জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(অষ্টম পর্ব)/মলয় সরকার

কবির প্রতি সম্মান জানিয়ে জুতার মডেল

মার্কেজের খোঁজে

(অষ্টম পর্ব)

মলয় সরকার


আমরা পৌঁছালাম ক্লক টাওয়ারের সামনে Plaza de los Coches এ বা Square of coaches এ । এর আগে নাম ছিল Plaza de la Yerba বা Plaza del Esclavo । এই জায়গাটি আগে ক্রীতদাস কেনা বেচার জায়গা ছিল।এখানে একটি অনেক উঁচু ছাদের ঢাকা বারান্দা বা পথ রয়েছে তার নাম El Portal de los Dulces বা মিষ্টি বিক্রীর রাস্তা। এখন এখানে রয়েছে ফুটপাথে ও রাস্তার গায়ে নানা স্থানীয় মিষ্টি আর বিস্কুট টফির দোকান।একটি মূর্তিও রয়েছে শহরের প্রতিষ্ঠাতা Pedro de Heredia র।এর উল্টোদিকেই রয়েছে সরকারি মিউজিয়াম।
কেল্লার ছাদের উপর আমরা

ফোন এল। ওপর প্রান্তের বক্তার কথা শুনে গেটের বাইরে এগিয়ে যেতেই আমাদের নিতে এগিয়ে এল দুটি ছেলে। আমরা তাদের সঙ্গে গিয়ে সামনেই একটি পার্কে জমা হলাম,অন্য যাত্রীদের সঙ্গে। বলল বসুন, একটু পরেই নিয়ে যাব। পার্কটি, আমাদের কোলকাতার মতই পার্ক। ভিতরে খুব যে যত্ন নেওয়া হয় , তা নয়। ভিতরে ভবঘুরে থেকে আমাদের দেশের চানাচুর ভাজা বিক্রেতার মত সবই আছে। দেরী আছে দেখে খাবার খাওয়া হল। ভালই বেশ। পেটও ভর্তি হয়ে গেল সারাদিনের মত।আকাশে ঝকঝকে রোদ, গরমও আছে।তবে সব মিলিয়ে ঘোরার মতই পরিবেশ।সামনে রাস্তা রয়েছে অনেকগুলো, দূরে দূরে দোকান। আসলে এটা মিটিং পয়েন্ট তো, অনেক গাড়ি আসার বা দাঁড়ানোর জায়গা , অনেক লোক , সব মিলিয়ে জায়গাটা জমজমাট।আমরা দেখছিলাম পার্কে অনেক লোক বসে খাচ্ছে, কেউ আলস্যভরে বসে আছে। বুলবুল বলল, এরকম একটা জায়গায় বসে থাকতে বেশ লাগে।বেশ চারিদিকে একটা চলমান জগতের মাঝে এই জায়গাটা একটা যেন নিশ্চিন্ত বিশ্রামের বা আলস্যের জায়গা।আমাদের দুজনেরই মাথায় রোদ-টুপি পিঠে ব্যাকপ্যাক। বেশ ট্যুরিস্টের মত চেহারা-কে বলবে বুড়োবুড়ি!
এর মধ্যে গাড়ি এল। ‘গাড়ি’ বলতে ভেবেছিলাম, ভাল ‘এসি’ গাড়ি হবে। তা নয়, এল পুরানো দিনের একটা ঝরঝরে বাস, তার গায়ে নানা ঊজ্বল রঙ দিয়ে চিত্রবিচিত্র করা।তার আবার নাম নাকি CHIVA।বাসের গায়ে বড় বড় অক্ষরে তাই লেখা আছে।  সব জানালাগুলো খোলা।ভিতরে মোটামুটি বসার জায়গা রয়েছে। আর ওঠা নামার জন্য অনেক সময়েই আলাদা কাঠের সিঁড়ি লাগাতে হচ্ছে।অর্থাৎ একটি কোন ফেলে দেওয়া ঝরঝরে বাসকে ওরা সাজিয়ে চালাচ্ছে। বাস চললে, বাসের ভিতর কথা বলা মুস্কিল, তার এতই আওয়াজ।মনে হল, বয়স বাড়া সত্বেও তাকে দিয়ে যে এত কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তার জন্য প্রতিবাদ আর আর্তনাদ করছে।দেখলাম এখানে এই ধরণের বাস আরও রয়েছে। তার ভিতরে সব জোরে জোরে গান বাজছে। আমাদেরটায়, অন্যসময় কি করে জানি না, এখন সেই কান ফাটানো গান নেই। অবশ্য তার ঝরঝরে শরীরের আর্তনাদেই আমাদের অবস্থা খারাপ।
একটি ছেলে গাইড হিসাবে কাজ করছে, সে কখনও স্প্যানিশ আর কখনও ইংরাজী বলছে। তবে ও আগেই জিজ্ঞাসা করে নিল, কে কোথায় থেকে এসেছে। সবাই জানাল, কেউ চিলি, কেউ মেক্সিকো, কেউ গুয়াটেমালা, কেউ পেরু ইত্যাদি। কাজেই স্প্যানিশ ভাষাভাষী বেশি। ছেলেটি নিশ্চিন্ত হল যতটা, আমার দুশ্চিন্তা বাড়ল ততটাই। কারণ এটা শুনে ও স্প্যানিশে যদি ৮০ ভাগ বলে তো ইংরাজীতে বলে ২০ ভাগ। বুঝলাম ও ইংরাজীতে বেশি সড়গড় নয়। অথচ বলেছিল, ইংরাজী ভাষী গাইড থাকবে। বুঝলাম, ফলে বাধ্য হয়ে অনেকখানিই আন্দাজে আর অনেকখানিই না বোঝা দিয়ে কাজ চালাতে হবে।
🍂
ad

অগত্যা- রওনা হলাম। বাস তো এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরে এখানে দাঁড়িয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে চলতে লাগল। কারণ বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের নিচ্ছে ওরা। আমরা এগোলাম, সমুদ্রের ধার বরাবর। ডানদিকে বিশাল নীল সমুদ্র। তবে এর বালিয়ারী মোটেই চওড়া নয়। বুঝতে পারলাম, অনেক জায়গাতেই বালি ফেলে জায়গা তৈরী হয়েছে।। দেখতে পাচ্ছি বন্দরের নোঙ্গর করা জাহাজ, দূরে  সারি সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সেই বন্দর, যেখান থেকে এককালে বাইরে পাঠানো হত হতভাগ্য ক্রীতদাসদের আর পরে মাটির বুক থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সোনা আর রূপোর ভাণ্ডার। হয়ত এই বন্দরের ছবিই সাহিত্যিককে অনুপ্রাণিত করেছে বিপন্ন নাবিকের ছবি আঁকতে।

তবে এই ফাঁকে নতুন গজিয়ে ওঠা বোকাগ্রান্ডে শহরটাও দেখা হল। তবে শহরটা ঘোরার সময় , সত্যি বলছি আমার মনে হচ্ছিল যেন,  আমাদের কোলকাতার সল্ট লেকের বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে দিয়ে ঘুরছি। ঠিক একই রকমের দোকানপাট, তাদের সামনের ফুটপাথ বা অন্যান্য যাবতীয় কিছু, মানুষজন, তাদের সাজসজ্জা ব্যবহার সব এক। যেন আমাদের কলকাতাকে কেটে বসানো হয়েছে। শুধু একটু পরিচ্ছন্ন এই যা। এমন কি গাছগুলো পর্যন্ত এক। আমগাছগুলোতে গাছভর্তি মুকুল এসেছে।জবা গাছে ফুল ফুটছে।

যাই হোক এগোলাম। খানিকক্ষণ বাদে একটা জায়গায় পৌছালাম। ওরা নামাল। দেখলাম একটা উঁচু বেদীর উপর রাখা রয়েছে দুটো বিশাল বড় বড় জুতো, সম্ভবতঃ ব্রোঞ্জের।তবে বহু হাতের স্পর্শে পিতলের মত ঝকঝক করছে অনেকটাই। একটা জুতো শোয়া, একটা সোজা রাখা। সবাইকে বলল ওরা ওই জুতোর সাথে ছবি তুলতে।

ওদের কথা থেকে যা বুঝলাম, আর পরে এর ব্যাপারে  পড়ে যা জেনেছি বলি। ওখানকার বিখ্যাত কবি Guillermo Calve Mahe র লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা  An Ode to Old Shoes কবিতাকে সম্মান জানানোর জন্যই এটার সৃষ্টি।কবি বর্তমানে কলম্বিয়া নিবাসী,  যদিও তিনি আমেরিকার নাগরিক। কবিতাতে কবি বোঝাতে চেয়েছেন, একটি জুতোকে কবি যেমন নতুন অবস্থাতে ভালবাসতেন, সুদীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে তার প্রতি যে মায়া ও ভালবাসা তৈরী হয়েছে, তাতে যতদিন যাচ্ছে, পুরানো হলেও ভালবাসা যেন বেড়ে যাচ্ছে। জুতো জীর্ণ বলে তার প্রতি অবজ্ঞা নয় ভালবাসাই যেন প্রধান হয়ে উঠছে। এই জুতোকে তিনি স্বদেশের প্রতি ভালবাসার রূপক হিসাবেই ব্যবহার করেছেন।তাই এই জুতো ওখানে কবির প্রতি সম্মানের স্মারক।
সমুদ্রের ধারে লেখা রয়েছে কার্তাহেনার নাম

এর ঠিক পিছনেই দেখা যাচ্ছে একটি পুরানো কেল্লার সুউচ্চ দেওয়াল। এটিই  সেই Castillo San Felipe de Barajas যেটি ১৬৩৯ সালে তৈরী হয়েছিল আফ্রিকান ক্রীতদাসদের হাতে স্প্যানিশ  তত্বাবধানে। এখান থেকে ভূমি বা সমুদ্র যে কোন পথেই শত্রু আসুক তার দিকে নজর রাখার সুবিধার জন্যই এটি তৈরী।এটির নামকরণ হয়েছিল স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপের নামে।এটি একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। ১৮১৬ সালে এর পতনের আগে পর্যন্ত এটি স্প্যানিসদের হাতে ছিল এবং অনেক যুদ্ধের সাক্ষী এটি।

সমুদ্র থেকে ১৩৫ ফুট উঁচুতে থাকা San Lazaro পাহাড়ের উপরে প্রধানতঃ পাথরের তৈরী এই ফোর্টটিতে নীচের থেকে উপর দিকে ক্রমশঃ বিস্তার কমিয়ে আনা হয়েছে। এতে অনেক গুলি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। এখানে অনেক সৈন্য ও বেশ কিছু কামানের বন্দোবস্ত ছিল। এখনও দু একটি কামান রয়েছে দেখলাম।এর প্রথম ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৫৩৩ সালে।১৯৮৪ সালে এটি  ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পাওয়ার পর এটির বেশ কিছু সংস্কার হয়।
ক্রমশঃ-
বন্ধুরা,চলতে থাকি পথে আর দেখে যাই আপনাদের সাথে গল্প করতে করতে–

Post a Comment

0 Comments