জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে( ত্রয়োদশ পর্ব) /মলয় সরকার

বাস থেমেছে বোগোটার রাস্তায় ট্রান্সমিলেনিওর স্টেশনে

মার্কেজের খোঁজে
( ত্রয়োদশ পর্ব)

মলয় সরকার


আসলে বোগোটা শহরের এই জায়গাটা সমুদ্রতল থেকে ৮৬৬০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ী এলাকা , যা উত্তর আন্দিজ পর্বতমালার দুটি পাহাড়ের গায়ে  তৈরী হয়েছে। পাহাড় দুটি হল গুয়াদালুপে (Guadalupe) ও মন্সেরাতে (Monserrate)। এখানে সব রাস্তাই পাহাড়ী, তাই একদিক উঁচু এবং অপর দিক নীচু। সেজন্যই এখানে সাইকেল চললেও সেগুলি সবই মোটর লাগানো, উপরে ওঠার জন্য।রাস্তায় বেশ ভিড়, তবে সব রাস্তাই একমুখী, কারণ একটা রাস্তায় দুটো গাড়ি তো পাশাপাশি চলতে পারবে না, এমনই সরু। 

ভাবছিলাম, এই সেই শহর, যেখানে মার্কেজ কাটিয়েছেন জীবনের প্রথম দিকটাতে।আমি এখানে আসার পর থেকেই কেমন যেন একটা আবিষ্টতার মধ্যে রয়েছি।শহরটা আমার কাছে যেন এক  পূণ্যক্ষেত্র।এর আগে এমন হয়েছিল, প্রথম যখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করি এবং বিশ্বকবির হেঁটে চলে বেড়ানোর জায়গায় ঘুরে ঘুরে সেখানের ধূলা স্পর্শ করছিলাম।
 
 স্নাতক হওয়ার পর মার্কেজ, ১৯৪৭ সালে, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার জন্য , বোগোটায় চলে আসেন। এখানেই তাঁর লেখক জীবন শুরু হয়।যদিও তাঁর আইন পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বাবাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তিনি আইন পড়তে শুরু করেন। তবে ভাগ্য তাঁর ইচ্ছার অনুকূলে কাজ করেছিল।যার ভাগ্যে লেখা আছে সাহিত্যের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা, তাকে কি আইনের কচকচানির সুক্ষ্ম জালে বাঁধা যায়। ১৯৪৮ সালে ৯ই এপ্রিল বোগোটায় এক নেতার (Jorge Eliecer Gaitan,liberal party leader) হত্যাকাণ্ডে বিদ্রোহ শুরু হওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় ও তাঁর বোর্ডিং হাউস পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি তখন কার্তাহেনায় চলে আসেন।যদিও লেখালিখির এবং নানা ধরণের পড়ার সূত্রপাত এই বোগোটাতেই হয়, কার্তাহেনাতে তিনি আরও বেশি করে জার্ণালিস্ট হিসাবে লেখালিখি শুরু করেন। 
বোগোটার সরু একমুখী পরিচ্ছন্ন রাস্তা ও সরু ফুটপাথ

এখানে ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হয়েছিল এরা তো আমারই স্বদেশের মানুষ, এদের ব্যবহার, ভালবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এখানে পথে ঘাটে সেই ভালবাসা আর আন্তরিকতা মাখা পরাগচূর্ণ উড়ে বেড়াচ্ছে। হেলেন ইয়ং তাঁর breakfast in Bogota উপন্যাসে যা বলেছেন ,’ I am in love with the vast, chaotic city of Bogotá, Colombia.” আমিও তার আক্ষরিক অনুভূতি পেলাম শহরে প্রতি পদে পদে।এখানে মানুষ আনন্দময় সজীব সচল ও প্রাণচঞ্চল।
 এখানে যে বিখ্যাত কলম্বিয়া কফির কাপের ধূমায়িত পেয়ালায় উড়ত গল্প আর আড্ডার ফোয়ারা, তরুণদের প্রাণে আনত চঞ্চল প্রেমের ছোঁয়া, তার অনেকখানিই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, এখানকার বিখ্যাত হত্যাকাণ্ড, ৯ই এপ্রিল ১৯৪৮ এ ,শ্রম,-স্বাস্থ্য মন্ত্রী  Jorge Eliecer Gaitan এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর। আর সেইদিন এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আমাদের বিখ্যাত সাহিত্যিক। গেতানের মৃত্যু পর কনজারভেটিভ পার্টি ও লিবারালদের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে দেশে এক অস্থির সময় ও অরাজকতা শুরু হয়। জেগে ওঠে কম্যুনিস্ট পার্টি। এর পরবর্তী পনের বছরে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ বিভিন্ন ভাবে মারা যায়। এই সমস্ত ঘটনাই রয়েছে মার্কেজের বিখ্যাত বই ‘যে গল্পটা বলব বলে বেঁচে আছি’ Living to tell the Tale’ তে। সে সময় তিনি তরুণ আইনের ছাত্র, দ্বিপ্রাহরিক আহার সারছিলেন কাছেই দোকানে বসে। তখন দেখতে পান উন্মত্ত জনতা তাঁকে কি ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার সাথে কিভাবে হত্যা করল। তিনি একটু পরেই সেখানে ছুটে যান।
🍂
ad

বোগোটা এমনই একটা শহর, যার ঝুলিতে রয়েছে সেই বড় সাহিত্যিকের কর্মের জমি তৈরী করা ছাড়াও, অনেক কিছু।পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি বাস রাস্তায় র‍্যাপিড ট্র্যাঞ্জিট সিস্টেম  রয়েছে, রয়েছে পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি বাই-সাইকেল চলার রাস্তা, প্রায় ৫০০ কিমি।এর এত বেশি পার্ক আছে যে, একে পৃথিবীর সবচেয়ে সবুজ শহর (Greenest city) বলা হয়।এর  Luis Angel Arango library পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম লাইব্রেরী গুলির মধ্যে অন্যতম, যেখানে ২০ লক্ষ বইয়ের সম্ভার রয়েছে। বোগোটাকে বলা হয়, ‘ Melting pot of Columbia’ ।এখানকার মজাদার, বিখ্যাত কলম্বিয়া কফির আড্ডা,সারা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পীঠস্থান। ক্যারিবিয়ান উৎসবের আনন্দ,Valle de Cauca উৎসব বোগোটাকে এক স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। 

আমাকে বুলবুল বলল, আচ্ছা, আমরা যা দেখছি, এদের সবই তো আমাদের মতই, হাঁটা চলা, কথা বলা , আতিথ্য, হাসি কান্না ইত্যাদিতে আমি তো কোন অমিল পাচ্ছি না।
আমি বললাম, আসলে তুমি তো পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘুরেছ, বল তো তোমার কোন দেশকে বা কোন দেশের মানুষকে খারাপ মনে হয়েছে?
ও একটু চুপ করে থেকে বলল, সেরকম তো কাউকেই মনে পড়ছে না। আমি বললাম সেটাই সত্যি কথা। আসলে সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষই এক ভাবে আনন্দে হাসে, দুঃখে কাঁদে, এটা মানবচরিত্র।এর পর যা দেখ তা হল, মানুষের বহিরঙ্গের প্রকাশ। যেমন ,চীন- জাপান দেখ পরিচ্ছন্ন, দুবাই আরব দুনিয়ায় বৈভব বেশি, আবার ইটালী ফ্রান্স বা অন্যান্য ইউরোপীয়ান দেশগুলো স্বভাবগত ভাবে নিজেদের ঐতিহ্য ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং তারা সেগুলো রক্ষা করে। এগুলোর পিছনে কিন্তু দেখবে অনেকখানি রাষ্ট্রের প্রভাব, কিছুটা ভৌগোলিক, কিছুটা অর্থনৈতিক কিছুটা প্রাচীন ধর্মীয় বা অন্যান্য সংস্কারের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ এই বাহ্যিক চরিত্রগুলোর খোলস ছাড়ালে যে মানুষটা বেরিয়ে  পড়ে ,সারা পৃথিবীতে তারা সবাই এক ধর্মীয়- মানবধর্মীয়।
এর ফলে ,আমি দেখেছি, পৃথিবীর যে কোন দেশে গেলে, আমার আজকাল যা হয়, তা হল, দু একদিন সময় লাগে জায়গাটাকে নিজের করতে। তারপর মনে হয় যেন, নিজের দেশেরই কোন প্রদেশে আছি। আর কোন অসুবিধাই হয় না, সে দেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে।

আমাদের ঘরের পাশেই একটি ছোটো চা-টিফিনের দোকান রয়েছে। সেদিন সকালে গিয়েছিলাম দোকানে। ওরা কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করল , কোথা থেকে এসেছেন, ইত্যাদি। আমি বললাম, আমি তোমাদের গ্যাবো, লোরকা ইত্যাদি নানা সাহিত্যিকদের লেখা আমাদের দেশে বসে পড়েছি। তাই দেখতে এলাম, সেই দেশটাকে যেখানে এই সমস্ত সাহিত্যিকদের পায়ের ধুলো পড়েছে, জানতে এলাম, সেখানকার মানুষদের। তারা তো আমার কথা শুনে আপ্লুত। বলে আপনারা ওখানে বসে এঁদের লেখা পড়েছেন? বললাম, হ্যাঁ। মেয়ে দুটি তা শুনে খুব খাতির করে আমাদের বসিয়ে, তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী যথা সম্ভব, যত্ন করে চা ও অন্যান্য খাবার খাওয়াল।সাধ্যমত খুব যত্ন করল। আমরা বললাম, আমরা রোজ তোমাদের দোকানে আসব, যতদিন আছি। 
ওরা তো খুব খুশী।সত্যিই আমরা যে দু একদিন ছিলাম, ওদের দোকানে যেতাম, ওরাও খুবই খাতির করত।

বুলবুলকে বললাম, চল, জায়গাটা একটু পায়ে হেঁটে দেখি। আমি বিশ্বাস করি, পায়ে হেঁটে না দেখলে, মানুষের গায়ে না গা ঘেঁসলে, একটা দেশকে সত্যিকারের দেখা হয়ে ওঠে না।একটা দেশ দেখা মানে , আমি বিশ্বাস করি না, শুধু কিছু মন্দির আর বড় বড় সৌধ দেখা। তার ধুলোর গন্ধ না শুঁকলে, তার ঘামের গন্ধে আবিষ্ট না হলে কি আর দেশটাকে জানা যায়। তা-ও তো আমার দুঃখ থেকে যায়, আমি যেভাবে দেখতে চাই, সব জায়গায় সেভাবে ঠিক পেরে উঠি না। তার অনেকখানিই অর্থনৈতিক, কিছুটা আবার সময়াপেক্ষীও বটে। অতএব, স্বল্প সময়ে যতটুকু পারি আমার মত করে বুঝতে চেষ্টা করি।আর সে কারণেই বিভিন্ন জায়গায় এ আর বি এন বি গুলো আমার বেশি পছন্দের।
বোগোটার রাস্তা, পিছনে আন্দিজ পর্বতমালা , ফলে মাঝে মাঝেই মেঘলা ও বৃষ্টি

আমরা ধীরে ধীরে মোবাইলের জিপিএস দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগলাম। মনে পড়ল, নিউইয়র্কের কথা। তখনও জিপিএস বোধ হয় এতটা ভরসা করার মত ভাল, বা দক্ষ হয়ে ওঠে নি।আমরা যাব ব্যাটারী পার্ক, সেখান থেকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখতে। জিপিএস ব্যাটা কেবলই একটা বিশাল কয়েকতলা বাড়ির চারপাশে ঘুরপাক খাওয়ায়। আমি বললাম, আচ্ছা মুস্কিল হল তো। শেষে বললাম নিজেকে, ‘বাঙ্গালী বাংলায় ফেরো’। বাধ্য হয়ে, একটা দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, এই তো ওপাশে।বুঝলাম, ব্যাটা আমাকে ঠকিয়ে লুকোচুরি খেলছিল।
জিপিএস এখন দেখছি, তা নয়, অনেকটাই ভরসা করা যায়। তবে অনেক সময় হয়ত’ সঠিক বাড়ির দরজায় নিয়ে যেতে পারে না, তবে কাছাকাছি নিয়ে যায়।এখানে শহরটা অনেকটা গ্রিডের মত , অর্থাৎ একটা চৌকো খোপের তার জালি যেমন হয়, রাস্তাগুলো ঠিক ঢালু পাহাড়ের গায়ে তেমনই, তা আগেই বলেছি।কাজেই জিপিএসের নির্দেশ মানতে কোনই অসুবিধা হয় না।
ক্রমশঃ-
সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা। আপনারাই আমার সাথী এবং পথচলার সাহস–

Post a Comment

0 Comments