জ্বলদর্চি

ইতিহাসের ফাঁদ/পর্ব ৫/ অরিজিৎ লাহিড়ী

ইতিহাসের ফাঁদ
পর্ব ৫
 
অরিজিৎ লাহিড়ী

কালো এস ইউ ভি গাড়িটা থেমে গেছে। অস্ত্রধারী তিনজন লোক নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। ঋতব্রত গুহ থমকে দাঁড়ালেন। কিন্তু হেমাঙ্গ হাজরা? ভেপের ধোঁয়া মুখে, বুক ফুলিয়ে হাঁটছেন। একটুও দমে যান নি।

‘এই যে ভাই, পিস্তলটা একটু নামা—ভয় দেখানোর চেষ্টা বুঝলাম। কিন্তু তোর এই নাটকটা একেবারে দু হাজার নয়ের পুরনো ভার্সন। আপডেট কর রে ভাই।’
তিনি হালকা হাসলেন।

ঋতব্রত ফিসফিসিয়ে বলল—‘স্যার…’

হাজরা চোখ মিটমিট করে বললেন—‘আরে তুমি চিল কর। শোন, তুমি তো জানো এই রাস্তাটায় আমরা আগেও হেঁটেছি? হুবহু এইভাবে। মনে পড়ছে না? ডেজা ভু রে ভাই। আসলে যা দেখছ, সেটা তো দেখছ না। মাথার মধ্যে ফাঁক আছে। আমরা একটা লুপে পড়ে গেছি। অতএব, একটু রিস্টার্ট দরকার, কেমন?’

একজন হোঁচট খেল। হাজরা ফাজলামি করে বললেন—‘ওই তো! বলেছিলাম না?দেখ, পা টা ঠিক আছে তো? নাকি শুধু ছায়া? ছায়া তো নড়ছে, শরীরটা কই?মানে—পুরোটাই গন্ডগোল রে বাবা। গ্লিচটা বুঝেছ?’

দু’জন লোক ইতস্তত। মুখ থমথমে।

হাজরা ফিসফিস করে বললেন—‘গন্ধ পাচ্ছিস তোরা? বাতাসে একটা জ্বলা পপকর্নের গন্ধ, না রক্তের? নাকে আসছে তো? না, আসলে ব্রেন তোদের ট্রিপ খাওয়াচ্ছে।’

ঋতব্রত স্তব্ধ। হাজরা থামছেন না—‘দেখ, এই বাস্তব জিনিসটা আসলে একটা বাজে কোড করা গেম। তুমি এত সিরিয়াস কেন ব্রো? ওই যে সিম্যুলেশন দেখাল—ওটা একদম নেটফ্লিক্স-এর ডার্ক সিরিজের মতো। শেষ কোথায়, শুরু কোথায় কেউ জানে না।’

একজন অস্ত্রধারী পেছনে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—‘কেউ আমাদের ফলো করছে…’

হাজরা চোখ সরু করে হেসে বললেন—‘ঠিক ধরেছিস।
প্লট আরও জমাট বাঁধছে। শুধু একটা কথা মাথায় রাখিস—ভুয়ো যুদ্ধ, ভুয়ো শান্তি, ভুয়ো বিশ্বাস—সব ঠগবাজি। আর তোরা সেই ঠগবাজির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর।’

রাস্তাটা নিঃশব্দ। অন্ধকারের গায়ে একরকম ছায়া লেগে আছে। তিনটে অস্ত্রধারী লোক দাঁড়িয়ে। যে তাঁদের ভুবনেশ্বর নিয়ে এসেছিল, সেই লোকটা এবার আর সহ্য করতে পারছে না।
গলা চড়িয়ে করে বলে উঠল—‘আর একটাও শব্দ নয়।
চুপ। না হলে এখানেই গুলি করব।’

ঋতব্রত কাঁপছে। বুকের ভেতর ধুকপুক। কিন্তু হাজরা দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে আধপোড়া ভেপ, চোখে বিদ্রুপাত্মক হাসি।
—‘কেন? এত ভয় পেয়ে গেলি? সত্যিটা সহ্য করতে পারছিস না? তোর গেম ওভার বলে দিচ্ছি, কাকা।’

লোকটা পিস্তল উঁচিয়ে বলল—‘আমি বলেছি চুপ।’

হাজরা এবার এক পা এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন—‘একটা কথা শোন… খেলা কে চালাচ্ছে, সেটা তুই জানিস না। কারণ তুই নিজেও একটা গল্পের চরিত্র। তোকে যে এই স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিয়েছে, সে-ও জানে না গল্পটা কে লিখছে।’

অস্ত্রধারী লোকগুলোর হাত কাঁপছে। আঙুল ট্রিগারে। ঋতব্রত ভয়ে জমে গেছে। মুহূর্তটা যেন থেমে আছে।

ঠিক তখনই—দূর থেকে একসাথে কয়েকটা বাইকের গর্জন। ধাতব শব্দ, টায়ারের ঘর্ষণ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামনে এসে দাঁড়াল ছয়-সাতটা কালো বাইক। বাইক আরোহীরা—সব কালো পোশাকে। চোখে কালো চশমা। রিভ্যলভার নিয়ে নেমে তিন জন তাঁদের চারপাশ ঘিরে ফেলল।

ঋতব্রত হতবাক।হাজরা ভেপের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন—‘আসল গড। বাকি সব কপি।এবার বুঝতে পারছিস তো, ভাই?’

বাতাস এখন থমকে। তীব্র উত্তেজনা।এক চুল সরলেই যেন বিস্ফোরণ।

তাদের একজন, লম্বা চেহারা এগিয়ে এল। কড়া গলায় বলল—‘অস্ত্র নামান। এখনই।’

মুখে আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে পড়ল আগের দলের। যে লোকটা হেমাঙ্গ হাজরা আর ঋতব্রতকে নিয়ে এসেছিল, সে পিস্তল টাইট করে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল—‘এই মিশন আমার। তোমরা কে?’

তখনই বাইকে বসা একটা লোক ঠান্ডা গলায় বলল—‘তোর মিশন নয়। এটা আমাদের বিচারব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। বন্দুক নামাও। অথবা… আমরা নামিয়ে দেব।’

লোকটা ঘাবড়ে যায়। তার দুই সঙ্গী পিছিয়ে দাঁড়ায়। হাজরা ফিসফিসিয়ে বললেন—‘ওরে বাবা! ভাই, তোদের তো দেখছি কনফিডেন্স কমে গেছে। আরে, তোরা জানিস না কাদের সঙ্গে খেলছিস!’

ঋতব্রত কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন—‘স্যার, ওরা কে?’

হাজরা হেসে বললেন—‘রিয়েল গড। বাকিরা সব পাপেট।’

ছোটখাটো ধস্তাধস্তি হল একটা।একটা ঠান্ডা, হিসেবি, দ্রুত হস্তক্ষেপ।পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেই তিনজন মাটিতে। নিঃশব্দ। অস্ত্র গুলো কেড়ে নিয়েছে গডের লোকেরা।

তখনই এই নতুন বাইকারদের মধ্যে একজন—দলপতি গোছের—দাঁড়াল সামনে এসে। সোজা চোখে তাকাল হাজরার দিকে। গলায় কোনো অহংকার নেই, কেবল নিখুঁত শীতলতা—‘চলুন ডক্টর হাজরা। চলুন প্রফেসর গুহ। আমাদের সঙ্গে।’

হাজরা ভেপে শেষ টান দিয়ে বললেন—‘অবশ্যই ! তবে মনে রেখো—গল্পটা জমিয়ে লিখতে হবে। বোরিং হলে তো পয়েন্ট নেই।’

ওদের পেছনের সিটে বসিয়ে লোকগুলো বাইক নিয়ে একটু এগিয়ে একটা বিরাট ক্যারাভানের সামনে দাঁড়ালো। দলপতি গোছের লোকটি বললেন—‘ চলুন স্যার ! ভেতরে।’

হাজরা ভ্রু তুললেন। চোখে মুচকি হাসি।
—‘ওয়াও! পাঁচ তারা হোটেল মনে হচ্ছে। এইবার তো ক্যাফে ল্যাতে পাব নিশ্চয়ই?’

ঋতব্রত চুপ করে আছেন। তাঁর ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। দু’জনেই হাঁটতে শুরু করলেন ক্যারাভানের দিকে। গেট খুলে গেল স্বয়ংক্রিয়ভাবে। হালকা আলো।
ভিতরটা অবাক করা ধরণের সাজানো। আধুনিক প্রযুক্তি আর পুরনো ইতিহাসের কোলাজ।

হাজরা একটা আরামদায়ক সিটে বসে পড়লেন। পা তুলে বললেন—‘চলো ভাই, গল্প শোনা যাক। দেখিই না, কে কাকে ঠকায়।’

ঋতব্রত স্তব্ধ। ক্যারাভানের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি নড়ে উঠে স্টার্ট দিল।

ক্যারাভানটা চলতে শুরু করেছে। ভিতরের আলোটা নিঃশব্দ আর আরামদায়ক।
ঋতব্রত ভেতরে ঢুকে চুপচাপ বসে। হাজরা ভেপের ধোঁয়া ছাড়ছেন। মুখে চাপা হাসি।

তখনই সামনের কেবিন থেকে একজন এসে দাঁড়াল। ত্রিশের কোঠার এক যুবক। ছিমছাম, কড়া চোখ। গলায় গাঢ় অথচ শান্ত স্বর—‘আমি মহানির্বাণ মিত্র।জি ও ডি-র ভারতীয় শাখার প্রধান।’


হাজরা হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন—‘নাম আর কাজ—দুটোই জমে গেছে।’

মহানির্বাণ শান্ত ভাবে বললেন—‘গতকালই আমরা একটা মেসেজ পেয়েছিলাম।ডার্ক ওয়েব মারফৎ। ডক্টর হাজরা, আপনিই পাঠিয়েছিলেন। আমাদের সিস্টেম ধরে ফেলেছিল কিছু অস্বাভাবিকতা। সেই সূত্রেই ঋতব্রত স্যারকে চিঠিটা পাঠানো হয়েছিল। আর তারপর থেকে উনি এবং পরে আপনারা দুজনেই আমাদের নজরে ছিলেন।’
🍂

ঋতব্রত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।

‘মানে?’—ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন।

মহানির্বাণ বললেন—‘আপনারা একটু বিশ্রাম নিন। আরও কথা হবে। আমি পাশের কেবিনে আছি। আপনাদের তো সারাদিন কিছু খাওয়ায় হয়নি আমাদের বিপক্ষের এই লোকগুলোর জন্য। এরা একেবারে জঘণ্য।’

তিনি নীরবে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ।হাজরা সিটে পা ছড়িয়ে দিলেন। ধোঁয়া ছেড়ে বললেন—‘তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো, ব্যাপারটা হঠাৎ করে ঘটছে। আসলে তা নয়।
তোমার আগের কাজ—চৈতন্যদেবের রহস্য নিয়ে—আমি পড়েছিলাম।সেখান থেকেই বুঝেছিলাম, অশোককে নিয়ে তোমার সন্দেহটা পুরনো। তুমি হয়তো নিজেই বুঝতে পারোনি তখন।’

ঋতব্রত চুপ। মুখের রঙ ফ্যাকাসে।হাজরা শান্ত গলায় যোগ করলেন—‘তোমার মাথার গেমটা অনেক গভীর।
আর আমি… আমি শুধু দেখছি—শেষ অবধি কারা জেতে, আর কারা গল্পটা লেখে।’

ক্যারাভান ছুটছে। বাইরের অন্ধকার ঘন হচ্ছে।গন্তব্য সম্ভবত ভিজয়ওয়ারা।

ক্যারাভানের জানালা দিয়ে কালো অন্ধকার ছুটছে। ভিতরে আলোর ঝাপসা রেখা। ঋতব্রত চুপ করে বসে। মুখে বিস্ময়, ভেতরে অস্থিরতা।ডক্টর হাজরা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিচু গলায় বললেন—

‘শোনো, ঋতব্রত…তোমার মাথার ভিতরে যা চলছে, সেটা খুব স্বাভাবিক।কারণ, সমস্ত ইতিহাস—আমরা যেটাকে ইতিহাস বলি—সেটা একটা বয়ান।একটা ন্যারেটিভ। আমরা অনেকেই জানি না, সেই বয়ানটা কে লিখেছে।কেন লিখেছে।কাদের জন্য লিখেছে।আর কাদের ভুলিয়ে রাখার জন্য লিখেছে।’

তিনি থামলেন। চেয়ারের পায়ে আলতো টোকা মারলেন।

—‘আমি পেশায় মনোবিজ্ঞানী এবং বর্তমানে প্যারা সাইকোলজি নিয়ে একটু আধটু চর্চা করে থাকি।কিন্তু আমার ভেতরে একটা শূন্যপন্থী লোক বাস করে।কারণ, মানুষ যেমন ভাবে, ইতিহাসও সেইভাবেই তৈরি—স্মৃতি আর ভুল স্মৃতির মিশেলে। প্রচলিত ইতিহাসের গল্পগুলো—যেমন অশোকের গল্প—সবই আসলে একরকমের সম্মোহন। একটা প্রোগ্রাম।তোমাকে বিশ্বাস করানো হয় যে, এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, কারণ না ঘটলে বর্তমানটা অর্থহীন হয়ে যাবে।এটাই ইতিহাসের সম্মোহনী খেলা।’

হাজরা এবার চেয়ারে হেলান দিলেন। চোখে নিঃশব্দ হাসি।

—‘আর আমি?আমি সেই খেলা ভাঙতে পছন্দ করি। কারণ আমি জানি—সবাই মিথ্যে।সবই শূন্য।অর্থ খোঁজার দরকার নেই।প্রশ্ন করো।নিজেকে প্রশ্ন করো। আমিও সেটা-ই করি।’

ঋতব্রত আস্তে বলল—‘আপনি বলছেন… অশোকের যুদ্ধটাই হয়নি?’

হাজরা হেসে বললেন—‘না, আমি বলছি—অশোকের যুদ্ধটা হয়তো একটা গল্প।হয়তো সেটা সত্যির থেকে বেশি সত্য।হয়তো সেটা এমন একটা স্মৃতি—যেটা আসলে কারও সিম্যুলেশন।এটাই পোস্ট ট্রুথ।’

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. Kamalika BhattacharyaNovember 07, 2025

    ভেপের ধোঁয়া ছাড়াটা একটু কমান,এত ধোঁয়ায় দম বন্ধ লাগছে।
    😊

    ReplyDelete