যেসব কথা লেখা হয় না
পর্ব- ১১
সুমনা সাহা
অনেক বছর আগে কেদারনাথ দর্শনে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পথ উঠে গেছে। আমাদের গাড়ি একবার পাহাড়ের এই ঢালে, তখন একদিকে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল, আরেকদিকে গভীর খাদ। ভয়ে কাঁটা হয়ে বসে আছি। দূরে দেখছি ওদিকের পাহাড়ের উপত্যকায় রোদ পড়েছে, সবুজ গালিচার উপর নরম আলো। দেখতে দেখতেই আমাদের গাড়ি পাহাড়ের ঐ উল্টোপিঠের ঢালে, আর পিছনের ফেলে আসা পথটা কত নিচে পড়ে আছে পাইনের সবুজ বর্ডার দেওয়া একটা সরু রেখার মত! গাছ পাথর সব এত্তটুকু। ভয়ও নেই, কষ্টও নেই। অনেকটা পথ পেরিয়ে আসার পর সব স্মৃতিও এমন ছবির মত লাগে। মনে পড়লে মন ভরে যায়, সেই গানটার মত—“স্মৃতির জানলা খুলে চেয়ে থাকি, যতটুকু আলো আসে, সে আলোয় মন ভরে যায়!” জীবন আবার নদীর মতো বয়ে যায়। কোথাও দুরন্ত গতি, কোথাও বা মন্থর। বাঁকে বাঁকে কত ঘটনার ঘূর্ণি। এক একটা চরিত্র এসেছে, কেউ চলে গেছে, কেউ হারিয়ে গেছে, কেউ থেকে গেছে। মাত্র একদিনের একটা স্মৃতিও অদ্ভুত ভাবে মনের মধ্যে স্থায়ী হয়ে গেছে, তখন বুঝিনি। তখন বারুইপাড়ায় রামকৃষ্ণ সারদা মিশন শিক্ষামন্দির-এ পড়ি। সেই সময়ের একটা কথা। আমরা স্কুলে যেতাম রিক্সায় চেপে, ‘মাসকাবারি রেস্কা’ এই শব্দটা শিখেছিলাম ওই রিক্সাওয়ালার কাছেই। বাড়ির দরজা থেকে নিয়ে যেত, আবার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যেত। সে মাঝে মাঝে বিনা নোটিশে কামাই করত। আমাদের ফিরতে দেরি দেখলে মা দাদাকে পাঠিয়ে দিত আমাদের নিয়ে আসবার জন্য। খুব বেশি দূরে নয়, তবুও ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে সময় লাগত বৈকি। দাদা নানা শর্টকাট পথে আমাদের নিয়ে আসত। ‘ছেরপদ আলা’-র খাটালের পাশ দিয়ে, কচুরিপানা ঢাকা ঝিলের পাড় ধরে, বালানন্দের মন্দিরের সামনে দিয়ে। পরে জেনেছি ঐ দুধওয়ালার নাম ছিল শ্রীপদ। তারই অপভ্রংশ উচ্চারণে নিজের অমন সুন্দর নামখানার সত্যনাশ করেছিল সে নিজেই। ‘সম্পদ তব শ্রীপদ ভব গোস্পদ বারি যথায়’, শ্রীরামকৃষ্ণ আরাত্রিক ভজনে পেলাম সেই শব্দ শ্রীপদ! শুনেছি তার উত্তরপুরুষেরাই এখন এক নামী প্রাইভেট ইনস্টিট্যুশনের মালিক। জল মেশানো দুধ বেচে এত সম্পদ করেছে সে, একথা দুষ্টু লোকেরা বলে। যাইহোক, বালানন্দের মন্দির তখন একটুখানি। কয়েকজন সাধু কোনমতে থাকেন আর গড়ে উঠছে নতুন বিশাল মন্দিরের কাঠামো। আমরা জেদ করতাম দাদার কাছে ঐখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুজন সাধু কনস্ট্রাকশনের কাজ দেখতেন। তাঁদের মধ্যে একজন আমাদের দেখলে মিষ্টি করে হাসতেন। সেটুকু প্রশ্রয় পেয়ে আমাদের কলকণ্ঠের অজস্র প্রশ্ন তাঁকে ঘিরে ধরত। তিনি কোনও কথাই বলতেন না, কেবল হাসতেন। আমরা বারম্বার ‘তুমি কথা বলো না কেন?’ এই বলে উত্যক্ত করাতে একদিন তিনি সামনে পড়ে থাকা বালির উপর আঙুল বুলিয়ে লিখলেন, ‘আমরা মৌন ধারণ করেছি।’ তারপর ইশারায় যা বলেছিলেন, দাদা আমাদের সেকথা বুঝিয়ে দিল, মন্দির সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত যাতে শুভ কাজে কোন বাধা না আসে, তাই তাঁরা কয়েকজন মৌন ব্রত সংকল্প করেছেন। সেদিনের পর থেকে দাদা আর আমাদের ওখানে নিয়ে যায়নি। বলত, “এখন তোরা গিয়ে ওঁদের বিরক্ত করবি, তোদের জন্য যদি ওঁদের ব্রত ভঙ্গ হয়, পাপ হবে। মন্দির তৈরি হয়ে যাক, তারপর আমরা যাব।” বড় হয়ে জেনেছি, বাক-সংযম থেকে অনেক শক্তি আসে। পতঞ্জলির যোগসূত্র পড়েছি, ১২ বছর মৌন-ধারণ করলে ব্রতধারীর মুখের কথা সত্য হয়, সে সত্যসঙ্কল্প হয়ে যায়, তখন সে মুখ দিয়ে যা বলবে, তাই ফলে যাবে। যদি খটখটে রোদের মধ্যেও বলে বৃষ্টি হবে, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে মেঘ করবে এবং বৃষ্টি হবে। এসব পড়ে চমৎকৃত হতাম। কিন্তু যোগসূত্রে পড়া কোন শক্তি লাভ করবার মত ধৈর্য আর মনের জোর হয়নি কোনদিন। আরও পরে রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়েছি, আনন্দের খনি যেন! কোন যোগ যাগ কঠোরতা কিচ্ছু করতে হবে না, সরল হও, সত্য কথা বলো, মন মুখ এক করো, কপটতার আশ্রয় নিও না। ভগবান কেবল মন দেখেন। কত সহজ আর কেমন সুন্দর কথা। জেনেছি, কেবল তিতিক্ষা আর দৈহিক কৃচ্ছ্রতা নয়, সাধনা এক আনন্দের যাত্রাও হতে পারে। আমরা সবাই এবং মামাবাড়ির দিকের সমস্ত পরিবারই শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ থেকে দীক্ষা নিয়েছে, কেবল আমাদের এক বোন ওর শ্বশুরবাড়ির গুরুদেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। একই বাগানে বেড়ে ওঠা চারটি গোলাপ চারা যেমন আলাদা সময়ে এবং আলাদা সংখ্যায় ফুল দেয়, তেমনই আমরাও সময়ের সাথে সাথে ধীর বিবর্তনের পথরেখা বেয়ে চারটি নদীর মত প্রবাহিত হয়েছি। যদিও জানি, অন্তিমে সবই মিলবে এক মহামিলনের অমৃত সাগরে।
শৈশবের আরেক স্মৃতির নাম—‘পাগলি বিচারি তাড়ং তাড়ং!’ তখন রাজকুমারী স্কুলে পড়ি। বোধহয় আমি সেভেন আর বোন ক্লাস ফাইভ। কি একটা ঘটনায়, কারণ মনে নেই, বাড়িতে কিছু লোক আসবে আর তারা আমাদের পছন্দের মানুষজন নয়। অথচ বাড়িতে এলে এড়িয়ে যাওয়াও যায় না। দিনটা রবিবার। স্কুলও নেই যে ওই সময়টা স্কুলে কাটবে। তখন রবি দা-র রিক্সায় স্কুলে যেতাম। মা বলত, ‘রবিটা একটা পাগল।’ কিন্তু ওই পাগলামিগুলোর জন্য রবিদা ছিল আমাদের চোখে হিরো। রিক্সা চালাতে চালাতে সে পকেট থেকে আয়না চিরুণি বের করে চুল আঁচড়াত আর হ্যান্ডেল ছেড়ে দিয়ে পায়ে প্যাডেল মারত। আমরা উত্তেজনায় ফেটে পড়তাম। আবার পথচলতি কোন দাদুর লুঙ্গিতে দিত টান, দাদু বেদম গালাগালি করত আর রবিদা আমাদের দিকে পিছন ফিরে চোখ টিপত, ওর কাণ্ড দেখে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম। রবিদা-র পাগলামির কারনামা বলতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। একবার অসময়ে স্কুল ছুটি হয়ে গেল, প্রেয়ারের পর। কি একটা বিশেষ কারণ ছিল। আমরা জানতাম, আমরা স্কুলে বেরনোর পরে, মা আজ মামাবাড়ি যাবে। রবিদাকে বললাম, “স্কুল যখন ছুটি হয়ে গেল, এখন আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না। আমাদের মামাবাড়ি নিয়ে যাবে রবিদা?” রবিদা অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দে লাফিয়ে উঠল, “কোথায় তোদের মামাবাড়ি?” তারপর পুলিশের কেস খেয়ে রবিদা আমাদের মৌখিক বিবরণ শুনে শুনে বেলা একটার সময় পৌঁছে দিল আমাদের সেসময়ে দমদমের মামাবাড়িতে। মাথানিচু করে মা-র অজস্র বকা শুনল। আমরা ততক্ষণে মামাতো বোনের সঙ্গে হুল্লোড়ে মেতে উঠেছি। বয়সে সে ছিল আমার আর বোনের ঠিক মাঝখানে। যাক, সেসব অন্য ইতিহাস। আজকের কথাটা আলাদা। আজ রবিবার। অতএব রবিদা আসবে না। সেটা মোবাইল জমানা নয়। ফলে ডেকে আনার উপায় নেই। কিন্তু আমরা মা-কে বললাম, “মা আমরা আজকে স্কুলে গিয়ে সময় কাটাব?” মা তো অবাক, “রবিবার স্কুল?” আমরা হাসলাম। মা তো জানে না। আমাদের স্কুলের দারোয়ানের সঙ্গে বিশেষ আলাপ আছে। বিশেষ করে ওর মেয়ে আমাদের খেলার বন্ধু। রবিদা আসতে দেরি করলে আমরা স্কুলের মাঠে খেলা করি। স্কুলের গেট সংলগ্ন ওর ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরেও গিয়েছি ওর সঙ্গে। ফলে আমরা সিওর যে দারোয়ান আমাদের স্কুলের মাঠে এলাও করবে। শীতের দিন। “রোদে মাঠে বসে পড়াশুনো করব,” মাকে এই বলে রাজি করালাম। আমি আর বোন গরম গরম দুটি ঝোলভাত খেয়ে অভিযানে বেরিয়ে পড়লাম। ছুটির পর অপেক্ষা করে করেও যখন রবিদা এক একদিন আসত না, আমরা হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। তাই বিশেষ প্রয়োজনে স্কুলে যাওয়ার হাঁটাপথ জানাই ছিল। স্কুলে পৌঁছানোর পর জিজ্ঞাসাবাদ করে দারোয়ান কাকু গেট খুলে দিল আর সাবধান করে দিল, চুপচাপ যেন বসে পড়া করি, দুষ্টামি করলেই বড়দিকে বলে দেবে। আমরাও মাঠের কিনারায় আমগাছের ছায়ায় বই খুলে বসলাম। কী অপূর্ব রূপ নিস্তব্ধ স্কুলবাড়িটার! বিশাল মাঠটা কালিপুজো পার হওয়া হৈমন্তী শীতের রোদে তার মখমলি সবুজ শাড়িখানি মেলে দিয়েছে। ঘাস ফড়িং-এর ওড়াউড়ি, মাঝে মাঝে ‘টু টু টুই’ শব্দে পাখির ডাক, ভারি মনোরম লাগছে। এমন সময় তিড়িং বিড়িং করে একটা রোগা কাঠির মত মেয়ে এল কোথা থেকে। আমাদের সামনে একটা শানদার ডিগবাজি খেয়ে তার প্রথম আত্মপরিচয় দান। তার মা এই মাঠে ছুটিছাটার দিনে ঘাস ছাটতে আসে। তাই এখানে ছুটির দিনে তার অবাধ এন্ট্রি। সে স্কুলে পড়াশুনো করে না। সারাদিন শুধু খেলে আর ছাগল চড়ায়। আমাদের বইপত্র শিকেয় তুলে শুরু হল খেলা। ছোঁয়াছুঁয়ি, কিতকিত, দৌড়-রেস আরো কত রকমের খেলা এখন মনেও নেই। সেই মেয়ে যেন একটা উন্মত্ত ঝড়ো হাওয়া। আমরা এমন খেলার সাথী আগে কক্ষনো পাইনি। জীবন ও প্রকৃতির কত জটিল নিগূঢ় রহস্য যে সে জানে! পাখির বাসা থেকে কচি ছানা চুরি, ছাগলের দুধ বিক্রি করে সেই পয়সায় লুকিয়ে সিনেমা দেখা আর মা-র কাছে রাম-পিটুনি খাওয়া এমন সব মজার গল্পে আমরা সময়ের হিসেব ভুলে গেলাম। একসাথে মশলা মাখানো বিলাতি আমড়া কিনে খেলাম। এক সময় রোদের রঙ বদলে গেল, বিকেল হয়ে এল। দারোয়ান আমাদের ঘরে ফেরার জন্য তাগাদা দিয়ে গেল। আমরা তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর নাম কি রে?” ও বলল “পাগলি।” আমরা হাসলাম, “সে তো তুই পাগলিই, কিন্তু আসল নাম কি?”
“পাগলি। আমি যেখানেই যাই লোকে আমায় দুচ্ছাই করে তাড়ায় আর বলে ‘পাগলি বিচারি তাড়ং তাড়ং’,” এই বলে সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল, ডিগবাজি খেল, কিন্তু চোখ দিয়ে জলও পড়ছিল দেখলাম। মুছে নিল হাতের তালুর উল্টোপিঠে। আর চলে যেতে যেতে পিছন থেকে সে চেঁচিয়ে বলল, “ছাগলের দুধ চুরি করে বিক্কিরি করে পয়সা জমিয়েছি। আরেকদিন আসবি? সিনেমা দেখতে যাব।” আমি বললাম, “কার সিনেমা?” ‘মিঠুন মিঠুন মিঠুন’ এই বলে সে হাসতে হাসতে মিলিয়ে গেল। স্ট্রাগল করে মুম্বাইতে নিজের জমি তৈরি করা মিঠুনই তার হিরো। তবে আমরা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অনুমতি পেয়েছিলাম আরও পরে। প্রথম দেখা সিনেমা ‘গেহেরি চাল’, পারমিশন আদায় করেছিলেন সেই বিনীর মা, আমাদের ঠাকুমা। এখনকার দিন হলে তাকে কেউ ঠাকুমা বলত না। মা ‘মাসিমা’ ডাকত, সেই সূত্রে আমাদের ঠাকুমা। কিন্তু তিনি মানসিকতায় অষ্টাদশীকে হার মানান। আমাদের দুঃখে আক্ষরিক চোখ দিয়ে তাঁর জল পড়েছিল, “হায় হায়! এখনও লম্বুরে দ্যাখোনি বাছারা? আমি তোমাদের মায়েরে রাজি করাব্যানে।” তিনি গলবস্ত্র হয়ে মাকে আমাদের একদিন তাঁর সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিতে অনুরোধ করেছিলেন। আরও পরে সাদা কালো টিভিতে দেখা হল মিঠুন চক্কোত্তির বাংলা সিনেমা ‘ত্রয়ী’। আজও কোন মেয়েকে কষ্টের মধ্যেও হাসতে দেখলে ঐ কথাটা মনে পড়ে, ‘পাগলি বিচারি তাড়ং তাড়ং’। আর কোনদিন ওই মেয়েটাকে দেখিনি।
এই সময়ের আগে-পরে আমাদের পাড়ায় একটি নতুন পরিবার এসেছিল। তিন জনের সংসার, মা-বাবা-একমাত্র ছেলে। ছেলেটি, বাবাই, আমাদের আরেকজন খেলার সাথী হয়ে গেল। ছুটির দিনগুলোতে বাবাই আমাদের বাড়িতে প্রায় সারাদিন পড়ে থাকত। পরদিন যখন আসত, দেখতাম, ওর নাকের উপরে বা কপালের রগের পাশে দগদগে কাটা দাগ। আমার মা জিজ্ঞেস করত, “কিরে বাবাই? এতটা কাটল কিভাবে?”
ও বলত, “মা মেরেছে।”
“এইভাবে মেরেছে? মায়েরা কখনো এরকম আঘাই-বিঘাই মারে? তুই মিথ্যে কথা বলছিস। পড়ে গিয়েছিলি কোথাও? কেটে গেছে?”
“না, মা-ই মেরেছে। তোমাদের বাড়িতে আসি বলে মা মারে।”
আমরা স্তম্ভিত। বলে কি? মা-তো খুব রেগে গেল, “তাহলে তুই আসিস কেন? আর কোনদিন আসবি না।” কিন্তু ও কোন কথা শুনত না। আসবেই আর মা ওকে ঘরে না ঢুকতে দিলে কান্নাকাটি করবে। একদিন মা ওদের বাড়িতে গেল। বাবাইয়ের মায়ের কথা একটু বলি। সেই ধন্যি মেয়ের জয়া ভাদুরির মতো বেঁটে খাটো, আর পাছা ছাড়িয়ে যাওয়া এক ঢাল চুল। চোখ দুটো বড় বড়, রাগী রাগী। শ্যামবর্ণা, বিরাট একটা সিঁদুরের টিপ কপালে, মা কালীর মতো একটা রূপ। তাকে মা সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “আপনার ছেলে আমাদের বাড়িতে খেলতে আসে বলে আপনি ওকে মারেন?” কাকিমা হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ মারি তো! কেন যায় হ্যাংলার মত লোকের বাড়িতে? গেলেও বা অতক্ষণ থাকে কেন? আপনাদের অসুবিধা হয় না? এখন থেকেই শাসন না করলে বড় হলে তো আমাকে না জানিয়ে যেখানে খুশি চলে যাবে।” মা গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “তাই বলে এইভাবে কেউ মারে? এমন এমন জায়গায় মেরেছেন, খুব বিপদ হতে পারে। আর আমার নিজেরই চারটে, তার সঙ্গে আরেকটা জুটলে কোন অসুবিধা হয় না। ওরা খেলে। খেলা হয়ে গেলে আমি তো বাড়ি পাঠিয়ে দিই, এই তো এখান থেকে ওখানে। এতে এত দুশ্চিন্তা করার কি আছে? বরং এইভাবে মারলেই বড় হয়ে পালিয়ে যাবে।” তারপর থেকে আমরা আর বাবাইকে খেলায় নিতাম না। ও আমাদের চারপাশ দিয়ে মলিন মুখে ঘুরে বেড়াত। একদিন বাবাইয়ের বাবা আমাদের বাড়িতে উপস্থিত। হাতে একটা নতুন উপন্যাসের বই। তিনি বেশ সুপুরুষ ছিলেন মনে আছে। বাবার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হলেও তিনি উঁচু ডিগ্রিধারি এবং প্রথম থেকেই চাকরিতে উচ্চপদে যোগ দিয়েছিলেন। বাবা ঘরে ছিল না। আমাদের সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে অনেক কথা হল। বললেন, “এই বইটা পড়ে দেখবেন, আপনি তো শুনেছি অনেক পড়াশুনা করেন, আমার এক বন্ধু এই বই লিখেছে।” পরে জানতে পারলাম, বইটি ওই কাকুরই লেখা। মা বিনীর মা-কে বলল, “ভদ্রলোকের অনেক গুণ।” বিনীর মা রহস্যের সুরে বলল, “আরও আছে গো বুলির মা, উনি একজন কাপালিক, তা জানো?” আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম। বিনীর মা বলে গেল, “এই অমাবস্যা আসছে, খেয়াল করবে, রাত্রে ঘণ্টার শব্দ শুনতে পাবে। প্রত্যেক অমাবস্যায় উনি পুজো করেন।” আমরা সত্যিই গভীর রাতে শুনতে পেলাম ঘণ্টার শব্দ। একদিন আমরা বাবাইকে চেপে ধরলাম, বাবাই সব বলে দিল। প্রত্যেক অমাবস্যায় নাকি ষোড়শোপচারে পুজো হয়, বাড়িতে কালী ঠাকুর আছে। তবে ও ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে প্রসাদ খায়। মা বুদ্ধি করে আমাদের হাতে পরের অমাবস্যার আগে ফল কিনে পাঠিয়ে দিল, বলল, “কাকুকে দিয়ে বলবি, শুনেছি আপনি মায়ের পুজো করেন, আমাদের নামেও পুজো দেবেন, মা পাঠালো।” উনি রাগ করেননি, খুশি হয়ে একসেপ্ট করেছিলেন এবং পরদিন আমাদের জন্য থালাভরে প্রসাদ এল। খিচুড়ি, পাঁচ রকম তরকারি, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। একদিন উনি বই কেমন লাগলো, রিপোর্ট নিতে এলেন, আমার এখন আর বইটার নাম মনে পড়ে না, তবে মা-পিসিরা আলোচনা করত শুনেছি, একেবারে অশ্লীল বর্ণনায় নাকি ভর্তি। পুলিশি ডায়েরি, কেস, তদন্তর নানা ঘটনা। মা দাদাকে বলত, “লোকটা একটা ছুপা রুস্তম!” একদিন কালী পুজোর ব্যাপারটা কি, এই কৌতূহলের নিরসনে মা কাকুর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছিল। বড়দের কথার মধ্যে আমাদের থাকতে দেয়নি, কিন্তু আড়ালে আবডালে ঘুরঘুর করে যেটুকু শুনেছি, আজও মনে আছে। মা বলেছিল, “আপনার স্ত্রী তো আদর্শ ধর্মপত্নী। এই যে আপনি সারারাত জেগে এইসব করেন দিনের পর দিন, উনি তো আপনাকে সব গুছিয়ে দেন, সব রকম ভাবে সাহায্য করেন।” তখন কাকু বলল, “তা তো করবেই। আগের জন্মে ওকে মায়ের চরণে বলি দিয়েছিলাম। সেই পুণ্যে এই জনমে মায়ের পুজোর কাজ করছে। তবে ওর খুব রাগ, একেবারে পশুর মতো। আগের জন্মের চিহ্ন ওর শরীরেই আছে। ওর ডান হাতের কনুইয়ের পিছনে কখনো দেখে মিলিয়ে নেবেন। আমার এই চাকরি ফাকরি সব বাহ্য। লোকদেখানো। আমার আসল কাজ আগের জন্মের অসম্পূর্ণ সাধনাকে সম্পূর্ণ করা।” এই কথা শোনার পর আমাদের কি আর তর সয়? ছুতোনাতা করে বাবাইদের ঘরে গিয়ে ‘কাকিমা জল খাব’ বলে টলে তার ডান হাত লক্ষ্য করলাম, বিশাল একটা কালো জড়ুল, ঠিক যেন এক খণ্ড ছাগলের চামড়া কেটে বসানো! ওরা আমাদের পাড়ায় বেশিদিন থাকেনি। দুয়েক বছর পরেই ট্রান্সফার হয়ে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল।
(ক্রমশ)
0 Comments