জ্বলদর্চি

আত্মসমীক্ষা:অসিতরঞ্জন ঘোষ

আত্মসমীক্ষা :অসিতরঞ্জন ঘোষ


হে মানুষ,
চল, ঘুরে আসি সেই সময়ে, সৃষ্টির শুরুতে।
যখন ভালোবাসার এ পৃথিবীর জন্ম হয়নি।
যখন মহাকাশে চলছে সেই রহস্যময়তা।
সময় হয়নি পরিমিত।
কী অভাবনীয় গতিময়তায় হাজারো অযুত নীহারিকা,
পুঞ্জে পুঞ্জে আকাশ-গঙ্গায় প্রস্ফুটিত হচ্ছে!
কী আশ্চর্যের সেই বিরামহীন অসম্ভব সব ঘটনা।
ঘটে গেছে, যখন এই সৌরজগৎ, এই গ্রহাবলী, এই নক্ষত্রপুঞ্জ,
সব, সব কিছু কেমন আধিদৈবিক, আদিভৌতিক অবিশ্বাস্য, রহস্যময়!
শত সহস্র কোটী বর্ষ আগে ঘটে গেছে সেই মহাজাগতিক রচনা,
মহাকাশে সে কী প্রলয়-বিলয়! 
মনে করো, সময় নিরিখে সে সব বিস্ময় উন্মোচিত হোল,
উন্মোচিত হোল প্রায় চোদ্দ ঘন্টা আগে!
মহাশক্তির অদ্ভুত প্রস্ফুরণ! মহাজাগতিক সে মহাবিস্ফোট!
তরঙ্গিত আলোকরশ্মির তেজোময় প্রহেলিকা!
মহা সমারোহে চলে আলোকবর্ষের গতিশীলতায় উল্কাপাত!
মহাজাগতিক প্রলয় লীলায় সময় সামিল, জন্ম হোল তাঁর।
🍂

এরই মধ্যে কেটে গেছে নয় ঘন্টা!
মহাতান্ডবের মাঝে সে অপরিসীম বিস্ময়- সৌরশক্তির প্রকাশ।
সৃষ্ট হোল সৌরমন্ডল!
আদিকণায় মন্ডিত প্রকাশ জগত! অস্থির, তপ্ত লাভায় অতৃপ্ত!
দুরন্ত ঘূর্ণিপাকে আছড়ে পড়ছে বার বার, সহস্র- নিযুত- কোটি বার,
সময়ের মাপকাঠিতে অপরিমেয় সে অস্থিরতা!
গ্রহ-গ্রহান্তরে নিবিড় বোঝাপড়ায় গড়ে উঠছে সূর্যের সংসার!
জন্ম নিচ্ছে আমাদের ভালোবাসার পৃথিবী-
কিন্তু এ কী! এতো অগ্ন্যুৎপাতের গলিত লাভায় অভিসিক্তা,
নবজন্মা পৃথিবী, রক্তিমা, বনহিশিখায় চর্চিতা, লাজবন্তিকা,
অভূতপূর্বা, আলোকময়ী, রণচণ্ডী, দীপান্বিতা- আমাদের বসুন্ধরা।
এরই মধ্যে অতিবাহিত হোল আরও এক ঘন্টা! রইলো চার!
সদ্য-জন্মা ধরিত্রি তপ্ত আভায় অভিসিক্তা বসুমতী হোল স্থির। 
এখন সে সুশীলা, সুরমা, সুধীরা, শিশু, সুষমা ধরনী। 
গলিত লাভার কর্দমে অপরিমেয় আকর্ষণে- বিকর্ষণে
সৃষ্টি হোল টেথিস মহাসমুদ্র। 
নবজন্মা পৃথিবীর ক্রোড়ে তখন অদ্ভুত প্রসব বেদনা।
মথিত- স্থলিত হলো পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু। অন্তর হোল বিচলিত।
স্থলে-জলে-বায়ুতে সঙ্ঘটিত হোল মহাজাগতিক বিস্ময়!
অন্তরস্থল হোল কম্পিত, ঘর্ষণ হোল আশু গঠনে।
এক ধাক্কায় টেথিস হোল স্থানান্তরিত। 
সৃষ্ট হোল বিশ্বের বিস্ময়-হিমালয়! আরও কত শত পাহাড়- পর্বত।
বায়ুর কম্পনে, জাগতিক জলোচ্ছ্বাস ও ভুমিকম্পে জন্ম নিল উপলখন্ড, 
দ্বীপ, দ্বীপমালা, শুষ্কভুমি, হৃদ, জলাভূমি! 
আরো সম্পূর্ণা হলেন সাগরকন্যা হয়ে। 
সৃষ্ট হোল মহাসাগর-নদ-নদী-উপনদী।
সৃষ্টির কৃষ্ণবর্ণ ধোঁয়ায় আকৃতি পেল মেঘ, বৃষ্টি, বজ্র।
অন্তঃসলিলা ধরিত্রি হলেন সম্পৃক্তা। সৃষ্টি হোল তিন ভুবনের।
আমাদের ধরনী মা তৈরি হচ্ছেন সন্তান প্রতিপালনের সন্ধিক্ষণে!
মহাকাশে তখন অযুত তারা-নক্ষত্র- গ্রহ- উপগ্রহের সমারোহ। 
দিন-রাত্রির বিস্ময়কর ক্রিড়া, সাথে চন্দ্রের গতায়াত।
অমাবস্যা- পূর্ণিমা, গ্রহন। অন্যান্য গ্রহপুঞ্জের নিয়মিত আবর্তন।
বাতাসে এখন প্রানবায়ুর সঞ্চালন অনুভূত। 
সমুদ্র-কল্লোলে সূর্য- রস্মির অবাধ মেলামেশা।
কেটে গেল আরো এক ঘন্টা। রইলো হাতে তিন!
কালের প্রবাহে সমুদ্র- গর্ভগৃহে সৃষ্টি হোল প্রথম প্রাণের।
তা এখন থেকে মাত্র ঘণ্টা তিনেক আগে।।
প্রাণের জন্য অবসম্ভাবী প্রাণবায়ু এসে আরো প্রান-সম্ভবা করে তুললো-
ধরনী বিচিত্র প্রাণ সম্ভারে সিদ্ধ হলেন মাত্র দু ঘন্টা আগে। রইলো হাতে দুই।
জীবনের ঘড়িতে সরল প্রাণ, আণুবীক্ষণিক প্রাণের সঞ্চার হোল।
ঐ দেখ, ঘন্টাখানেক আগে সমুদ্রের অতল থেকে সূর্যালোকের পরশে
জলধির কন্দরে কন্দরে জাত হচ্ছে নতুন নতুন প্রাণ,
জলকেলিতে জীবন আন্দোলিত হতে শুরু করেছে!
অদেখা-দেখা সব জীবন কেমন যেন বিবর্তিত হতে শুরু করেছে।
শত-সহস্র-কোটি-কোটি প্রাণের সমারোহ, 
আকার ও রঙের বিভিন্নতায় বিপুল-বিশাল এই জলধি পরিপূর্ণ।
এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
সৃষ্ট জীব সমুদ্রের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল ভু-খন্ডে, দ্বীপে, দ্বীপান্তরে।
সরল জীবন প্রকৃতির পরিমন্ডলে হোল পরিশীলিত ও জটিল।
ক্ষুদ্রতম হোল ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র হোল বৃহৎ, বৃহত্তর।
সমুদ্রের গর্ভ থেকে হিমালয়ের চুড়ায় হরেক জীব হোল বিস্তৃত।
সবুজ ঘাসের আবরনে ধরনী হোল সম্মানিত। 
বনানী ছেয়ে গেল পৃথিবীর পরিমন্ডলে। আর রইলো মাত্র এক মিনিট
নবপল্লবে, পুষ্প- স্তবকে, মঞ্জরীতে রেনুর ঘ্রানে ধরনী হলেন সজ্জিতা!
ভুধর হয়ে উঠলো জীবকুলের বাসভূমি।
এই কুড়ি সেকেন্ড আগে এলো বৃহত্তম জীব ডাইনোসর, তিমি, মেটাসিকোয়া-
ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ মরুঝড়, তুষার ঝড়ে প্রতিষ্ঠিত প্রাণ প্রায় নিশ্চিহ্ন,
তবু জীবন ত্রান পেল।
মাত্র দশ সেকেন্ড হল, এলো চতুস্পদী, খেচর।
পাখীদের কুজন, বাতাসের নিক্কন, সমুদ্রের গর্জন তখনও ভাষা পাইনি।
আকাশের রামধনু বা ঝর্নার নৃত্য বা অস্তমিত সূর্যের সে শোভা,
সবই তখনও অনাস্বাদিত। অনাবৃত, অনাদৃত।
এই পাঁচ সেকেন্ড আগে বিবর্তিত চতুস্পদ রূপ হলো দ্বিপদী।
মানুষ, তুমি এলে বিবর্তনের পথে তিন সেকেন্ড আগে।
স্বাবলম্বী হতে আরো কিছু সময় গেলো। 
প্রকৃতির ভয়ে গাছের কন্দরে, পাহাড়ের গুহায় বাস খুঁজে নিলে।
পাথর কেটে তৈরি করলে বল্লাম, বর্শা, পরে আগুন জ্বালাতে শিখলে।
ছড়িয়ে পড়লে সারা বিশ্বময়!
আবিষ্কার করলে চলমান চাকার। 
অবিরাম বাঁচার সংগ্রাম করতে করতে থিতু হলে সমুদ্রবেলায়, নদী অববাহিকায়।
চাষ শিখলে, ঘর বাঁধলে। সমাজ গড়লে। গড়লে গ্রাম । শহর গড়লে।
পৃথিবীর দানকে করলে অবহেলা। অহংবোধে প্রকৃতিকে দাস করতে চাইলে।
এরপর মননিবেশ করলে রাজপাটে, 
হিংস্র- পাশবিক চেতনায় পৃথিবী সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব নিকৃষ্টতার পরিচয় দিলে পলে পলে। 
সভ্যতার প্রাচীন সেই আঁতুড় ঘর যা শুরু হয়েছিলো দশমিক তিন সেকেন্ড আগে,
সেখান থেকে দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে আজ এই একবিংশ শতকের মানুষ-
তোমার উপস্থিতি মাত্র সেকেন্ডের এক শতাংশ।
কত অহঙ্কার তোমার! সত্যি!

Post a Comment

0 Comments