দূরদেশের লোকগল্প— ২৫১
ঘানা (আফ্রিকা)
ভেঙে গেল জ্ঞানভাণ্ড
চিন্ময় দাশ
সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। কত কাল আগের কথা, সেটাও কারো জানা নেই। এতকাল আগে যে, তখন মানুষের জ্ঞান ছিল অতি সামান্য। কী করে চাষবাস করতে হয় জানতো না। কী করে যন্ত্রপাতি বানাতে হয় জানতো না। কী করে কাপড় বুনতে হয় জানতো না। জানতো না তারা অনেক অ-নে-ক কিছুই। কেবল সামান্য কিছুই জানাজানি ছিল তাদের।
দুনিয়ার যত জ্ঞান, সব ছিল একজনের হেফাজতে। তিনি আর কেউ নন। তিনি স্বর্গের দেবতা, বিধাতা পুরুষ। সামান্য কিছু জ্ঞান মানুষজনকে দিয়েছিলেন। বাকি যত জ্ঞান, একটা ভাঁড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে, বিশেষ যত্ন করে গচ্ছিত রেখে দিয়েছিলেন।
একদিন বিধাতার মনে হল, একবার যাই। পৃথিবীটা চক্কর দিয়ে আসি। এত যে জীব জন্ম দিলাম, তারা কে কেমন আছে? কেমন তাদের ভালো-মন্দ? একবার খোঁজ নিয়ে আসি।
কিন্তু তিনি হলেন বিধাতা পুরুষ। জগতের সব কাজের ভার তাঁরই উপর। চলে যাব বললেই তো যাওয়া হয় না। কাকে কোন কাজের ভা্র দিয়ে যাবেন।
কাজের দায় বাঁটোয়ারা সারা হোল। এবার বিধাতার আসল চিন্তা হল, জ্ঞানের ভান্ডার নিয়ে। কোথায় রেখে যাবেন? যদি কেউ জানতে পারে? কিছু জ্ঞান যদি কেউ হাতিয়ে নেয়? অনেক ভেবে ভেবে, একজনের কথা মনে হলো তাঁর। বেশ বিশ্বস্ত লোক। কারো সাতে-পাঁচে থাকে না। পাড়াপড়শি বা তেমন কোন বন্ধু-বান্ধবও নাই তার। ফলে, তার হেফাজতে রেখে গেলে, জিনিসটা মনে হয় ঠিকঠাক গচ্ছিত থাকবে।
বিধাতার সেই বিশ্বস্ত লোকটি হল মাকড়সা। অনেক ভেবে মনস্থির করেই ফেললেন। মাকড়সাকেই ভাঁড়ের দায়িত্ব দিয়ে যাব।
মাকড়সাকে ডেকে পাঠিয়ে, সমস্ত বুঝিয়ে দিলেন। পই-পই করে সাবধান করে দিলেন—দেখিস, কেউ যেন এই জিনিষের হদিস না পায়। খুব বড় ওলট-পালট হয়ে যাবে গোটা দুনিয়ার। মুখ ফুটে কিছু বলবি না কাউকে। ভাঁড়টা যেমন আছে, ওখানেই যেন থাকে। যেমনটি আছে ঠিক তেমনটি যেন থাকে। নাড়াচাড়া করবার কোন দরকার নেই।
বিধাতা চলে গেলেন সফরে। তখন মাকড়সাকে আর পায় কে? এমনই দেমাক, মাটিতে পা পড়ে না যেন। আর, পা তো একখানা নয়। গুনে গুনে আটখানা পা তার।
মাকড়সার সমস্যা হল বিধাতার দরবার নিয়ে। বিধাতা সফরে গিয়েছেন, তেমন কাউকে কিছুটি না বলে। কেউ টেরটিও পায়নি কখন তিনি চলে গেছেন। ফলে, তাঁর দরবারে লোকজনের আসা যাওয়ার বিরাম নেই কোনও। আজ এরা আসছে, তো কাল ওরা আসছে। ভীড় যেন লেগেই আছে।
মাকড়সার মনে ভয় এই ভীড়টা নিয়ে। ভাঁড়ের কথাটা যদি কেউ জানতে পেরে যায়। তাহলে তো বিপদের শেষ নাই। বিধাতা পুরুষ আস্ত রাখবেন না তাকে।
অনেক ভাবনা চিন্তা করল মাকড়সা শেষে তার মন বলল, ভাঁড়টা যদি আমি সরিয়ে রেখে দেই, তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যায়।
রাতের শেষ প্রহর তখন। মাকড়সা করলো কী, জ্ঞানের ভাঁড় বের করে, একটা দড়িতে বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে নিল। লম্বা মতন একটা গাছে উঠতে লাগলো। তরতরিয়ে একবার একবার খানিকটা ওঠে, একবার নিচের দিকে তাকায়। কেউ তাকে দেখে ফেলল কি না, মনে এই ভয়। আবার খানিকটা ওঠে, আবার নীচে তাকায়। ভোরের আলো সবে ফুটে উঠতে আরম্ভ করেছে। গাছের একেবারে মগডালে হাজির হয়ে গেল মাকড়সা। আবার একবার নিচে তাকিয়ে দেখল। না, কেউ কোত্থাও নেই। কারোর চোখে পড়েনি। একেবারে নিশ্চিন্ত।
ভাঁড় নিয়ে গাছের ডগায় উঠে এসেছে। মনমেজাজ এখন ফুরফুরে। সারাদিন দরবারে যতজনই হাজির হোক না কেন, ভাঁড়ের কথা কেউ জানতে পারবে না।
মগডালে উঠে সবে থিতু হয়ে বসেছে। ভাঁড়টা খুলে রেখেছে নিজের কোলের উপর। ভাবল, একটি বার খুলে দেখি। কী আছে এর ভেতরে? এত কেন লুকিয়ে রাখেন বিধাতা ঠাকুর।
মাকড়সা মগডালে। এদিকে তারই সামান্য তফাতে একটা ধনেশ পাখি বসে আছে, সে খেয়ালই করেনি। পাখিটা ভাবছে, আস্ত একটা মাটির ভাঁড় শরীরে বেঁধে নিয়ে মাকড়সা গাছে উঠে এসেছে কেন? এমন কান্ড দেখেছে কেউ কখনো? পাখিটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।
সামান্য দূরেই এসে মাকড়সা বসেছে। পাখিটা আর থাকতে না পেরে, জিজ্ঞেস করল—কী ভায়া, কী এমন সম্পদ আগলে নিয়ে এসেছ?
ধনেশের গলা বলে কথা। যেমন সরু, তেমনি তার তেজ। যেন বর্শার ফলা। কথাটা বিঁধেছে এসে একেবারে মাকড়সার বুকে। আচমকা এমন একটা গলা শুনে, বেদম চমকে গিয়েছে মাকড়সা। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো সামান্য তফাতে বসে আছে পাখিটা।
দশাসই চেহারা ধনেস পাখির। বিশেষ করে ঠোঁট দু’খানা। পুরো ভাঁড়টাকেই গিলে ফেলতে পারে। ভয়ানক ভয় পেয়ে গেল মাকড়সা। নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছে। পাখি আবার জিজ্ঞেস করল-- তোমার হাতে ওটা কী গো? কী এনেছ লুকিয়ে? তা, নীচে ঘরের ভেতরে না থেকে, হঠাৎ এত উপরে উঠে এসেছে কেন?
আর যায় কোথায়? ধনেশ জেনে ফেললে সর্বনাশ। সবাই জেনে ফেলবে। তাড়াহুড়ো করে কোল থেকে ভাঁড়টা পিছন দিকে আড়াল করতে গেল মাকড়সা। অমনি হাত ফসকে, ভাঁড় গেল পড়ে।
তার পর? তার আবার পর কী? যা হবার তাই হল। ধপাস করে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল ভাঁড়টা। ভেঙে চৌচির। একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। টুকরোগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মনি এক মজার ব্যাপার। মজা হলো, যত জ্ঞান লুকিয়ে ভরে রাখা ছিল ভাঁড়ের ভেতর, সবাই মুক্ত এখন। সবাই ছড়িয়ে পড়তে লাগল এদিক ওদিক। আর জ্ঞান কি কোথাও আটকে থাকার জিনিষ? ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
জ্ঞান বলে কথা। বেরিয়ে পড়লেই সে ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও স্থির থাকে না। গোটা দুনিয়ায় জ্ঞান ছড়িয়ে পড়ল সেদিন থেকে। কতজন কত কিছু শিখে নিল। কতজন কত কিছু বুঝে নিল। কারোর কোনও অসুবিধা থাকলো না আর। সবাই জ্ঞানের অধিকারী হয়ে উঠল সেদিন থেকে। কেউ কিছু বেশি। আর, কেউ কিছু কম, এই যা!
কিন্তু সমস্যা হল মাকড়সার। হাত থেকে পড়ে যেতেই, সে বেচারা একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কী জবাব দেবে বিধাতাকে? ছোট্ট একটা কাজের ভার দিয়ে গিয়েছিলেন তাকে। সেটাই ঠিক মতো করতে পারল না। মরমে মরে যাচ্ছে মাকড়সা। বিধাতা পুরুষ ফিরে এলে, কী জবাব দেবে তাকে।
জুতসই কোন জবাব আসছে না মাথায়। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল, বিধাতার সামনে না যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এছাড়া অন্য কোন উপায় তার মাথায় এলো না। সেদিন থেকে সেই যে লুকিয়ে পড়ল, আজও সকলের থেকে আড়ালেই থাকে মাকড়সা্রা। সহজে কারো সামনে আসতে চায় না।
0 Comments