মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭৫
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (মধ্যযুগের কবি, আড়রাগড়)
ভাস্করব্রত পতি
একসময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আনন্দপুর থানার আড়রা গ্রামে বসেই কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছিলেন বিখ্যাত চণ্ডীমঙ্গল তথা অভয়ামঙ্গল কাব্য।
'শুন ভাই সভাজন কবিত্বের বিবরণ এই গীত হইল যেন মতে।
উরিয়া মায়ের বেশে কবির শিয়র দেশে চণ্ডিকা বসিলা আচম্বিতে।।'
আজও সেই কাব্য অমর হয়ে আছে। কবি কিন্তু জন্মসূত্রে মেদিনীপুর জেলার বাসিন্দা ছিলেননা। তাঁর আদি বাসস্থান ছিল বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত দামিন্যা বা দামুন্যা গ্রামে। মেদিনীপুরের ইতিহাসকার যোগেশচন্দ্র বসু মন্তব্য করেছেন, "সংস্কার যুগের তিনটি প্রধান পুরুষ -- কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কাশীরাম দাস এবং রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য। মেদিনীপুরের বড়ই সৌভাগ্য যে, এই তিন জনের সহিত তাহার একটা ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে। রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য মেদিনীপুর জেলারই অধিবাসী। কিন্তু মুকুন্দরাম বা কাশীরাম মেদিনীপুরের অধিবাসী না হইলেও আজ যে জন্য তাঁহাদের এত গৌরব তাহার ষোল আনা অংশ মেদিনীপুরেরই প্রাপ্য।"
কবির বাবা ছিলেন হৃদয় মিশ্র। তিনি চাষাবাদ করতেন ও টোলের পণ্ডিত ছিলেন। কবির পিতামহের নাম জগন্নাথ মিশ্র, বড় ভাইয়ের নাম কবিচন্দ্র। তাঁর পুত্রের নাম শিবরাম, মেয়ের নাম যশোদা এবং পুত্রবধূর নাম ছিল চিত্রলেখা।
'মহামিশ্র জগন্নাথ হৃদয় মিশ্রের তাত কবিচন্দ্র হৃদয় নন্দন।
তাহার অনুজ ভাই চণ্ডীর আদেশ পাই বিরচিল শ্রীকবিকঙ্কন।।'
এই দামুন্যা গ্রামের পাশেই সিলিমাবাজ গ্রামে ছিল ডিহিদারের রাজধানী। এই দুই গ্রাম নিয়ে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন,
'সহর সিলিমাবাজ তাহাতে সজ্জন রাজ নিবসে নিয়োগী গোপীনাথ।
তাঁহার তালুকে বসি দামিন্যায় চাষ চষি নিবাস পুরুষ ছয় সাত।।'
কিন্তু সে সুখ সয়নি। একসময় এতদঞ্চলে শুরু হয় মাৎস্যন্যায়। চারিদিকে একটা অস্থির পরিবেশ। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার শুরু হয়। ঠিক যে সময় সেলিমাবাজের ডিহিদার মাহমুদ শরিফের রাজত্ব চলছে তখন সেখানে অত্যাচারের মাত্রা লাগামছাড়া হয়ে পড়ে। ক্রমশঃ বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে এলাকা।
'ধন্য রাজা মানসিংহ বিষ্ণুপদাম্বুজ ভৃঙ্গ গৌড় বঙ্গ উৎকল অধিপ।
উজির হলো রায়জাদা বেপারিরে দেয় খেদা ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের হল্য অরি।
মাপে কোণে দিয়া দড়া পনর কাঠায় কুড়া নাহি শুনে প্রজার গোহারি।।
সরকার হইলা কাল খিল ভূমি লেখে লাল বিনা উপকারে খায় ধুতি।
পোদ্দার হইল যম টাকা আড়াই আনা কম পাই লভ্য লয় দিন প্রতি।
ডিহিদার অবোধ খোজ কড়ি দিলে নাহি রোজ ধান্য গরু কেহ নাহি কেনে।
প্রভু গোপীনাথ নন্দী বিপাকে হইলা বন্দী হেতু কিছু নাহি পরিত্রাণে।।'
ফলে পারিবারিক বাস্তুভিটা, জমিজমা, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ছেড়ে প্রাণে বাঁচতে এবং সামাজিক নিরাপত্তার খোঁজে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেন।
'পেয়াদা সবার কাছে প্রজারা পালায় পাছে দুয়ার চাপিয়া দেয় থানা।
প্রজা হইল ব্যাকুলি বেচে ঘরের কুড়ালি টাকার দ্রব্য বেচে দশ আনা।।'
শোনা যায়, মুকুন্দরাম ডিহিদারের এক পেয়াদাকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে সেলাম করেননি। তার জেরে তাঁকে গ্রাম থেকে তাড়ানো হয়। সেসময় রীতিমতো ঢেঁড়া পিটিয়ে তাঁকে পরিবার সহ উচ্ছেদ করা হয়। মনের দুঃখে তিনি এলাকা ছেড়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ১৫৪৪ সালে কবি ঘর ছেড়েছিলেন বলে জানিয়েছেন। ঘর ছাড়ার সময় কবির সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, পুত্র এবং ভাই রামনাথ বা রামানন্দ।
'সহায় শ্রীমন্ত খাঁ চণ্ডীবাটী যার গাঁ যুক্তি কৈলা মুনিব খাঁর সনে।
দামুন্যা ছাড়িয়া যাই সঙ্গে রমানাথ ভাই পথে চণ্ডী দিলা দরশনে।।'
কেউ কেউ বলেন, তাঁর সঙ্গে অনুচর হিসেবে ছিলেন দামোদর বা ডামাল নন্দী। তবে কবির এই জন্মভিটে ত্যাগের কারণ সম্পর্কে ভিন্নমত দিয়েছেন ড. সনৎকুমার নস্কর। তিনি বিবরণ দিয়ে লিখেছেন, "মানসিংহ যখন বাংলা ও উড়িষ্যার সুবেদার পদে অধিষ্ঠিত, এমন সময় প্রজাদের দুর্ভাগ্যে ডিহিদার হলেন মামুদ সরীপ নামে এক অত্যাচারী মুসলমান। আর যে রায়জাদাকে (খুব সম্ভব পত্রদাসের পুত্র কিসুদাস) উজির করে পাঠানো হয়েছিল তিনি বণিক, ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবের প্রতি অত্যন্ত রূঢ় ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এঁদের আমলেই প্রচলিত হল জমির কৌণিক মাপ, যার ফলে পনেরো কাঠাকে বিঘে বলে চিহ্নিত করা হল এবং অনাবাদী জমিকে আবাদী জমিরূপে নির্দেশ করে নির্ধারিত হল উপযুক্ত কর। অসাধু কর্মচারীরা উৎকোচ গ্রহণেও ছিল সিদ্ধহস্ত। অন্যদিকে পোদ্দারেরা টাকা বদলের বাট্টায় কেটে নিতে লাগল আড়াই আনা এবং বোধহয় মূলধনী কারবারে সুদের পরিমাণ ছিল দিনপ্রতি টাকায় এক পাই। লোকে এত দরিদ্র হয়ে পড়েছিল যে, ধান বা গরুর মতো সম্পত্তিও বিক্রি করতে গেলে কেউ তা কিনত না। এ হেন অবস্থায় কবির তালুকদার গোপীনাথ নন্দী বিপাকে পড়ে বন্দী হলেন, মুক্তি মিলল না কিছুতেই। প্রজারা যদি তাদের দেয় রাজস্ব ও আবওয়াব না দিয়েই পালায় এই আশঙ্কায় পেয়াদা নিযুক্ত হল। ব্যাকুল প্রজা দেনা মেটাতে আর সংসার যাত্রা নির্বাহ করতে ঘরের কুড়ালিও (অর্থাৎ কিনা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস) বিক্রি করলো। দাম পাওয়া গেল আসল মূল্যের অর্ধেকের কিছু বেশি। দামিন্যার কাছে ছিল চণ্ডীবাটি গ্রাম। সে গ্রামের অধিবাসী শ্রীমন্ত খাঁ (বোধহয় কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি) ও মুনিব খাঁর সঙ্গে যুক্তি করে কবি দামিন্যা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।"
এইভাবে দক্ষিণাভিমুখে চলতে চলতে ভেঠনাতে এলে জনৈক রূপ রায় কবির যাবতীয় ধনসম্পদ লুঠ করে নেয়। কিন্তু এই সময় তিলি সম্প্রদায়ের যদু কুণ্ডু নামে এক ব্যক্তি তাঁদের অতিথি হিসেবে সেবা করে।
'ভেঠনায় উপনীত রূপ রায় নিল বিত্ত যদু কুণ্ডু তিলি কৈল রক্ষা।
দিয়া আপনার ঘর নিবারণ কৈল ডর দিবস তিনের দিল ভিক্ষা।।'
এখানে তিনদিন থেকে তাঁরা পৌঁছায় মুণ্ডেশ্বরী বা মুড়াই নদীর ধারে। নদী পেরিয়ে তেউট্যা গেলেন। এখান থেকে আবার পেলেন নদী -- দারকেশ্বর। এই নদীও পেরিয়ে পৌঁছালেন বাতন গিরিতে। এবার তিনি সাথে পেলেন গঙ্গাদাসকে।
'বহিয়া গোড়াই নদী সদাই স্মরিয়ে বিধি তেউট্যায় হইলু উপনীত।
দারুকেশ্বর তরি পাইল বাতন গিরি গঙ্গাদাস বড় কৈলা হিত।।'
আবার সামনে নদী। এবার পেরোতে হবে দামোদর (মতান্তররে আমোদর)। নদী পেরিয়ে কবি পৌঁছালেন কুচট্যা নগরে। কপর্দকশূন্য কবির তখন সাথে আর কানাকড়িটুকুও নেই। স্নান করার তেল নেই, খাবার মতো খাদ্য নেই। ছোট্টো ছেলেটি একমুঠো ভাতের জন্য কাঁদছে। সেখানে এক পুকুরপাড়ে পথশ্রমে কাতর এবং ক্লান্ত কবি আশ্রয় নিলেন।
'নারায়ণ পরাশর এড়াইল দামোদর উপনীত কুচট্যা নগরে।
তৈল বিনা কৈল স্নান করিলু উদক পান শিশু কাঁদে ওদনের তরে।।'
সেখানে স্নান করে জল পান করে ভক্তিভরে শালুকফুল দিয়ে পূজা করলেন। অচেনা অজানা জায়গায় এসে ক্ষুধা তৃষ্ণায় জেরবার কবি ঘুমিয়ে পড়লেন সেখানে। সেসময়েই দেবী কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চণ্ডীমঙ্গল লেখার নির্দেশ পান।
'আশ্রম পুখরি আড়া নৈবেদ্য শালুক পোড়া পূজা কৈনু কুমুদ প্রসূনে।
ক্ষুধা ভয় পরিশ্রমে নিদ্রা নাই সেই ধামে চণ্ডী দেখা দিলেন স্বপনে।।
হাতে লইয়া পত্র মসী আপনি কলমে বসি নানা ছন্দে লিখেন কবিত্ব।
যেই মন্ত্র দিল দীক্ষা সেই মন্ত্র করি শিক্ষা মহামন্ত্র জপি নিত্য নিত্য।।'
এরপর আরও দক্ষিণে এগিয়ে চলেন কবি। পেরোলেন শিলাবতী নামে আরও একটি নদী। একসময় পৌঁছে যান মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে।
'দেবী চণ্ডী মহামায়া দিলেন চরণ ছায়া আজ্ঞা দিলেন রচিতে সঙ্গীত।
চণ্ডীর আদেশ পাই শিলায় বাহিয়া যাই আড়রায় হইলু উপনীত।'
সেসময় আড়রায় ছিল ব্রাহ্মণভূম পরগনার জমিদার বাঁকুড়া রায়ের রাজত্ব। তাঁর বাবার নাম বীর মাধব এবং মা ছিলেন দুলাল সিংহের কন্যা দনাদেবী। কবি লিখেছেন --
'দুলাল সিংহের সুতা
দনাদেবী পাটমাতা।'
রাজা বাঁকুড়া রায় ছিলেন অত্যন্ত প্রজাবৎসল এবং গুণীর গুণের কদরকারী। জাতিতে ব্রাহ্মণ। ব্যাসের মতো প্রাজ্ঞ।
মুকুন্দরাম যখন আড়রাগড়ে এসে বসবাস শুরু করেন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিত্বশক্তির প্রকাশ পেতে থাকে। সে খবর পৌঁছে যায় রাজা বাঁকুড়া রায়ের কানে। তিনি তৎক্ষণাৎ মুকুন্দরামকে ডেকে নিজের রাজসভার সভাকবি পদে আসীন করেন। আর কবিকে পাঁচ আড়া ধান দিলেন উপহার হিসেবে। সেইসাথে নিজের ছেলে রঘুনাথ রায়ের গৃহশিক্ষক পদে নিযুক্ত করেন। এই ঘটনা কবির জীবনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর কাব্যে কবি তা উল্লেখ করে লিখেছেন --
'আড়রা ব্রাহ্মণভূমি ব্রাহ্মণ যাহার স্বামী নরপতি ব্যাসের সমান।
পড়িয়া কবিত্ব বাণী সম্ভাষিনু নৃপমণি পাঁচ আড়া মাপি দিলা ধান।।
সুধন্য বাঁকুড়া রায় ভাঙ্গিল সকল দায় শিশুপাছে কৈল নিয়োজিত।
তার সূত রঘুনাথ রাজগুণে অবদাত গুরু করি করিল পূজিত।।'
চণ্ডীমঙ্গল লেখার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন কবি, এ তথ্য জেনেছিলেন তাঁর ছাত্র তথা বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ রায়। বাঁকুড়া রায়ের মৃত্যুর পর তিনি মুকুন্দরামকে উদ্বুদ্ধ করেন তা লিখতে।
'বীরমাধবের সূত রূপে গুণে অদ্ভুত বীর বাঁকুড়া ভাগ্যবান।
তার সূত রঘুনাথ রাজগুণে অবদাত শ্রীকবিকঙ্কণে রস গান।।'
সকলের অনুরোধে আড়রাগড়ে বসে রঘুনাথ রায়ের রাজত্বকালে লিখে ফেলেন চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। রাজার অনুগ্রহেই শুরু করেন কাব্যচর্চা।
'শ্রীরঘুনাথ নাম অশেষ গুণধাম ব্রাহ্মণভূমি পুরন্দর।
তাহার সভাসদ রচিয়া চারুপদ মুকুন্দ গান কবিবর।।'
এই সম্পূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে ড. সনৎকুমার নস্কর লিখেছেন, "কবি উপস্থিত কবিত্বের দ্বারা রাজাকে সম্মানসূচক সম্ভাষণ জানালে সন্তুষ্ট রাজা তৎক্ষণাৎ পাঁচ আড়া ধান তো দিলেন কবিকে, আর স্থায়ীভাবে নিয়োগ করলেন তাঁর শিশুপুত্র রঘুনাথের শিক্ষাদানে। সঙ্গে যে অনুচর দামোদর বা ডামাল নন্দী এসেছিল (কবি এর কথা আগে বলেননি), একমাত্র সেই জানত পুকুর পাড়ের স্বপ্নের কথা। এখন সে প্রতিনিয়ত তাগাদা দিতে লাগল কাব্য লেখার জন্য। এছাড়া অনুজ্ঞা করলেন শিষ্য রঘুনাথ নিজে, যিনি এখন নিজেই রাজা। কবি হয়তো এসবকেও উপেক্ষা করতেন, কিন্তু তাঁর শিশুপুত্রের মৃত্যু দৈবরোষ সম্পর্কে ভীতি জাগিয়ে তুললে আর স্থির থাকতে পারলেন না। কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করলেন।" এই দামোদর বা ডামাল নন্দী কথা পাই কবির লেখায় --
'সঙ্গে দামোদর নন্দী যে জানে স্বরূপ সন্ধি অনুদিন করিত যতন।
যে বাঁকুড়া রায়ের রাজধানীতে এসে কবি দেবী চণ্ডীর আখ্যান লিখেছিলেন, সেই এলাকায় কোনও চণ্ডীর মন্দির নেই। এ প্রসঙ্গে ক্ষেত্রসমীক্ষক চিন্ময় দাশের লেখায় পাই, "জমিদার বাঁকুড়া রায়ের রাজধানীতে কোন মন্দির নেই। তাঁর আরাধ্যা দেবী ছিলেন চন্ডী। প্রতিদিন প্রভাতে স্নানের পর তিনি দেবীর পাদোদক পান করে দিন শুরু করতেন। দেবীরই স্বপ্নাদেশে। পার্শ্ববর্তী জয়পুর গ্রামে দেবীর মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনি জয়চণ্ডী নামে খ্যাত।"
শোনা যায়, চণ্ডীমঙ্গল লেখার পর কবি টানা তিনদিন ধরে তাঁর লেখা কাব্যটি রাজা রঘুনাথ রায় সহ রাজ্যের জনগনকে শোনাতে থাকেন। বিক্রমদেবের পুত্র প্রসাদ ছিলেন কবির লেখা পাঁচালীর প্রথম গায়ক।
'বিক্রমদেবের সুত গান করে অদ্ভুত
বাখান করয়ে সর্বজন।
তালমানে বিজ্ঞ দড় বিনয় সুন্দর বড়
নতিমান মধুর বচন।।'
কেউ কেউ বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে কবিদের নিয়ে যে কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হয়, সেদিন মুকুন্দরামের কাব্য শোনার জন্য যে আসরের আয়োজন করা হয়েছিল, সেটিকেই এরাজ্যের কবিতা উৎসবের প্রথম দৃষ্টান্ত বলে বলা যেতে পারে। কাব্য শোনার পর আপ্লুত রাজা নিজের হাতের কঙ্কন বা বালা খুলে কবিকে উপহার দিয়েছিলেন আসরেই। সেই থেকে কবির নামের সাথে যুক্ত হয় খেতাব 'কবিকঙ্কণ'।
কেমনতর কাব্য এই চণ্ডীমঙ্গল? কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের এই কাব্যের প্রথম অংশের নায়ক কালকেতু এবং নায়িকা হলেন কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরা। এই কাহিনিতে রয়েছে আরও অনেক কুশীলব -- মুরারি শীল, ভাড়ু দত্ত, কলিঙ্গের রাজা প্রমুখ। রয়েছে গুজরাট নগর প্রতিষ্ঠার কথা।
'অযোধ্যা সমান পুরী বিশাই নির্মাণ করি পুরদ্বারে রচিল কপাট।
চণ্ডী পদে করি ধ্যান শ্রীকবিকঙ্কনে গান পত্তন নগর গুজরাট।।"
এছাড়াও এঁদের সাথে আছে বনের পশু। যাঁদের আচরণ মানুষেরই মতো। ঠিক যে মুহূর্তে বনের পশুরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় দেবীর কাছে করজোড়ে প্রার্থনা জানায় শিকারী কালকেতুর বিরুদ্ধে, তখন যেন অনুভূত হয় রাজ্যের গরিবগুর্বো জনসাধারণ অভিযোগ জমা করছে তাঁদের রাজার পদতলে। কবি তাঁর এই চন্ডীমঙ্গল কাব্যে পৃথিবীর বুকে দেবী ভগবতীর পূজা প্রচারের জন্য কালকেতু ব্যাধের ও শ্রীমন্ত সওদাগরের দুইটি বড়সড় উপাখ্যানের অবতারণা করেছেন। আর সেই উপাখ্যানকে সমৃদ্ধ করতে নানা ধরনের বিষয় এনেছেন। যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন, "প্রসঙ্গক্রমে রামায়ণ, মহাভারত, হরিবংশ প্রভৃতির অনেক উপাখ্যান, সুরলোক ও সুরগণের বিবরণ, ভারতবর্ষস্থ নানা দেশের নদ, নদী, গ্রাম, নগর, অরণ্য প্রভৃতির বর্ণনা এবং পশু পক্ষী ও নানা প্রাকৃতিক নানা জাতীয় লোকের বিভিন্ন প্রকার স্বভাবগুলি অতি সুন্দর ও মনোমুগ্ধকররূপে চিহ্নিত করিয়াছেন।"
এই কাব্যপাঠের আসরের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন গবেষক চিন্ময় দাশ। তিনি লিখেছেন, "নিকটবর্তী নেড়াদেউল গ্রামের মাঠে আয়োজন করা হয়েছিল কাব্য পাঠের আসর। কবি মুকুন্দরাম একাধিক দিনব্যাপী সেই আসরে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যটি পাঠ করে কয়েক হাজার শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। অনন্য এই কাব্য পাঠ করে মুগ্ধ রঘুনাথ কবিকঙ্কন উপাধিতে ভূষিত করেন কবিকে। সাথে প্রদান করেন বহু মূল্যবান পুরস্কার। এরপর পুরস্কারের সম্পদসহ মুকুন্দরাম নিজের গ্রাম দামিন্যায় ফিরে আসেন। সেখানেও তিনি প্রভৃত যশ ও সম্মান লাভ করেন। মুকুন্দরামের পুত্র শিবরামকে পরবর্তী ডিহিদার ২০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। মুকুন্দরামের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তিও পরে ফেরত দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। আড়রার জমিদার হয়ে রঘুনাথ রায় দেব উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর পুত্র উমাপতি দেবের আমলে আড়রাগড়ে প্রথম বর্গী আক্রমণ হয়। উমাপতিদেব সে আক্রমণ দমন করেছিলেন। উমাপতির পুত্র লোকনাথ। লোকনাথের পুত্র ত্রিলোচনদেবের আমলে পুনরায় বর্গীর আক্রমণ হলে, তিনি আড়রা ছেড়ে লোয়াদার কাছে এসে ত্রিলোচনপুর নামে নগর পত্তন করেন। পরে ব্রিটিশ রাজশক্তির সাথে সংঘর্ষের জেরে তিনি কেশপুর থানার গড়সেনাপোতা গ্রামে চলে আসেন।"
তবে কবির জীবনের নানা ঘটনা এবং সময় সারণি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গবেষক চিন্ময় দাশ লিখেছেন, "মুকুন্দরামের দামিন্যা গ্রাম ত্যাগ, বাঁকুড়া রায়ের জমিদারী আড়রাগড়ে আশ্রয়লাভ কিংবা চণ্ডীমঙ্গল রচনা এই সকল ঘটনার কালবিচারে পণ্ডিতদের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি আছে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে তিনি যা বলেছেন তাতে জানা যায় যে, তিনি দামিন্যা ত্যাগ করেছিলেন মুঘল পাঠানের বিরোধের সময়। অর্থাৎ সেটা ১৫৭৫ বা তার কাছাকাছি কোন সময়ে। আবার কাব্যের এক জায়গায় তিনি গৌড়বঙ্গ উৎকল - অধিপ মানসিংহের প্রশংসা করেছেন। স্বাভাবিকভাবে একথা মনে করার কারণ আছে যে, তাঁর কাব্যরচনার সূচনা পর্বে মানসিংহ বাংলার সুবেদার ছিলেন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ সাল। তিনি উড়িষ্যার বিদ্রোহী আফগানদের দমন করেছিলেন। এদিকে বাঁকুড়া রায় মারা যান ১৫৭৩ সাল নাগাদ। তাঁর পুত্র রঘুনাথ রায় জমিদারী করেছেন ১৫৭৩ থেকে ১৬০৪ সাল পর্যন্ত। কবির দামিন্য ত্যাগ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন যে বাংলায় যে অরাজক অবস্থার জন্য তাঁকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল বলে বলা হয়ে থাকে, তেমন অবস্থা বাংলায় একবার হয়েছিল ১৫৩৭-১৫৬৪ সাল সময়কালে। পাঠান অধিকারে সুরবংশ প্রতিষ্ঠার সময়ে। তা সঠিক হলে আবার গৌড়বাংলার সুবাদার মানসিংহ এবং বাঁকুড়া রায় রঘুনাথের সন তারিখ মেলে না। কবির কাব্যের বর্ণনা থেকে ষোড়শ শতকের বাংলার সমকালীন সমাজ চিত্রের সুস্পষ্ট ছবি পাওয়া গেলেও নির্দিষ্ট কোন সন তারিখ তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না। সেকারণে ভিন্ন ভিন্ন পণ্ডিত ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন।"
তারাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন কবির জন্ম হয়েছে ১৫৩৩ সালে। হরিমোহন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'বঙ্গভাষার লেখক' বইতে ১৫৪৭ সালে কবির জন্মের কথা বিধৃত করা হয়েছে। আবার কবির জন্ম ১৫৩৭ সালে এবং তিনি ১৫৭৭ সালে চণ্ডীমঙ্গল লিখেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন দীনেশচন্দ্র সেন। রাজনারায়ণ বসুর মতে ১৫৭৩ এ চণ্ডীমঙ্গল লেখা শুরু করেন এবং শেষ করেন ১৬০৩ সালে। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন ১৫৯৪ - ১৬০০ সালের মধ্যে কাব্যটি লেখা হয়। এ প্রসঙ্গে সুন্দর মত পোষণ করেছেন ড. সনৎকুমার নস্কর। তিনি জানিয়েছেন, "আরড়াতে পৌঁছনোর পর সঙ্গে সঙ্গে তো আর কাব্য লেখা হয়নি। ইতিমধ্যে কবির 'গীত না করিয়া মৈল ছাল্যা'। তারপর শিষ্য ও অনুগত রঘুনাথ রাজা হতেই পেলেন অন্নদাতা প্রভুর আদেশে রচনা করলেন চিরায়ত কাব্য চণ্ডীমঙ্গল। রাজা রঘুনাথও এই সময়টা (১৬০৩-০৪) ধর্মভাবনার দ্বারা, বিশেষত শাক্তদেবীর করুণার দ্বারা, এমনভাবে আপ্লুত ছিলেন যে, পুত্র জন্মলাভ করলে কেশিয়াড়িতে সর্বমঙ্গলার মন্দির স্থাপন করলেন। কবিকঙ্কণের প্রায় সব পুঁথিতেই চণ্ডীর নামরূপভেদে 'সকল মঙ্গলা' বা 'সর্বমঙ্গলা' নামটি পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিক থেকে ১৬৪০ খ্রীস্টাব্দে বারা খাঁ কর্তৃক কবিপুত্র শিবরামকে ভূমিদানের তথ্যটিও এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অক্ষুণ্ণ থাকে। অতএব ১৬০৪ খ্রীস্টাব্দের পূর্বেই চণ্ডীমঙ্গল রচনা শুরু হয়েছিল বলে যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত করতে হয়।"
কবির কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে কারও কোনও দ্বিমতের অবকাশ নেই। মঙ্গলকাব্যের অন্যান্য কবিদের সঙ্গে তুলনা টেনেছেন অনেকে। একাসনে বসিয়েছেন গবেষকরা। পন্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন কবি সম্পর্কে বলেছেন, "অন্যের কথা দূরে থাকুক, কবিত্ব বিষয়ে ভারতচন্দ্রের যে এত গৌরব এবং আমাদেরও যে ভারতচন্দ্রের প্রতি এত শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু চন্ডীপাঠের পর অন্নদামঙ্গল পাঠ করিলে, সে গৌরব ও সে শ্রদ্ধার হ্রাস হইয়া যায়। তদ্ভিন্ন ভারতচন্দ্র মধ্যে মধ্যে আদি রসের যেরূপ নিরবগুন্ঠন বর্ণনা করিয়াছেন, কবিকঙ্কণ সেরূপ করেন নাই। তিনি অসাধারণ পরিহাসরসিক হইয়াও তৎস্থলে বিশেষ বিজ্ঞতার সহিত লেখনী চালনা করিয়াছেন।" তেমনি রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁর "Literature of Bengal" বইতে কবি মুকুন্দরাম সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, "Bharat is a close imitator of Mukunda Ram. In character painting, however, Bharatchandra cannot be compared with the great master whom he has imitated. And in all the higher qualifications of a poet, in truth, in imagination, and even in true tenderness and pa-thos, such as we meet with in almost every other Bengalee poet, Bharatchandra is singularly and sadly wanting।"
কবির কাব্যে দুঃখের উল্লেখ থাকলেও কবি কিন্তু দুঃখবাদের কবি নন। হয়তো তাঁর জীবনে অনেক অত্যাচার, উৎপীড়ন, যন্ত্রনা প্রবাহিত হয়েছে। কিন্তু তিনি অজস্র দুঃখ পেলেও দুঃখকে বড় করে দেখেননি। গবেষকদের ব্যাখ্যা যে, মুকুন্দরামের আত্মজীবন কাহিনি আসলে মধ্যযুগীয় সাহিত্যের একটি সনাতন ধারারই অনুবর্তন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বপতি চৌধুরী কবি মুকুন্দরাম সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন, "মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে জীবনের যে প্রত্যক্ষ রূপ, যে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রচুর জীবনরস রসিকতা পাওয়া যায় তাহা বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ অভিনব। তাঁহার কৃতিত্ব কেবল বস্তুসঞ্চয়ে নহে, বাস্তবরসের পরিবেষণ নৈপুণ্যে। তাঁহার কাব্য হইতে কেবল যে সমকালীন সামাজিক অবস্থার প্রচুর উপকরণ সংগ্রহ করা যায় তাহা নহে, ইহাতে সমাজ জীবনের স্বচ্ছন্দ লীলায়িত গতিচ্ছন্দ, ইহার বহির্ঘটনার অন্তরালশায়ী মর্মস্পন্দন চমৎকারভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। মুকুন্দরাম যে সহজ কৌতুক ও সুস্থ, বলিষ্ঠ উপভোগশক্তির সহিত তাঁহার আখ্যায়িকা বিবৃত করিয়াছেন, তাহাতে আমরা আমাদের সাধারণ ঘরোয়া জীবনকে নূতনভাবে আস্বাদন করিতে শিখিয়াছি। তাঁহার প্রসন্ন কৌতুকপ্রিয়তা, বঙ্কিম কটাক্ষ, ঈষৎ তির্যক্ দৃষ্টিভঙ্গী দারিদ্র্যের ঊষর উপরিভাগের অভ্যন্তরে যে রসনির্ঝর প্রচ্ছন্ন আছে, তাহাই আবিষ্কার করিয়াছে।"
0 Comments