জ্বলদর্চি

ডুনেডিন বেড়ানোর গল্প /কথাকলি সেনগুপ্ত

ডুনেডিন বেড়ানোর গল্প

 কথাকলি সেনগুপ্ত 

নিউজিল্যান্ড এর সাউথ আইল্যান্ড এর ক্রিস্টচার্চ শহর থেকে স্টেট হাইওয়ে এক দিয়ে তিনশো তেষট্টি কিমি দক্ষিণের দিকে গেলে ডুনেডিন শহর টি আসে; যেতে প্রায় পাঁচ ঘন্টার একটু বেশি ই লাগে; তবে পাহাড় বন সবুজে ঢাকা উপত্যকা নদী আলপাকা হরিণ আর গবাদি পশুর ফার্ম  ফলের আঙুরের বাগান আদি দেখতে দেখতে যাওয়া বলে সময় টা ততো যেন বোধ হয় না; অবশ্যই পথে বার দুয়েক চা - টা এর বিরতি দিয়ে আরাম করে গেলে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ও লাগতে পারে ; আবার যদি প্লেন এতে করে যেতে মনস্থ  করে থাকেন , তাহলে তো মাত্র এক ঘন্টার মধ্যেই সেখানে পৌছানো যায়।
 মোয়েরাকি বোল্ডার। 

 ভাড়ার গাড়ির কিছু কোম্পানি আছে, আগে থেকে তাদের কে (অন - লাইন বুকিং মারফতে) বলে রাখলে তারা আপনার চাহিদা/ পছন্দ মতন গাড়ি পার্কিং এতে রেখে চাবি একটা বিশেষ জায়গাতে রেখে সেটিকে খোলবার কোড আপনাকে টেক্সট করে দেয়; তাই মাল পত্র সব গাড়িতে তুলে নিয়ে যে হোটেল বা মোটেল এতে উঠবার সেখানে সোজা চলে গেলেন; আমরাও প্লেন এতে করে দুইহাজার উনিশ এর জানুয়ারী মাসের তিন তারিখ থেকে সাত দিনের টুর এতে ডুনেডিন এই ভাবেই ঘুরেছিলাম।

একটু বিশ্রাম সেরে প্রথম বের হয়েই তো চোখ  প্রায় কপালে  উঠে  যাবার  জোগাড়  হয়েছিল ; কারণ টা হলো - ক্লুথা নদীটির চেহারা; সেদিন আমাদের প্রথমে 'মোরেয়াকি বোল্ডার' দেখতে যাওয়া আর তার পরে 'নাগেট পয়েন্ট লাইট হাউস' দেখতে যাওয়া! ঐ দুটি জায়গা তেই যেতে হলে সেই ক্লুথা নদীর  ব্রিজ  পার হয়ে  যেতে হবে , আর নদীর জল ফুলে ফেঁপে প্রায় পাড় ছোঁয় ছোঁয় আর কি! লোকাল রেডিও দলের ছেলেরা চালু করে জানতে পারলো, যে অতি - বৃষ্টির  ফলে সত্যি ওই দিকে বন্যার সতর্কতা জারি করেছে লোকাল কাউন্সিল। ফলে আমরা একটু সশঙ্কিত হয়েই এগুলাম; যদিও বৃষ্টি তখন স্থগিত, আর ঘন  মেঘে  আকাশ  একেবারে  কালো  করে রেখেছে। কার পার্ক এতে গাড়ি রেখে সমুদ্রের ধারে 'মোয়েরাকি' বোল্ডার গুলোর কাছে গেলাম; এরকম সুমসৃণ অথচ সুবিশাল পাথর কে আর কি করে যে ঐখানে এনে রেখেছে, আর কবে  রেখেছে, সেটা  ভাবলেই  আশ্চর্য্য হয়ে যেতে হয়; সৈকত টির নাম বেশ  - 'কয়েকহে'; বেশ কিছুক্ষণ  সেখানে কাটিয়ে তারপর নাগেট পয়েন্ট এতে চলে গেলাম।
লাইট হাউস

সেখানে পৌঁছে কার পার্ক এতে নামতে নামতেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছিলো; বড়রা দোনামনা করতে লাগলেও ছোটরা ওতে এতটুকুও বিব্রত না হয়ে হাঁটতে শুরু করলো মাথায় রেইনকোট এর টুপি তুলে; আমি ও ওদের সঙ্গে ভিড়ে পড়লাম। শিঙ ভেঙ্গে বাছুরের দলে গরুর ঢুকে পড়ার মতোন।  নতুন জায়গাতে এসেছি, যদি দেখাটা বাতিল হয়ে যায়? যেমন ঠান্ডা তেমনি হাওয়া বইছিলো; নুড়ি ঢালা সরু পথ উঁচু নিচু পাহাড় আর পাথর পার হয়ে প্রায় মিনিট বিশেক হাঁটবার পরে নাগেট পয়েন্ট এর ভিউ পয়েন্ট এতে উপস্থিত হলাম।
🍂

সত্যি মুখে কথা বন্ধ হয়ে যায়, জায়গাটি এটি সুন্দর! চোখ যতদূর যায়, একেবারে দিগন্ত রেখা পর্যন্ত, সমুদ্রের নীল জল আর তার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট বড় মেজো সব পাহাড়, বাঁদিকে একেবারে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের ওপরে সেই লাইট হাউস টি - যদিও বিগত একশো বছরের মতন আর সেটি ব্যবহার করা হয় না; তাও সুন্দর করে সাজিয়ে রেখে দেয়া আছে; তখন তেল এর ল্যাম্প জ্বালিয়ে দূরের থেকে আসা জাহাজ গুলো কে সতর্ক করা হতো; সেটি ও গুছিয়ে রেখে দেয়া আছে। 'ডক' তথা ডিপার্টমেন্ট অব কনজারভেশন এর দু জন বয়স্কা মহিলা স্চ্ছোসেবী কে দেখলাম, লোকেদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া বা বোঝানোর কাজে হাসিমুখে লেগে রয়েছেন। কিছুক্ষন সেখানে কাটিয়ে দুপুরের অনেকটাই পার করে প্রায় বিকেলের দিকে আমরা শহরের দিকে এলাম; আর একটু ঘুরে ফিরে খাবার খেয়ে রাতের কিছু কিনে নিয়ে মোটেল এতে ফিরে গেলাম।
সাদার্ন হেমিসফিয়ার এর সবচাইতে খাড়াই রাস্তা বলডউইন স্ট্রিট 

পরের দিন ডুনেডিন বোটানিক্যাল গার্ডেন আর টানেল বে বিচ দেখতে গেলাম; বের হবার আগে মোটেল এতে স্থানীয় পত্রিকা হাতে করে খানিকটা  সময় চোখ বুলিয়ে নিতে পেরেছিলাম; বেশ কিছু নিচু জায়গাতে বন্যা হয়েছে, তার ছবি  দিয়ে  সতর্ক করছে; অনেক কটি আঙ্গুর আর ব্লু বেরি অর্চার্ড জলে ভেসে গেছে , আর তাদের অনেক ফলন নষ্ট হয়ে গেছে বলেও খবর দেখলাম। ওটাগো অঞ্চল টিতে আঙ্গুর আর অন্য বেশ কিছু ফলের অর্চার্ড করেই অনেক লোকে জীবন ধারণ করে থাকে; খুব খারাপ লাগলো যে জায়গাটিতে আমরা আনন্দ  করে প্রথম বারে ঘুরে দেখতে এসেছি, তার লোকেদের এরকম বিপর্যয় এর মুখে পড়তে  হয়েছে জেনে।

বোটানিক্যাল গার্ডেন টি আমার বিশেষ করে ভারী সুন্দর লাগছিলো; ক্রাইস্টচার্চ এর বোটানিক্যাল গার্ডেন টি ও খুব সুন্দর, নানা দেশের বিশেষ ধরণের ফুল ফল যেমন আছে, তেমনি ফোয়ারা জলের ধারা এসব ও আছে; কিন্তু ডুনেডিন এর টি তে ল্যান্ডস্ক্যাপিং অনন্য সাধারণ, একেই জায়গাটা অনেক বেশি পাহাড়ি, আর সেটাকে ভালো করে কাজে লাগিয়ে এটিকে গড়ে তোলে হয়েছে; একটি অংশে লেবানন এর থেকে আনা বিশেষ গাছ গাছালি ফুল ও আছে, দেখে বেশ অভিনব বলেই মনে হলো; জানুয়ারী মাসে তো এই দিকে গরম কাল, তাই মরশুমি ফুলের ও কোনো অভাব ছিল না। দুই ঘন্টা কোথা দিয়ে যে পার হয়ে গেলো বুঝতেই পারি নি।

মাঝে রেল মিউসিয়াম আর ওটাগো মিউসিয়াম দুটো তেই ঘন্টা খানেক  করে ঘুরে দেখে নিলাম; তার পরে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েই টানেল বে বিচ এর দিকে চলে গেলাম; সেও অসাধারণ সুন্দর জায়গা, তবে ঝাড়া একটি ঘন্টা লাগে কার পার্ক থেকে উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে, পথ ও বড় খাড়াই, স্থানীয় রা তাইতে কেউ কেউ জগিং করে ফিরে আসছেন নজরে পড়লো। শেষের  দিকে তো আমার শ্বাসকষ্ট হতে লেগেছিলো!

 দলের ছোটরা তখন আমায় পথের ধারের একটি বেঞ্চ এতে বসিয়ে রেখে এগুলো; শ্বাস একটু ঠিক হতে আরো খানিকটা এগিয়ে উঁকি মেরে দেখি - আক্ষরিক অর্থেই একটি পাহাড়ের মধ্যে কার সুড়ঙ্গ পার হয়ে তবেই গিয়ে সৈকত এতে পৌঁছানো যায়; যদি জোয়ার চলে আসে, তাহলে যে যেদিকে আছে, সেই দিকেই ঘন্টা খানেক এর জন্যে একেবারে নট নড়ন চড়ন, জল নামলে তবে গিয়ে আবার যাতায়াত শুরু হয়। আবারো একটি ঘন্টা হেঁটে গাড়িতে এসে বসতে পেয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম; এতো ধকল আর যেন সয় না! জায়গা ও বড় সুন্দর, কিন্তু বয়স যেন হাঁটুতে আর শ্বাস নিতে বারে বারে জানান দিয়ে চলছিল!

এই দেখুন, আরো দু তিন টি জায়গার নাম বলতে তো ভুলেই গেছিলাম। একটি হলো - ডুনেডিন শহরের মধ্যেই একটি খুব সুন্দর সী - বিচ আছে, Clair Bay বলা হয় তাকে। সার্ফিং সাঁতার বা এমনিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ও দুর্দান্ত সেটি। 

দ্বিতীয়  - নিউজিল্যান্ড এর সবচেয়ে  খাড়াই রাস্তা টিতে চড়া। আর নিজের পায়ে হেঁটে। গাড়ি তে করে সিকি বা আধা পথ না উঠে। অবশ্যই দলের ছোটরা আমার থেকে অনেক আগেই উঠতে পেরেছিল। সময় বেশি লাগলেও আমিও যে পেরেছিলাম, সেটা তে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। 

আর তিন নং টি হলো Albatross point - সেটি দেখতে গিয়ে কতো যে শ'য়ে হাজারে সী গাল আর টার্ন পাখি দের ও দেখতে পেয়েছিলাম! আশ্চর্য হলেও সত্যি  - কোনো গুহায় নয়, পাহাড়ের খোপে নয়, ঘাসের জমির ওপরেই তারা কুচো কাচা নিয়ে জমিয়ে বসে আছে! মানুষ আসছে, হাঁটছে আশেপাশে দিয়ে, ওদের কোনো হেল  - দোল দেখি নি। তাই বড় কষ্ট পেয়ে ছিলাম যখন কার পার্ক এর একেবারে গায়ে ই দুটি টার্ন কে মরে পড়ে থাকতে দেখে ছিলাম। কোনো গাড়ির চালক নজর না করায় তারা চাপা পড়ে গেছিল!

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments