জঙ্গলমহলের লোকগল্প
বাঘ ও সিংহের লড়াই
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক- বিশ্বনাথ দাস, গ্ৰাম- ডুমুরিয়া, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম
অনেকদিন আগের কথা। একদিন এক বনমুরগি খাবারের খোঁজে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সে দেখে তার সামনে একটা শেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। শেয়ালকে দেখে মুরগি দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এদিকে মুরগিকে দেখে শেয়ালের জিভে জল চলে আসে। এরপর শেয়াল মুরগিকে তাড়া করে। এদিকে মুরগি শেয়ালের ভয়ে দৌঁড়াতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ শেয়াল মুরগির পেছন থেকে সামনে চলে আসে।
তখন মুরগি শেয়ালকে বলে-“এই শেয়াল তুই আমার রাস্তা আটকেছিস কেন? আমার সামনে থেকে সরে যা, আমি আমার বাসায় যাব।”
শেয়াল বলে-“না রে বনমুরগি তোকে আমি আজ বাসায় যেতে দেব না। আজ আমি তোকে খাব।”
তখন বনমুরগি বলে-“এইসব তুই কী বলছিস? তুই জানিস না যে এই জঙ্গলের কেউ কারোর প্রাণ নিতে পারবে না। তুই সিংহ মহারাজের হুকুম শুনিস নি। তুই কী সিংহ মহারাজের হুকুমকে অমান্য করছিস?”
শেয়াল তখন বলে-“রাখ তোর সিংহ মহারাজের কথা। আমি যদি তোকে খেয়ে ফেলি তাহলে সিংহ মহারাজ জানবে কী করে, আর তুই যদি মারা যাস তাহলে সিংহ মহারাজকে বলবেই বা কে?”
এইসব শুনে মুরগি ভয় পেয়ে যায়। তখন সে চেঁচাতে থাকে।
মুরগি চিৎকার করে বলে-“কে আছ আমাকে বাঁচাও গো। এই পাজী শেয়াল আমাকে খেয়ে ফেললো গো, দয়া করে আমাকে কেউ বাঁচাও।”
তখন শেয়াল বলে-“হা হা হা, কেউ আসবে না তোকে বাঁচাতে। এই নির্জন জায়গায় কেউ তোকে সাহায্য করবে না। আজ আমি তোকে খাবই। আজকে আমার হাত থেকে কেউ তোকে বাঁচাতে পারবে না।”
হঠাৎ সেই সময় সেখানে ভাল্লুক চলে আসে। আর ভাল্লুককে দেখে শেয়াল ভয় পেয়ে যায়।
তখন শেয়াল মুরগিকে বলে-“আজ তুই ভাল্লুকের জন্য বেঁচে গেলি। কিন্তু একদিন না একদিন তোকে আমি খাবই।”
এই শুনে ভাল্লুক শেয়ালকে তাড়া করে। আর ভাল্লুককের তাড়া খেয়ে শেয়াল সেখান থেকে চলে যায়।
এরপর ভাল্লুক মুরগিকে বলে-“কী রে মুরগি, শেয়াল কী তোকে খেতে চাইছিল?”
তখন মুরগি বলে-“হ্যাঁ, ওই পাজী শেয়াল আমাকে খেয়ে চাইছিল। তুমি যদি সময়মতো না আসতে তাহলে যে কী হতো কে জানে? ওই পাজী শেয়াল আমাকে খেয়েই ফেলত।”
ভাল্লুক বলে-“এবার থেকে তুই একটু সাবধানে চলাফেরা করিস।”
তখন মুরগি বলে-“আমি তো সাবধানেই চলাফেরা করি। কিন্তু সে বলেছে আমাকে যদি কখনো একা পায় তাহলে খেয়ে ফেলবে। এখন আমি কী করব বলো তো?”
ভাল্লুক তখন বলে-“আরে তুই কোনো চিন্তা করিস না। তুই সিংহ মহারাজের কাছে গিয়ে শেয়ালের নামে নালিশ কর। সিংহ মহারাজ নিশ্চয়ই এর কোনো না কোনো একটা বিহিত করবেন।”
মুরগি বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে আমি তাহলে সিংহ মহারাজের কাছে যাই। দেখি তিনি কী ব্যবস্থা নেন?”
এরপর মুরগি সিংহ মহারাজের কাছে যায় শেয়ালের নামে নালিশ করতে।
সিংহ মহারাজ মুরগিকে দেখে বলেন-“কী রে মুরগি, হঠাৎ এখানে কী মনে করে?”
তখন মুরগি তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা সিংহকে বলে। আর এও বলে যে শেয়াল একা পেলে তাকে খাবে বলেছে।
সিংহ মহারাজ তখন বলেন-“তুই কী শেয়ালকে বলিসনি যে এই জঙ্গলে একটা নিয়ম আছে। এই জঙ্গলে কোনো পশুপাখির প্রাণ নেওয়া নিষেধ।”
তখন মুরগি বলে-“হ্যাঁ মহারাজ, আমি বলেছিলাম। কিন্তু সে আমার কোনো কথাই শুনেনি।”
সিংহ তখন রেগে গিয়ে বলে-“কী…..তার এত বড় সাহস যে সে আমার হুকুম অমান্য করে। ঠিক আছে তুই যা আমি দেখছি শেয়ালের কী ব্যবস্থা করা যায়।
সিংহের মুখে এই কথা শুনে মুরগি নিশ্চিন্তে সেখান থেকে চলে আসে।
আর এদিকে সিংহ গুহা থেকে বেরিয়ে ভাবতে থাকে শেয়ালের কী ব্যবস্থা করা যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে দেখে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে।
পাখিকে দেখে সিংহ বলে-“এই পাখি এখানে শুনে যা। তোর সঙ্গে কথা আছে।”
সিংহের ডাক শুনে পাখি সিংহের কাছে আসে। আর বলে-“কী হয়েছে মহারাজ?”
তখন সিংহ বলে-“যা তো জঙ্গলের ভেতর যা। আর গিয়ে দেখ শেয়াল কোথায় আছে। আর শেয়ালকে দেখতে পেলেই বলবি আমি তাকে তলব করেছি।”
পাখি বলে-“ঠিক আছে মহারাজ, আমি এখুনি যাচ্ছি।”
এরপর পাখি শেয়ালের খোঁজে বের হয়। কিছুক্ষণ খোঁজার পর সে শেয়ালকে খুঁজে পায়। সে দেখে শেয়াল একটা গাছের নিচে শুয়ে আছে।
পাখি শেয়ালকে দেখে বলে-“এই শেয়াল ওঠ তাড়াতাড়ি ওঠ। সিংহ মহারাজ তোকে যেতে বলেছেন।”
পাখির ডাক শুনে শেয়াল উঠে পড়ে। আর বলে-“কী হয়েছে কী পাখি, তুমি এত ডাকছ কেন?”
তখন পাখি বলে-“সিংহ মহারাজ তোকে তলব করেছেন।”
শেয়াল বলে-“সিংহ মহারাজ আমাকে ডেকেছেন কেন?”
তখন পাখি বলে-“তা আমি জানি না। তুই নিজে গিয়ে দেখ তোকে কেন ডেকেছেন। আমার কাজ আছে আমি এখন যাই। তুই এখুনি মহারাজের কাছে যা।”
এরপর শেয়াল সিংহের কাছে যায়। আর গিয়ে বলে-“সিংহ মহারাজের জয় হোক। মহারাজ আপনি কী আমায় তলব করেছেন।”
তখন সিংহ বলে-“শেয়াল এইসব আমি কী শুনছি, তুই নাকি আজ মুরগিকে খেতে চেয়েছিলি। তুই আমার হুকুম অমান্য করেছিস।”
শেয়াল বলে-“আজ্ঞে মহারাজ আপনি ওই মুরগির কথা বিশ্বাস করেছেন। আমার এত সাহস কোথায় যে আমি আপনার হুকুম অমান্য করব। এখনো পর্যন্ত আমার এত সাহস হয়নি যে আমি আপনার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করব।”
তখন সিংহ বলে-“কিন্তু মুরগি যে এসে বলল তুই নাকি ওকে খেতে চেয়েছিলি।”
শেয়াল বলে-“আজ্ঞে মহারাজ ওসব মুরগির ভুল ধারণা। আমি তো ওর সঙ্গে খেলা করতে চেয়েছিলাম, আর ও ভেবেছে আমি ওকে খেতে চেয়েছি।”
সিংহ তখন বলে-“ও……আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুই এখন যা। তবে সাবধান জঙ্গলের কোনো পশুপাখির ক্ষতি করার চিন্তা কখনও মাথায় আনবি না।”
তখন শেয়াল বলে-“আজ্ঞে মহারাজ, আপনি যা বলবেন তাই হবে।” এইবলে শেয়াল সেখান থেকে চলে আসে।
আর অন্যদিকে জঙ্গলের শেষপ্রান্তে এক গুহায় এক বাঘ থাকত। সে খুবই ক্ষুধার্ত থাকায় খাবারের খোঁজে জঙ্গলের ভেতর আসছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর পথে শেয়ালের সঙ্গে তার দেখা হয়।
শেয়ালকে দেখে বাঘ বলে-“কী রে শেয়াল কোথায় যাচ্ছিস?”
শেয়াল বলে-“কোথায় আর যাব, এই যে সিংহের কাছে গিয়েছিলাম এখন বাড়ি ফিরছি।”
বাঘ তখন বলে-“সিংহের কাছে গিয়েছিলি কেন?”
শেয়াল বলে-“আর কেন, তুমি তো জানো এই জঙ্গলের কী নিয়ম। জঙ্গলের কোনো পশুপাখিকে খাওয়া যাবে না। আর আজ আমি একটা মুরগিকে খেতে চেয়েছিলাম। সেই মুরগি মনে হয় সিংহের কাছে নালিশ জানিয়েছে। তাই সিংহ আমাকে ডেকেছিল। মিথ্যা কথা বলে কোনোরকমে সেখান থেকে বেঁচে এসেছি।”
তখন বাঘ বলে-“আমার সামনে ওই সিংহের কোনো কথাই বলবি না। ওই বদমাইস সিংহের জন্য বাঘ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে ছাগলের মতো ঘাস খেয়ে থাকতে হয়। কী একটা নিয়ম করেছে বাবা, যে জঙ্গলের কোনো পশুপাখিকে খাওয়া যাবে না। এটা কোনো নিয়ম হল। আমি যদি রাজা হতাম তাহলে এইরকম নিয়ম কোনোদিনই করতাম না।”
শেয়াল তখন বলে-“আমি বলি কী বাঘ মামা ওই বুড়ো সিংহকে মেরে তুমি এই জঙ্গলের নতুন রাজা হয়ে যাও।”
বাঘ বলে-“কী বলছিস কী তুই আমি কী রাজা হতে পারি?”
তখন শেয়াল বলে-“কেন পারো না, নিশ্চয়ই পারো। তুমি নিজেকে কখনো দেখেছো তুমি কত সুন্দর। রাজা হওয়ার সমস্ত গুণ তোমার মধ্যে আছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ঘাস খাওয়ার ফলে তুমি কিছুটা রোগা হয়ে গেছ। কিন্তু এটাও ঠিক যে সিংহের থেকে তুমিও কোনো অংশে কম নও।”
বাঘ তখন বলে-“তাই নাকি শেয়াল। ঠিক আছে তাহলে তুই গিয়ে সিংহকে বল আজ থেকে এই জঙ্গলের নতুন রাজা বাঘ। আর সিংহ যদি না মানে তো বলবি আমি তার সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছি। যা শেয়াল তুই এখুনি যা।”
শেয়াল বলে-“ঠিক আছে মামা, আমি এখুনি যাচ্ছি।”
এরপর শেয়াল সিংহের কাছে যায় আর সিংহকে সব কথা বলে।
সব শুনে সিংহ বলে-“কী বলছিস শেয়াল, বাঘ এইসব বলেছে। ঠিক আছে ও লড়াই করতে চায় তো ঠিক আছে চল আজ আমি তাকে বুঝিয়ে দেব জঙ্গলের আসল রাজা কে?” এই বলে সিংহ বাঘের কাছে যায়।
বাঘের কাছে পৌঁছে সিংহ বলে-“কী রে বাঘ তুই নাকি আমার রাজত্ব কেড়ে নিতে চাস।”
তখন বাঘ বলে-“দূর, তোকে রাজা হিসেবে কে মানে। তুই যে এই জঙ্গলের রাজা হয়ে বসে আছিস তোর রাজা হওয়ার কোনো যোগ্যতা আছে।”
তখন সিংহ বলে-“কী… তুই আমার যোগ্যতা নিয়ে কথা বলিস। আয় আমার কাছে তোকে বুঝিয়ে দেব আমার যোগ্যতা আছে কিনা।”
বাঘ বলে-“আমি তোর কাছে যাব কেন, তুই আয় আমার কাছে। অনেকদিন ধরে তোকে মারার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম, আর আজ সেই সুযোগ পেয়েছি। আজকে তোকে মেরে আমি হব এই জঙ্গলের নতুন রাজা।”
তখন সিংহ বলে-“তাই না, তোর রাজা হওয়ার প্রচুর শখ। তুই আমাকে মারবি আর আমি কী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাব, এটা ভাবলি কী করে। আমার কী মুখে দাঁত নেই, নাকি পায়ে নখ নেই যে তোকে মারতে পারব না।”
বাঘ বলে-“তাহলে এত ভয় করছিস কেন? আয় আমার কাছে আয় আর আমাকে মার।”
তখন সিংহ বলে-“আমি তোর কাছে যাব কেন তুই আমার কাছে আয়।”
বাঘ তখন বলে-“আজকে তোকে পেয়েছি দেখি আজ আমার হাত থেকে তোকে বাঁচায় কে?”
এরপর বাঘ ও সিংহ একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে থাকে। সেই সময় সেখানে একটা খরগোশ আসে।
খরগোশ বলে-“কী হয়েছে কী তোমরা এত ঝগড়া মারামারি করছো কেন?”
তখন সিংহ বলে-“ওই খরগোশ তুই এখান থেকে যা। আজকে এই বাঘকে আমি প্রাণে মেরে ফেলব।”
বাঘ বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই আমাকে মারবি আর আমি কী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাব।”
তখন খরগোশ বলে-“এই বাঘ তুমি চুপ কর। তুমি যে সিংহের সঙ্গে লড়াই করছো তুমি যদি মারা যাও তাহলে তোমার লড়াই করে লাভ কী? আর সিংহ মহারাজ আপনি এইসব কী করছেন? আপনার তো বয়স হয়েছে আপনি যদি লড়াই করতে গিয়ে মারা যেতেন তাহলে আপনার রাজত্ব আর জীবন দুটোই যেত। তাহলে এমন লড়াই করে লাভ কী? একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন লড়াই করে কোনো সমস্যার সমাধান করা যায় না।”
সিংহ তখন বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে খরগোশ, তুমি যখন এত করে বলছো তখন আমি আর লড়াই করব না। তাহলে আজ থেকে বাঘই এই জঙ্গলের রাজা হয়ে যাক। কিন্তু বাঘের কাছে আমার একটাই অনুরোধ রইল যে সে যেন এই জঙ্গলের কোনো পশুপাখির ক্ষতি না করে।”
বাঘ বলে-“না আমি আর এই জঙ্গলের রাজা হব না। সিংহ রাজা ছিল আর সেই রাজা থাকুক। কারণ এখনও পর্যন্ত সিংহ কেবলমাত্র এই জঙ্গলের পশুপাখির কথা ভাবছে আর আমি তাদের খাবার চিন্তা করছি। তাই আমি বলছি এই জঙ্গলের আসল রাজা সিংহ। আমাকে তোমারা সবাই ক্ষমা করো, আর সিংহ মহারাজ আপনিও।”
তখন সিংহ বলে-“সত্যি কথা বলতে কী এই পৃথিবীতে সবারই বাঁচার অধিকার আছে, কেউ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না। তাই আমাদের উচিত কোনো জীবজন্তু বা পশুপাখিকে না মেরে কষ্ট না দিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করা। এতে আমাদের সবার মঙ্গল হবে। চল এবার আমরা সবাই যে যার বাসায় যাই।”
এরপর যে যার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল আর জঙ্গলের মধ্যে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
0 Comments