জ্বলদর্চি

অগ্রহায়ণ পৌষের গৃহলক্ষ্মী পূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ৫৩

অগ্রহায়ণ পৌষের গৃহলক্ষ্মী পূজা

ভাস্করব্রত পতি 

'নবজাগরণ লগনে গগনে বাজে কল্যাণশঙ্খ
এসো তুমি উষা ওগো অকলুষা, আনো দিন নিঃশঙ্ক।
দ্যুলোকভাসানো আলোকসুধায়
অভিষেক তুমি করো বসুধায়,
নবীন দৃষ্টি নয়নে তাহার এনে দাও অকলঙ্ক।
সম্মুখ পানে নবযুগ আজি মেলুক উদার চিত্র।
অমৃতলোকের দ্বার খুলে দিন চিরজীবনের মিত্র'। 
-- গৃহলক্ষ্মী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বৈশাখ, ১৩৩৪)

অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীর সরা বা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে গৃহলক্ষ্মীর পুজা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার গেরস্থ বাড়িতে। এজন্য আগের দিন বিকেলেই ঘরদোর সাফ সুতরো করে নেওয়া হয়। ধুয়ে মুছে সাফ করা হয়। আর মাটির বাড়ি হলে গোবর দিয়ে নিকোনো হয় তুলসীতলা, ধান রাখার খামার, উনুনশাল ইত্যাদি। পূজার জন্য প্রয়োজন পোড়ামাটির লক্ষ্মী ও গনেশ। স্থানীয় হাটে এগুলো বিক্রি করেন কুমোররা। অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতেই পূজোর জন্য কিনে আনা হয় হাট থেকে। কেনা হয় কাঠের তৈরি লক্ষ্মীর কুলুঙ্গি। এতেই পাশাপাশি রাখা হয় লক্ষ্মী গনেশের মূর্তি। প্রতি বৃহস্পতিবার নির্দিষ্ট কুলুঙ্গি থেকে মূর্তি দুটিকে নিচে নামিয়ে পিড়িতে রেখে পূজা করার পর ফের তুলে দেওয়া হয় কুলুঙ্গিতে। গৃহলক্ষ্মীর পূজায় ঘন্টা বাজানোর নিদান নেই। তুলসীপাতার দেওয়া হয় না। তবে পূজার পরে নারায়ণকে তুলসীপাতা দেওয়া হয়।
ড. শীলা বসাক উল্লেখ করেছেন, 'পৌষ মাস প্রাচুর্যের মাস, তাই এই মাসে বঙ্গনারীদের মধ্যে লক্ষ্মী ব্রত পালনের ব্যাপকতা বেশী। বাঙালি হিন্দুর প্রতিটি গৃহস্থ ঘরেই লক্ষ্মীদেবীর ব্রত বা পুজা করা হয়। এই ব্রতে আলপনা দেওয়ার রীতির প্রচলন আছে। বঙ্গনারীদের বিশেষত আলপনা অঙ্কনে অঙ্কনশিল্পের পারদর্শিতার কথা কারও অজানা নয়। কোন জিনিস দিয়ে কিভাবে আলপনা আঁকতে হয় এবং কোন ব্রতে কোন ধরনের আলপনার প্রয়োজন হয় যার মধ্যে দিয়ে নারী মনের কামনার প্রকাশ ঘটতে পারে, তার চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায় পূর্ববঙ্গ গীতিকার মধ্যে'। 

এই পূজোর জন্য প্রয়োজন পেতলের ঘট, গঙ্গাজল, আমসার, ডাব, সিঁদুর, পান, সুপুরি, আতপ চাল, ৪টি নৈবেদ্য (লক্ষ্মী, বিষ্ণু, কুবের এবং ইন্দ্রের নামে ৪ টি নৈবেদ্য), মিষ্টি ও ফল। চিড়ে প্রসাদ দেন কেউ কেউ। আতপ চাল বেটে আলপনা দেওয়া হয় সাতসকালেই। তুলসীমঞ্চ, বাড়ির উঠোন, দরজার চৌকাঠ, সিঁড়ির ধাপ, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, খামার এবং যেখানে লক্ষ্মী পূজা হবে সেখানে নানা ধরনের আলপনা দেওয়া হয়। এই আলপনা দেওয়ার বিষয়টি কেমনতর, তা মেলে দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা'তে। এখানে 'কাজলরেখার পালা'য় আছে -- 'উত্তম সাইলের চাউল জলেতে ভিজাইয়া। / ধুইয়া মুছিয়া কন্যা লইল বাটিয়া৷৷ /  পিটালি করিয়া কন্যা পথমে আঁকিল। / বাপ আর মায়ের চরণ মনে গাঁথা ছিল। / জোরা টাইল আঁকে কন্যা আর ধানছড়া / মাঝে মাঝে আঁকে কন্যা গিরলক্ষ্মীর পারা।। / শিব দুর্গা আঁকে কন্যা কৈলাসভবন। / পদ্মপত্রে আঁকে কন্যা লক্ষ্মী নারায়ন।। / আলিপনা আঁকিয়া কন্যা জ্বালে ঘিরতের বাতি। / ভূমিতে লুটাইয়া কন্যা করিল প্রণতি'।।
মূলতঃ পুরোহিতকে দিয়ে পুজো করানোর রীতি থাকলেও অনেক বাড়িতে বাড়ির মহিলারাই পূজো করেন। যিনি পূজো করেন তিনি উপোস থাকেন‌। রাতে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে হয় এবং ব্রতকথা শুনতে হয়। অগ্রহায়ণ পৌষের বৃহস্পতিবার কারোর বাড়িতে আমিষ খাওয়া হয়না। আর রাতে ভাত, মুড়ি হয়না। পিঠে পুলি, রুটি খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে।

এই লক্ষ্মীপূজার ব্রতকথার কাহিনীটি বেশ চমকপ্রদ। সেটি এরকম -- এক দেশে এক গরিব ব্রাম্ভণী তাঁর পাচটি ছেলে ও একটি মেয়েকে নিয়ে থাকতো। মেয়েটি সবচেয়ে বড়। ছোট ছেলেটি পেটে থাকাকালীন তাঁর স্বামী মারা যায়। অতি কষ্টে একমুঠো ভাত খেয়ে কোনও রকমে দিন কাটতো। হয়তো কোন দিন জুটলো, আবার কোন দিন জুটলোও না। মায়ের কষ্ট দেখে মেয়েটি বললো, 'মা, আমাদের মামা তো বড়লোক। তুমি বরং মামা মামির কাছে যাও। কিছু সাহায্য পেতে পারো'। মেয়ের কথা শুনে, একদিন ব্রাম্ভণী কোলের ছেলেটিকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়ি গেল। ভাই তখন বাড়ি ছিল না। ভাইয়ের বৌ দেখতে পেয়ে মুখঝামটা দিয়ে বললো, 'কি গো ঠাকুরঝি? হঠাৎ কি মনে করে?'

ব্রাম্ভণী তখন দুঃখের কথা জানিয়ে কিছু সাহায্য চাইলো। কিন্তু দজ্জাল বউ বলে, 'আমাদের অবস্থাও তথৈবচ। তোমার দাদাও সচ্ছল নয়। কিন্তু তোমার কষ্ট দেখে একটা প্রস্তাব দিই। তুমি বরং রোজ এসে আমার চাল ডাল পাছড়ে দিয়ে যেও। এতে যা ক্ষুদকুঁড়ো মিলবে তা তোমার। সেইসাথে আমার সংসারের কাজকর্ম্ম করো। আমি বাড়তি চাল ডাল তরকারি দেব। বাড়িতে গিয়ে সবাই মিলে খেও'। ব্রাম্ভণী সেইমতো এসে কাজে লেগে পড়লো একটু সুরাহার আশায়।

একদিন ব্রাম্ভণী ভাইবৌকে তাঁর বাগানের একটা লাউডাঁটা চাইলেও বৌ তাঁকে দেয়নি। কিন্তু কিছুদিন পরে বৌ তাঁকে তাঁর মাথার উকুন বেছে দেওয়ার শর্তে লাউডাঁটা দিতে রাজি হয়। এতে ব্রাম্ভণী বললো, 'কালকে দেব। আজ লক্ষ্মীবারে উকুন মারতে নেই। তাছাড়া বাড়িতে সবাই কাল থেকে অভুক্ত আছে। ক্ষুদ নিয়ে গেলে তাঁরা খাবে'। এতে বৌ রেগে গিয়ে ক্ষুদটুকুও কেড়ে নিয়ে ব্রাম্ভণীকে তাড়িয়ে দিয়ে বলে, 'বৃহষ্পতিবার ক্ষুদ দিতে নেই'। কাঁদতে কাঁদতে ব্রাম্ভণী বাড়ি চলে যায়।
যাওয়ার পথে মাঝ রাস্তায় মস্ত একটা মরা গোখরো সাপ দেখে সেটাকেই খাওয়ার জন্য নিয়ে গিয়ে কেটে কুচি কুচি করে উনুনে চাপিয়ে দেয়‌। এদিকে যতই জ্বালন দেওয়া হচ্ছে, জল ফুটে সোনার ফেনা উথলে উঠে ঘর ভেসে যাওয়ার উপক্রম। তা দেখে ব্রাম্ভণী তো অবাক। আনন্দে তাঁর ক্ষুৎপিপাসা দুর হয়ে গেল। তখন বড় ছেলেকে ডেকে একখানি মাটির খুরিতে করে একখুরি সোনার ফেনা দিয়ে স্যাঁকরার দোকানে বেচে কিছু টাকা আনতে বললো। স্যাঁকরা অবশ্য উচিৎ মূল্যই দিলো। সেদিনটা ছিল লক্ষ্মীবার। ব্রাম্ভণীর ইচ্ছে হোলো লক্ষ্মী পূজা করতে। সে তখন স্নান সেরে আলপনা দিয়ে নূতন ধানের সাথে লক্ষ্মী পূজা করলো। সেইসাথে সবাইকে ডেকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলো। সেই সাপ সেদ্ধ করার ফেনায় এতোই সোনা হয়েছিল যে, কয়েক মাসের মধ্যে সে বড়লোক হয়ে গেল।

এবার সেখানকার রাজা ব্রাম্ভণীর বড় মেয়েকে রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। সেইসাথে ছেলেগুলিরও বিয়ে হয় ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েদের সাথে। লক্ষ্মীর মত ঘর আলো করা বৌ'রা এলো। সবকিছুই পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো ব্রাম্ভণীর সংসারে।

এ খবর জানতে পেরে সেই ভাই বৌয়ের মনে সন্দেহ হোলো। সে তখন ননদকে তাঁর ছেলে বউ নিয়ে আসতে ডেকে পাঠালো। তখন ব্রাম্ভণী সেজে গুজে সবাইকে নিয়ে চললো বৌয়ের বাড়ি। ব্রাম্ভণীর পাল্কী আসতেই বৌ তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আদর করে ভাগ্নে, ভাগ্নে বৌ, ভাগ্নী, ননদ সবাইকে ঘরে এনে ভাল ভাল আসন পেতে ভালো ডাল তরকারি দিয়ে ভাত খেতে দিলো। ভাগ্নার বৌ'রা গায়ের ভারী ভারী গয়নাগুলো খুলে আসনে রেখে বলতে লাগলো - 'সোনাদানা হীরে মুক্তো ধন্য মান্য গণ্য \ যাঁদের কল্যাণে আজ মোদের নেমন্তন্ন'। ভাইয়ের বৌ এসব বুঝতে না পেরে, ব্রাম্ভণীকে বললো, 'ভাগ্নেবৌ'রা না খেয়ে কি সব বলছে গো?' ব্রাম্ভণী জানায়, 'বুঝতে পারছো না? ওঁরা বলছে যখন আমাদের দুঃখে দিন কাটতো, তখন খোঁজ কেউ নেয়নি। এমনকি এক মুঠো ক্ষুদও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সেদিন এক টুকরো লাউডাঁটাও দেয়নি কেউ। আর আজ, আমাদের গয়নাগাটি সম্পত্তি দেখে নেমন্তন্ন করেছে। তাই গয়নাগাটি খুলে আসনে রেখে ঐসব কথা বলছে ওঁরা'।
ভাইয়ের বৌ তখন ভীষণ লজ্জা পেলো। ব্রাম্ভণীর হাত দুটো  ধরে অপরাধ স্বীকার করলো কেঁদেকেটে। কিন্তু ব্রাম্ভণী চুপচাপ বৌ মেয়ে ছেলেদের নিয়ে বাড়ি চলে এল। এরপর ব্রাম্ভণী বহুদিন সুখে ঘরসংসার করলো। বয়ঃকালে বউদের লক্ষ্মীপূজার সব নিয়ম শিখিয়ে ইহলোক ত্যাগ করলো। এরপর বৌরা তাঁদের শাশুড়ির মতো ভক্তি সহকারে প্রতি বছর নিয়ম করে লক্ষ্মীপূজা করে। তাঁদের সেই লক্ষ্মীপুজা ক্রমশঃ চারিদিকে প্রচারিত হোলো। এই কাহিনীই আজ পূজোর পরে শুনতে হয়।

ড. শীলা বসাক লিখেছেন, 'লক্ষ্মী সকলেরই আরাধ্যা দেবী। বৃহস্পতিবারকে লক্ষ্মীবার বলা হয়ে থাকে। লক্ষ্মী ধন ঐশ্বর্য বা প্রাচুর্যের দেবী। শাস্ত্রীয় বচন অনুসারে ভাদ্র, পৌষ ও চৈত্র মাসে শুক্লপক্ষে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজা করলে অভীষ্ট ফল লাভ হয়। লক্ষ্মী গুণবান পুরুষ বা নারীর গৃহে অধিষ্ঠান করবেন এবং কাদেরই বা পরিত্যাগ করবেন'।

অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাস জুড়ে লক্ষ্মীপূজা করলে বাড়িতে সোনা দানা সম্পত্তি, মান সম্মান প্রভাব প্রতিপত্তির অভাব হয়না। সেইসাথে বিশ্বাস যে, এই সময় সোনার ফসল ঘরে ওঠে মাঠ থেকে। আর ধান মানেই লক্ষ্মী। দু মাস জুড়ে লক্ষ্মীপূজা চলে বাড়িতে। পৌষের সংক্রান্তিতে ঐ লক্ষ্মী গনেশ পূজা করে কুলুঙ্গি সহ ধানের গোলাঘরে তুলে রাখা হয়। ভাসানো হয় পরের বছর অগ্রহায়ণের শুরুতে। তখন আবারও নতুন লক্ষ্মী গনেশের মূর্তি এনে পূজা করা হয়।

Post a Comment

2 Comments

  1. ভীষণ ভাল লাগল

    ReplyDelete
  2. শুভ ইংরেজি নববর্ষ 🌹🌹

    ReplyDelete