জ্বলদর্চি

বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যাসাগর / প্রসেনজিৎ রায়

বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যাসাগর
           
প্রসেনজিৎ রায় 

              
১৮৫৪ সাল। ব্রিটিশ শিক্ষা পরিষদের অন্যতম সদস্য ফ্রেডারিক জে হ্যালিডে তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এক শিক্ষাবিদকে বললেন, আপনি বাংলা শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করুন। হ্যালিডে জানতেন এর আগেও বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লিখিত বিবৃতি এই তেজস্বী অধ্যাপকের কাছ থেকে পেয়ে, ব্রিটিশ প্রশাসন যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে। হ্যালিডে যখন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের সাথে  কিছুদিন যুক্ত ছিলেন, তখন থেকেই তিনি এই তেজস্বী শিক্ষাবিদের গুণমুগ্ধ।

কৃতি সিভিলিয়ান ফ্রেডারিক জে হ্যালিডে ১৮৫৫ সালে বাংলার গভর্ণর হয়েছিলেন, আর তাঁর অত্যন্ত পছন্দের মানুষটি আর কেউ নয়, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।‌ 

হ্যালিডে সাহেবের ভরসার মর্যাদা রেখে অত্যন্ত যথাযথ একটি প্রতিবেদন ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে জমা দেন এবং এই হ্যালিডে সাহেবের জোরালো সুপারিশেই বাংলার নির্দিষ্ট জেলাগুলিতে বাংলা মডেল স্কুল স্থাপন ও পরিদর্শনের দায়িত্ব ১ মে, ১৮৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্রকে দক্ষিণ বাংলার বিদ্যালয়গুলির সহকারী পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত করা হয়। এই অতিরিক্ত দায়িত্বের জন্য তাঁকে অতিরিক্ত বেতনও দেওয়া হল-দু'শ টাকা অর্থাৎ তাঁর মোট বেতন হল (৩০০+২০০) পাঁচশ টাকা। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি ৩০০ টাকা বেতন পেতেন। বিদ্যালয় পরিদর্শনের কাজটি ছিল তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্ব, যাকে পরিভাষায় বলা যায়, "অ্যাডিশনাল চার্জ"। হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর এবং নদীয়া জেলাগুলি স্পেশাল ইনস্পেক্টর ঈশ্বরচন্দ্রের অধীন ছিল।
🍂

স্কুল পরিদর্শক হিসেবে  তার অধীনে থাকা চারটি জেলায়  চারজন ডেপুটি স্কুল পরিদর্শক কাজ করতেন।  তাঁরা হলেন, হরিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধবচন্দ্র গোস্বামী, তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য এবং দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন।

নতুন দায়িত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যাসাগর সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিটা জেলায় একটি করে  মডেল স্কুল
থাকবে, যেগুলির পরিচালন-বিধি ও পঠনপাঠন ব্যবস্থাকে আদর্শ ধরে নিয়ে, সেই জেলার অন্যান্য স্কুলগুলি পরিচালিত হবে। উন্নতমানের এই বিদ্যালয়গুলিতে পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষক 
পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই শিক্ষকদের জন্য  শিক্ষণব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব দিতে হয়। 

১৮৫৫ সালের জুলাই মাসে সংস্কৃত কলেজ ভবনেই একটি নর্মাল স্কুল চালু করা হয় যার  প্রধানশিক্ষক নিযুক্ত করা হয় অক্ষয়কুমার দত্ত-কে।

স্পেশাল ইনস্পেক্টর পদটা যথেষ্ট মর্যাদার। দেশের একমাত্র বিদ্যালয় পরিদর্শক পদ। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে মর্যাদা বা সন্মানের প্রতিশব্দ হলো কঠোর পরিশ্রম। তাই বোধহয় সংস্কৃত কলেজে গরমের ছুটি পড়লে ( এই ছুটিও আবার তাঁরই চালু করা) চরম গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে  বিদ্যাসাগর সম্ভবত পদব্রজেই গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করেছেন। শিক্ষা অধিকর্তার কাছে পাঠানো তাঁর একটি প্রতিবেদন থেকে এ কথা জানা যায়। 

তাঁর দেওয়া সেই প্রতিবেদনে ২১ শে মে তারিখে কলকাতা থেকে  শিয়াখালা, ২২মে তারিখে কলকাতার ৪০ মাইল পশ্চিমে রাধানগর ও কৃষ্ণনগর গ্রাম, 
২৪ মে তারিখে ৬০ মাইল দূরবর্তী ক্ষীরপাই শহর এবং সেখান থেকে চন্দ্রকোণায় ভ্রমণের কথা নথিবদ্ধ রয়েছে। তিনি কামারপুকুর, মায়াপুর, মলয়পুর গ্রাম এবং  নদীয়া, বর্ধমান ও ২৪ পরগণা জেরাগুলিতেও বিদ্যালয় স্থাপনের কাজে ভ্রমণ করেন। তাঁর বিদ্যালয় পরিদর্শন এখনকার মতো "স্কুল দেখতে যাওয়া" নয়, স্কুল স্থাপন করার পরিস্থিতি রয়েছে কি না তা নিরীক্ষণ করতে যাওয়া। এই উদ্দেশ্যে তিনি সাধারণ গ্রামবাসীদের সাথে  সরাসরি সংস্পর্শে এসে  নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলে মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে ২০ আগস্ট ১৮৫৫ থেকে ১৪ জানুয়ারি, ১৮৫৬  কুড়িটি মডেল স্কুল স্থাপন করেন।

এই বিদ্যালয় (মডেল স্কুল) স্থাপনের জন্য বিদ্যাসাগর যে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে কাজ করেছেন, তা ব্যাখ্যার অতীত। 

নদীয়া জেলার বেলঘোরিয়া, মহেশপুর, ভজনঘাট, কুশদহ ও দেবগ্রাম বর্ধমানে আমাদপুর, জৌগ্রাম, খণ্ডঘোষ, মানকর ও দাঁইহাট হুগলীতে হারোপ, শিয়াখালা, কৃষ্ণনগর, কামারপুকুর ও ক্ষীরপাই এবং মেদিনীপুরে গোপালনগর, বাসুদেবপুর, মালঞ্চ, প্রতাপপুর, ও জকুশুরে তাঁর প্রচেষ্টায়  বিদ্যালয়গুলি স্থাপিত হয়। এই বিবরণীর স্থানগুলি  যদি এখনকার জেলার সাথে মিল না পাওয়া যায় তবে অবাক হওয়া চলবে না, কারণ তখন ঈষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্তিম যুগ- বিদ্যাসাগরের জন্মগ্রাম বীরসিংহ-ই ছিল হুগলি জেলার অধীন।

পরবর্তীকালে সাথে বিদ্যাসাগর  ডাইরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন গর্ডন ইয়ং-এর 
সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন এবং
প্রশাসনিক চক্রান্তের শিকার হন। অতিরিক্ত বিবরণী এড়িয়ে গিয়ে এটুকু বলা যায়, ভারতের প্রথম ডি পি আই গর্ডন ইয়ং যেভাবে বিদ্যাসাগর বালিকা বিদ্যালয়গুলি দ্রুত প্রতিষ্ঠা করে ফেলছিলেন, তা মেনে নিতে পারছিলেন না, হয়তো তিনি বুঝতে পারছিলেন, ভারতের, বিশেষ করে বাংলার মেয়েরা যতো লেখাপড়া শিখবে, ভবিষ্যতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের রাশ ততটাই আলগা হতে থাকবে। বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যাসাগরের সাথে অতএব শিক্ষাবিভাগের শীর্ষ অধিকর্তার বিরোধ শুরু হল আর অবশেষে জয় হল বীরসিংহের সিংহশিশুর-ই। কারণ সরকারী গ্র্যান্টের তোয়াক্কা না রেখে তিনি নিজ-খরচে তখন বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে ফেলেছেন। 

বিদ্যালয় পরিদর্শন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের বৃত্তি নয়, ব্রত ছিল। মাত্র তিন বছর পাঁচ মাস দক্ষিণবঙ্গের এই স্পেশ্যাল ইনস্পেক্টর পদ-টি তাঁকে ধরে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু বাংলার শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর পরশ সর্বক্ষেত্রে পেয়ে চলছিল। 

আজ আমরা শিক্ষার অধিকার আইনের কথা বলি। মেনে চলারও চেষ্টা করি। প্রবল ইচ্ছা হলেও মারকুটে শিক্ষক ছাত্রদমন করে হাতের সুখ করা থেকে বিরত থাকেন, সেকথা আলাদা। কিন্তু বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসাবে বিদ্যাসাগর-ও ছাত্রদের প্রহার করার পক্ষে ছিলেন না, বিদ্যালয় পরিদর্শনের একটি বিশেষ ঘটনা থেকে তা প্রমাণ হয়।

তখনকার দিনের পাঠশালায়  নানারকম দৈহিক শাস্তি ও মানসিক নির্যাতনের ঢালাও ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু সরকারি স্কুলে এইধরণের প্রহার বা শাস্তি অন্তত আইনত বৈধ ছিল না। বিদ্যাসাগর স্বয়ং তাঁর  একটি রিপোর্টে এই কথা লিখেছেন।

নাবালক জমিদারদের জন্য স্থাপিত  হয় ‘ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন’ নামে একটি স্কুল। এটি একটি আবাসিক একটি  বিদ্যালয় ছিল অর্থাৎ এখানে ছাত্রদের থাকতে হতো।

 ব্যবস্থাপক সভার এক আইন মোতাবেক ১৮৫৬ সালে চিৎপুরে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। পরে যখন মানিকতলায় শ্রীকৃষ্ণ সিংহের বাগানে স্কুলটি উঠে আসে তার ডিরেক্টর-এর দায়িত্ব পান রাজেন্দ্রলাল মিত্র। প্রতিষ্ঠানের  কাজকর্ম তদারকের জন্য নিযুক্ত হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং  আরও চার বিদ্যালয় পরিদর্শক। 


বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যাসাগর তাঁর বিভিন্ন প্রতিবেদনে বিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রহার করা ও শাস্তি দেওয়া বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, নিজের সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে থাকলে এমন শিক্ষাচিন্তার প্রবক্তা হওয়া যায় ।

যারা ভবিষ্যতের জমিদার হবে  তাদেরও কিন্তু প্রহার থেকে রেহাই ছিল না। বেত্রাঘাতের মাধ্যমে সমঝে দেওয়ার রীতি বিদ্যাসাগরের পছন্দ ছিল না। অগত্যা তিনি বেত্রাঘাত-এর রেজিষ্টার চেক করে দেখলেন, অনেক ক্ষেত্রেই এই সংশোধনমূলক ব্যবস্থার অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। 

নিজের প্রতিবেদনে বিদ্যাসাগর এই প্রহার-ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করার কথা বললেন। তাঁর যুক্তি ছিল,  অন্য সরকারি স্কুল যদি  বেত ছাড়াই চালানো যায় তাহলে ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন-ও চালানো যাবে।  

তিনি লেখেন, প্রহার পড়ুয়াদের সংশোধন করে না, বরং তাদের মনোবল আর আত্মবিশ্বাস চিরতরে হরণ  করে। বিদ্যাসাগর বললেই যে সবাই মেনে নেবেন, বাঙালী এমন জাত নয়। ঐ ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন-কেন্দ্রিক নানা প্রস্তাব মানুন আর না মানুন, ছাত্রদের প্রহারের রীতি বন্ধ করতে রাজি হলেন না রাজেন্দ্রলাল মিত্র। আর বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যাসাগর ? শিক্ষানীতি ও ছাত্র-সুরক্ষার প্রতি এই অবহেলায় ব্যথিত হয়ে তিনি এই পরিদর্শকের পদ থেকেও  পদত্যাগ করেন।

(  আজ ২৯ শে জুলাই পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র  বিদ্যাসাগর-এর ১৩৫-তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর চরণে  শ্রদ্ধাঞ্জলি )

Post a Comment

1 Comments

  1. Pradyut Kumar BiswasJuly 29, 2025

    বিদ্যালয় পরিদর্শক বিদ্যাসাগর / প্রসেনজিৎ রায়
    এই গবেষণামুলক প্রতিবেদনটি আমাদের সমৃদ্ধ করেছে । গবেষক শিক্ষানুরাগী শিক্ষাব্রতী লেখক মহাশয়কে অজস্র ধন্যবাদ ও সশ্রদ্ধ প্রণাম।

    ReplyDelete