চিত্র- শুভম দাস
ওথেলো সিন্ড্রোম
পুলক কান্তি কর
এই অফিস বেরোবার মুখে টিনার মধুর কন্ঠস্বরের চিমটিতে গা টা রি রি করে জ্বলে গেল সৌরীনের। তবু নেহাৎ এখন ঝগড়া করার মুড নেই বলে যথা সম্ভব নরম গলা করে বলল,‘আবার কী হল?’
-কী আর হবে? এত ডিও স্প্রে করছো তো! তাই ভাবলাম শাকচুন্নি আবার আজকে বুকে মুখ ঘষবে নাকি?
-মানে?
-মানে বোঝ না? ন্যাকা!
-মুখ সামলে কথা বল টিনা! রোজই তো ডিও লাগাই।আজ নতুন কী হলো?
-রোজ দু-বগলে এক একটা স্প্রে মারলেই হয়ে যেত! আজ বুকে-পিঠেও স্প্রে হচ্ছে কিনা!
-মানুষ শান্তিতে একটু সেন্টও মাখতে পারবে না তোমার জ্বালায়? নিজের পয়সায় তো মাখি!
-যার পয়সাতেই মাখো, মাখছো কেন? কারণ আছে নিশ্চই! সেই কারণটা জানতে চাইছি!
-জানতে চাইছো কোথায়? সিদ্ধান্ত তো নিয়ে ফেলেছ, কেন মাখছি!
-অন্যায় বলছি কি? আমি বুঝি না? যাওয়া আসার সময় পেত্নীটাকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাও, আমি বুঝতে পারিনা মনে কর?
-তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই -আমি তাকাতে তাকাতে যাই, তবে আজই এত সেন্ট লাগানোর সাথে তার সম্পর্ক কি? নিজের গন্ধে কি নিজের দৃষ্টিশক্তি বদলে যাবে?
-চালাকি করা হচ্ছে আমার সাথে? আমি আবোদা? তুমি ভাবছো কথা ঘুরিয়ে পার পাবে? বলি, আজ কোথায় গিয়ে দেখা করবে? পার্কে নাকি সিনেমায়?
-টিনা আমার অফিসে দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! বাড়াবাড়ি করো না। নিজের কল্পনাকে লাগাম দাও। অনেক সহ্য করছি - আমার কিন্তু সহ্যের সীমা আছে!
-কেন কী করবে? গায়ে হাত তুলবে? নাও মারো! বলে টিনা এসে সৌরীনের কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগলো।
-কী পাগলামি করছ টিনা? ছাড়ো, জামায় ভাঁজ হয়ে যাবে। অফিসের কলিগেরা কী ভাববে?
-অফিস কলিগের ভাবার গুরুত্ব আছে, আমি কী ভাবছি তার দাম নেই?
-ছাড়ো বলছি টিনা!
-না ছাড়বো না। দেখি তুমি আজ কীভাবে যাও!
-অফিসে আমার জরুরী কাজ আছে। ছাড়ো আমায়!
-না। তুমি আজ এখানে আমার সামনেই বসে থাকো।
-আমি কিন্তু এবার তোমায় ধাক্কা দিয়ে সরাবো টিনা! তখন কিন্তু বলো না, আমি গায়ে হাত তুলি।
-এর চেয়ে গায়ে হাত তোলা তো ভালো! বলেই আরোও জোরে জাপটে ধরলো টিনা। এবার সৌরীন মোটামুটি জোরের সাথেই ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল খাটে। ‘হা আমার পোড়া কপাল, আমার কপালে এমনই লম্পট জুটলো’ - ইত্যাদি বহুবার শোনা হুতাশ বাক্য আওড়াতে আওড়াতে টিনা দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলো। সৌরীন বহুবার তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু টিনা মাথা ঠুকেই চললো। বহু কষ্টে যখন নিরস্ত হলো, তখন ওর কপালে দু-তিনটে আলু।
-টিনা আজ যা তুমি সিনক্রিয়েট করলে, আমার আর কিছু বলার নেই। তোমার যা ইচ্ছে করো, আমি চললাম।
টিনা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে হাবিজাবি অনেক কথা বকতে লাগলো। সৌরীন যখন দরজা খুলে বেরোতে যাবে, তখন টিনা বলল, বেশ আজ আমি গলায় দড়ি দেব। দেখি, এরপর জেলে বসে কত অফিস কর।
-টিনা আজ আমার অফিস যাওয়া জরুরী। আজ একটা ফরেন কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভের সাথে আমার অ্যাসাইনমেন্ট আছে। না গেলে আমার চাকরী যাবে!
-গ্রহ যাবে! তোমার চাকরী যাক্, তাতে যদি তোমার আলুবাজি কমে।
এর উত্তরে আর কিছু বলা চলে না। সৌরীন তার সহকর্মীকে ফোন করে অনেক মিথ্যের দোহাই দিয়ে কোনওক্রমে আজ অফিস না যেতে পারাটা ম্যানেজ করল। কিন্তু টিনার এই পাগলামি তো দিনে দিনে বাড়ছে। ওর এখন কেমন দম বন্ধ লাগছে। ভালোবেসে বিয়ে, কাকেই বা অভিযোগ জানাবে। শ্বশুর-শাশুড়ী তো নিশ্চই মেয়ের কথাই বিশ্বাস করে। বিয়ের সাতবছর হয়নি! কিছু হলেই তো এখন ফোর নাইন্টি এইট! কোনও কথা শুনবে না পুলিশ। সটান জেল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার উপায় নেই। বললেই বলবে - ‘ওঃ আমাকে পাগল সাজিয়ে পথ পরিষ্কার করার চিন্তা! ও আমি হতে দেব না!’ আগের অফিস এই করেই ছাড়তে হয়েছিল তাকে। অনুরাধা বলে একটি ইউ.পির মেয়ে ওদের অফিসে জয়েন করেছিল মাস সাতেক আগে, ওরই আন্ডারে। বাইরের মেয়ে। ওর এখানে চেনাশোনা কেউ ছিল না। অফিসের কাছাকাছি ঘর ঠিক করে দেওয়া, খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া, গ্যাসের কানেকশন ইত্যাদি ব্যাপারে সৌরীন যথেষ্ট ইনভলভ্ড হয়ে পড়েছিল। এই কারণে মাঝে মাঝেই অনুরাধা ওকে ফোন করতো, হোয়াটস অ্যাপ করতো। কিছুদিন ঠিক ছিল, তারপরেই শুরু হল সন্দেহ, খোঁচাখুঁচি। সৌরীনও সেসময় খুব তেরিয়া জবাব দিত। মিথ্যা অভিযোগ কাঁহাতক শোনা যায়! একদিন মাঝরাত পর্যন্ত এই নিয়ে ছুঁচোর-কেত্তন হতে হতে টিনা গায়ে কেরোসিন তেল পর্যন্ত ঢেলে দিয়েছিল।পরে কোনও রকমে হাতে পায়ে ধরে নিরস্ত করে সৌরীন। শ্বশুরমশাইকে জানাতে উনি পার্টির গুন্ডাদের দিয়ে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া শুরু করলেন। শাশুড়ি তুলনায় ভালো, তবু বহুমানুষ আছে যারা স্বার্থের সামনে নিজের নীতি দাঁড়ালে চোখ বুজে ফেলে, তিনি তেমন মানুষ। উপরি হল, শ্বশুর পার্টির বড় নেতা। ফলে নিজের সংসারে শাশুড়ি যাই দাপট দেখান না কেন, এক্সটার্নেল অ্যাফায়ার্স নিয়ে তাঁর বক্তব্য যে বিশেষ পাত্তা পাবে না - এ একপ্রকার সৌরীনের জানাই। আদর-টাদর করে কতদিন আর আগুন চেপে রাখা যায়? একদিন না একদিন নিজের মেজাজও যুক্তির সীমা মানতে চাইবে না। দু-চারদিন খিটখিট চলছিলই, একদিন টিনা ওদের অফিসের ম্যানেজারের কাছে লিখিত কমপ্ল্যান ঠুকে দিল। এতো আর সরকারী চাকরী নয় যে মৌরসীপাট্টা গজিয়ে যাবে, অতএব অবিলম্বে বহিষ্কার দুজনকেই! সৌরীন তাও সিনিয়ার - এই ফিল্ডে জানাশোনা আছে, কোনওরকম আর একটি জুটিয়ে নিল, কিন্তু অনুরাধার সে সৌভাগ্য হল না। ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। বাবা-মার সামনে কী রকম হিউমিলিয়েশন! ছিঃ ছিঃ। নিজের উপরই মাঝে মাঝে ঘেন্না ধরে যায়। যাইহোক বহু কষ্টে কিছুদিন আগে অনুরাধাকে অন্য একটা চাকরী যোগাড় করে দিতে পেরেছে সে, তবে কলকাতায় নয়, গুরগাঁওতে। একদিক দিয়ে অনুরাধারও ভালো হয়েছে। ও বাড়ীর কাছাকাছি থাকতে পারবে।
আপাততঃ ফুলে ওঠা কপালে বরফ ঘষা ছাড়া কী করা যায় ভাবতে বসল সৌরীন। এ পাড়ায় ওদের বহুপুরুষের বাস। পাড়ার যারা ডাক্তার, কমবেশী সবাই চেনা। ওদের সামনে নিয়ে গিয়ে কীই বা বলবে সে! গেলেই তো ডাক্তার জিজ্ঞাসা করবে - কী করে হলো! হঠাৎ মনে পড়ল ওর এক ক্লাশমেট ছিল অর্ণব, ও হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ওকে ফোন করলে হয়। সেই মতো মনস্থ করে ফোন লাগালো সে।
-হ্যালো অর্ণব, তুই কি চেম্বারে?
-হ্যাঁ। কী হয়েছে? হঠাৎ ফোন?
-শোন্ না, একটা বিশেষ দরকারে ফোন করলাম। টিনার দরজায় মাথা লেগে কপালটা একটু ফুলে গ্যাছে, কী খাওয়াই বল দেখি?
-বড় মানুষ, কপালে ধাক্কা খায় কী করে? মাথায় গুঁতো-ফুঁতো মানা যায়।
এর উত্তরে কী বলবে সৌরীন। বলল, ‘কী আর বলব, বল্! আজকাল সব মোবাইল-নেশা বুঝলি না? ক্যান্ডি ক্র্যাশ খেলতে খেলতে এঘর ওঘর করলে, দরজার আর কী দোষ? তাও ভাগ্যিস আজ অফিস ছুটি নিয়েছিলাম, নইলে অফিস থেকে কেটে আসতে হত।‘
-বরফ-প্যাক দিয়েছিস?
-হ্যাঁ।
-তবে একটু আর্ণিকা এনে খাওয়া। তুই দোকানে গিয়ে ফোন করিস আমি মাপ-টাপগুলো বলে দেবো।
-কিছু কি লাগাবো?
-ওই আর্ণিকাটাই তুলোয় ভিজিয়ে লাগিয়ে দে। নইলে আজকাল আর্ণিকা মলমও পাওয়া যায়, কিনে আনতে পারিস।
আর্ণিকা কিনে টিনে এবেলার মতো সন্ধি হয়ে গেল। কিন্তু সৌরীন চোখের সামনে কোনও আশার আলো দেখতে পেল না। এরকম সাময়িক জোড়াতাপ্পি দিয়ে কদিন চলবে? এর একমাত্র সলিউশন, ডিভোর্স। কিন্তু এই কারনে ডিভোর্স পাওয়া শুধু মুশকিল নয়, অসম্ভবও বটে। তাও যদি কোনও মহিলা স্বামীর চরিত্র খারাপ ইত্যাদি বলে ডিভোর্স ফাইল করে, তাতে ডিভোর্স পাওয়া যায়; কিন্তু পুরুষেরা করলে, না হওয়ার চান্স নব্বই শতাংশ। অন্তত, ও ওর বন্ধু-বান্ধবদের থেকে যতটুকু শোনে, তার ভিত্তিতেই এই অনুমান। সিরিয়াসলি বিষয়টা নিয়ে যে সে এতদিন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, এমন নয়। সবসময়ই সাময়িক সন্ধি, নইলে চক্ষুলজ্জা এসে বিষয়টা আড়াল করে দিয়েছে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, কোনও না কোন উপায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের করা উচিৎ। এরকম চললে, এ চাকরীও যাবে। এসব কথা কর্পোরেট জগতে চাউর হতে সময় লাগে না। নতুন চাকরী জোটানোও মুশকিল হয়ে যাবে তখন। কিন্তু কাকে বলবে? অনীককে? না না, বড় পেট পাতলা ও। ওদের ঠেকে বলে দেবে সে! বারিদ? ও তো ল-ইয়ার! এটা কিসের আওতায় পড়ে? ক্রিমিনাল না কি সিভিল? লোকে বলে উকিলের বুদ্ধি! বুদ্ধি যাই হোক না কেন, বারিদ বড় প্যাঁচালো। ওর বন্ধু ঠিক আছে, কিন্তু এমন পেঁচিয়ে কথা বলে, কেউ পছন্দ করে না ওকে। ও অনেক ভেবে টেবে সমীরণকে বলাটাই মনস্থ করল। সমীরণ ওর বেশ কাছের বন্ধু ছিল। টিনাকে বিয়ে করার পর বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা বা ঠেক সবই গিয়েছে শুধুমাত্র পরিবারের শান্তি রাখার তাগিদে। আগে যদিও বা মাসে দু-মাসে দু-একবার যেত, এখন একবারও যাওয়া হয়না। শুধু তাই নয়, ফোন করে গল্প করাও গেছে। এতরকম সাইড কমেন্ট আসতে থাকে ফোন করার সময়, যে ইদানীং খুব দরকার ছাড়া সে কাউকে ফোনও করেনা।
আজ যা পরিস্থিতি, সন্ধেবেলা কি বেরোনো ঠিক হবে? তখন যদি সকালের অনুমান আবার মনে পড়ে যায়, তবে ভারি মুশকিল। দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যাবে। সৌরীন অনেক ভেবে টেবে কাল অফিস ফেরৎ সমীরণের সাথে দেখা করা মনস্থ করল।
পরেরদিন সকাল এগারোটা নাগাদ সমীরণকে অফিসের ফোন থেকেই ফোন করলো সে।সমীরণ বলল, কী ব্যাপার রে সৌরীন, তুই যে ডুমুরের ফুল হয়ে গেলি? ভালোবেসে তো আমরাও বিয়ে করেছি, কিন্তু বউ এর আঁচল ছাড়ার বয়স কি এখনও পার হয়ে যাইনি?
-তোরা ভাগ্যবান রে সমীর! আমার তো তেমন কপাল নয়!
-মানে?
-তোর সাথে কি আজ দেখা হওয়া সম্ভব? খুব আর্জেন্ট।
-নিশ্চই। ব্যাপারটা কী?
-ফোনে না। সামনা-সামনি বলব।
-ঠিক আছে। অফিস ফেরৎ চলে আয়।
-অফিস ফেরৎ না রে! তবে বাড়ী ফিরতে দেরী হবে। তখন আর এক অশান্তি।
-কিসের অশান্তি?
-সে কথাই তো বলব তোকে। এই অফিস আওয়ার্সের মধ্যেই কর।হয় আমি তোর ওখানে যাই,নয় তুই এখানে আয়!
-তোর আজ কাজের চাপ কেমন সৌরীন?
-বলিস না। কাল অফিস কামাই করেছি। জরুরী অ্যাসাইনমেন্ট ছিল কাল। এসে থেকে বসের ঝাড় খাচ্ছি। কিভাবে বেরোব তাই বুঝতে পারছি না। তবে বেরোতেই হবে। আমার বিষয়টা ভীষণই ডেলিকেট এবং আর্জেন্ট।
-তবে এক কাজ কর। সেকেন্ড হাফে আমার একটু পার্কস্ট্রীট যাওয়ার আছে। ওখানে আমার তিনটে সওয়া তিনটের মধ্যে কাজ মিটে যাবে। সাড়ে তিনটা নাগাদ নন্দনের সামনে চলে আয়। ওখানেই কথা বলে যে যার বাড়ী ফিরে যাবো।
-বেশ। সাড়ে তিনটায় আমি চলে যাবো। সমীর আসবি কিন্তু!
(২)
-তোর তো লাভম্যারেজ সৌরীন। তিন বছর তো কমসে কম ঘুরেছিলি। বুঝতে পারিসনি? সমীরণ বেশ দুশ্চিন্তার সুরেই জিজ্ঞাসা করল।
-তেমন না। টুকটাক যখন কিছু মনে হতো, তখন সাবকনসাস বুদ্ধি দিত - দ্যাখ কত কনসার্নড্, কত ভালোবাসে! ফলে সমস্যাটাকে ভালোবাসার চোখে উপেক্ষা করেছি।
-এখন কি তবে ভালোবাসার টান পড়েছে? যার জন্য টিনার সন্দেহ বেড়েছে?
-সমীর তুই বল রোজ কাঁহাতক এসব ভালোলাগে? একটা মহিলার ফোন এলেই হলো! যদি কোনও কোম্পানির কলও হয়, তাহলেও উপায় নেই। তাছাড়া আজকাল বিভিন্ন মেল আসে - ‘নিধি সিনিয়র ম্যানেজার অমুক ব্যাঙ্ক উইশেস ইউ’...বা এই জাতীয়...
-ও তো এম.এ পাশ মেয়ে! বোঝে না, এগুলো ফ্রড মেল? বা বানিজ্যিক?
-বুঝলে কি আর এমন হতো? বোঝাবুঝির ঢাকনা সব বন্ধ হয়ে গেছে। বুঝলি সমীর, আমি আগে ভাবতাম বা বিশ্বাসও করতাম, ভালোবাসা অন্ধ! যেখানে কোনও বিনিময় আছে, সেসব ভালোবাসা নয় ইত্যাদি। কিন্তু এখন মনে হয়, ভালোবাসার দিব্যি চোখ কান আছে। তারা দিব্যি দেখে, দিব্যি শোনে! একজন দিনের পর দিন ব্লেইম দিয়ে যাবে, তাও অকারণে-কতদিন সহ্য করব? দেখ না, এই সব অশান্তির ভয়েই আমি কেমন দিনে দিনে আনসোশ্যাল হয়ে গেছি। জানি, তোরা আওয়াজ দিস, তবুও আমি ঠেকে যাইনা, ফোন করি না।
-তুই প্রথম থেকেই বাড়তে দিয়েছিস।বলছিসই যখন অকারণ, সহ্য করেছিস কেন?
-কী করব? গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিতে গেছিলো। সবসময় তো বাবা-বাছা করে রেখেছি, যাতে পরিবারে শান্তি থাকে।
-এভাবে কি শান্তি রাখা যায় সৌরীন? এটা হল সাময়িক শান্তি। আর এর চক্করে পড়লে দেখবি একদিন এত অশান্তি পুঞ্জীভূত হতে থাকবে তলে তলে, সেদিন আর তল পাবি না।
-এখন তো সেই অবস্থা হয়েছে রে! এর জন্য একটা চাকরী গেল। ভাবতে পারিস?
-টিনা তো বুঝে গেছে ওর মোক্ষম অস্ত্র। তুই বেশী কিছু ওর অপছন্দের কাজ করলে এই কোম্পানিতেও আগের মতো নালিশ করতে পারে।
-কিন্তু সমীর এতে ওর সাইকোলজিটা কী হতে পারে? বরের চাকরী গেলে তো নিজেও খেতে পাবে না।
-ওরকমটা ও ভাবছে না। তুই যদি বহুদিন বেকার বসে থাকতিস বা ঘরে টানাটানি পড়তো, তবে এমনটা ভাবতো। তোর কোয়ালিটি আছে, এই ফিল্ডে যোগাযোগও ভালো। ও জানে, তুই কিছু না কিছু ম্যানেজ করে নিবি। ও না খেতে পেয়ে মরবে না।
-তাহলে ও কোম্পানিতে এসব সিন ক্রিয়েট করছে কেন?
-সিম্পলি তোকে হ্যাকেল করা। কোনওভাবে তোকে যদি হিউমিলিয়েট করা যায়।
-মানুষ কেন এমন করে সমীর? মানুষ সন্দেহ করে কেন? অধিকার বোধ থেকেই না! অধিকার ভালোবাসা থেকেই তো আসে। তাই নয় কি?
-দ্যাখ সৌরীন, অধিকার বোধটা সবসময় ভালোবাসা থেকে আসে এমন নয়। ভালোবাসায় গ্যাটিস আছে অথচ অধিকার বোধ টনটনে, এমন আমি প্রচুর দেখেছি। ভালোবাসা ছাড়াও অনেক ফ্যাক্টর আছে, যাতে মানুষের এমন দাবী তৈরী হয়। যেমন মনে কর - অনেক সন্তান বাবা মাকে ভালোবাসে না, কিন্তু তার সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার বোধ দেখায়।
-সম্পত্তির ব্যাপারটা আলাদা। মানুষের প্রতি অধিকার বোধের জন্ম ভালোবাসা ছাড়া হয় কী করে?
-ধর তুই বাবা-মার একমাত্র সন্তান, একবাড়ীতেই থাকিস, অথচ বাবা-মাকে দেখিস না। আমি যদি উপযাচক হয়ে তোর বাড়ী গিয়ে তাঁদের খোঁজখবর নিই, ওঁদের ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাই, তাঁরা খুশী হয়ে আমাকে একটা দামী ঘড়ি উপহার দেন, তুই কেমন চোখে দেখবি? তুই মানে আমি তোকে মিন করছি না। সাধারণ মানুষের অমনি মনে হবে, বুড়োবুড়ির আবার বেশী আদিখ্যেতা! নিজের ছেলে থাকতে, পরকে গিফ্ট? এটা অধিকার বোধ ছাড়া আর কি? বাবা-মার সবকিছু আমার। স্নেহের ক্ষেত্রেও তেমনই। থাক বা না থাক, জবরদস্তি দেখানোর নামই অধিকার।
-এ না হয় জন্মসূত্রে পাওয়া। টিনার এত অধিকার বোধের কী কারণ হতে পারে?
-আরে বর-বউ এর সম্পর্কে তো সবথেকে বেশি অধিকার বোধ। মন্ত্র পড়ে যখন বিয়ে হয়েছে, এই মানুষটার সবকিছু আমার। ওর দেহ-মন, নিশ্বাস-প্রশ্বাস সব আমার নিয়ন্ত্রনে থাকবে। ওর সাথে ওর বাবা-মা-ভাই-বোন সবার সম্পর্ক আমি ঠিক করবো। ও কী খাবে, কার সাথে বন্ধুত্ব করবে, এমন কি ক’বার পটি-হিসি করতে যাবে, তাও আমার হিসেব মতো হওয়া চাই। বহু বাড়ীতে, বউকে তার বান্ধবীর সাথে সিনেমা দেখতে যেতে হলেও বরের পারমিশন নিতে হয়। সেক্ষেত্রেও এই অধিকার বোধ!
-সমীর, সাড়ে চারটে বেজে গেল। পাঁচটা সওয়া পাঁচটায় না বেরোতে পারলে বাড়ী গিয়ে আর এক অশান্তি। এসব তত্ত্বকথা পরে আলোচনা করব। তুই বরং বল, আমি এখন কী করব?
-দ্যাখ এখন তোর যা অবস্থা, ডিভোর্সই একমাত্র সলিউশন। কেন না এ শোধরাবার নয়। বেষ্ট হচ্ছে একজন ল-ইয়ার কনসাল্ট করা।
-বারিদের কাছে যাবো?
-আমার মনে হয় ওর কাছে না যাওয়াই ভালো। বন্ধুর কেস। পয়সা পাবে না ভেবে প্রফেসনালি ডিল করবে না। আমার এক কলিগের ডিভোর্স হয়েছে রিসেন্টলি। ওর থেকে বরং ওর উকিলের ফোন নম্বর নিয়ে অ্যাপয়েনমেন্ট নিই। দেখা যাক কী বলে।
-বেশ তো। একটা ডেট ফিক্স কর। কিছু একটা ম্যানেজ করে যেতে হবে। চল, আজ উঠি।
সমীর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সন্দেহটা বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস রে সৌরীন। মানুষের স্বাভাবিক বোধ, বুদ্ধি, যুক্তি, বিচার কিছুই কাজ করে না। এ হল মনের ব্যামো। আর মনকে কন্ট্রোল করা সাধারন মানুষের ক্ষমতার বাইরে।
দিন চারেকের মধ্যেই উকিলের অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়া গেল। অফিস কলিগের জন্মদিন পার্টি, এই অজুহাত দিয়ে সৌরীন সমীরণকে নিয়ে যথাসময়ে পৌঁছালো। ভদ্রলোকের কন্সাল্টেশন ফীস সাত হাজার টাকা। আজকাল টাকার মূল্য কোথায় দাঁড়িয়েছে! কেস লড়লে না জানি কতটাকার ধাক্কা, কে জানে! যাইহোক ভদ্রলোক সব শুনে টুনে বললেন - ‘কোনও ডাক্তার দেখিয়েছেন? সাইকিয়াট্রিস্ট?’
-না। দেখাতে নিয়ে যাবো কী বলে? তখন আবার অন্য অশান্তি।
-কোর্টে আপনি তবে কিসের এগেনস্টে ডিভোর্স চাইবেন সৌরীন বাবু? যদি একে মানসিক রোগী প্রমাণ করতে পারেন, তবেই আপনার ফেভারে রায় মিলবে।
-কিন্তু ডাক্তারি সার্টিফিকেট যোগাড় করব কোত্থেকে?
-সে তো বলতে পারবো না! এখন মেন্টাল-হেল্থ আইন খুব কড়া। আগে শ্বশুরবাড়ীর লোকজন জোর-জবরদস্তি করে বউকে মেন্টাল নার্সিংহোমে ভর্ত্তি-টর্তি করিয়ে কাগজ পত্র দাখিল করতো। আজকাল সেসব করা মুশকিল; আর আপনাকে দেখে যা মনে হচ্ছে, আপনি ওসব পারবেনও না।
-তাহলে উপায়?
-দেখুন ভারতবর্ষের আইন এক্ষেত্রে মেয়েদের দিকেই অনেকখানি ঝুঁকে। আপনি মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে ধোপে টেকাতে পারবেন না। আমাদের আইনে পুরুষ নির্যাতন করতে পারে – এটা যত সহজে সিদ্ধ করা যায়, সে নিজে ততোধিক নিপীড়িত হতে পারে – এটা প্রমাণ করানো যায় না।আপনি চাইলে কেস ফাইল করতে পারি, তবে এ কেস আপনি জিততে পারবেন না।
-কিন্তু আমার বিষয়টাতো জেনুইন। সত্যেরই তো জয় হওয়া উচিৎ।
উকিলবাবু হাসলেন। বললেন, ‘আল্টিমেট সত্যের জয় হয় কিনা জানিনা সৌরীনবাবু, তবে কেস জিততে গেলে এভিডেন্স দরকার। এক্ষেত্রে সেটা কোনও ডাক্তারের দেওয়া সার্টিফিকেট হতে হবে। নইলে এটা প্রমাণ করতে হবে আপনার স্ত্রী দুশ্চরিত্র।‘
-আমার স্ত্রী তো আমাকে দুশ্চরিত্র ভাবছেন - সেই অ্যাঙ্গেল থেকে ব্যাপারটা লড়া যায় না?
-তিনি আপনাকে দুশ্চরিত্র ভাবছেন ঠিক, কিন্তু তিনি এই কারণে ডিভোর্সের মামলা ঠুকছেন না। এবং আমার বিশ্বাস, তিনি কোনওভাবেই মনেপ্রাণে আপনাকে ডিভোর্স দিতে চাইবেন না।
-আমি বলতে চাইছি, ধরুন আমি কেস ফাইল করলাম, তখন আমার স্ত্রী তো কোর্টে বলবেন - তিনি আমাকে অমুক তমুকের সাথে সম্পর্কে জড়িত বলে সন্দেহ করেন! তাতেই তো আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে!
-আপনি সিনেমা সিরিয়াল দেখেন না?
-হ্যাঁ। তার সাথে এর কী সম্পর্ক?
-ওখানে দেখেন না, উকিলরা মক্কেলদের বক্তব্য তৈরী করে দেয়? এখানে যেমন আমি আপনার হয়ে লড়ছি, কেউ না কেউ তো ওনার হয়েও লড়বেন! তিনি যদি শিখিয়ে দেন আর আপনার স্ত্রী বলেন, ‘না তো! আমি তো এমন সন্দেহ করিনা! আমার স্বামীরই মতলব খারাপ’। তখন আপনি উল্টো কেস খাবেন। আর তাছাড়া অভিযোগ করলেই তো হলো না, তার সাপোর্টে এভিডেন্স দেখাতে হবে।
-তাহলে উপায়?
-একমাত্র উপায় যদি আপনি কোনও ফটো-টটো দেখিয়ে এটা প্রমাণ করতে পারেন যে আপনার স্ত্রীর চরিত্র ঠিক নয়।
-এ অসম্ভব। ও ষোলআনাই আমার প্রতি বিশ্বস্ত।
-আপনি কী করে জানলেন? সকাল থেকে মাঝ-সন্ধ্যা পর্যন্ত আপনি ঘরের বাইরে থাকেন। সেইসময় তিনি কী করছেন না করছেন, আপনার পক্ষে কী বোঝা সম্ভব?
-ও ঠিক বোঝা যায়।
-তাহলে সৌরীনবাবু আপনিই বা নিজেকে ধোওয়া তুলসী পাতা ভাবছেন কেন? আপনার স্ত্রীও হয়ত-এরকম আপনার বিষয়ে কিছু বুঝতে পারছেন! আফটার অল, স্ত্রী তো!
শালা! একেই বলে উকিলের প্যাঁচ! কোনওক্রমে ঢোক গিলল সৌরীন। নিজের কথার ফাঁদে এভাবে পড়ে যাবে ভাবেনি সে। কোনওক্রমে নিজের সপক্ষে বলল, ‘আমি তো নিজেকে সবচেয়ে ভালো চিনি উকিলবাবু! আমি জানি, আমি একটু এক্সট্রোভার্ট, সামাজিক! আমি মানুষের সাথে রাস্তা ঘাটে দেখা হলে কথাবার্তা বলি, হাসি। প্রতিবেশীদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে চাই। আমার স্ত্রী যাঁর সাথে আমাকে সন্দেহ করছেন আপাতত, তিনি আমাদের থেকে কয়েকটা বাড়ী পরে থাকেন। রাস্তাঘাটে হাই-হ্যালোর বেশী কিছু করি না। ইদানীং তো পারতপক্ষে ওইটুকু রাস্তা ছাতার আড়াল করে চলে যাই। ‘আমার স্ত্রী সন্দেহ করেন, তুমি বাইরে এসময়ে এসো না’ – এমন কথা বলার মতো গোপন সময়ও আমি ওনার সঙ্গে কাটাই না। আমি কী করব তবে?
-শুনুন সৌরীনবাবু, আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। তবে কিনা, এ জীবনে এরকম কেস তো কম লড়লাম না! এরকম একটা ঘটনা বলছি আপনাদের। আমি আগে কসবার ওদিকটায় থাকতাম। আমাদের পৈতৃক বাড়ী ছিল ওখানে। আমাদেরই পাড়ার এক ভদ্রলোক, বেশ সজ্জন, বিবাহোত্তর সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলেন। ওঁদের কোনও সন্তানাদি ছিল না। বছর পাঁচেক পরে, ঠিক আপনারই মতো, এক যুবতীকে ঘিরে ওনার স্ত্রীর সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। ঐ যুবতীটি ওনাদের বাড়ী থেকে পাঁচ-ছটা বাড়ীর পরেই থাকতেন। আপনার মতোই রাস্তা-ঘাটে টুকটাক দেখা হওয়া ছাড়া মেলামেশার কোনও সুযোগ ছিল না। ওই যুবতীটিও ভদ্রবাড়ীর সন্তান। আমি দুজনকেই ভালো মত চিনতাম। হঠাৎ একদিন ভদ্রলোক মানে বিমলবাবু আমার চেম্বারে এলেন। তিনি তাঁর স্ত্রী রমার বিরুদ্ধে ডিভোর্স ফাইল করতে চান, কেন না, সন্দেহে সন্দেহে তিনি জেরবার। আপনার মতো তাঁর চাকরী যায়নি বটে, তবে তাঁর অফিসেও রমাদেবী হাঙ্গামা করেছিলেন। রমাদেবী আপনার স্ত্রীর মতো এতখানি টেঁটিয়া ছিলেন না বলে তাঁকে দু-একবার ডাক্তার দেখানো গেছিল। একবার স্লিপিং পিলস খেয়ে নিয়েছিলেন বলে নার্সিংহোমেও ভর্ত্তি করাতে হয়েছিল। যাইহোক, এভিডেন্স ছিল, কেস ফাইল হতে বিমলবাবু জিতেও গেলেন। অল্প কিছু খোরপোস দিয়ে ব্যাপারটার ফয়সালা হয়ে গেল। আমি বিষয়টা আস্তে আস্তে ভুলেও গেলাম একসময়। প্রায় বছর সাতেক পরে আমি একদিন শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে যাই কোনও কাজে। হঠাৎ দেখি বিলমবাবু ওই যুবতী মহিলার সাথে ওখানে কোথাও যাবার জন্য ট্রেন ধরতে এসেছেন। আমি কসবা ছেড়ে এখানে চলে এসেছি বলে ওনাদের খোঁজ খবরও বহুদিন রাখতাম না। আমাকে দেখে মহিলাটি ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দিলেন। ওঁর হাতে ধরা এক বছর চারেকের ছেলে। বিমলবাবু বললেন, সংসারটা একেবারেই চলছিল না। তাই মুনমুনকেই বিয়েটা করে ফেললাম। ওইটি আমার পুত্র, সত্যঋক।
সৌরীন বুঝল, উকিলবাবু কী বলতে চাইছেন। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বুঝে বলল, ‘তবে আপনি আমাকে কী পরামর্শ দেন?’
-এই কেস লড়লে আপনার জিৎ হবে না। অহেতুক লোক হাসানো আর টাকা খরচ হবে। কোনও এভিডেন্স যদি জোগাড় করতে পারেন, তবেই আমার সাথে বা অন্য কোনও উকিলের সাথে পরামর্শ করবেন। গুড নাইট।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে সমীর বলল, ‘অতঃপর?’
-আমার কিছু মাথায় ঢুকছে না রে সমীর! আমাদের মতো মানুষদের জন্য কোনও দরজা খোলা নেই?
-উকিলবাবুর কথায় তো তাই মনে হলো রে! উল্টে বিমলবাবুর গল্প শুনিয়ে যা বোঝালেন, তাতে তো তোর দিকে প্রচ্ছন্ন একটা ইঙ্গিত রয়েই গেল।
-তুই আবার তাই ভাবছিস না তো রে সমীর?
-কিন্তু টিনা কোন মেয়েটাকে সন্দেহ করছে রে? দেবলের বোন?
-হ্যাঁ।
-কী যেন নাম ছিল ওর?
-রিয়া। ভালো নাম মৌপর্ণা। দেবল যখন এদেশে থাকতো, তখন ওদের বাড়ীটিতেই তো ঠেক্টা হতো। তুই বল, রিয়া এমন মেয়ে?
-এতে এমন অমন কিছু নেই সৌরীন। মানুষ তো! কখন কার মনে কার প্রতি অনুরাগ জন্মায় বলা যায় না। বাই দা বাই, রিয়াকে সন্দেহ করার কী কারণ ঘটল? রিসেন্টলি কি তুই ওর সাথে কোনওকিছু নিয়ে মাখামাখি করেছিলি?
-মনে তো পড়ে না। ফোনটোন হয় না। তবে মাঝে মাঝে হোয়াটস অ্যাপ চালাচালি হত আগে। বিজয়া, পয়লা বৈশাখ ছাড়াও আজকাল যে ধরনের ফরোয়ার্ড মেসেজের ঠেলাঠেলি হয়, সে সব হত। ইদানীং আমি একদম করিনা। রিয়াও বোধ হয় বুঝে গেছে। আজকাল বিজয়া, পয়লা বৈশাখ ছাড়া কিছু করে না।
-টিনা কি তোর ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে?
-হ্যাঁ।
-অ্যালাউ করিস কেন?
-না করলে তো আরও অশান্তি! ‘তোমার এমন কী গোপন বিষয় আছে মোবাইলে, যা তোমার স্ত্রী জানতে পারে না?’
-বিয়ের পর থেকেই এসব বিষয়ে রিজিড হওয়া উচিৎ ছিল তোর। এটা একটা পার্সোনাল জোন। এটা শিক্ষিত মাত্রেরই বোঝা উচিৎ।
-দ্যাখ সমীর, বিয়ের পর আমি নিজেও এ ব্যাপারে উদার ছিলাম। আমার নিজেরও মনে হত, সত্যি তো আমার কীই বা গোপন বিষয় আছে, যার ভাগ স্ত্রী পেতে পারে না? দোষ তো আমার আছেই।
-এখন আর একটাই উপায় আছে তোর। চল একবার সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করি।
-পেশেন্ট না নিয়ে গেলে কোন্ ডাক্তার অ্যালাউ করবে?
-চেনা কারুর কাছে যেতে হবে।
-আমার তো কোনও সাইকিয়াট্রিস্ট চেনা নেই, সমীর।
-আমার বউ এর পিসতুতো দাদা সাইকিয়াট্রিস্ট। তুই চাইলে যাওয়া যেতে পারে।
-কিন্তু সুমনা জেনে যাবে তো!
-ব্যাটা, আমি জানলে আমার বউ জানবে না? এই না ডিভোর্সের কথা ভাবছিলি? তখন তো সবাই জানবে!
-খারাপ লাগে রে! সবাই তো চাটনিটাই বিশ্বাস করে। সত্যি-মিথ্যা যাচাই করতে যায় কে?
-কবে নাগাদ অ্যাপয়েনমেন্ট করবো বল?
-তোর যবে খুশী।
(৩)
ডাঃ মানব চক্রবর্তী বেশ ‘মাইডিয়ার’ টাইপের লোক। উনি সমীরণ, সৌরীনেরই বয়সী। রাসবিহারীর মোড়ে ওনার একটা বেশ বড় চেম্বার। রাত সাড়ে আটটায় সব রোগী দেখার পরই সময় দিয়েছেন তিনি। সৌরীনের জন্য টাইমটা যথেষ্ট বিপজ্জনক, তবু ‘সন্ধ্যায় মিটিং আছে, ফিরতে রাত হবে’-এই ভুজুংভাজুং দিয়েই আজকের রিস্কটা নিয়েছে সে। ডাঃ চক্রবর্তী সব শুনলেন মন দিয়ে। তারপর বললেন – আপনার স্ত্রী কি মনে মনে বিড়বিড় করেন?
-না।
-শুচিবায়ুগ্রস্ত?
-না।
-উনি কি এমন ভাবেন যে কেউ ওঁকে ষড়যন্ত্রে ফাঁসাতে চাইছে, বা কেউ খুন করতে চাইছে?
-এমন কোনও কিছু আমি কখনও শুনিনি ডাক্তারবাবু!
-অবিশ্বাস্য কোনও কথা বিশ্বাস করেন? যেমন ‘আমার সাথে মুখ্যমন্ত্রীর পরিচয় আছে’,‘আমি বিরাট ক্ষমতাবান’,‘আমি কমিশনারকে বলে তোমায় জেল খাটাবো’ – এই জাতীয়?
-ডাক্তারবাবু উনি এধরনের কথা বলেন না বটে, তবে আমাকে নিয়ে যা সন্দেহ করেন, সেটাও তো অবিশ্বাস্যই।
-আপনি মনে করছেন, ওটা ঠিক নয়। কিন্তু অন্যের কাছে অবিশ্বাস্য, এমনটা ভাবছেন কেন? কী বল হে সমীর?
-হ্যাঁ মানবদা। যারা সৌরীনকে চেনে না, তারা তো মনে করতেই পারে এরকম একটা অবৈধ সম্পর্ক ওর রয়েছে।
সৌরীন বলল, ‘আমার কী করনীয় ডাক্তারবাবু? উকিলের কাছে গেছিলাম, উনি বলছেন, ডাক্তারের সার্টিফিকেট না হলে কেস লড়া যাবে না। আর আমার স্ত্রীকে ডাক্তার দেখানোর কথা বললে বাড়ীতে দক্ষযজ্ঞ হয়ে যাবে। কী যে করি!
-এটা একটা বড় সমস্যা সৌরীনবাবু। কিন্তু আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই। আমি একটা ওষুধ লিখে দিতে পারি। কিন্তু খাওয়াবেন কী করে? হাজব্যান্ডের এমন সমস্যা হলে বউ এটা ওটায় মিশিয়ে খাওয়াতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু করার নেই।
-এটা কি কোনও রোগ ডাক্তারবাবু?
-হ্যাঁ, এটা একটা ডিলিউশনাল ডিসঅর্ডার। জেলাসি টাইপ।
-জেলাসি?
-হ্যাঁ। আগে একে ওথেলো-সিনড্রোম বলা হত।
-ওথেলো মানে সেকস্পীয়রের ওথেলো-ডেসডিমোনা?
-হ্যাঁ। সপ্তপদীতে উত্তম-সুচিত্রার ওই সিনটা মনে আছে? উৎপল দত্ত আর নেলি সেনগুপ্তার সেই অসামান্য ডায়লগ? ওখানে দেখুন, ওথেলো তার স্ত্রী ডেসডিমোনাকে প্রাণের চাইতেও বেশী ভালোবাসত। কিন্তু সন্দেহ বড় মারাত্মক জিনিস! একদিন মনে হল, ডেসডিমোনা পর-পুরুষে আসক্ত। শেষ-মেষ তাকে গলা টিপে হত্যা করল ওথেলো। সেখান থেকেই এই রোগের নাম হয়েছে ওথেলো-সিনড্রোম।
-কিন্তু মানবদা, এখন একদল গবেষক বলছে ওথেলো সত্যি সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন। সমীরণ বলল।
-সেটা অন্য ইস্যু। আসলে সেকস্পীয়ারের নাটকটাই তো জনমানসে সাড়া ফেলেছিল! যে চিকিৎসক এই নামকরণটা করেছিলেন, তিনি বোধ হয় এই নাটক দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিলেন।
-এই রোগ কেন হয় ডাক্তারবাবু?
-বলা বড় মুশকিল। অনেকসময় বিভিন্ন রোগ থেকেও হয়, আবার শুধু মনের বৈষম্য থেকেও হয়।
-ডাক্তারবাবু এটা কি শুধু মেয়েদের হয়?
-না,না। ছেলেদেরও হয়। এখুনি ওথেলোর গল্প বললাম তো। ইতিহাসে, পুরাণে এরকম ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। এই তো আজকেই একটা পেশেন্ট এসেছিলেন আমার কাছে। ভদ্রলোকের আসল নাম মনে নেই। বলার সুবিধার জন্য ধরে নাও রামবাবু। বয়স এই বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশের মতো। ওর স্ত্রী নিয়ে এসেছিলেন আজ। ভদ্রলোকের সমস্যা সেই একই। ভয়ঙ্কর রকমের সন্দেহ। আগে মুখে মুখে চলতো। অভিমান, তার থেকে ক্রোধ, এখন বাড়তে বাড়তে মারধোর, জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি। দেখলাম ওর মিসেসের কপালটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে ফাটিয়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক।
-তা ভদ্রমহিলা সহ্য করছেন কেন? পুলিশে রিপোর্ট করতে পারতেন? ডিভোর্স পেতে সুবিধা হত। সৌরীন খুব উত্তেজনা নিয়ে বলল।
-ডিভোর্স করলেই কী সব সমাধান হয় সৌরীনবাবু? এখন আপনি শুধু এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন বলে সব ডোমেস্টিক প্রব্লেমের একটাই সলিউশন ভাবছেন!
-স্যরি ডাক্তারবাবু। আপনি বলুন।
-আসলে রামবাবুর পরিবার বলতে তো শুধু রামবাবু আর তাঁর স্ত্রী নন। ওঁদের দুটো বাচ্চা আছে। বড়টা মেয়ে, ক্লাশ এলেভেনে পড়ে। ছোটটা ছেলে, ক্লাশ নাইন। বৃদ্ধা শাশুড়ি আছেন। কুড়ি একুশ বছরের সংসার। ডিভোর্স কি এত সহজে পাওয়া যায়?
-তা রামবাবু আসতে রাজী হলেন কেন? ওঁর বউ ওনাকে রাজী করালেন কী করে? সৌরীনের কন্ঠে তীব্র কৌতুহল ঝড়ে পড়ল।
-ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। বছর খানেক আগে রামবাবুর সিভিয়ার সি.ভি.এ হয়।
-সি.ভি.এ মানে কী? সমীরণ জিজ্ঞাসা করল।
-সেরিব্রো ভাস্কুলার অ্যাক্সিডেন্ট। মানে, চলতি কথায় স্ট্রোক। ভদ্রলোক খুব ব্যাডলি অ্যাফেক্টেড হন। বামদিকটা পুরো প্যারালাইসিস হয়ে যায়। দীর্ঘদিন যমে মানুষে টানাটানি চলে। ওনার বাল্যবন্ধু, ধরে নিন ওঁর নাম শ্যামবাবু, এইসময় জান-প্রাণ দিয়ে ওঁদের পাশে এসে দাঁড়ান। দীর্ঘদিন হাসপাতাল ভোগ করে ধীরে ধীরে ফিজিওথেরাপি করতে করতে এখন কন্ডিশন অনেক স্টেবল। সমস্যাটা শুরু হল মাস ছয়েক আগে। নিজের শারীরিক অক্ষমতার কারনে ওঁর সাথে ওনার স্ত্রীর কোনও ফিজিক্যাল রিলেশন বন্ধ আছে দীর্ঘদিন। সেই সি.ভি.এ হওয়ার পর থেকেই। রামবাবুর বউ এর বয়স পঁয়এিশ-ছএিশ। দেখতে শুনতেও বেশ । রামবাবুর হঠাৎ মনে হতে লাগল, ওঁর বউএর সাথে বন্ধু শ্যামের একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে। হিষ্ট্রি নিয়ে দেখেছি, শ্যামবাবু ছোটোবেলা থেকই রামবাবুর বাড়ীতে নিয়ম করে আসেন, ওনাদের আপদে বিপদে পাশে দাঁড়ান। রামবাবুর স্ত্রীর সাথেও শ্যামবাবুর প্রীতি মধুর সম্পর্ক – সেটা রামবাবুর জ্ঞাতসারেই। একসাথে আড্ডা দেওয়া, সিনেমা যাওয়া - সবই চলত। ইদানীং হাসপাতালে ভর্ত্তির কারণে হয়তো বা শ্যামবাবুর প্রতি রামবাবুর স্ত্রীর নির্ভরতা বেড়ে থাকলেও থাকতে পারে । যাইহোক, রামবাবু ইদানীং ব্যাপারটা একেবারেই নিতে পারেন না। অসুস্থতার জন্য হুইলচেয়ার বা খাটে বসে তিনি যখন টিভি দেখেন – হয়তো তাঁর স্ত্রী শ্যামবাবুকে কিছু একটা বাজার করে আনার জন্য ফরমাস করলেন আর রামবাবু ভাবলেন, শ্যাম কিসের টানে এখানে বেগার খাটে। প্রথম প্রথম ঠোঁট ফুলতো। একদিন ক্ষোভ মুখে প্রকাশ করলেন। ধীরে ধীরে হ্যালুসিনেশন হতে লাগল।
- মানে? সমীরণ এবং সৌরীন দুজনেরই চোখে-মুখে কৌতুহল।
- রামবাবু বিশ্বাস করতে লাগলেন তাঁর স্ত্রীর সাথে শ্যামবাবুর ফিজিক্যাল রিলেশন আছে। শুধু তাই নয়, তিনি নাকি চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁদের গোপন ফিসফিসানি তাঁর কর্ণগোচর হয়েছে ইত্যাদি। ওনার স্ত্রী যখন অস্বীকার করেন, তখন রামবাবুর ক্রোধ বাড়ে। একদিন স্ত্রী দু-একটা কথা মুখের উপরে বলে দিতে পেপারওয়েট ছুঁড়ে মেরে দিলেন মাথায়। রামবাবুকে যে ডাক্তার দেখতো সে আমার বন্ধু, ডাঃ পরিমল মাইতি। ওকে যখন লাস্ট ভিজিট করতে গেছিলো, তখন ও আমার কাছে রামবাবুকে রেফার করে। নইলে অত সহজে এখানে আসতে রাজী হতো না।
সমীর জিজ্ঞাসা করল, ‘মানবদা, তুমি কী সাজেশন দিলে?’
- দ্যাখো সমীর, এই যে ডিলিউশন হচ্ছে ওর, এটা সিমপ্লি প্যারালাইসিস রোগটার কারণে। ব্রেনের মধ্যে ওর এমন একটা জায়গায় ইনজুরি হয়েছে সেই জায়গাটাই সন্দেহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ডিল করে। অতএব ওটা ঠিক না হলে এই সন্দেহ যাবে না। রামবাবুর মিসেসকে ব্যাপারটা বোঝালাম। এটা নিছক সন্দেহ নয়, এমনটা ওকে রোগে করাচ্ছে। উনি বিষয়টা বুঝলেন।
সৌরিন বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমার স্ত্রীরও কি ব্রেনে এমন কোনও ইনজুরি আছে?
- সে বলা যায় না সৌরিনবাবু। এখনও বিজ্ঞান ততখানি উন্নত হয়নি যে কোনও ডায়গনস্টিক মেথডে আবিস্কার করে ফেলবেন ব্রেনের ঐ এরিয়ায় কী রকম সমস্যা। অন্য কোনও রোগের কারণে সন্দেহবাতিক হলে সেই সেই রোগের লক্ষণ পাওয়া যাবে। শুধুমাত্র সন্দেহ করা ছাড়া যেখানে অন্য কোনও রোগের লক্ষণ নেই, তাকেই ওথেলো সিন্ড্রোম বলে।
- আচ্ছা ডাক্তারবাবু, এটা কি মানসিক রোগই। বদমাইশি হতে পারে না?
- হতে পারে না – এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়না সৌরিনবাবু। দুষ্টুলোকের দুষ্টুমির ছলের অভাব হয়না। তবে আমার মনে হয় আপনার স্ত্রী বদমায়েশি করার জন্য এটা করছেন না। উনি সন্দেহ করছেন, জেনুইন আপনি এমনটা করেছেন ভেবেই।
- বুঝলাম না ডাক্তারবাবু ।
- মানে বলতে চাইছি – উনি এইসব বলে টলে যে আনন্দ পাচ্ছেন তা নয়। উনি রীতিমত বিশ্বাসভঙ্গের কষ্ট পাচ্ছেন আপনার থেকে। না হলে কেউ দেয়ালে মাথা ঠুকে নিজের কপালে এত বড় সোয়েলিং করতে পারতেন না।
হঠাৎ করে সৌরিনের মনটা নরম হয় গেল। তার মনে পড়ল বছর দশেক আগে দেখা টিনার মুখটা। সরল, ফর্সা, দুদিকে দুটো বিনুনি বানানো উজ্জ্বল কালো চোখের মেয়েটি। একটা পাতিয়ালা সালোয়ার স্যুটে যেদিন প্রথম দেখেছিল ওকে, তখনই ওর মনের মধ্যে কেউ বলে উঠেছিল ‘সৌরিন, এই সেই মেয়েটি’। এম-এ পাশ, বাবা-মায়ের এক সন্তান। হয়তো আদরের সন্তান, এই ভেবেই ওর ছোটখাটো অসংলগ্নতাকে আর গা করেনি সৌরিন। সেই মেয়ে আজ ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে ভেবে ওর মনটা হা-হুতাশ করে উঠলো। কোনও রকমে ডাক্তারবাবুর থেকে বেরিয়ে ও ভাবলো, আজ টিনাকে খুব করে আদর করবে সে, যতটা পারবে ওর কষ্ট গুলো শুষে নেবে আজ। ঈশ্বরকে প্রার্থনা করলো, যাতে টিনা এত দেরী হওয়া নিয়ে কোনও হুজ্জোতি না করে।
রাতে যখন সৌরিন বাড়ি ফিরল, তখন রাত দশটা। টিনা সে সময় রান্নার কিছু বাসন ধুয়ে রাখছিল বেসিনে। সৌরিন এসে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। টিনা একটু হেসে বলল, কী ব্যাপার? আজ এত আদরের ঘনঘটা?’
- কেন, করি না কি?
-তা করো। তবে এটা কি ঘুষ নাকি?
- কিসের?
- দেরী করে আসার!
- আজকাল বড় পেঁচিয়ে কথা বল টিনা। আগে তো তুমি এমনটা ছিলে না?
- ফ্রেশ হয়ে নাও। খাবার রেডি করছি।
সৌরিন জামাকাপড় গুলো ওয়াশিং মেশিনের উপর রেখে বাথরুমে গেল। একটু বাদে চেনা চেনা চিৎকার কানে এলো তার। ‘লম্পট, দুশ্চরিত্র! এজন্যই এত জড়াজড়ি!’ সৌরিন মুখ বাড়িয়ে দেখল ওয়াশিং মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে টিনা একমনে চিৎকার করে যাচ্ছে।
হঠাৎ ভয় নিয়ে সৌরিন জিজ্ঞাসা করল, ‘আবার কী হল’?
- কী হল! নিজে জানো না? দেখাচ্ছি আজ পেত্নীটাকে। এখুনি গিয়ে ওর বাপ-মাকে বলছি।
- আরে কী হয়েছে, বলবে তো?
- দেখতে পাচ্ছো না? দ্যাখো! দ্যাখো!
সৌরিন দেখল ওর জামার বামহাতের নিচের দিকে একটা সিঁদুরের দাগ লেগে আছে। টিনা রোজ রাতে শোওয়ার আগে ওয়াশিং মেশিনটা চালিয়ে রাখে। আজও সেইজন্য জামাকাপড়ের কলার-টলারগুলোয় সাবান লাগাতে গিয়ে ও এই দাগ আবিস্কার করেছে। সৌরিন সমানে বোঝানোর চেষ্টা করল, বাসে ওর পাশে হয়তো কোনও মহিলা দাঁড়িয়েছিল – ওখান থেকে লেগে গিয়ে থাকবে; কিন্তু কে শোনে কার কথা! টিনা একটা হাউসকোট জড়িয়ে ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সৌরিন একটা হ্যাঁচকা টান মেরে বলল, ‘যাচ্ছো কোথায়?’
- পেত্নীর বাড়ি।
- ও কী করেছে?
- তুমি জানো না? লীলা-খেলা করার সময় মনে রাখোনি কী কী লীলা করেছ?
- মুখ সামলে কথা বলো টিনা। স্বাভাবিক বুদ্ধিটা লাগাও। রিয়া কি বিবাহিতা? ওর মাথায় সিঁদুর আসবে কোত্থেকে?
- তাহলে কি বিয়ে-টিয়ে করে ফিরলে নাকি? এত রাত হল কেন? লগ্ন কি রাতে ছিল?
- কী আবোল-তাবোল বকছ? আমার কিন্তু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
-তাহলে ঠিক কী করেছ, বলো। রিয়া যদি না হয়, তবে কি অফিসে আবার কাউকে জুটিয়েছ? রাতের বেলা ফাঁকা অফিসে, ছিঃ! ছিঃ! ভগবান! আগে একটা ছিল। এখন তো এ দেখছি একেবারে কৃষ্ণলীলা! মরণ হয় না তোর! ছিঃ!ছিঃ!, কুকুর বেড়ালেরও চরিত্র এর থেকে ভালো হয়। থুঃ!
হঠাৎ করে সৌরিন আবিষ্কার করলো, এতক্ষণ সীসার মতো যেসব কথা ওর কানে বাজছিল, কোনও অদৃশ্য কারণে সেসব আর ওর কানে ঢুকছে না। ও শুধু টিনার মুখ নাড়া আর অঙ্গভঙ্গি দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু কোনও কিছু শুনতে পাচ্ছে না। রাস্তায় আসতে আসতে যেসব আদর করার প্ল্যান ও ছকে এসেছিল, আপাতত তারা ভোকাট্টা হয়ে গেছে। এখন আর টিনাকে ভালবাসতেও ইচ্ছা করছে না তার। লাভ আ-ন-ক-ণ্ডি-শ-না-ল! টিনার মুখের দিকে শুধু ফ্যা্ল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে।
1 Comments
ReplyDeleteগল্পটা তরতর করে এগিয়েছে।
শেষটা বেশ ভালো!