জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—জাপান (এশিয়া)পাথুরিয়ার ইচ্ছা অনিচ্ছা /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—

জাপান (এশিয়া)

পাথুরিয়ার ইচ্ছা অনিচ্ছা

চিন্ময় দাশ


এক ছিল গরিব পাথুরিয়া। লোকটার সম্বল বলতে দুটো ছেনি আর হাতুড়ি। সারা জীবন একটাই কাজ তার, পাথরকাটা। প্রতিদিন সকাল উঠে পাহাড়ের দিকে রওনা হতো লোকটা। পাহাড়ের তলায় পৌঁছে পাথর কাটতে লেগে যেত। 

চৌকো চৌকো করে পাথর কাটত সে। কবরের মুখে চাপা দেবার ঢাকনা হিসেবে লোকে কিনে নিয়ে যেত সেগুলো। কেউ বা বাড়িঘর বানাবার জন্যও কাজে লাগাতো। কোন কাজের জন্য ঠিক কী রকম পাথর লাগবে, তার মাপজোক সে খুবই ভালো জানতো। ফলে, তার খদ্দেরের অভাব ছিল না কখনো। আয় উপার্জন যা হত, তাতেই দিন চলে যেত লোকটার। এটা নাই ওটা নাই বলে হা-হুতাশ করত না কোনদিন। লোভও করতে না কোন কিছুতেই।

যে পাহাড়ে পাথর কাটতে যেত মানুষটা, সেই পাহাড়ে বাস করত এক যাদুকর। মাঝে মাঝে নাকি লোকজনকে দেখা দিত সে। আর, যার যা মনের বাসনা পূরণ করে দিত সব। তার দয়ায় দু’চারজন নাকি বড়লোক হয়ে গিয়েছে। তারা নাকি সুখেই দিন কাটায় এখন। পাথুরিয়া এসব গল্প শোনে, আর অবিশ্বাসে মাথা নাড়ে। কিন্তু কতদিন আর এড়িয়ে থাকা যায়, বা বিশ্বাস না করে থাকা যায়? আস্তে আস্তে মন বদলাতে লাগলো তার।

একদিন পাথর দিতে এক ধনীলোকের বাড়িতে এসেছে পাথুরিয়া। সেখানে সুন্দর সুন্দর সব আসবাবপত্র দেখল লোকটার। যা সে কল্পনাও করেনি জীবনে। হঠাৎ নিজের পাথর কাটার কাজটাকে বড্ড কঠিন, আর ভারি বলে মনে হতে লাগলো তার। নিজের মনেই বলতে লাগলো-- হায় ভগবান! আমিও যদি এমনি বড়লোক হতাম। দামি পালঙ্কে মখমলের নরম বিছানায় শুয়ে দিন কাটাতে পারতাম। কী ভালোটাই না হতো তাহলে।

ভাবনা শেষ হয়েছে কি হয়নি, অমনি কোথা থেকে একটা গলা ভেসে এলো-- শুনেছি তোমার চাহিদা। ঠিক আছে। আজ থেকে তুমি বড়লোক হয়ে যাবে।

চমকে গিয়ে, চারিদিকে তাকাতে লাগল পাথুরিয়া। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। কোত্থাও কেউ নাই। সে ভাবলো তার মনের ভুল এটা। নিজের যন্ত্রপাতি দুটো তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে চলল। সেদিন আর কাজ করতে মন চাইলো না তার।

কিন্তু বাড়ি ফিরেই চমকে গেল। নিজের এতদিনের ঘরটাই খুঁজে পাচ্ছে না। বলতে গেলে একেবারে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল লোকটা। তার তো ছিল কাঠের ঠেকনা দেওয়া নড়বড়ে একটা কুঁড়েঘর। এখন কোথাও তার চিহ্নমাত্র নাই। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা সাতমহলা বাড়ি। দামি দামি সব আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। 

সবচেয়ে বেশি চমকে গেল নিজের শোবার ঘরটা দেখে। দামি আবলুস কাঠ থেকে দিয়ে বানানো মস্ত এক পালঙ্ক। ঝলমল করছে তার কালো রঙের বাহার। তাতে মখমলের নরম বিছানা পাতা। যেমনটা দেখে এসেছে ধনীর বাড়িতে। আনন্দে লাফিয়ে উঠলো পাথুরিয়া। তারপর ক’দিন যেতেই, নিজের পুরানো দিনগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গেল লোকটা।

 তখন গরম পড়তে শুরু করেছে। মাথার উপর গনগনে সূর্য। তাপ এমনই যে বাইরে বের হওয়া দায়। একদিন এমনই অবস্থা যে দম নেওয়া যায় না। পাথুরিয়া ভাবল, সূর্য না ডোবা পর্যন্ত আজ আর বাইরে বেরোবে না। অলসের মতো ঘরে বসে আছে লোকটা। আসলে খাটাখাটুনি করবার লোক সে।  ঘরে বসেই বা কী করতে হয়, জানাই নাই সেসব। 

জানালার ধারে বসে বাইরে রাস্তাঘাট দেখতে লাগলো। হঠাৎ দেখল, রাস্তা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি চলেছে। সোনায় মোড়া গাড়িটা। তাতে বসে আছে এক রাজকুমার। ঘোড়ার খুরের মিষ্টি খটখট আওয়াজ মিলিয়ে গেল একটু বাদে। পাথুরিয়ার মন বলল-- আহা, আমি যদি কোন রাজার কুমার হতাম! যদি এরকম একটা গাড়ি থাকতো আমারও। এরকম সব ঘোড়ায় টেনে নিয়ে যেত গাড়িটা। তাহলে আমিও এভাবে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে পথ দিয়ে যেতে পারতাম।

যেমন ভাবনা তেমনি ফল। সাথে সাথে সে নিজেই একজন রাজকুমার হয়ে গেল। সাত ঘোড়ায় টানা ঝলমলে গাড়ি। রঙ-বেরঙের পোশাক ঘোড়াগুলোর। ঝালর দেওয়া ছাতার নিচে বসে আছে পাথুরিয়া। তার গাড়ির সামনে, হাতে বল্লম নিয়ে  চলেছে একজন পাহারাদার। পিছনেও একজন। পথের দু’পাশে লোকজন দাঁড়িয়ে পড়ে দেখছে হাঁ করে।

যা চাইছে, সবই হয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু পাথুরিয়ার মন ভার হয়ে গেল। সে ভাবল, সব হয়নি। কোথায় কী একটা যেন বাকি আছে। সে দেখল সে যদি ঘাসের উপর জল ছিটিয়ে দেয়, সাথে সাথেই সেই জল উবে যাচ্ছে। এমনই তাত সূর্যের। মাথার উপর এমন সুন্দর একটা ছাতা আছে, তবু মুখ চোখ পুড়ে তামাটে হয়ে যাচ্ছে তার। রাগে চিৎকার করে বলল—দেখা যাচ্ছে, সূর্যটা আমার চেয়ে বেশি বলশালী। আহা, আমি যদি সূর্য হতে পারতাম!

 অমনি পাহাড়ের সেই জাদুকরের গলা শোনা গেল-- তোমার ইচ্ছে শুনেছি। ঠিক আছে। তুমি সূর্য হয়ে যাবে।

সেদিন থেকেই সূর্য হয়ে গেল পাথুরিয়া। তখন নিজের ক্ষমতা নিয়ে কী গর্ব তার। নিজের রশ্মিগুলোকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে লাগল। উপরে ছড়ায়, নিচে ছড়ায়। সামনে ছড়ায়, পেছনে ছড়ায়।  রাজার কুমার থেকে গরিব-গুর্বো কাউকেই রেয়াত করে না। সবার মুখই পুড়ে তামাটে হয়ে গেল।

মাঠে-ঘাটে গাছ-পাতা সব ঝলসে গেল। নদীর জল শুকিয়ে গেল। তারপর কিছুই যখন আর করার রইল না, সে হাঁপিয়ে উঠলো ভেতরে ভেতরে। এই যখন অবস্থা, একদিন কোথা থেকে একটা মেঘ এসে গেল ভাসতে ভাসতে। এমন যে গনগনে তার রোদ, তাকে ঢেকে আড়াল করে দিল মেঘটা। তাতে নদী-নালা, মাঠ-ঘাট, পাহাড়-পর্বত সবকিছু কেমন সুন্দর মিষ্টি ছায়ায় ঢেকে গেল।

🍂

ভয়ানক রেগে পাথুরিয়া চিৎকার করে উঠল-- আমার রশ্মিগুলো সব গেল কোথায়? ওই মেঘটা বন্দী করেছে তাদের। তাহলে, মেঘ তো আমার চেয়ে বড়। আহা, আমি যদি মেঘ হতে পারতাম। সবার চেয়ে বড় হতাম তাহলে। 

পাহাড়ের জাদুকর শুনল সে কথা আড়াল থেকে। জবাব দিল-- তোমার ইচ্ছে কথা শুনেছি। তুমি মেঘ হয়ে যাবে।

মেঘ হয়ে গেল পাথুরিয়া। সূর্য আর পৃথিবীর মাঝ বরাবর ভেসে বেড়াতে লাগলো। সূর্যের রশ্মিগুলোকে ধরে ধরে বন্দী করে ফেলে। যত বন্দী করে, তত আনন্দিত হয়। আর, ততই সবুজে ঝলমল করে ওঠে পৃথিবী। ফুল ফুটে ওঠে গাছের ডালে ডালে। মিষ্টি সুরে গান গায় পাখিরা। 

কিন্তু তার আনন্দ বেশিদিন বেঁচে থাকে না। কয়েকটা দিন বা সপ্তাহ না যেতেই, জলে থই-থই করে উঠল চারদিক। বন্যার জল ছুটতে লাগলো নদীর দু’পাড় উপচে। গ্রাম ভেসে গেল। নগর ভেসে গেল সেই জলের তোড়ে। সে কী দুর্গতি মানুষজনের।

কিন্তু পাথুরিয়া অবাক হয়ে গেল পাহাড়কে দেখে। এই এত দুর্গতিতে তো পাহাড়ের কোন হেলদোল নেই। সে আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে অচল অটল অবস্থায়।

মেঘ ভীষণ অবাক হয়ে গেল। ভাবতে লাগল, তাহলে পাহাড় তো আমার চেয়ে বড়। আহা, আমি যদি পাহাড় হতাম। 

অমনি সেই জাদুকরের গলা ভেসে এল-- শুনেছি তোমার ইচ্ছের কথা। তুমি পাহাড় হয়ে যাবে। 

পাহাড় হয়ে গেল পাথুরিয়া। চারদিকের সবই নীচু। সবাইকে ছাড়িয়ে তারই মাথা কেবল অনেক উঁচুতে। দুনিয়ায় আর যা কিছু, সব পড়ে আছে একেবারে তার পায়ের কাছটিতে। এত উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরে, ভারী গর্ব হোল তার। সূর্যের তাপ তাকে পোড়াতে পারে না। বন্যার জল নাড়াতে পারে না তাকে। নিজের মনে বলল—বাহ, আমি সবচেয়ে বড়। 

এভাবেই দিন যায়। সবাইকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে পাহাড়। সবাইকে দেখে চেয়ে চেয়ে। ভীষণ আনন্দ তার মনে। ভীষণ সুখী সে।

এমনই একদিন হঠাৎ কিসের একটা শব্দ কানে এলো পাহাড়ের। কিসের শব্দ, কোথা থেকে আসছে? চেয়ে দেখতেই, অবাক হয়ে গেল সে। একটা খুদে মানুষ ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে পাথর কাটছে পাহাড়ের তলায়। একটা করে হাতুড়ির ঘা মারছে। আর, তার কাঁপুনি ছড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ভেতরে। 

একটু পরেই খানিকটা পাথর কেটে ফেললো লোকটা। চাঙ্গড়টা যেই খসে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল, ভয়ে চিৎকার করে উঠল পাহাড়। ভয় পেয়েছে বেমালুম। এত্তটুকুন একটা ক্ষুদে মানুষ। সেকি না পাহাড়ের চেয়েও শক্তিশালী! হায় হায়, পাহাড় না হয়ে আমি যদি মানুষ হতাম! 

তখনই পাহাড়ের ভেতর থেকে সেই জাদুকরের গলা ভেসে এলো-- তোমার ইচ্ছে কথা শুনেছি। ঠিক আছে। আবার একবার তুমি মানুষ হতে পারবে।

পাহাড় থেকে আবার মানুষ হয়ে গেল সেই পাথুরিয়া। সাত ঘোড়ায় টানা মণি-মুক্তোর ঝালর দেওয়া সোনার রথ উধাও। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাথর কাটে দিনরাত। কবরের ঢাকনা বানায়। ঘর বানাবার চৌকো পাথর কাটে মাপমতন। এখন আর মখমলের নরম বিছানা নাই তার। এখন তার বিছানা পাথরের মতোই শক্ত। সাতমহলা বাড়িও নেই । ঘরখানা সেই ঠেকনা দেওয়া একটা নড়বড়ে কুঁড়ে। দু’বেলা কোনরকমে সামান্য দুটা খাবার জোটে কেবল। 

কিন্তু তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখে গেল সে। অন্য কিছু বা অন্য কেউ হতে চায় না সে আর। যে জিনিসটা নেই এখন আর সেটা চায় না সে। অন্য কারও চেয়ে বড় বা বলশালী হতেও চায় না আর। নিজের দুটো ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে বেশ সুখেই আছে মানুষটা।

পাথুরিয়ার চাহিদার কথা কোনদিন আর শুনতে পায় না পাহাড়ের জাদুকর। পাথুরিয়াও আর শুনতে পায় না জাদুকরের ইচ্ছাপূরণের সেই মিষ্টি ভরাট গলা।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments