জ্বলদর্চি

ছাতা/ কমলিকা ভট্টাচার্য

ছাতা 

কমলিকা ভট্টাচার্য 

নন্দিনী ট্যাক্সিতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। সামনের সিটে বসে সাগ্নিক ক্রমাগত গজগজ করে চলেছে। 
ড্রাইভার দুইবার ঘুরে তাকিয়ে বলেছে, "কাহেকো ঝগড়া করতে হো? চুপ হো জাইয়ে।" সে বাংলা না বুঝলেও বুঝে নিয়েছে—স্যার ম্যাডামকে বকছে। তার চোখেমুখে বিরক্তি, কিন্তু কোথাও যেন সহানুভূতির ছায়াও।

ব্যাঙ্গালোর স্টেশনের বাইরে নেমে, জিনিসপত্র গাড়িতে তুলছিল সাগ্নিক আর নন্দিনী। ভারী এক ব্যাগ তুলে দিতে গিয়ে পড়ে যায় ছাতাটার ওপর—পুরনো দিনের ব্যাকানো হাতলওয়ালা ছাতা, কলকাতা থেকে শখ করে কেনা। হাতলটা ভেঙে যায়।

যদিও ছাতাটায় হাতও দেয়নি নন্দিনী। সে কেবল তার নিজের হাতে থাকা বাক্সের উপর থেকে খাবারের ব্যাগটা তুলছিল। সামনের ব্যাগটা উল্টে গিয়ে এই কাণ্ড। অথচ সাগ্নিক রেগে গিয়ে লোকজনের সামনেই রাগারাগি শুরু করল।

নন্দিনীর চোখে লজ্জা, কষ্ট আর ক্ষোভ একসাথে,ছাতাটা সেও অনেক শখ করে কিনে ছিল সেটা ভেঙে যেতে তারও অনেক কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু কষ্ট আরো বেশি হচ্ছিল একটা বাইরের লোক—ড্রাইভার—যা বুঝেছে, অথচ নিজের মানুষটা কি সেইটুকু তাকে  বুঝতে পারে না?

এই মুহূর্তে,  নন্দিনীর মনে পড়ে যায় অর্চির কথা।

ছোটবেলায় অর্চির সামনে কেউ কোনোদিন নন্দিনীকে বকতে পারেনি। কেউ কিছু বললেই অর্চি গম্ভীর গলায় বলত, "আমার কুর্চি কি করেছে? ওর কোনো দোষ নেই।"
মায়ের হাত থেকে বাঁচাতে হাতের কাছে রাখা ছাতা খুলে সে বলত, “কুর্চি কুর্চি তুই ছাতার পেছনে লুকিয়ে পড়। আন্টি তোকে ধরতে পারবে না।”

অর্চিই নন্দিনীকে আদর করে ডাকত 'কুর্চি' নামে। অর্চি আর কুর্চি, পাশাপাশি বাড়ি, পাশাপাশি শৈশব। যত ভাব, ততই আড়ি। কিন্তু কেউ কাউকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না।তাদের এই সম্পর্কের নাম কেউই ঠিকভাবে জানত না—ভগবানও বোধহয় না।
🍂


অর্চি দারুণ ছবি আঁকত, কুর্চি চাইত শিখতে।
অর্চি বলত, “আমি মাস্টারমশাই, ফাও শেখাব কেন?”

তখন কুর্চি মাটিতে পড়ে থাকা দু-চারটে নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে বলত—
“এইটা মার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, এইটা শেখার ফিস, এইটা তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু বলে।”

অর্চি তা যত্ন করে তার আঁকার ব্যাগে রেখে দিত।

বলত, “এই তো পেলাম, আয়, আজ তোকে বেলুন আঁকা শেখাই।”

কুর্চি বলত, “ওতে শেখার কী আছে? গোল করে আঁকলেই বেলুন! আমাকে ওই গোলাপফুলটা শেখাও।”

অর্চি বলত, “গোলাপ ফুল আঁকা অনেক কঠিন, তোর দ্বারা হবে না।”

কুর্চি মুখ ফুলিয়ে বলত, “তাহলে আমার দুটো নুড়ি ফেরত দাও।”

অর্চি হেসে বলত, “ওগুলো আমার কাছে থাক, একদিন তুই পারবি, তখন শেখাব।”

সেই ছোটবেলাটা ছিল উজ্জ্বল, হাসিমাখা।

একদিন হঠাৎ অর্চি এসে বলল, “চল, তোকে গোলাপ ফুল আঁকতে শেখাই। আজ নুড়ি চাই না। জমিয়ে রাখ, একসাথে নেব।”

সেদিন তারা সারা দুপুর গোলাপফুল এঁকেছিল।


তাদের সেই রঙিন দিনগুলোতে কোনো গোপনতা ছিল না, ছিল কেবল নুড়ির বিনিময়ে গড়ে ওঠা ভালোবাসা।

কিন্তু একদিন অর্চি এল না। কুর্চির জ্বর, অভিমান, বকা—কিছুতেই অর্চি ফিরল না। পরে জেনেছিল, হঠাৎই অর্চির বাবার বদলি হয়ে গেছে অন্য শহরে। অর্চি চলে গেছে...

কুর্চি, মানে নন্দিনী, বড় অভিমানী ছিল। তাই কোনোদিন ফোন বা চিঠি লেখেনি। তার বিশ্বাস ছিল—একদিন ঠিক অর্চি আসবে, তার গোলাপ আঁকা শেখানোর পারিশ্রমিক নিতে। তখন সে তাকে হাতে তুলে দেবে তার কুড়িয়ে রাখা সব নুড়ি।

আজও কোনোদিন কেউ বকলে, অপমান করলে, মনখারাপ হলে—নন্দিনী চুপিচুপি একটা করে নুড়ি জমা রাখে। যেন সেসব একদিন ফেরত দেবে তার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় আশ্রয় অর্চিকে।

আজ সেই ড্রাইভার—এক অচেনা মানুষ, ছাতা ভেঙে যাওয়ার জন্য বকুনি থেকে তাকে ছায়ার মতো রক্ষা করেছে। একটা নরম ছাতার আড়াল দিয়েছে। ঠিক যেমন অর্চি দিত এক সময়।

নন্দিনী পার্স খুলে বের করল তার পাহাড় থেকে কুড়িয়ে আনা তিনটে নুড়ি। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল সেগুলোর উপর। আঁচলে মুছে দুটো ব্যাগে রাখল, আর একটা ট্যাক্সির সিটে রেখে দিল চুপিচুপি।

তারপর জানালার বাইরে তাকাল সে—গাছপালা, মাঠ, বাড়িঘর সব কেমন পিছনে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও এক টুকরো ভালোবাসাও, একটা পুরনো বন্ধুত্ব, একটা আশ্রয়,একটা অপেক্ষা রয়ে গেছে তার পাশে...
তার জমানো নুড়ির মধ্যে,রয়ে গেছে এক আকাশ মেঘ মাখানো শৈশব।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments

  1. Sweetness thy name is love. Very sweet story. Adorable.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Kamalika BhattacharyaNovember 22, 2025

      💚 thank you

      Delete