জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা / সত্যজিৎ পড়্যা

গুচ্ছ কবিতা 
সত্যজিৎ পড়্যা


সম্ভোগ


কাষ্ঠবর্ণ নৈঃশব্দ্যের অন্তর্বর্তী গাত্রে
জেগে ওঠে সম্ভোগ পুংঙতির ধ্বনি —
নির্বাক ত্বকের উপান্তে ছড়ায়
ভগ্ন মায়ার ত্রিমাত্রিক রেণু।

আলোকহীন প্রজ্ঞার স্বাদে
জমে থাকে ঋজু আকাঙ্ক্ষার জৈব উপপাদ্য,
যেখানে প্রত্যেক উচ্ছ্বাসে বাজে
অন্তঃস্থ লোভের পরমাণু সংকেত।

আসক্তির স্নিগ্ধ তলদেশে
উল্টো মুখে ঝোলে নৈতিক জড়তা,
প্রেমহীন আবেগের অস্পষ্ট সমীকরণে
গলে যায় অলীক শরীরতত্ত্ব।

নির্দেশহীন স্পন্দনে
উন্মোচিত হয় প্রকৃতির যৌবনমদির ছায়া,
নির্মম স্বরে উচ্চারিত হয়
অর্ধেন্দু দেহের আদি লিপি।

চেতনার জড়ত্বে গেঁথে
জন্মায় ইন্দ্রিয়নির্ভর ভবিষ্যতের প্রতিমা —
যেখানে সম্ভোগ শুধু শরীর নয়,
এক নিঃশব্দ নন্দনতত্ত্বের প্রতিবাদী উল্লাস।



কলমের সত্তা

শব্দের অন্ধ গহ্বরে
কলম আঁকে নীরব পুংঙক্তি—
একটি আত্মার চূড়ান্ত টান
অন্ধকার অক্ষরের রক্তশিরায় প্রবাহিত।

স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তার নিকষকোণে
ঝুলে থাকে বিমর্ষ বাক্য-আত্মচিত্র,
যেখানে সত্তা খুঁজি ছিন্ন লিপির
প্রত্যয়হীন অলিন্দে।

কলম নয় কেবল বাহন,
সে তো অনির্বাণ বিদ্রোহের স্নায়বিক ক্যানভাস,
ভাষাহীন বোধের ক্রান্তিকালেই
সে বাঁধে প্রতিজ্ঞার দুর্বোধ্য স্তবক।

শিরায় শিরায় কালি ছড়িয়ে
জেগে ওঠে প্রতিস্বরের গোপন অনুরণন—
প্রতিটি বিন্দুতে স্ফুরিত হয়
জীর্ণ যুক্তির স্নিগ্ধ প্রতিস্পন্দ।

সৃষ্টির ক্ষণে, কলমের নিবে
নিভে আসে এক প্রান্তিক লিপিগত অনুশোচনা—
কাগজের স্তরে স্তরে জমে ওঠে
ব্যর্থতার পাণ্ডুলিপি, সত্তার স্তব।

তবু কলম থামে না,
সে ছিঁড়ে ফেলে অলীক নৈঃশব্দ্যের কঙ্কাল,
তার পুংঙক্তিতে লুকানো থাকে
সমস্ত মানবকথনের প্রাগৈতিহাসিক স্পর্শ।


🍂
ad


মোক্ষ

চেতনার গহীন ছিদ্রে
নিবদ্ধ আত্মা ছুঁয়ে যায় মোক্ষ পুংঙতির সীমানা—
যেখানে জাগতিকতা মিশে যায়
বর্ণহীন নির্বাণের পরম স্পন্দনে।

দেহাতীত বোধের মৌনতা ভেঙে
আর্তনাদে ফেটে পড়ে এক সর্বশেষ আর্তিপ্রবাহ,
অস্তিত্বের কাব্যরেখা খুঁজে ফেরে
অনুভবাতীত অদৃষ্টরেখার ধূসর মানচিত্রে।

প্রজ্ঞাহীন উল্লাসে
ভবনের সকল দ্বার হয়ে ওঠে অনর্থক,
বোধিসত্ত্ব কাঁপে
যথার্থ শূন্যতার অনুচ্চারিত স্তরে।

তপস্যার সুপ্ত কন্দরে
ঝরে পড়ে মননচ্যুত বাক্যের নিঃশেষ ধ্বনি,
যেখানে পরিণতি এক প্রকার
অস্তিত্বের চূড়ান্ত অনাস্বাদিত গর্ভস্ফুটন।

বেদবিহীন অনুভবের সংবেদনশূন্য রেখায়
মোক্ষ পুংঙতির একমাত্র ইঙ্গিত—
এক শূন্যসার দ্যুতিময় অন্তিম-আলোক
যা ভাষার অতীত, যুক্তির অপসারণ।

কিন্তু কবি জানে,
এই মুহূর্তে কলম থামে না—
তবু প্রতিটি অক্ষর নিঃশেষের দিকে ঝুঁকে পড়ে
যেন প্রত্যেক বাক্য এক প্রশান্ত পলায়নের প্রস্তুতি।



অনুশোচনার আড়ালে জীবন

অন্তর্গত নৈঃশব্দ্যের কঙ্কাল ছুঁয়ে
জেগে ওঠে অনুশোচনার পুংঙতি —
একটি অলক্ষ্য স্পর্শ,
যেখানে নৈতিহাসিক ব্যর্থতা খুঁটে খায় আত্মার তলদেশ।

নন্দনতত্ত্বের উপপাদ্য ভেঙে
ভাষা আর আত্মবীক্ষণের দ্বৈতস্বর ঘূর্ণায়মান;
তবু নিঃশব্দে লেখা হয়
এক নির্মম নিষ্কৃতি—অভ্যন্তরীণ পশ্চাৎচারণের দলিল।

স্মৃতির অনিবার্য ধ্বংসস্তূপে
ছড়িয়ে থাকে অপূর্ণ প্রয়াসের ব্যাকরণহীন শবদেহ,
প্রতিটি অনুচ্চারিত সিদ্ধান্ত
পরিণত হয় নৈর্ব্যক্তিক পাপবোধের ঘনীভূত পরিভাষায়।

মানসিক অনিমেষতায়
আত্মা চায় এক প্রতিসরণ—
তবে আলো নয়,
বরং ছায়ার তাপে পুড়ে গলে সত্তার মিথ্যা জ্যামিতি।

অনুশোচনা এখানে নিছক কষ্ট নয়—
এ এক অনতিবাচ্য বৌদ্ধিক প্রতিক্রিয়া,
যেখানে সিদ্ধান্ত একটি নৈতিক কালো গহ্বর,
আর মনবৃত্তি তার চারপাশে আবর্তিত গ্রহমণ্ডল।

সে কলমে ধারণ করে সম্ভাব্য নৈরাশ্যের ছায়াপথ,
তাকে প্রতিফলিত করে শব্দের ভেতর —
যেখানে প্রতিটি চিহ্নই একটি অনুরণিত ক্ষমাভিক্ষা।

Post a Comment

0 Comments