উন্মত্ত বন্য প্রাণীর চিৎকারে মনুষ্যত্বের শ্মশানভূমি হল আজকের এই সমাজ। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কবি খুঁজে চলেছেন মরুদ্যান।

🍂

কবি অমর সাহার এই কাব্য চির পরিচিতের মধ্যে অপরিচিতের সন্ধান। আমরা সকলে সামাজিক হলেও সমাজ সচেতন নই, এমনকি আত্মসচেতনও নই। যে যার বৃত্তে পরিক্রমশীল স্বার্থসন্ধানী নয়তো নিস্পৃহ। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কবির সমাজভাবনা ও জীবনভাবনা।

কাব্যটি পড়ে আমার যেটা মনে হয়েছে, এই কাব্যটি মূলত তিনটি বিষয়ভাবনার ওপর কেন্দ্রীভূত,-- (ক) রক্তে ভেজা জঙ্গলমহল, (খ) করোনা মহামারী ও পরিযায়ী শ্রমিক এবং (গ) অতীত স্মৃতিচারণ ও তজ্জনিত বেদনাবোধ। এছাড়াও ভিন্ন স্বাদের ও ভিন্ন বিষয়ক কয়েকটি কবিতা রয়েছে। কবির আত্মকথনে এই কাব্যে রোমান্টিকতাকে দূরে সরিয়ে রাখার কথা বলেছেন, আমি তাঁর সাথে একমত নই। সে আলোচনা পরে। এখন আমি বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় আসি।

(ক) রক্তে ভেজা জঙ্গলমহল: যেকোনো কারণেই হোক, একুশ শতকের প্রথম দশকে বাংলা ও বাঙালির রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন উত্তাল হয়। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় পশ্চিমের জঙ্গল পরিবৃত জেলাগুলিতে, যা জঙ্গলমহল নামে পরিচিত। ডান,বাম,অতি বাম এবং রাজনৈতিক সওদাগরেরা এই অঞ্চলটিকে রাজনৈতিক লাভালাভের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। ফলত,মাওবাদী, হার্মাদ এবং যৌথবাহিনী এই ত্রয়ীর সংঘর্ষে মৃত্যুমিছিল দেখতে পায় জঙ্গলমহল। কত যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ ঘাতকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে! কত মায়ের কোল খালি হয়েছে! কত বধূ বৈধব্যের হাহাকার বুকে নিয়ে বেঁচে আছে! জঙ্গলে পাওয়া গেছে ছিন্ন বিছিন্ন পচা গলা লাশ। এই রাজনীতি এখন অতীত কিন্তু তার জ্বালা এখনও স্বজনহারা মানুষের বুকে জ্বলছে।
'কঙ্কাল' কবিতায় রয়েছে সেই জ্বালা যন্ত্রণার কথা, --

" এখানে অনেক কঙ্কাল আছে;
সঞ্জীবনী সুধা দিলে কঙ্কাল কবে কি কথা?"

কিংবা,

" জল মাটিতে পোঁতা কঙ্কাল কেমন করে কই যে কথা "
এ বেদনা এক কালো ইতিহাসের সাক্ষী।
'জীবন' কবিতায়, -

" বুলেটের দাগ এখনও রয়েছে দেওয়ালে
কিন্তু ভয়ে আর ভয়ালুতাকে জয় করে
সরষে ফুলের ঢলানি, বাঁধাকপির হাসি।"

জীবন থেমে নেই, থেমে নেই মানুষের কর্মধারা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, " শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে/ ওরা কাজ করে।"

আবার ' সারদ্বত' কবিতায় দেখতে পাই, --
" শাল মহুয়ার সুবাস ছড়ানোর আগে
এখানে ছড়িয়েছে পচা মানুষের দুর্গন্ধ-
বাতাসে বারুদের ঘ্রাণ আর রক্ত লোলুপ মানুষ
গ্রাস করেছে নিরন্ন ভুখা মানুষকে,
এরা কেউ নেতা নয়, তুচ্ছ মানুষ-"


'এইখানে' কবিতাতেও এক ধরনের বিষন্নতা কবি আচ্ছন্ন করে, -
" এইখানে শিমুলের তলে দিয়েছে প্রাণ
কত শত নামধারী- শত শত নারী।"

(খ) করোনা মহামারী:
বিষে ভরা বিশ সাল। শুধু বিশ নয়, পর পর দু'বছর ২০২০ এবং ২০২১ সাল সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে মৃত্যুর মূর্তিমান বিভীষিকা। এক অদৃশ্য আনুবীক্ষণিক জীব ( করোনা ভাইরাস)-এর প্রবল আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে মানুষের তৈরি গর্বের বিজ্ঞান সভ্যতা। দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী শক্তিধর দেশগুলিও অর্গলবদ্ধ কক্ষে লুক্কায়িত। লড়াই করেছেন অসম সাহসী ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীরা। লড়াই করেছে একেবারে সাধারণ স্তরের শ্রমজীবীরা। কয়েক কোটি মানুষের প্রাণ গেছে, আরও বহু কোটি মানুষ মারণ রোগের ছোবলে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তার জন্য বিশ্বের অর্থনীতি ভূমিস্যাৎ, সমাজনীতি বিকলাঙ্গ।

এই বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে বলি, আমরা অনেক নতুন ধারনাকে জীবনের অঙ্গ করলাম। যেমন, 'সোশ্যাল ডিসট্যান্স', ' লক ডাউন', ' কোয়ারেনটাইন' ইত্যাদি। এর ফল কী হল? আমরা গৃহবন্দী হলাম। কৃষি,শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা- সব রসাতলে গেল। মারাত্মক প্রভাব পড়ল ' দিন আনি দিন খাই ' অর্থাৎ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবনে। অসংগঠিত কর্মচারী এবং পরিযায়ী শ্রমিক- এদের জীবন যাপন দুর্বিষহ হল। সেই সময় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য পরিযায়ী শ্রমিকেরা পড়ল বিপদে। তাদের ভিন রাজ্য থেকে নিয়ে আসার জন্য গুটিকয়েক স্পেশাল ট্রেন চালিয়ে বিভিন্ন স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হল। ব্যাস, এবার সেখান থেকে পঞ্চাশ কি একশো বা তারও বেশি পথ হেঁটে বাড়ি ফেরা। দিন রাত তারা হাইরোড ধরে মাথায় ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছে। খাবার ফুরোলে কাছাকাছি জনালয়ে খাবার ভিক্ষা করেছে। কবি অমর সাহা তাঁর কিছু কবিতায় এ দৃশ্য তুলে ধরেছেন।
" একটু খাবার দাও: দাও নুন
লকডাউনে কত আর অভুক্ত থাকি
আমি ভুখা মানুষ; পরিযায়ী শ্রমিক "
                         পরিযায়ী শ্রমিক

" প্রকৃতির খেয়ালিপনা আজ ভেঙে দিয়েছে
শিক্ষালয়ের বারান্দা, কচিকাঁচাদের বুলি "
                                                  শিক্ষালয়

(গ) অতীত স্মৃতিচারণ ও তজ্জনিত বেদনাবোধ: জীবনের একটা পর্যায়ে এসে পিছন ফিরে চাইতে ইচ্ছা হয়। শৈশব, কৈশোর, যৌবনের স্বর্ণমাখা অতীত প্রৌঢ়ের মালিন্যে বড়ই বেদনাময়। স্নেহ, ভালোবাসা,বন্ধুত্বের সব বন্ধন বয়সের সাথে সাথে আজ ক্ষয়িষ্ণু। মন চায় সেই অতীতকে ছুঁয়ে দেখতে, কিন্তু তা সম্ভব নয়। তা কেবল ধূলিজর্জর স্মৃতি কোঠায় নিমজ্জিত।
" বয়স গিয়েছে বেড়ে অর্ধ শতাব্দী,
সময় দিন ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ড প্রশিক্ষণ
বাড়াচ্ছে বয়স কলি ক্ষয়মান; গতিশীল"

কিংবা ঐ কবিতার অন্য জায়গায়, -
"মনে পড়ে খালি পায়ে তুমি আর আমি
যেতাম খুনসি পরে পিচ রাস্তায় "
                          আপন পর

" তিরিশ তিরিশ বছর আগে; আমরা-
আমাদের জীবন ছিল- লাল নীল হলুদ "
                                    জীবনধারা

প্রেম আছে কিছু কবিতায়,
" তোমার জন্য চাঁদ দেখতে দেখতে
পেলাম চন্দ্রমুখীকে
তোমার জন্য সূর্য কিরণ মেখে মেখে
পেলাম সূর্যমুখী। "

গ্রন্থের একেবারে প্রথম কবিতা বিশ্বপ্রেমের বানীমূর্তি নির্মিত হয়েছে ' বুদ্ধ' কবিতায়। শেষ কবিতায় আছে চির প্রবাহিত, চিরন্তন জীবনধারা প্রসঙ্গে 'চিরন্তন' কবিতা।
স্বল্প দৈর্ঘ্যের শ্রুতিসুখকর কবিতাগুলি আশাকরি পাঠকের ভালো লাগবে।

Post a Comment

0 Comments