জ্বলদর্চি

সত্যজিৎ রায়ের বিশ্বশ্রী গুণময় বাগচী ওরফে মলয় রায়-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বাগতা পাণ্ডে


সত্যজিৎ রায়ের বিশ্বশ্রী গুণময় বাগচী ওরফে মলয় রায়-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বাগতা পাণ্ডে


স্বাগতা  পাণ্ডে — জয় বাবা ফেলুনাথ এর ফেলুদা কে নকল করে বলি, আপনার নাম শুনেছি কিন্তু চাক্ষুষ দেখা হয়নি। এখনো কি আপনার বাইসেপ সতেরো এণ্ড হাফ ?

মলয় রায় -- (প্রাণখোলা হাসি) আগে তাই ছিল এখন ৭৬ বছর বয়েস, সামান্য একটু পরিবর্তন হয়েছে বৈকি।

স্বাগতা -- কোন নামে মানুষ বেশি চেনে আপনাকে ? মলয় রায় না গুণময় বাগচী ? 

মলয় রায় -- এখনো রাস্তায়, বাজারে লোকজন গুণময় বাগচী, গুণময়দা, গুণময় বাবু বলেই ডাকাডাকি করে (আবার প্রাণখোলা হাসি) 

স্বাগতা -- আপনার বাবা ছিলেন অত্যন্ত বিখ্যাত একজন মানুষ। মিঃ ইউনিভার্স মনোতোষ রায়। আপনি কি ছোট বেলা থেকেই শরীর চর্চার সাথে যুক্ত ছিলেন ?

মলয় রায় -- বাবা বিশ্বশ্রী ছিলেন, আর আমাকে বিশ্বশ্রী গুণময় বাগচী বানিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। আমি আসলে মিঃ এশিয়া,এবং অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত। বাবা ছোটবেলা থেকেই অনেক চেষ্টা করেছিলেন বিভিন্ন ক্লাবে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য, সুইমিং বা শরীর চর্চা করার জন্য। কিন্তু আমি প্রতি বার ই দু-এক মাস করতাম তারপর ছেড়ে দিতাম। এছাড়া ও বাড়িতে বাবা অভ্যাস করিয়েছিলেন স্নান করার আগে গায়ে তেল মাখা নানান ধরনের ম্যাসাজ করা। তো এই রকম করতে করতেই একটু বড় হবার পর আয়নায় দেখলাম নিজের শরীরের একটু পরিবর্তন হয়েছে। আমি আগে খুব রোগা ছিলাম। তো এই ভাবে ই একদিন দেখলাম যে চেহারার একটা পরিবর্তন হয়েছে, মানে শরীরের মাসল গুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে, তারপর থেকেই আমার শরীরের উপর একটা যত্ন এসে গেলো আর তারপর থেকেই শরীর চর্চা শুরু করে দিয়েছি, আর শেষ করতে পারিনি (হাসি) এখন ৭৬ ।

স্বাগতা -- জয় বাবা ফেলুনাথ এর সময় আপনার বয়স তাহলে কত ছিল ? 

মলয় রায় -- তখন ২৪ , ২৫ হবে।

স্বাগতা -- আপনার সাথে সত্যজিৎ রায়ের যোগাযোগ কি ভাবে হয়েছিল ? 

মলয় রায় -- আমার বাবার কাছে ফিল্ম জগতের অনেকেই আসতেন। যেমন উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার বাবার কাছে যোগাসন শিখতেন। একদিন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার বাবাকে ফোন করে বললেন যে "মনোতোষ দা সত্যজিৎ রায় ওর সিনেমার জন্য একজন ব্যায়াম বীর ছেলে চাইছে, আপনার ছেলে তো বডিবিল্ডিং করছে, চ্যাম্পিয়ন ও হয়েছে, খবরে দেখলাম মিঃ এশিয়া ও হয়েছে, তো ওকে বলুন না যে সত্যজিৎ রায় এর সাথে একবার দেখা করতে"। বাবা আমাকে বললেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে ফোন করতে। আমি সৌমিত্রদা কে ফোন করে বললাম, এত বড়ো মাপের লোক এর সাথে দেখা করতে যাব কিন্তু আমি তো অভিনয় এর কিছু ই জানি না। জীবনে কোন দিন স্কুল কি কলেজ কোথাও অভিনয় করিনি, তাহলে কি করে কি করব। তখন সৌমিত্র দা বললেন তুই চল না । তারপর সৌমিত্রদা  ই আমাকে নিয়ে গেল সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে।  ওনার বাড়িতে গিয়ে দেখি, গোটা ঘরে শুধু বই আর বই,বই এর পাহাড় । মাঝখানে আরাম চেয়ারে বসে সত্যজিৎ রায় বই পড়ছেন। উনি আমাদের দিকে পেছন করে বসে ছিলেন। ঘরে ঢুকেই সৌমিত্রদা বললেন আমি মলয় কে নিয়ে এসেছি। সত্যজিৎ বাবু সাথে সাথেই বললেন "হ্যাঁ মলয় বসো বসো" ।   তখন চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে উনি বললেন " মলয় তুমি সব শুনেছো তো ? "  আমি তখন বললাম হ্যাঁ শুনেছি, কিন্তু আমি কি পারব ? আমি তো কোনদিন নাটক বা অভিনয় করিনি। শুনে উনি বললেন "কোন চিন্তা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তো আছি, আর সৌমিত্র আছে সন্তোষ দত্ত আছে, কোন চিন্তা নেই, সব ঠিক ঠাক হয়ে যাবে। আমি তখন বললাম , আপনার সাথে থাকতে পারব এটাই আমার কাছে সব থেকে বড় ব্যাপার।  আমি তারপর ওনার ঘর টা খুব ভালো করে দেখছিলাম  , তারপর আমি বললাম, এখানে আমি তো আপনার একটাও প্রাইজ দেখতে পাচ্ছি না, ওগুলো দেখার আমার খুব ইচ্ছা।  তখন উনি বললেন " মলয় এখানে আমি কোন প্রাইজ রাখিনি, সব ব্যাঙ্কের লকারে রেখে দিয়েছি" । ওনার কোন প্রাইজ আমার আর দেখা হলো না, এটা আমার কাছে খুব দুঃখজনক ব্যাপার। তারপর উনি বললেন যে "আমি তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট লিখে দিচ্ছি, এটা তুমি বাড়িতে অভ্যাস করো"। 

স্বাগতা -- আপনার কাছে  সত্যজিৎ রায়ের লেখা স্ক্রিপ্ট এখনো আছে ? 

মলয় রায় -- হ্যাঁ, এটা আমার কাছে অতি মূল্যবান পরম সম্পদ। আমি জি- বাংলার চ্যানেল ও ওটা নিয়ে গেছলাম। সবাই ওটা মাথায় তুলে প্রনাম করেছিল।

স্বাগতা -- পরবর্তী সময়ে আপনি আর কখনো সিনেমায় অভিনয় করার কথা ভাবেননি। 

মলয় রায় -- না আমি আর কখনো কোন ফিল্মে অভিনয় করিনি।  তবে কয়েক জায়গায় চেষ্টা করেছিলাম, তবে ফিল্ম জগতে দেখেছি অন্য রকম রাজনীতি চলে, ওখানে আমি ঠিক মানাতে পারিনি। সত্যজিৎ রায় এর সাথে কাজ করার সময় দেখেছি, ওটা একটা অন্য রকম ব্যাপার। ওনার ব্যাবহার একদম আলাদা সবার থেকে। ওনাকে আমি রাগ করতে দেখিনি। উনি নতুন নতুন মুখ আনতেন, সবাই কে খুব ভালো ভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতেন। ওনার ব্যাপার টা ই অন্যদের থেকে আলাদা। সব থেকে বড় কথা, উনি আমাকে বুঝতেই দেননি যে আমি শুটিং করছি। তবে সৌমিত্রদা , সন্তোষ দত্ত ও আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন অভিনয় করার সময়। সত্যজিৎ রায়ের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা টাই আলাদা।

স্বাগতা -- সত্যিই কি আপনার আঙ্গুল মচকে গিয়েছিল শুটিং চলার সময় ? 

মলয় রায় -- হ্যাঁ ( হাসি ) আসলে ওয়েট তোলা আর মানুষকে তোলা দুটো তো একরকম না, আলাদা।  (হাসতে হাসতে) আমি সন্তোষ দত্ত কে কোমর ধরে তুলছি, কোমরে হাত দিলে এমনিই কাতুকুতু লাগে। আর সন্তোষ দত্ত মোটাসোটা লোক, প্রথম বার সন্তোষ দত্ত কে তোলার সময় উনি ছটফট ছটফট করছিলেন, আর ব্যাস আমার ও আঙ্গুল মচকে গেল তোলার সময়।  সেটা অন্যরা যখন বুঝতে পারলো তখন সন্দীপ রায় তাড়াতাড়ি বরফ নিয়ে এলেন, বরফ- টরফ লাগানোর পর আবার শুটিং শুরু হলো, সেই টেক এই আমি সন্তোষ দত্ত কে তুলে ফেললাম (হাসি) 

স্বাগতা --  শরীর চর্চার বাইরে অন্য কিছু করেছেন কখনো ? 

মলয় রায় -- চাকরি করতাম। প্রথমে ইনকাম ট্যাক্স এ ছিলাম, তারপর একসাইজ ডিপার্টমেন্ট এ, আর তারপর ইছাপুর গান ফ্যাক্টরি তে। সবটাই অবশ্যই স্পোর্টস এর কোটায়। ইছাপুর এ থাকার সময় ই আমাকে একবার বদলী করে দেয় কানপুর এ। ওখানে আর যাইনি। চাকরি ছেড়ে দিলাম, তারপর যে টুকু যা সঞ্চয় ছিল সেটা দিয়ে জিম খুললাম।

স্বাগতা -- এখন বর্তমান এ কি ভাবে শরীরচর্চা করেন ? 

মলয় রায় -- আমার একটা জিম আছে, আমার বাড়ির কাছাকাছি ই, সারাদিন ওটা নিয়ে ই থাকি। আমার স্ত্রী মারা গেছেন  , আমার একমাত্র মেয়ের ও বহু বছর হলো বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আমি একাই থাকি, জিম টা চালাই, ওটা নিয়ে ই থাকি।

স্বাগতা -- এখনো আপনি আগের মতো ই স্বাস্থ্য ধরে রেখেছেন, এখনো নিয়মিত বডিবিল্ডিং করেন ? আর ডিসিপ্লিন ও এক ই রেখেছেন ? 

মলয় রায় -- (হাসতে হাসতে) হ্যাঁ, সেটা তো আছেই। চেষ্টা করি, ওই আর কি। জিমটাই এখন আমার সবকিছু। তবে যা কিছু করেছি , সবটাই নিজেই  করেছি, সরকার থেকে কোন সাহায্য পাইনি। 

স্বাগতা --- আপনার একটা জীবনী বেরিয়েছে।

মলয় রায় -- হ্যাঁ। পবিত্র মুখার্জি লিখেছেন। বই টার নাম " সত্যজিতের বিশ্বশ্রী মলয় রায়" ।

স্বাগতা --- বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করে আজ আপনি বিখ্যাত, এই বিষয় টা আপনার কেমন লাগে ? 

মলয় রায় -- এটা আমার কাছে সত্যি ই খুব গর্বের বিষয়। লাইক ফাদার লাইক সান হবার সৌভাগ্য সবার হয় না, কিন্তু আমার হয়েছে। আমি সত্যিই খুব গর্বিত। আর তাছাড়া সত্যজিৎ রায় এর মতো মানুষের সাথে কাজ করতে পেরেছি এবং ওই একটা পরিচয় এ এখনো পর্যন্ত আমি পরিচিত, এটাও আমার কাছে পরম সৌভাগ্যের। আজ আমি অর্জুন মলয় রায়। এই দুজন মানুষের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments